Breaking News

মেঘকন্যার রাজ্যে । পর্ব -০১

মহানগর প্রভাতী ট্রেন এসে কমলাপুর রেলস্টেশনে থেমেছে, ঘড়িতে সকাল ৬ টা ৩০ মিনিট। ট্রেন থেকে সারারাতের জার্নিতে ক্লান্ত মানুষগুলো নামছে আর উঠার জন্যও তাড়াহুড়ো করছে অনেকে।
“ক নং বগিটা আমাদের?”
ইকরার কথায় ওর দিকে ফিরে তিথি বলল,
“হুম।”
“তবে তো সামনে থাকবে।”
“তাই তো থাকার কথা, কিন্তু বাকিরা কোথায়? পরে ট্রেন মিস হলে তো পুরো প্লেনটাই শেষ।”
তিথির কাঁধ চাপড়ে ইকরা বলল,
“এসে পড়বে, এতো উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই।”
চশমাটা ঠেলে উপরে উঠিয়ে মুখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিথি। বন্ধুরা মিলে চট্টগ্রামের বান্দরবন যাবে, তা নিয়ে প্লেনিং এর শেষ নেই। আজ সেই সুবর্ণ দিন এসেছে, কিন্তু বন্ধুদের দেখা নেই।
৫-৬ মিনিট পর ইরা ও সারাহ্ এসে তাড়াহুড়ো করে প্লাটফর্মে ঢুকে।
তিথি কপাল কুঁচকে বলল,
“না আসলেই পারতি।”
“আহা, রাগিস কেন? প্রথমবার আমরা একসাথে কোথাও যাচ্ছি, তাতেও এতো রাগ?”
ইরার কথায় তিথির রাগ পুরোপুরি না কমলেও নিজেকে সামলে নিলো।
একে একে সাবা, তন্বী, সুহানা, অনিয়া, মিথিলা এসে প্লাটফর্মে ঢুকে। সাতটা বাজতে মাত্র আর ১০ মিনিট বাকি।
ইকরা ঘুরেফিরে এসে বলল,
“বগি নাম্বার তো ক কিন্তু সেটা সবার শেষে যাবে।”
তন্বী কপাল কুঁচকে বলল,
“কেন কেন?”
“আরে, ওটা আগে এসেছে তাই শেষে যাবে। ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরবে যে।”(ইকরা)
“ওহ।”
অনিয়া সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
“চল, আমরা উঠে যাই।”
“কিন্তু মিম যে এখনো আসলো না।”(সারাহ্)
ইরা গেইটের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এসে যাবে, আমরা উঠি?”
সবাই গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল। ক নাম্বার বগিটা পুরোটাই ওদের দখলে। যে যার মতো সিট পছন্দ করে বসছে। এমনসময় বগিতে হালকা ধাক্কা হয়, বুঝতে পারে ট্রেনের ইঞ্জিন লেগেছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়বে।
সাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“ওইতো মিম এসে পড়েছে।”
মিম দৌঁড়ে এসে ট্রেনে উঠে হাতের ব্যাগটা রেখে সামনের সিটে বসে পড়ে। দৌঁড়ানোর কারণে প্রচন্ড হাঁপিয়ে গেছে বেচারি।
সাবা ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা নেড়ে বলল,
“তাও ভালো ট্রেন ছাড়ার আগেই এসে পড়েছিস, না হলে তোর জন্য দিল ওয়ালে দুলহানিয়া টু হয়ে যেত।”
সবাই সমস্বরে হো হো করে হেসে উঠে।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলেছে নিজেদের আপন পথে। সুহানা উঠে ডানহাতে সিটটা ধরে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
“সবচেয়ে ভালো হতো যদি আমরা সবাই একটা কেবিন নিতে পারতাম।”
“কেবিন নিলে কি এমন স্পেশাল হতো যা এখন সম্ভব নয়?”(মিথিলা)
সুহানা গলা খাকিয়ে বলল,
“এখানে, এই মাঝখান দিয়ে (দুইসারি সিটের মাঝের অংশটা দেখিয়ে) মানুষ আশা যাওয়া করবে। এতে আমাদের কথা বলায় সমস্যা হবে।”
“কথাটা কিন্তু ঠিক।”(তন্বী)
“কিন্তু কেবিন নিতে হলে তিনটা বা চারটা নিতে হতো। এতোজন তো এক কেবিনে হবে না।”(ইরা)
“হ্যাঁ, কেবিনে বেশি মানুষ এলাউ না।”(ইকরা)
অনিয়া দাঁড়িয়ে বলল,
“রিলেক্স গাইস, আমরা কি অন্যকোনো টপিক নিয়ে আলোচনা করতে পারি না?”
“ওয়েট আ মিনিট, আমরা কি এখানে আলোচনা আর সমালোচনার জন্য এসেছি?”(সারাহ্)
“নিশ্চয়ই না।”(ইরা)
“তবে আমরা কেন কথা বলছি?”(সারাহ্)
অনিয়া সারাহ্কে বাধা দিয়ে বলল,
“ওয়েট, সবাই কি সকালের নাস্তা করে এসেছো?”
“না, আমাদের একসাথে নাস্তা করার কথা ছিল।”(মিথিলা)
“তোদের কারণেই তো এতো দেরি হলো। ক্ষুধায় আমার পেট লাফাচ্ছে।”(তিথি)
ইকরা একটা হাই তুলে বলল,
“তারচেয়ে বেশি তুই লাফাচ্ছিস।”
পুরো বগিতে ওদের হাসাহাসির শব্দটাই শোনা যায়।
ইতোমধ্যে খিলঁগাও পার হয়ে গেছে ট্রেনটি, নিজের স্বাভাবিক গতিতে ছুটে যাচ্ছে সে। ওরা সবাই নাস্তা করতে বসেছে। সবাই নিজেদের বাসা থেকেই খাবার এনেছে, স্কুল-কলেজে টিফিন টাইমে যেমন করে টিফি ভাগ করে খেতো তেমন একটা পরিবেশই সৃষ্টি হয়েছে আজ।
এয়ারপোর্ট এসে ট্রেনটা ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়েছে। তারপর আবারো চলা শুরু করেছে। ইরা ল্যাপটপ খুলে চট্টগ্রামে একরাত থাকার মতো হোটেলের খোঁজ করছে। সবাই ওকে ঘিরে বসে ভালো করে দেখছে। আজ রাত হোটেলে থেকে কাল ভোরে রওনা দিতে হবে বান্দরবন থানার উদ্দেশ্যে। যদিও সরাসরি গাড়িতে থানা পর্যন্ত যাওয়া যাবে না।
প্রায় ১ ঘন্টা পর,
জানলা দিয়ে বাইরে দৃষ্টিপাত করে আছে সবাই। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। এই সময়টা টুরিস্টদের জন্য না হলেও এডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের জন্য ঘুরতে যাওয়ার প্রধান সময়।
নিরবতা ভেঙে সাবা বলল,
“ট্রেনটা ধীরে চলছে মনে হচ্ছে?”
ওর পাশে বসা মীম ওর কথায় তাল মিলিয়ে বলল,
“সত্যি, ঠেলাগাড়িও এরচেয়ে দ্রুত চলে।”
“কি করা যাবে? বাংলাদেশের রেলের গড়গতি সম্ভব ৮০ কিমি/ঘন্টা। এটা তো তারচেয়ে অনেক ধীরে চলছে।”(সুহানা)
“আরে, গড়গতি আর সর্বোচ্চ এতো এতো হবে এসবই আজাইরা কথা। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ট্রেনের ইঞ্জিনই অনেক পুরোনো থাকে, তাই গতি কম থাকাই স্বাভাবিক।”(মিথিলা)
ইতোমধ্যে নরসিংদী জাংশনকে পিছনে ফেলেছে ট্রেনটি। খুব সকালে উঠেছে তারউপর বাইরের ঠান্ডা বাতাসে ঘুমঘুম পাওয়া পরিবেশ।
“ওই দেখ, এই বৃষ্টিতে ওখানে একটা গরু বাঁধা আছে।”
তিথির কথায় সবাই একটু চমকে উঠে। হঠাৎ এমন চেঁচালে চমকানোটাই স্বাভাবিক।
তিথি হো হো করে হেসে বলল,
“সবাই ঝিমাচ্ছিলি তাই বললাম আরকি?”
সবাই ফিক করে হেসে দেয়। সত্যিই ঝিমুনি আসার মতোই পরিবেশ।
আশুগঞ্জ, শশীদল, লাকসাম, ভাতশালা, নোয়াখালী, ফেনী একে একে সব জাংশনকে পিছনে ফেলে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে ট্রেনটি। ততক্ষণে দুপুর পেরিয়ে গেছে।
দুপাশে পাহাড়, দূরের মাঠ পেরিয়েও পাহাড়, বৃষ্টি থামার পর ভেজা পল্লবে ঢাকা সবুজ পাহাড়ের মাঝে কোনো কোনোটাতে আবার খাসিয়া, মারমা উপজাতিদেরও চোখে পড়ে।
সকলের চোখই বাইরের দিকে। অনেকেই হয়তো এখানে অনেকবার এসেছে-গিয়েছে, কিন্তু পরিবেশটা এতোই মহনীয় যে বারবার একই নেশায় আটকে যেতে হয়। বৃষ্টি থামার পর আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘগুলো পাহাড়ের উঁচুতে হয়তো লেপ্টে আছে।
“মাঝে মাঝে এমন পরিবেশকে ছবি মনে হয়। যত্ন করে আঁকা কোনো ছবি।”
অনিয়ার কথায় ওর দিকে তাকায় সবাই। অনিয়া মুচকি হেসে বলে,
“মনোযোগ নষ্ট করার জন্য দুঃখিত। তবে যতবার দেখি ততবারই খুব ভালো লাগে।”
“নষ্ট করে আবার দুঃখিত।”(সারাহ্)
“না মানে, তোরা যেভাবে তাকিয়ে ছিলি তাতে পড়ে যেতে পারতিস, তাই আটকে দিলাম। উপকার করলেও কথা শুনতে হয়, কি দিনকাল পড়ল রে!”(অনিয়া)
“আপনারউপকারে আমরা খুবই উপকৃত হইলাম।”(তন্বী)
দুটো সমান্তরাল পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ট্রেন ছুঁটে চলেছে। ওদের ইচ্ছে হচ্ছে এখানেই নেমে পড়তে। ইচ্ছেমত ছুটে বেড়াতে এই ট্রেনটার মতো, তবে ইচ্ছেটা ভেতরেই রাখে ওরা।
বিকাল ৫ টায় চট্টগ্রাম পৌঁছায় ওরা। চট্টগ্রামে নেমে যে যার ব্যাগ নিয়ে স্টেশন ছাড়ে। চারটা টেক্সি নিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে যায় ওরা। কাল ভোরে যে মেঘের রাজ্যে যাবে, বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে মেঘের স্পর্শ নিবে ওরা।
চলবে…

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com