মেঘকন্যার রাজ্যে । পর্ব -০৩
ছোট একটি পুকুর থেকে বোতল ভরে পানি আনে সুহানা। পানি মোটামুটি পরিষ্কার হলেও সবাই কিছুটা জোর করেই পান করেছে, সচরাচর এ পানি খাওয়ার অভ্যাস তো ওদের আর নেই।
ইকরা, তিথি, মিথিলা তাবু খাটাচ্ছে। অনিয়া একপাশে আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে। রাত হয়ে এসেছে, পাহাড়ি ভাল্লুক বা হিংস্র পশুদের ভয়ে সবাই তটস্থ।
তাবু খাটানো শেষে তাবুর সামনে বসে পড়ে ওরা। ইকরা বলে,
“বাকিরা যদি আমাদের সাথে থাকতো তবে কিছুটা সাহস পেতাম।”
“এসব ভেবে আর কোনো লাভ নেই রে।”(তিথি)
“কিন্তু আজ রাতে নাহয় থাকলাম, কাল কি করবো?”(মিথিলা)
সুহানা কাঁদোকাঁদো সুরে বলল,
“আমরা বাঁচতে পারবো এই জায়গায়? এখানে যেকোনো সময় হামলা হতে পারে, পশু অথবা ডাক…”
আর কিছু বলার আগেই সুহানার মুখ চেপে ধরে অনিয়া। ফিসফিস করে বলে,
“চুপ, আশেপাশে থাকতে পারে।”
অনিয়া সোজা হয়ে বসে পড়ে। ইকরা কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
“সবার কাছে ফল কাটার ছুড়ি আছে না?”
“আছে তো।”(মিথিলা)
“কাছে রাখিস।”(ইকরা)
শুনশান নিরবতায় ঝিঝি পোকার ডাক, বাতাসে পাতার শব্দ আর মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে জংলী কুকুরগুলো। আকাশের দিকে তাকালে মেঘের আড়ালে দু-একটা তারা দেখা যায়। মাঝে মাঝে সেটাও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ জোড়া চোখ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, মেঘের আনাগোনা দেখছে প্রতিনিয়ত। ওই মেঘগুলো ছুঁতেই তো এসেছিল ওরা।
অন্যদিকে,
সাকুরা রিসোর্টে এসে সারাদিন বাকিদের জন্য অপেক্ষা করেছে ইরা, সাবা, তন্বী, মিম ও সারাহ্। হতাশ হয়েছে ওরা, সাথে একঝাঁক দুশ্চিন্তা ওদেরকে ঘিরে ধরেছে।
বিকেলের পরেই খুঁজতে বেরিয়েছে এবং এখনো আনাচেকানাচে খুঁজেই যাচ্ছে। সারাহ্ ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“কোথায় গেল ওরা?”
“জানি না, মিম শুন।”(ইরা মিমকে বলে)
মিম একটু দূরে ছিল। এগিয়ে এসে বলে,
“কি?”
“অনিয়া কি বলেছিল? ভালো করে শুনেছিলি?”(ইরা)
“ও বলেছিল ওরা থানার কাছে ছিল আর আমাদের সাথে সাকুরাতে দেখা করবে বলেছিল।”(মিম)
“থানার কাছে মানে আমরা যেখানে নেমেছিলাম সেখানে ছিল, চল ওখানে আবার যাই। যদি ওদেরকে খুঁজে পাই।”(সাবা)
তন্বী আশপাশটা দেখে এসে বলে,
“অনেককেই জিজ্ঞাসা করেছি, কেউই ওদেরকে দেখেনি।”
ইরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“সাবা বলছে থানার কাছে আবার যেতে।”
“ওখানে থাকলে তো ওরা এতোক্ষণে এখানে চলেই আসতো। তাই না?”(সারাহ্)
সারাহ্-র কথাটা ফেলে দেয়ার মতো না। সবাই চিন্তায় পড়ে যায়। তন্বী বলে,
“এককাজ করি, আমরা থানা পেরিয়ে সাঙ্গু নদীর কাছে গিয়ে খোঁজ নিতে পারি। এমনও হতে পারে যে ওরা ওদিকে চলে গেছে।”
“তুই পাগল হলি, এতো রাতে সাঙ্গু নদীর তীরে কি কি থাকতে পারে জানিস?”
ধমকের সুরে কথাটা বলল মিম।
ইরা মিমের কথায় সায় দিয়ে বলল,
“আমরা প্রায় থানচি পাড়ার কাছাকাছি আছি তন্বী। এখন যদি আমরা আবারো আগের পথে হাঁটা শুরু করি তো এই অন্ধকারে পথ হারাতে পারি।”
“তাই বলে কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবো?”(তন্বী)
“না, আমরা এখন থানচি পাড়ায় যাবো এবং সেখান থেকে কারো সাহায্য নিবো। তারপর ভোর ভোর বেরিয়ে পড়বো, ওদিকে কি আছে তা না জেনে বের হওয়াটা বিপদজনক হবে।”(মিম)
“ভালো আইডিয়া।”(সাবা)
ওরা থানচি পাহাড়ে উঠতে থাকে। একটা লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে উপরে উঠছে ওরা। বৃষ্টিতে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে আছে।
হঠাৎ ইরার পা পিছলে যায়। পড়ে যেতে নিলেই সাবা একহাতে ওকে টেনে ধরে চিৎকার করে উঠে,
“ইরা।”
মিম হাতের লাঠিটা ফেলে এসে ওকে টেনে তুলে। সারাহ্ ও তন্বী এগিয়ে আসে। ইরা মিমকে ধরে দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছে। পায়ে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে ও।
তন্বী ওকে বলে,
“ঠিক আছিস?”
ইরা মাথা নেড়ে বলল,
“হুম।”
সারাহ্ পানির বোতল ইরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“পানি খেয়ে নে।”
ইরা বোতল হাতে নিয়ে পানি পান না করে চুপ করে থাকে। সারাহ্ বলল,
“কি হলো?”
“বাকিরা কি অবস্থায় আছে তাই ভাবছি। এমন ভয়ংকর পরিবেশে কিভাবে আছে ওরা।”
তন্বী লাইট ধরে রেখেছে। লাইটের চার্জও প্রায় ফুরিয়ে আসছে। তন্বী ওদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আগুন জ্বালানো দরকার, লাইটটা হয়তো বেশিক্ষণ আর জ্বলবে না।”
“গ্যাসলাইট আছে?”(সাবা)
“হুম, কিছু কাঠের দরকার।”(তন্বী)
সাবা, তন্বী, মিম মিলে কিছু কাঠ ও গাছে ডাল এনে আগুন জ্বালায়। আগুনের আশেপাশে ঘিরে ওরা বসে থাকে। ঠান্ডা বাতাসটা হাড় কাঁপাচ্ছিল এতোক্ষণ।
ভোরের আলো ফুটে উঠেছে, থানচি পাড়ায় এসে কয়েকজনের সাথে কথা বলেছে ওরা। ওরা ভেবেছিল এখানকার মানুষের সাথে কথা বলতে ওদের কষ্ট হবে, কিন্তু এখানের অনেকেই শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলে।
খোঁজখবর নিয়ে ওরা সাঙ্গু নদীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর আবারো বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির মাঝেও ওরা থামে না। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে, আর দেরি হওয়া যাবে না।
ইরার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। সারাহ্-র একহাত ধরে হাঁটছে ও। বাকি তিনজন সামনে সামনে হাঁটছে।
কিছুক্ষণ পর ইরা থেমে যায়। ওদেরকে ডেকে বলল,
“একটু থাম, পায়ে প্রচুর ব্যথা হচ্ছে।”
ক্যাটস খুলতেই দেখে পা ফুলে গেছে, রক্ত জমাট বেঁধে জায়গাটা নীল হয়ে আছে। ইরা রাস্তার পাশে বসে বলে,
“তোরা চলে যা, আমাকে এখানেই ছেড়ে দে।”
“তা আবার হয় নাকি? আমরা একটু থেমে নিই।”(সাবা)
তন্বী আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
“তোরা থাক, কোনো ফার্মেসি থাকলে ওষুধ নিয়ে আসতাম।”
“থাকার তো কথা।”(সাবা)
“আমার কাছে পেইন কিলার আছে।”
বলেই মিম নিজের ব্যাগ থেকে ট্যাবলেট বের করে ইরাকে দেয়।
ইরা ওষুধ খেয়ে নেয়। পরে যা হওয়ার হবে, এখন আপাতত ব্যথা তো কমুক।
অন্যদিকে,
তাবু গুছাচ্ছে ইকরা, মিথিলা। তিথি, অনিয়া নিজেদের ব্যাগ থেকে কিছু বিস্কুট বের করে। এইটুকুই বেঁচে আছে এখনো পর্যন্ত। এগুলো শেষ হলেই খাবার ফুরিয়ে যাবে। সুহানা আগুন নিভিয়ে পোড়া লাকড়িগুলো মাটিতে পুঁতে দেয়।
সবাই এসে একসাথে বসে। সুহানা বলে,
“খাবার শেষ হলে আগে কিছু ফল জোগাড় করতে হবে। তারপর রাস্তা খুঁজতে যেতে হবে।”
“এটা সিনেমা নারে গাধা।”(ইকরা)
তিথি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
.
“সিনেমা হবে কেন পাগলা? সিনেমা হলে একজন নায়ক আসতো, আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যেত। ঠিক যেমনটা স্নো হোয়াইটের সাথে হয়েছিল।”
মিথিলা গালে হাত দিয়ে মাথা বাঁকিয়ে বলে,
“তা না হয় হতো, কিন্তু পড়ে একজনকে নিয়ে আমাদের মাঝে টানাটানি হতো না?”
সবাই হো হো করে হেসে উঠে। মিথিলা আবারো বলে,
“এক কাজ করতিথি, তোর একপাটি জুতা এখানে ফেলে যা। বলা তো যায়না, তোর প্রিন্সেস যদি এসে পড়ে। তখন তুই নাহয় সিন্ড্রেলা হয়ে যাস।”
আবারো একটা হাসাহাসির ধুম পড়ে যায়। এমন কঠিন সময়ে একমাত্র বন্ধুরাই হাসি ফোটাতে পারে।
.
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com