শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -১৩
আলিয়ার নিজের রুমে শুয়ে আছে। বাসায় এসে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়েছে, ভাত খেয়েছে। তবুও এখনো চিনচিন করে ব্যথা করেই যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে উঠে বসে তুবাকে কল দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই তুবা রিসিভ করে,
“আলি।”
“হুম, তুবা। তখন কল করেছিলে কিন্তু কথা বলতে পারিনি।”
তুবা বেশ হাসিখুশি ভাবেই বলল,
“একটা জরুরি কথা বলার জন্য কল দিয়েছিলাম।”
“কি কথা? তোমাকে কি বিয়ে দিয়ে দিবে? তোমার বাসায় প্রস্তাব পাঠাতে হবে?”
আলিয়ারের কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে তবুও স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছে সে। তুবা হেসে বলে,
“ধুর, কি যে বলেন? এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিবে না।”
“তাড়াতাড়ি মানে পুরো ২১ বছর আপনার। আজ বিয়ে দিলে কালই বাচ্চার মা হয়ে যাবেন।”
তুবা কিছুটা লজ্জা পায় এমন কথায়। শুধু তুবা কেন? পৃথিবীর যেকোনো মেয়েই এমন কথায় মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলবে। আলিয়ার বলল,
“কি ম্যাডাম, জরুরি কথাটা বলবেন না?”
“না, আপনি অনেক খারাপ।”
“তা আমি জানি। আমি খারাপ, আমি বেহায়া, আমি ফাজিল জানি এসব।”
“কি সব বলছেন? আমি তো অন্য কারণে খারাপ বলেছি।”
“আচ্ছা, বাদ দাও। কি কথা বলো।”
“আজকে ভাবি আপনার ব্যাপারে জানতে পেরেছে।”
আলিয়ার হেসে বলল,
“কি জানতে পেরেছে?”
“আপনার নাম জানতে পেরেছে।”
“আর?” -আর কিছুই বলিনি। আর কিছুই বলোনি?”
“বলেছি কালকে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলেন।”
আলিয়ার বেশ ভনিতা করে বলল,
“তো ভাবি কি বলল?”
“কিছুই না, হেসেছে।”
“তো ফ্যামিলির বাকিরা জানে?”
“না না, ভাবি এখনি কাউকে জানাবে না।”
“আচ্ছা।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ থাকে। আলিয়ার ব্যথায় নড়াচড়া করতে পারছে না, জ্বরও এসেছে। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখছে৷ শুধু শুধু কারো চিন্তা বাড়িয়ে তো লাভ নেই। আর তাছাড়া এ ব্যথা প্রায়ই ওকে সহ্য করতে হয়।
নিরবতা ভেঙে তুবা বলল,
“কি ব্যাপার আজকে কথার ঝুড়ি শেষ?”
আলিয়ার চমকে উঠে বলে,
“আসলে ব্যাপারটা তা না আমি আজকে একটু টায়ার্ড।”
“ওহ”
বলেই কল কেটে দেয় তুবা।
আলিয়ার বুঝতে পারে তুবার অভিমান হয়েছে। আলিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রেখে উঠে গিয়ে মাথায় পানি দেয়। তারপর বিছানায় এসে চুপচাপ শুয়ে থাকে। জ্বর বেড়েই চলেছে, শীত অনুভব হচ্ছে আরো বেশি। আলিয়ার উঠে গিয়ে একটা কম্বলে এনে তা পেঁচিয়ে শুয়ে থাকে, কিছুতেই ঘুম আসছে না।
পরেরদিন সকালে,
মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙালো আলিয়ারের। চোখ কচলে উঠে বসে বুঝতে পারল পুরো শরীর ঘেমে একাকার। রাতে জ্বর থাকলেও এখন একদম জ্বর নেই।৷ গতরাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে ছিল তা ও নিজেই টের পায়নি।
আছিয়া এসে ওর গায়ের কম্বল সরিয়ে দিতে দিতে বলে,
“কম্বল দিয়েছিস কেন?”
আলিয়ার মাথার চুল ঠিক করে ফোন হাতে নিয়ে দেখে ভোর ৪ টা। আলিয়ার কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলে,
“আম্মু, এখনো কি আযান দিয়েছে? শুধুই ঘুম ভাঙালে?”
আলিয়ার আবারও শুয়ে পড়তে নিলে আছিয়া ওকে ধরে বলে,
“এত ঘুম কিসের? কথা আছে, বসে থাক।”
আলিয়ার বসে বসে চোখ কচলাচ্ছে। আছিয়া ওর পাশে বসে বলে,
“জিনাতকে কেমন লাগে?”
আলিয়ার হেঁয়ালি করে বলে,
“ভালো।”
“ভালো মানে? কিরকম ভালো?”
আছিয়ার কথায় বেশ জোর খুঁজে পায় আলিয়ার।
“কিরকম ভালো মানে?”
“মানে ও মেয়ে হিসেবে ভালো, সেটা আমি জানি কিন্তু কোন বাড়ির বউ হিসেবে কেমন হবে?”
“ভালই হবে।”
“যদি আমাদের বাড়ির হয়?”
“কি বলতে চাচ্ছো আম্মু?”
“সেটা বোঝার মত বয়স নিশ্চয়ই তোমার হয়েছে।”
এবারে আলিয়ার অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এতটা ধমক আর কড়া ভাষায় আছিয়া কখনোই কথা বলে না, তাহলে আজ কেন?
আলিয়ারকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে আছিয়া বলল,
“জিনাত আর তোমার মধ্যে কি সম্পর্ক?”
“ভাই বোনের সম্পর্ক।”
“তবে এখানে বিয়ের কথা আসছে কেন?”
আলিয়ার কপাল কুঁচকে চেঁচিয়ে উঠে,
“কি?”
“হুম, আজ তোমার আর জিনাতের বাগদান এবং আকদ।”
আলিয়ারের মনে হচ্ছে ও কোনো স্বপ্ন দেখছে, ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। যে স্বপ্নে তুবাকে সে সারাজীবনের মতো হারাতে চলেছে।
আছিয়া ওকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“চেঁচিয়ে লাভ নেই। জিনাত আমাদের বলল তোমার আর ওর মধ্যে অনেক গভীর সম্পর্ক আছে। সবাই তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে একমত, তোমার বাবাও মত দিয়েছে।”
আলিয়ার উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করলে না?”
“তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চায়।”
আলিয়ার নাক ছিটকে বলে,
“ছি, এটা সারাজীবনের ব্যাপার। দুএকদিনের ব্যাপার না যে সারপ্রাইজ দিবে৷ হ্যাঁ, আমরা সমবয়সী তাই বেশি গল্পগুজব করতাম, অনেক মিল আমাদের মধ্যে। কিন্তু তার অর্থ কি এই যে আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতে হবে?”
আছিয়া ওকে ওর পাশে বসিয়ে বলে,
“রেগে লাভ নেই, আলি। সবটা তোমাকে জানানোর প্রয়োজন ছিল তাই জানালাম। এক কাজ করো, তুমি সবার সাথে কথা বলো।”
“না, আমিও সবাইকে সারপ্রাইজ দিবো।”
“কি বলছো?”
“হুম।”
এমনসময় ফজরের আযান দেয়। আলিয়ার মুচকি হেসে বলল,
“তোমার কি মত আম্মু?”
“জিনাতকে আমার পছন্দ নয় আর জিনাতের কথায়ও আমার বিশ্বাস হয়নি। শুধুমাত্র তোমার বাবার দিকটা ভেবে সবার সাথে স্বাভাবিক ছিলাম।”
আলিয়ার মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“এমন মিথ্যাবাদী নয়, লাল টুকটুকে বউ আসবে তোমার ঘরে।”
“হুম, এখন নামাজ পড়ে নে।”
আছিয়া বেরিয়ে যায়৷ আলিয়ার ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে।
অন্যদিকে,
সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছে তুবা৷ কাল রাগ করে কল রেখে দিলো আর আলিয়ার একবারও কল দিলো না, এতেই রেগে আছে সে।
আযান শুনে নামাজ পড়তে যায় সে৷ নামাজ পড়ে রান্নাঘরে যায় চা বানাতে৷ আজ চা না খেলে ভার্সিটিতে আর যেতে পারবে না।
চা নিয়ে বারান্দায় এসে বসে তুবা। ১০-১৫ মিনিট পর অনুও এসে ওর সাথে বসে। তুবা একবার অনুর দিকে তাকায় তারপর আবারো বাইরের আকাশের দিকে মন দেয়। অনু বুঝতে পারে তোমার মন খারাপ নয় তো এতক্ষণে কথার ঝুড়ি খুলবে বসতো।
অনু একবার গলা খাকিয়ে বলে,
“আমার ননদীনির কি মন খারাপ?”
তুবা আগের মতোই বসে আছে। অনু আবারও বললো,
“উত্তরটা পেলাম না।”
“পাওয়া লাগবেনা।”
বেশ রাগ দেখিয়ে কথাটা বলল তুবা।
অনু মুচকি হেসে বলল,
“মিস্টার আলিয়ার এর সাথে কোন সমস্যা হয়েছে?”
“না, সে নিজের মত ভালই আছে।”
“আচ্ছা বুঝলাম, কি নিয়ে সমস্যা হয়েছে?”
“বললাম না কিছুই হয়নি।”
অনু তুবার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“আমি কি তোমাকে বুঝি না এবার বল কি হয়েছে?”
তুবা এবারে কান্না করে দেয়, অনুকে ধরে কাঁদছে সে। অনু বিচলিত হয়ে বলে,
“ওমা, কাঁদছো কেন? “আমি কি কান্না করার মত কিছু বলেছি?”
তুবা গত রাতের পুরো ঘটনা অনুকে বলে।
সকাল ৭:৩০, আলিয়ার অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সবাই সেখানে নাস্তা করার জন্য বসে আছে। সুলতানা ও আছিয়া নাস্তা তৈরি করছে।
আলিয়ারকে দেখে আছিয়া বলে,
“আজ তাড়াতাড়ি চলে আসিস।”
“চেষ্টা করব, আম্মু।”
এটুকু হলেই চেয়ার টেনে বসে আলিয়ার।
ইব্রাহিম বলে,
“কি হয়েছে আলিয়ার? তোমার চোখ লাল হয়ে আছে কেন?”
“তেমন কিছু না বাবা, একটু এলার্জি সমস্যা।” “ঠিক আছে, ওষুধ নিয়ে নিও।”
জিনাত কিছুক্ষণ পরপর আলিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। একবার চোখাচোখি হতেই জিনাত চোখ নামিয়ে নেয়। আলিয়ার বলে,
“কিরে আজ ভার্সিটিতে যাবি না?”
জিনাত আমতা আমতা করে বলে,
“না মানে, আজ শরীরটা ভালো লাগছেনা।”
“শুধু ফাঁকিবাজির ধান্দা না?”
তারপর চুপচাপ নাস্তা করে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় আলিয়ার।
একহাতে ড্রাইভিং করছে আরেকহাতে ফোন বের করে তুবাকে কল করে আলিয়ার। প্রথমবার কেটে যায়, দ্বিতীয়বার তুবা কল কেটে দেয়।
তারপর আলিয়ার মেসেজ দেয়, “ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি।”
সঙ্গে সঙ্গে কল আসে আলিয়ার রিসিভ করে তুবা গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“কেন অপেক্ষা করবো আমি?”
আলিয়ার ওর অভিমানী কন্ঠটা ঠিকই চিনে নেয়। আলিয়ার মুচকি হেসে বলে,
“তা আমি এসেই বলবো। এখন ড্রাইভিং করছি।”
কিছুক্ষণ পর আলিয়ার ভার্সিটিতে পৌঁছায়। ভার্সিটির পেরিয়ে একটু দূরেই তুবা দাঁড়িয়ে আছে। আলিয়ারকে দেখেই মুখ ভেংচায় সে। আলিয়ার মুচকি হেসে গাড়ি থেকে বেরিয়ে ওর সামনে গিয়ে বলে,
“রাগ নাকি অভিমান?”
“জানি না।”
তুবা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আলিয়ার গাড়ি থেকে একটা ছোট বক্স বের করে তুবার হাতে দেয়। তুবা চোখ কুঁচকে আলিয়ারের দিকে তাকালে আলিয়ার বলল,
“এক্সেপ্ট করবে?”
তুবা বক্সের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি আছে এতে?”
আলিয়ার মুচকি হেসে বলে,
“তেমন কিছু না, একটি বাচ্চার জন্য চকলেট এনেছি।”
“বাচ্চা? আমার বাচ্চা নেই, আমার বাসায়ও কোনো বাচ্চা নেই। তাহলে এটা আমাকে কেন দিচ্ছেন?”
“তোমাকেই দিয়েছি। তুমি নিজেই তো একটা বাচ্চা।”
বলেই আলিয়ার চোখ টিপ দেয়।
তুবা গাল ফুলিয়ে বলল,
“আমি বাচ্চা?”
“হ্যাঁ, কাল একটু কথা বলিনি বলে, তোমার রাগ ভাঙাইনি বলে খুবই অভিমান হয়েছে।”
“কেন? হওয়া উচিত হয়নি?”
“আসলে তা বুঝিনি।”
তুবা বেশ ভাব নিয়ে বলল,
“তো কি বুঝিয়েছেন?”
“বুঝেয়েছি তুমি একটা বেড়াল। তোমাকে চকলেট না দিয়ে মাছ দেওয়ার দরকার ছিল।”
বলেই আলিয়ার হাসতে থাকে।
তুবা ওর হাত থেকে চকলেটের বক্সটা নিয়ে ভার্সিটির দিকে চলে যায়। একবার আলিয়ারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। আলিয়ার বুঝতে পারে অভিমানের সমাপ্তি হয়েছে।
.
চলবে….
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com