শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -০২
নিজের রুমে শুয়ে আছে তুবা। ওর মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে অনু। তুবার মাথার কাছে বসে আছে তওবা। উনি তুবাকে বকাঝকা করতেছে। কারণটা হলো তুবার জ্বর। বিকেলে বৃষ্টি ভিজে বাসায় আসার কারণে সন্ধ্যার পর থেকেই জ্বরে ভুগছে তুবা।
তওবা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে অনুকে বলে,
“দেখলে অবস্থা? এখনো জ্বর কমার নাম গন্ধ নেই। এমন অবেলার বৃষ্টিতে কেন যে ভিজতে গেল মেয়েটা।”
অনু একটা গামছা ভিজিয়ে এনে তুবার শরীরটা মুছে দিতে দিতে বলল,
“আম্মু, আপনি এতো চিন্তা কেন করছেন? ঠিক হয়ে যাবে। তাজিমকে কল করেছি, ও আসার সময় ওষুধ নিয়ে আসবে।”
“ঠিক হলেই হলো। আমি পারি না এই মেয়েকে নিয়ে। বিয়ের বয়স হয়ে গেল কিন্তু আক্কেল হলো না।”
তুবা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। মায়ের কথায় রেগে উঠে বসে বলল,
“আম্মু, এটা ঠিক না। তোমার মেয়ে এখনো বাচ্চা, বিয়ের বয়স হয়েছে মানে কি?”
তওবা উঠে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলছে,
“এমন বাচ্চা আর কখনোই বড় হবে না।”
তওবা চলে গেলে অনু জোরে হেসে দেয়। তুবাকে শুইয়ে দিয়ে বলে,
“কি গো ননদিনী, আজ এমনভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে কেন?”
“ভাইয়ার সাথে দেখা করে অফিস থেকে বেরিয়েই দেখলাম তুমুল বৃষ্টি। আচ্ছা বলো, এমন বৃষ্টি কেউ হাতছাড়া করে নাকি?”
.
অনু মাথানেড়ে মুচকি হাসে। তুবার মাথায় জলপট্টি দিয়ে অনু বলল,
“এখন যে জ্বর হলো তার কি হবে?”
তুবা অবহেলার সুরে বলে,
“এতো সামান্য জ্বর, এমনিতেই সেরে যাবে।”
“সামান্য নয় গো ননদিনী, সামান্য নয়। ১০২ ডিগ্রি হয়ে আছে এখনো।”
“তো ১১০ তো আর নয়।”
তুবার মাথায় একটা গাট্টা দেয় অনু। তুবা হেসে দিলে অনু চোখ রাঙায়। তুবা চোখ বন্ধ করে। মুখে বড়বড় কথা বললেও শরীরটা তো মানতে পারছে না।
অন্যদিকে,
.
অফিস থেকে বাসায় ফিরছে আলিয়ার। নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করছে সে। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম, চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে বসে আছে আলিয়ার।
এখনো বৃষ্টি হচ্ছে, আলিয়ার গাড়ির জানলা খুলে বাইরে তাকায়। ওর মনে পড়ে বিকেলের কথা, মেয়েটির অকৃত্রিম হাসিটার কথা মনে হতেই মুচকি হাসে আলিয়ার। মেয়েটির ঠোঁটের লিপস্টিকটা পারফেক্ট লাগছে ওর কাছে।
জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে, আলিয়ারও গাড়ি স্টার্ট দেয়। মাথায় ঘুরছে একটাই কথা,
“মেয়েটি অফিসের সামনে কেন ছিল? তাও গেইটের ভিতরে। কারো সাথে দেখা করতে এসেছিল? হতে পারে, নাহলে তো ভিতরে ঢুকার কথা না।”
এদিকে তাজিমও বাসায় যায়। গিয়েই সোজা তুবার রুমে ঢুকে। তুবা ফোনে গেমস খেলছে। ওর পাশে বসে কপালে হাত রেখে জ্বরটা দেখে। তুবা ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলায়।
তাজিম একহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি তোমাকে অফিসের গাড়ি করে আসতে বললাম আর তুমি বৃষ্টিতে ভিজলে?”
“নিজের গাড়ি না থাকলে এমনই হয়।”
.
ফোনের দিকে তাকিয়েই কথাটা বলল তুবা।
অনু স্যুপ নিয়ে ওর রুমে আসে, সাথে তওবাও আসে। তাজিম মাকে বলল,
“বোঝাও তোমার মেয়েকে, তার ভাইয়ের পক্ষে কি গাড়ি কিনা সম্ভব? আগে ওর বিয়ে দিই, সেটার টাকাই তো জোগাড় হচ্ছে না।”
তুবা চোখ ছোটছোট করে তাজিমের দিকে তাকায়। রেগে বলল,
“আমাকে বিয়ে দেয়ার পর গাড়ি কিনবে কেন? তোমার বউকে নিয়ে হানিমুনে যাওয়ার জন্য?”
“বিয়ের পর আর এভাবে ভিজতে পারবি না। তাই বিয়ে দিবো।”(তাজিম)
“যা, নিজে আরেকটা বিয়ে কর।”
“একটাতেই যথেষ্ট।”
“তবে দুইটা বাচ্চা নে।”
“ফ্যামিলি প্ল্যানিংটা আমাদেরকেই করতে দে।”
তুবা ভাইয়ের হাত ধরে বলল,
.
“ভাই, তুই একসাথে ১১ টা বেবি নে। পুরো বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম হয়ে যাবে। ভাব একবার, তোর ঘর থেকে সাকিব, তামিম, মাহমুদুল্লাহ, মুশফিক আর আমার জানু মাশরাফি বেরোবে। ভেবেছিস?”
“তোর ভাবির পেট কি…”
কথার মাঝেই থেমে যায় তাজিম। এতোক্ষণে খেয়াল হলো রুমে ওর মা আছে। ও তাকাতেই মুচকি হেসে তওবা বেরিয়ে যায়। অনু মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জায় পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে।
তাজিম একটা কাশি দিয়ে বলল,
“তুবাকে স্যুপটা খাইয়ে দেও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি, এককাপ গরম কফি করে রেখো।”
অনু মাথানিচু করেই বলল,
“হুম”
তাজিম উঠে যাওয়ার সময় ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
“তুবার বুদ্ধিটা কিন্তু খারাপ না।”
লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে অনুর। তুবা হো হো করে হেসে উঠলো। তাজিম চলে গেলেও অনু আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো।
তুবা দাঁত কেলিয়ে বলল,
“ইমাজিন পড়ে করো, এখন স্যুপটা দেও।”
অনু মুচকি হেসে তুবার পাশে বসে ওকে স্যুপ খাইয়ে দেয়।
.
সারাদিন অফিসে কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছে মুগ্ধ। ড্রইংরুমে সোফায় বসে আছে। ওর মা এসে ওর হাতে শরবতের গ্লাস দিয়ে বলল,
“কাল দেশে আসলি আজই অফিসে যাওয়ার কি দরকার ছিল?”
“আহা, আম্মু। অফিসে কাজ আছে আর কোম্পানিটা আমার নিজের না।”
ওর মা ধমক দিয়ে বলে,
“চুপ, একদম মুখে মুখে তর্ক করবি না। একদিন ছুটি দেয় না আবার বিদেশে পাঠায়।”
মুগ্ধ মুচকি হাসে। ওর মা রান্নাঘরে যেতে যেতে বলে,
“ফ্রেশ হয়ে আয়, ভাত বাড়ছি।”
মুগ্ধ শরবত খেয়ে রুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং-এ এসে দেখে ওর মা ড্রইংরুমে টিভি লাগিয়ে বসে আছে। ডাইনিং টেবিলে সব খাবার সাজানো আছে।
মুগ্ধ চেয়ারে বসতে বসতে বলে,
“শুভ (মুগ্ধের ছোটভাই), কোথায় তুই?”
ওর মা টিভি দেখতে দেখতেই বলে,
“চেঁচিয়ে লাভ নেই, শুভ ওর বন্ধুর বাসায় গেছে।”
“এতো রাতে?”
“হুম, বন্ধুর জন্মদিন।”
“ওহ।”
.
মুগ্ধ বুঝতে পারছে ওর মা ওকে ইগনোর করছে। গাল ফুলিয়ে বলল,
“আম্মু, আজ আমার প্লেটে খাবার দিচ্ছো না। আমার উপর রেগে আছো?”
কথাটা বলতে দেরি কিন্তু ওর মায়ের হাতে থাকা রিমোটটা ছুড়ে ফেলতে দেরি না। মুগ্ধ চমকে উঠে। ওর মা উঠে এসে চেঁচিয়ে বলল,
“সব মায়ের স্বপ্ন থাকবে ছেলেকে বিয়ে করাবে। ছেলের বউ ঘরে আসবে, নাতি-নাতনীর মুখ দেখবে। কিন্তু আমার দামড়া ছেলে তো তা বুঝেই না। যত্তসব।”
মুগ্ধের হাসি পেলেও কষ্ট করে হাসিটা চেপে রাখে। মাকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে বলল,
“তোমার কেমন বৌমা চাই?”
“চাইলেই কি আনবি নাকি?”
“আহা, আগে বলো তো।”
মুগ্ধের মা দাঁড়িয়ে সিনেমার স্টাইলে বলে,
“সুন্দরী বউ চাই। তাই বলে সাদা সুন্দরী বা মেকাপ সুন্দরী না। সুন্দরী বলতে আমি বুঝি যার হাসি সুন্দর। শিক্ষিত বউ চাই। কমপক্ষে অনার্স পাশ তো হতেই হবে। ভদ্র বউ চাই, তবে প্রতিবাদী হতে হবে। এমন একজনকে চাই যে আমাকে মায়ের মতো ভালোবাসবে।”
মুগ্ধের মাথা ঘুরছে। এমন অলরাউন্ডার বউ কোথায় পাবে সে। মুগ্ধ একটা ঢোক গিলে বলল,
“আর সাংসারিক বউ লাগবে না?”
.
“সে কি ট্রেনিং সেন্টার থেকে আসবে নাকি? ও আসবে ওর বাবার বাড়ি থেকে। ওখানে নিশ্চয়ই আরামে থাকবে, তাই সাংসারিক সবকিছু আমি হাতে ধরে ধরে শিখাবো।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
“ঠিক আছে। তোমার মন মতো বউ নিয়ে আসবো। এখন তো আমাকে খাইয়ে দাও। তা আব্বু কোথায়?”
“তোর আব্বু? দেখ, হয়তো ছাদে বসে সিগারেট টানছে। তার ওই অভ্যাসটা সারাজীবনেও পাল্টাবে না।”
মুগ্ধ কপাল কুঁচকে ছাদে যায়। বাবাকে সিগারেট টানতে দেখে কিছুটা রাগ হয়। সিগারেটটা ছোঁ মেরে নিয়ে বলে,
“কতবার বললাম তোমাকে এসব ভালো না। আই হেট ইট। কেন শুনো না?”
“আহা, এটা শুধুই একটা নেশা।”
“কথা বলবে না তুমি। এসব নেশা করবে না, আর নয়। অনেক সহ্য করেছি আব্বু, আর না।”
ছেলের কন্ঠে রাগটা স্পষ্ট বুঝতে পারে বাবা। তাই আর কিছু না বলে উঠে নিজে যায়। মুগ্ধও নিচে যায়, বাবার উপর খুব রাগ হচ্ছে ওর। কেন এসব বাজে নেশা হবে?
পরেরদিন,
.
আজ জিনাতকে ভার্সিটিতে ছাড়তে গেছে আলিয়ার। ওকে ভার্সটিতে দিয়ে তারপর অফিসে যাবে সে। জিনাতের ছোট্ট বায়না পূরণ করতেই এসেছে সে। আবার ওর বায়না মতো আজ বাইক নিয়ে এসেছে সে।
ভার্সিটির সামনে বাইক থামিয়ে আলিয়ার বলল,
“এবারে ভিতরে গিয়ে আমাকে উদ্ধার কর।”
“আমি আবার কখন তোকে গর্তে ফেললাম যে উদ্ধার করবো।”
“কথা পেছাস কেন? যা তো।”
জিনাত মুখ ভেংচিয়ে চলে যায়।
আলিয়ারের ফোনে মুগ্ধের কল আসে। আলিয়ার বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ফোন রিসিভ করে। এমনসময় ওর সাথে ধাক্কা খায় এক মেয়ে। আলিয়ার একহাতে মেয়েটিকে ধরে ফেলে। আলিয়ার দেখে এই মেয়েকেই তো কাল ভিজতে দেখেছিল সে।
তুবার শরীর খুব দুর্বল। বাসার সবাই ওকে ভার্সিটিতে আসতে নিষেধ করলেও একপ্রকার রাগ করেই না খেয়ে একা একা বাসা থেকে বেরিয়ে আসে সে। প্রেশার লো হওয়ার কারণেই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেছে সে।
তুবা ধীরে ধীরে মাথা তুলে নিজেকে একটা ছেলের বাহুডোরে আবিষ্কার করে। ছিটকে সরে যেতে নিয়ে আবারো পড়ে যেতে নেয়, আলিয়ার ওকে ধরে ফেলে।
ওদিকে মুগ্ধ “হ্যালো, হ্যালো” করেই যাচ্ছে। তুবা আলিয়ারের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকায়, না কেউই ওদের দিকে খেয়াল করছে না।
তুবা ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“ধন্যবাদ।”
.
কথা ঠিকমতো বলতে পারছে না তুবা।
আলিয়ার বলল,
“আপনি কোথায় যাবেন?”
“বাসায়।”
“উঠুন, আমি ছেড়ে দিই।”
“না, আমি যেতে পারবো।”
আলিয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছেন না, আবার নাকি বাসায় যাবে?”
তুবাকে ধরে বাইকে উঠিয়ে নিজের পানির বোতলটা ওর দিকে এগিয়ে দেয় আলিয়ার। তুবা পানি পান করে, কিছুটা মাথায় দেয়। আলিয়ার নিজেও বাইকে উঠে বসে বলল,
“বাসার ঠিকানা বলুন।”
“লাগবে না, আমি যেতে পারবো।”
আলিয়ার ধমক দিয়ে বলল,
“চুপচাপ বসে থাকুন আর ঠিকানাটা বলুন।”
আলিয়ার এমনভাবে ধমক দিলো যেন তুবার প্রতি ওর কত অধিকার। তুবা কিছুটা অবাক হলেও ঠিকানা বলে দেয়। কিন্তু ঠিকানাটা ওর বাসার সামনের গলির একটা বাসার ঠিকানা, আসল ঠিকানা দেয় না সে। বিশ্বাস নেই এই ছেলের প্রতি, কিন্তু এখন উপায়ও নেই।
আলিয়ার ওর বলা ঠিকানা মতো পৌঁছে যায়। তুবা নেমে ওকে বলে,
“অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
খুব তাড়াহুড়ো করে কথাটা বলে হেঁটে চলে যায় তুবা। আলিয়ার ওকে ডেকে বলল,
“ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?”
তুবা ফিরে বলল,
.
“বাসায়।”
“ওদিকে?”
তুবা এগিয়ে এসে বলল,
“আপনার কি মনে হয় আমার বাসার সঠিক ঠিকানা আপনাকে দিবো? আমি কি পাগল?”
তুবা খুব ভাব নিয়ে হেঁটে চলে যায়। ব্যাপারটা আলিয়ারের ইগোতে লাগে। ও যাকে সাহায্য করলো সে ওকে খারাপ ছেলেদের কাতারে ফেলে দিলো। না, এই অপমান মানা যায় না। মানা যায় না বললেই কি হয়? ওকে তো অফিসে যেতে হবে, তাই বাইক ঘুরিয়ে অফিসের দিকে যাত্রা করে।
কিছুদূর গিয়েই মনেই হলো মেয়েটার নামটাই তো জানা হলো না। আলিয়ার আফসোস করে বলল,
“ইশ, নামটা যদি জেনে নিতাম।”
.
.
চলবে….
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com