শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -২৭
তুবাকে স্কুটি কিনে দিয়েছে তাজিম। কিছুদিন আগেই বোনের আবদার মেটাতে স্কুটি কিনে দেয় ওকে। এই স্কুটি এখনো গ্যারেজে পড়ে আছে। কারণ তুবার বিরক্তি, স্কুটির উপর খুব বিরক্ত সে। ও চেয়েছে গোলাপী স্কুটি কিন্তু তাজিম ওকে লাল টুকটুকে রঙের স্কুটি কিনে দিয়েছে, যা ওর তেমন একটা পছন্দ হয়নি।
ভার্সিটি থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয় তুবা। নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়তেই অনু এসে ওর পাশে শুয়ে পড়ে।
তুবা একবার অনুর দিকে তাকায়, তারপর সিলিংফ্যানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মুখটা এমন কেন করেছো?”
অনু তুবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আজ একটু বাইরে যাবো, যাবে?”
“কোথায় যাবে?”
“শপিংয়ে।”
তুবা অবাক হয়ে বলল,
“এমন অসময়ে? না মানে সামনে তো কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠান নেই, কোনো ঈদও নেই। তবে?”
অনু মুচকি হেসে বলে,
“সেটা পড়ে বলবো, আগে যাবে কিনা বলো?”
“গেলাম।”
“স্কুটিতে করে যাবো।”
“ওটা কে চালাবে?”
“যার নামে লাইসেন্স সেই চালাবে।”
বলেই মুচকি হাসে অনু।
তুবা সোজা হয়ে শুয়ে বলে,
“আচ্ছা?”
“হুম।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ থাকে। দুপুরের খাবারের পর সবার শরীরেই কিছুটা আলস্য ভর করে, তুবারও তাই হয়েছে। অবশ্য এর কারনটাও খুব সাধারণ, খাবারের সমস্ত কার্বোহাইড্রেট শরীরে একই রকম প্রভাব ফেলে, এগুলো গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয় এবং এর জন্য ইনসুলিনের প্রয়োজন হয়। ইনসুলিনে একবার সুগার উঠলে, এটি মস্তিষ্কে ট্রিপটোফ্যানের অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিড প্রবেশে উৎসাহ দেয়। এই প্রক্রিয়াটি মেলাটোনিন এবং সেরোটোনিন বৃদ্ধি করে যা শান্ত হরমোন এবং তন্দ্রা সৃষ্টি করে। মেলাটোনিন ও সেরোটোনিন ঘুম সৃষ্টিকারী হরমোন।
তুবার ফোনে কল আসায় দুজনেই চমকে উঠে। তুবা ধীরেধীরে মাথা তুলে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে আননোন নাম্বার। রিসিভ করে তুবা,
“হ্যালো।”
কিছুক্ষণ শুরু হ্যালো হ্যালোই করে তুবা, ওপাশ থেকে কেউই কোনো কথা বলে না। তুবার মেজাজটাই বিগড়ে যায়। রাগের মাথায় বলল,
“তোর মাথায় ঠাডা পড়ুক।”
তুবা ফোন রেখে দেয়। অনু হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি বের করে ফেলছে। ওর হাসি দেখে তুবার আরো রাগ হচ্ছে। বেচারীর কাঁচা ঘুমটা কল দিয়ে ভাঙালো আবার কোনো কথা বলে না, তারপর এই অনুর খিকখিক হাসি।
অন্যদিকে,
মুগ্ধ আজ মা-বাবাকে নিয়ে বাইরে এসেছে। অফিস থেকে একদিনের ছুটি নিয়ে সারাদিন উনাদের নিয়ে শপিং করেছে মুগ্ধ। মায়ের পছন্দে কেনা জামদানী শাড়ি, সুতির শাড়ি, সিল্কের নানা রঙের শাড়ি, কাতান শাড়ি, তাঁতের শাড়িগুলো জানান দিচ্ছে জিনাতের বাসায় প্রস্তাব পাঠাতে বেশিদিন বাকি নেই। যদিও মুগ্ধের মা এখনো জিনাতের ব্যাপারে জানে না।
দুপুরের খাবার বাইরে রেস্টুরেন্টে খেয়েছে তিনজনে। তারপর আবারো শপিং করা হয়। এবারে ছেলেকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন মুগ্ধের মা। নাছোড়বান্দা মায়ের কথাও শুনবে এবারে মুগ্ধ।
বিকেলে মুগ্ধের বাবা বাসায় ফিরে যায়। মুগ্ধ ওর মাকে নিয়ে ওর মায়ের একটা বান্ধবীর বাসায় যায়। অনেকদিন নাকি তাদের দেখা হয়না। ওখানে মা আর আন্টির কথা শেষ হতে হতে সন্ধ্যে নেমে যায়। প্রকৃতির গতানুগতিক নিয়মে সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যায়।
মুগ্ধ ওর মাকে নিয়ে বেরিয়েছে৷ রিকশায় উঠে পেছন থেকে মাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে ও।
মুগ্ধের মা একটু গলা খাকিয়ে বলল,
“বিয়ের পরেও কি এভাবে আমাকে কেয়ার করবি?”
মায়ের এমন অবুঝ কথায় অবাক হয় মুগ্ধ। তবুও হাসিমুখে বলে,
“তখন কি আর আমি একা কেয়ার করবো? তখন তোমার পুত্রবধূও থাকবে তোমাকে কেয়ার করার জন্য।”
“যদি সে আমাকে ভালো না বাসে?”
“তবে আমিও তাকে ভালোবাসবো না। সিম্পল।”
মুগ্ধের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যতটা সিম্পল ভাবো ততটা সিম্পল সবটা নয়।”
“কেন?”
“বিয়ের পর নাকি ছেলেরা স্ত্রীর কথায় উঠবস করে?”
মুগ্ধ এবারে একটু জোরেই হেসে দেয়৷ তারপর মাকে আরেকটু কাছে টেনে ন্যাকাসুরে বলল,
“মা, সবাই একরকম নয়। (একটু থেমে) ওই আন্টি তোমাকে এসব বলেছে?”
মুগ্ধের মা ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
“কই? না তো।”
“আমি বুঝেছি।”
এমনসময় সামনে থাকা স্কুটির সাথে রিকশার ধাক্কা লাগে। স্কুটিতে থাকা দুজন মেয়েই চিৎকার করে উঠে৷ সামনের জন হেলমেট খুলে চেঁচিয়ে বলল,
“আহা মামা, চোখে দেখেন না সামনে দুইটা বাচ্চা মেয়ে।”
মুগ্ধ ওর মাকে সামলে রাখায় ব্যস্ত ছিল। কন্ঠ শুনে সামনের দিকে তাকিয়ে মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে যায়। ছেলে হলে এক্ষুণি মাইর লাগাতো, কিন্তু মেয়েদের তো আর মারা যাবে না৷
স্কুটিতে থাকা দুজন মেয়ে তুবা ও অনু। তুবা আবারো চেঁচিয়ে উঠে,
“আমার স্কুটির সামনের দিকে ক্র্যাক পড়ে গেছে।”
মুগ্ধ রেগে রিকশা থেকে নেমে গিয়ে তুবাকে বলল,
“এই যে ম্যাডাম, আস্তে কথা বলতে পারেন না?”
তুবা কপাল কুঁচকে মুগ্ধের দিকে তাকিয়েই কপালের ভাঁজগুলো উবে যায়৷ সেদিন হাসপাতালে জিনাতের সাথে এই ছেলেকেই দেখেছ তুবা। হ্যাঁ, তুবা স্পষ্ট দেখেছে জিনাত একে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। তারমানে এই ছেলে আলিয়ার ও জিনাত উভয়কে অথবা জিনাতকে অবশ্যই চিনে।
তুবা বাঁকা হেসে বলে,
“আমার স্কুটির ক্ষতিপূরণ চাই।”
মুগ্ধ কপাল কুঁচকে বলল,
“ক্ষতিপূরণ কেন? আপনি নিজেই বেখেয়ালি ভাবে চালাচ্ছিলেন।”
“কোনো কথা শুনতে চাই না, আমার ক্ষতিপূরণ চাই।”
অনু এতোক্ষণ অনেক সহ্য করেছে, কিন্তু এভাবে তো রাস্তায় ঝগড়া করার কোনো মানেই নেই। অনু তুবাকে বলে,
“কি সব বলছো? রাস্তায় শুধু শুধু ঝগড়া করছো কেন?”
তুবা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে অনুকে চুপ থাকতে ইশারা করে। মুগ্ধ মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে উনি খুবই বিরক্ত হয়ে আছেন।
মুগ্ধ তুবাকে বলল,
“কত টাকা ক্ষতিপূরণ চাই?”
তুবা নিজের এক ভ্রু উপরে তুলে বলল,
“আমি কি একবারো টাকা চেয়েছি?”
“তো কি চাই?”
“কালকে আমার সাথে দেখা করবেন।”
মুগ্ধ মানিব্যাগ খুলছিলো, তুবার কথায় কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকায়। তুবা মুগ্ধের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“ধানমন্ডি লেক পার্কে আসবেন বিকাল সাড়ে ৫ টায়।”
মুগ্ধ বাঁকা হেসে মানিব্যাগটা পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে,
“কেন দেখে করবো?”
“অন্তত জিনাতের জন্য।”
মুগ্ধ এবারে অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায়। তুবা মুগ্ধের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিজের নাম্বার ‘তুবা’ নামে সেইভ করে দেয়। তারপর স্কুটিতে উঠে অনুকে বলল,
“উঠো এবারে? শপিং কি করবে না?”
অনু চমকে উঠে বলে,
“হুম, হুম।”
মুগ্ধের সামনে দিয়ে বেশ আনন্দ করে স্কুটি নিয়ে চলে যায় তুবা। মুগ্ধ অবাক হয়ে নিজে নিজেই ভাবে,
“আমি কি এই মেয়েকে কোনোভাবে চিনি?”
রাতে,
তাজিম এখনো বাসায় আসেনি। অনু নিজের রুমে বসে ফোনে গেমস খেলছে। এমনসময় ওর ফোনে কল আসে৷ অনু রিসিভ করে কিছু বলার আগেই ওপরপাশ থেকে পুরুষকন্ঠ শোনা যায়,
“আসসালামু আলাইকুম।”
অনু কন্ঠটা কার তা বুঝতে পারে না। তবুও শান্তসুরে বলল,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কে বলছেন?”
“আমি আলিয়ার, চিনতে পেরেছেন কি?”
অনু অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠে গেছে।নিজেকে শান্ত রেখে বলল,
“জি, চিনেছি।”
আলিয়ার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“এটা হেল্প চাই ভাবি। আপনার ছোটভাই ভেবে কি আমাকে হেল্প করবেন?”
এমন অসহায় অনুরোধের সুর ফেলতে পারে না অনু,
“ঠিক আছে, বলো।”
আলিয়ার একটা ঢোক গিলে বলা শুরু করে। ওদের মধ্যে হওয়ার সমস্যা এবং সমস্যার অজানা কারণ সম্পর্কেও বলে। সমস্যা কিছু যে হয়েছিল তা অনু আগেই আন্দাজ করেছিল, কিন্তু এমন সমস্যা তা অনু বুঝতে পারেনি। নিজের অসুস্থতার কথাও আলিয়ার ওকে জানায়, কিভাবে বেঁচে ফিরেছে তাও বলে। অনু শুধুই শুনছে, একজন মনোযোগ শ্রোতার ভূমিকা নিরবে পালন করে যাচ্ছে।
সবটা বলার পর অনু বলল,
“এবার বলো আমি কি হেল্প করতে পারি?”
“তুবার সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দিতে হবে। কিভাবে করাবেন তা আমি জানি না, কিন্তু অ্যানিহাউ দেখা করিয়ে দিন প্লিজ।”
খুব তাড়াহুড়ো করে কথাগুলো বলে ফেলে আলিয়ার।
অনু কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
“তুবা যদি রাজি না হয়?”
“প্লিজ ভাবি, আমি বললে ও রাজি হবে না কিন্তু আপনি বললে তো…”
আলিয়ারের কথার মাঝেই অনু বলে,
“ঠিক আছে, এইটুকু সাহায্য করতেই পারি। কিন্তু তোমার ফ্যামিলি কি রাজি হবে? মানে তোমাদের বিয়ের কথা বলছি।”
আলিয়ার ওর বাবা মায়ের বলা কথাগুলো মনে করতে থাকে। কথাগুলোকে সুন্দর করে সাজালে তার অর্থটা এমন হয় যে ওর পছন্দের মেয়ের সাথেই ওর বিয়ে হবে।
আলিয়ার চুপ থাকায় অনু বলল,
“কনফিউজড নাকি?”
“না, (একটু থেমে) আম্মু আব্বু রাজি হবেন।”
“আচ্ছা, আমিও তবে চেষ্টা করবো।”
আলিয়ার মুচকি হাসে। অনু কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায়, আলিয়ারকে তো বলল চেষ্টা করবে কিন্তু তুবা কি আদৌ রাজি হবে?
.
চলবে…..
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com