Breaking News

শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -১৭



সকাল ৭:১৫,
আলিয়ার অফিসে যাবে, তাই রেডি হয়ে নাস্তা করার জন্য ডাইনিং এ যায়। কাল ঠিকমতো অফিসে কাজ করেনি তাই আজ তাড়াতাড়ি অফিসে যাবে সে।
আছিয়া খাবার সার্ভ করছে। জেরিন রেডি হয়ে এসে তাড়াহুড়া করে খেতে বসে বলে,
“তাড়াতাড়ি খাবার দেও, চাচী আম্মু।”
আছিয়া খাবার দিতে দিতে বলে,
“এতো তাড়াহুড়ো করার কিছুই নেই, এমন কোনো দেরি হয়নি।”
সুলতানা এসে খেতে বসে পড়ে। এমন একটা ভাব করছে যেন আছিয়া এ বাড়ির চাকরানি। আলিয়ার বিষয়টা নোটিশ করে বলে,
“খালা (ওদের বাড়িতে যে কাজ করে) আজ আসেনি।”
“আজ আসবে না, ওর মেয়ের শরীরটা নাকি ভালো নেই। কয়েকদিন আগে বলেছিলো ওর মেয়ে প্রেগন্যান্ট।”
আলিয়ার রুটি মুখে দিয়েছে সবে। আছিয়ার কথায় উনার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কিছু টাকা পাঠিয়ে দিও, ওষুধপত্র লাগবে তো।”
আছিয়া আলিয়ারের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আমি বিকেলে ওদের বাসায় যাবো। তখন দিয়ে আসবো।”
“তাহলে তো আরো ভালো, চাচী আম্মু যাবে না?”
সুলতানার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে আলিয়ার। সুলতানা খেতে খেতে বেশ গম্ভীরভাবে বলে,
“না, কোনো কাজের বুয়ার বাসায় যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই।”
আলিয়ার বাঁকা হেসে একবার আছিয়ার দিকে তাকায় তারপর সুলতানাকে বলল,
“তুমি নিজেও এই জায়গায় না থেকে খালার জায়গায় থাকতে পারতে, অহংকার করো না চাচী ফলাফল খুব খারাপ হতে পারে।”
“আমাকে ভয় দেখাচ্ছো?”
“প্রেতাত্মাকে ভয় দেখানো কি আমার কাজ?”
জেরিন ফিক করে হেসে দেয়। সুলতানা একবার জেরিনের দিকে তাকায়। আছিয়াও মুখ টিপে হাসছে। জিনাত ডাইনিং এ আসে। একবার সকলের দিকে তাকিয়ে তারপর চুপচাপ খেতে বসে।
সুলতানা জিনাতকে বলে,
“তোমার বাবা তো আজ অফিসে যাবে না, তুমি কি একা ভার্সিটিতে যাবে?”
“হুম, জেরিনকে কলেজে দিয়ে আমি চলে যাবো।”
আছিয়া ওদের কথা শুনেও না শুনার ভাণ করে ইব্রাহিমকে ডাকতে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ইব্রাহিম ও আহমেদ এসে খেতে বসে।
সুলতানা ইব্রাহিমকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
“জিনাত, একা তোমাকে যেতে হবে না। তোমাদের একা ছাড়তে আমার খুব ভয় হয়। বলা তো যায় না, কোথায় কোন বিপদ হয়।”
ইব্রাহিম বলে,
“একা যাবে কেন?”
“আজ তো আপনার ভাই অফিসে যাবে না, তাই একা যেতে হবে ওদেরকে।”
ইব্রাহিম আলিয়ারকে বলে,
“আলি, তুমি জেরিন ও জিনাতকে নিয়ে যাবে।”
আলিয়ার কিছু বলতে নিলে ইব্রাহিম হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি যা বলেছি তাই করবে, আর কোনো কথা শুনতে চাই না।”
আলিয়ার একবার আছিয়ার দিকে তাকায় তারপর ইব্রাহিমকে বলে,
“ঠিক আছে।”
সুলতানা মুচকি হাসে। এতোক্ষণের এতো চিন্তা যেন এই কথাটা শুনার জন্য। এখনো সে আশা রাখে আলিয়ার জিনাতকে বিয়ে করবে। এমন সুন্দরী মেয়েকে তো কেউ হাতছাড়া করতে চায় না।
আলিয়ার কিছুটা বাধ্যই হয়েছে বাবার কথায় রাজি হতে। বারবার বাবার বিপক্ষে কথা বলতে ওর খারাপ লাগে। খাবার শেষ করে আলিয়ার ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করছে জিনাত ও জেরিনের জন্য। দুজনেই রেডি হতে গেছে।
আলিয়ারের ফোনে ম্যাসেজ দেয় তুবা,
“কি খবর? এখন কেমন আছেন?”
আলিয়ার মুচকি হেসে রিপ্লাই দেয়,
“ভালো আছি, তা তোমার মন ভালো আছে?”
“তা তো কাল রাতেই হয়েছে। আপনার কথা শুনলে যেকোনো কারো মন ভালো হয়ে যাবে।”
আলিয়ার আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই এখানে, তাই ভয়েজ ম্যাসেজ করে,
“আমার এতো প্রশংসা করো না, বদহজম হয়।”
তুবা ম্যাসেজটা শুনে হেসে দেয়। আলিয়ার আবারো ম্যাসেজ দেয়,
“আজ ভার্সিটিতে আসবে না?”
“আসবো তো, একটু পরেই বেরবো।”
“সাথে কি ভাইয়া থাকবে?”
“না, ভাইয়া তো অফিসের জন্য বেরিয়ে গেছে।”
“আচ্ছা।”
এমনসময় জিনাত ও জেরিন চলে আসে। আলিয়ার তুবাকে ছোট্ট করে ম্যাসেজ দেয়,
“বাই।”
তারপর ওদেরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। জেরিনকে কলেজের সামনে ড্রপ করে জিনাতকে নিয়ে ভার্সিটির দিকে রওনা দেয় আলিয়ার। জিনাত চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, আলিয়ার কয়েকবার ওর মুখ দেখে মনে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। আলিয়ার এখনো বুঝতে পারছে না তুবাকে নিয়ে এই বাড়িতে কি কোনো সমস্যা হবে? জিনাত কি কোনো সমস্যা করবে নাকি সুলতানা চাচী?
ভার্সিটির সামনে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে আলিয়ার বলে,
“যা, গাড়ি থেকে নাম।”
জিনাত ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে নামে। আলিয়ারও নেমে দাঁড়ায়, সে তো তুবার অপেক্ষা করছে। জিনাত আলিয়ারকে বলে,
“একটা হেল্প লাগতো।”
আলিয়ার ফোন টিপতে টিপতে বলল,
“কি?”
“আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই।”
“তো?”
“তোর বিকাশে কি টাকা আছে?”
“আছে।”
জিনাত কিছুটা ইতস্ততভাবে বলল,
“আমার নাম্বারে ৫০ টাকা রিচার্জ করে দিবি?”
আলিয়ার একবার ওর দিকে তাকায়। জিনাত দাঁত কেলিয়ে আছে। আলিয়ার চুপচাপ ওর নাম্বারে টাকা রিচার্জ করে দিয়ে বলে,
“হয়েছে?”
“হুম, থাংকু।”
আলিয়ারের গাল টেনে দিয়ে ভার্সিটিতে ঢুকে যায় জিনাত। আলিয়ার কপাল কুঁচকে তাকায়। আলিয়ার ঘুরে দেখে গাড়ি থেকে একটু দূরেই তুবা দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখের পানি একদম ছলছল করছে, চোখের পাতার আলতো ছোঁয়ায় গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।
এতোক্ষণ আলিয়ার আর জিনাতকে একসাথে দেখেছে তুবা। জিনাত আলিয়ারের গাল টেনে দিয়ে গেছে এটাও দেখেছে। আলিয়ার তুবার দিকে এগিয়ে গেলে তুবা বলে,
“এটা আশা করিনি আলিয়ার।”
আলিয়ারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ভার্সিটিতে ঢুকে যায় তুবা। আলিয়ারের ইচ্ছে করছে জিনাতকে কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারতে, আর বাকি রাগটা নিজের উপরে কেন যে বাবার কথায় রাজি হলো।
ক্লাসে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে তুবা। সুপ্তি ও স্নিগ্ধা এসে ওর দুদিক দিয়ে বসে। তুবা কাঁদছে দেখে দুজনেই অবাক।
সুপ্তি বলে,
“তুবা।”
তুবা মাথানিচু করে বসে থাকে। স্নিগ্ধা ওকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,
“বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে রে?”
তুবা ডানেবামে মাথা নাড়ায়। সুপ্তি বলে,
“শরীর খারাপ তোর?”
“না।”
সুপ্তি ওর কাছে গিয়ে বলে,
“আলিয়ার ভাইয়ের সাথে কোনো সমস্যা হয়েছে?”
তুবা সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আলিয়ার অন্য কাউকে ভালোবাসে।”
“কি?”
চমকে উঠে সুপ্তি ও স্নিগ্ধা একসাথে বলে।
তুবা উপরেনিচে মাথা নেড়ে বলে,
“আজকে ভার্সিটিতে আসার সময় দেখেছি উনাকে একটা মেয়ের সাথে।”
“একটা মেয়ের সাথে দেখেছিস মানেই উনি তাকে ভালোবাসে? তোর মতো মেয়ে এসব ভাবতে পারে?”(সুপ্তি)
তুবার গাল দিয়ে আবারো পানি বেয়ে পড়ে। ডানহাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলে,
“মেয়েটা উনার গাল টেনে দিয়েছে। উনিও কিছু বলেনি।”
“হয়তো ফ্রেন্ড?”(স্নিগ্ধা)
“ফ্রেন্ড হলে কি ওরকম গা ঘেঁষাঘেঁষি করবে?”
তুবার কথায় দুজনে একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। সুপ্তি বলে,
“আচ্ছা, তুই শান্ত হ। আসল ঘটনা তো আলিয়ার ভাইই বলতে পারবে। আমার তো মনে হচ্ছে তুই উনাকে ভুল বুঝছিস।”
তুবা কিছু না বলে মাথানিচু করে বসে থাকে। সুপ্তি ও স্নিগ্ধা ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও তুবার কান্না থামে না।
অন্যদিকে,
মুগ্ধ আজ একটু বাইরে আছে। অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী হতে হলে জায়গা কিনতে হবে। সে কিছু বাংলোর মডেল দেখছে আর ছবি তুলছে।
কয়েকটা ছবি মায়ের ফোনে পাঠিয়ে মাকে কল করে সে,
“আম্মু, দেখো তো ছবিগুলো।”
ওর মা গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“ভাবলাম বিয়ের পাত্রী দেখছিস।”
মুগ্ধ হতাশ হলো মায়ের কথায়, মায়ের এই বিয়ে রোগ ওর বিয়ের পরেই থামবে হয়তো। ওর মা আবার বলল,
“দেখলাম, এগুলো দিয়ে কি হবে?”
“কিনতে চাই, কোনটা সুন্দর হবে? যেটার বাইরের ডিজাইন তোমার ভালো লাগবে সেটার ভিতরের ভিডিও পাঠাবো।”
“একটাও না।”
মুগ্ধ প্রচন্ড রকমের মানসিক ধাক্কা খায়। তারমানে কি ওর মা এখানে আসতে চায় না?
মুগ্ধ ভয়ে ভয়ে বলল,
“আরো কিছু ছবি পাঠাবো?”
“না।”
“কি হয়েছে তোমার আম্মু? শরীর খারাপ নাকি?”
মুগ্ধের মা ধমক দিয়ে উঠে,
“সে খবরে তোর কি কাজ? তুই আছিস তোর চাকরী নিয়ে, তোর ক্যারিয়ার নিয়ে, তোর সেটেল হওয়া নিয়ে। তুই তোর স্বপ্ন সত্যি করছিস আর যে তোকে জন্ম দিয়েছে তার স্বপ্নের কোনো দামই নেই তোর কাছে।”
মায়ের কথাটা মুগ্ধের বুকে তীরের মতো বিঁধে। মুগ্ধ কিছুটা আবেগী হয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“বিয়ে করলে তুমি খুশি হবে তো?”
“সেসব জেনে তোর কি কাজ?”
মুগ্ধ মুচকি হেসে বলে,
“মেয়ে দেখো, আমি নেক্সট উইক দেশে আসছি।”
“সত্যি?”
“একদম।”
“আমার সোনা ছেলে, আমাকে কত্তো ভালোবাসে।”
মুগ্ধ হাসতে থাকে। সন্তানের জন্য মায়েরা তো কত কষ্টই সহ্য করে, মুগ্ধ নাহয় মায়ের জন্য কিছু কষ্ট সহ্য করল। কিন্তু যাকে বিয়ে করবে তাকে কি প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে পারবে মুগ্ধ?
মুগ্ধের মা কল রেখে ওর বাবাকে এই ঘটনা জানায়। দুজনে মিলে ফ্যামিলির প্রায় সবাইকে এই ঘটনা জানিয়ে দেয়। যেভাবেই হোক একজন সুযোগ্য কন্যা লাগবে মুগ্ধের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে।
রাত ১০ টা,
তুবা নিজের ঘরে বসে বসে একটা হাতপাখাতে সুই-সুতার নকশা তুলছে। গ্রামের বাড়িতে মহিলারা যেমন অবসরের সময় সুন্দর সুন্দর কাঁথা, পাখায় নকশা করে ঠিক সেইরকম। পার্থক্যটা হলো মহিলাটা আনন্দের সাথে অবসরে নকশা তুলে আর তুবা কষ্টটাকে ভুলার জন্য করছে।
আলিয়ার সারাদিনে প্রায় ৫০ বার ওকে কল করেছে। তুবা রিসিভ করেনি, কেন করবে? অন্য মেয়েদের সাথে কেন কথা বলবে আলিয়ার? কেন অন্য একজন মেয়ে ওর গাল ধরে টানবে? আলিয়ার শুধু তুবার, অন্যকারো কেন হবে?
আলিয়ার ওর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কল করছে। তারপর বাধ্য হয়ে ম্যাসেজ দেয়,
“বাসার সামনে আছি, একটু বাইরে এসো নাহলে ফোন রিসিভ করো।”
আলিয়ার আবারো কল দেয়, তুবা কল রিসিভ করে কিন্তু চুপ থাকে।
“দেখো, ভুল বুঝছো আমাকে। যাকে আমার সাথে দেখেছো ও আমার কাজিন, জিনাত। আমার ছোটবোন আর তুমি কিসব ভেবে নিয়েছো?”
তুবা কিছুই বলে না। আলিয়ার আবারো বলে,
“আজ কাকা বাসায় থাকবে তাই ওকে ভার্সিটিতে দিতে এসেছিলাম, ওর ফোনে টাকা ছিল না তাই রিচার্জ করে দেয়ায় ওভাবে গাল টেনেছে। টেইক ইট নরমালি।”
তুবা গাল ফুলিয়ে বলে,
“নরমাল? তারমানে প্রায়ই ওরকম করে গাল টেনে দেয়?”
“আরে না না, তুমি উলটাপালটা বুঝতেছো।”
“তাহলে ভাজটা কি? আপনি আর আপনার ওই কাজিন একদম ভাই বোনের মতো থাকেন?”
“হুম।”
তুবা ধমক দিয়ে বলে,
“এসব কাজিনকে গাল টানাটানি থেকেই একসময় বলবে আলিয়ার তোমাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব।”
শেষের কথাটা ব্যঙ্গভাবে বলে তুবা।
আলিয়ার কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
“কিসব বলছো তুমি তুবা?”
তুবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“এখনো নিচে দাঁড়িয়ে আছেন?”
“হুম।”
তুবা কল না কেটেই ফোন রেখে চুপিচুপি নিচে নেমে যায়। আলিয়ার ফোন কানে দিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। তুবা পেছন থেকে গিয়ে হঠাৎ করে বলে,
“ভাও।”
আলিয়ার চমকে পেছন ফিরে তাকায়। তুবা আলিয়ারের গলা জড়িয়ে ধরে ওর গালে চুমো দিয়ে আবারো দৌঁড়ে উপরে চলে যায়। আলিয়ার আচমকা এমন ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।
.
চলবে……

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com