Breaking News

শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -০৮



ভার্সিটির সামনে সুপ্তি রিকশা থেকে নামলে শুভ এসে ওর সামনে দাঁড়ায়। সুপ্তি কপাল কুঁচকে বলে,
“কি সমস্যা?”
“তুমি আলিয়ার ভাইকে কিভাবে চিনো?”
“সেটা তোকে কেন বলবো?”
“ওকে না বললেও আমাকে তো বলতেই হবে।”
এমন কথায় পিছনে ঘুরে তাকায় সুপ্তি। ফিরেই একটা ঢোক গিলে সে। আনমনেই বলে,
“আলিয়ার ভাই?”
আলিয়ার বাঁকা হেসে ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“ভাই কেন বলছো? তুমি না আমাকে ভালোবাসো? আমার ভালোবাসায় তুমি নাকি রাতের বেলা সূর্য দেখো, ঢাকার ড্রেনকে নীলনদ দেখো?”
সুপ্তি দাঁত কেলিয়ে বলে,
“তুবা।”
আলিয়ার সুপ্তির হাত টেনে ভার্সিটি থেকে একটু দূরে নিয়ে আসে। আসার আগে শুভকে বলে,
“ক্লাসে যাও।”
সুপ্তিকে দূরে এনে আলিয়ার একটা ধাক্কা দিয়ে দাঁড় করিয়ে বলে,
“সমস্যা কি তোমার? কি সমস্যা?”
আলিয়ারের ধমক খেয়ে ভয়ে চুপসে যায় সুপ্তি।
আলিয়ার আবারো ধমক দিয়ে বলে,
“চেনো আমাকে? চেনো?”
সুপ্তি ডানেবামে মাথানেড়ে বলল,
“ভালোভাবে চিনি না, কিন্তু আপনার নাম আলিয়ার সেটা জানি আর আমি আপনার ছবি দেখেছি।”
“ছবি?”
“হুম, তুবা দিয়েছিল আর আমি আপনাকে কল দেইনি। কাজটা তুবা করেছে।”
আলিয়ারের চোখের চাহনিই বলে দিচ্ছে যে সুপ্তির কথায় ওর বিশ্বাস হয়নি। সুপ্তি বলে,
“আমি তুবাকে ডেকে আনছি, আপনি দাঁড়ান।”
সুপ্তি যেতে নিলে আলিয়ার আবারো ওর হাত টেনে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বলে,
“তুবা কে?”
“আমার বেস্টফ্রেন্ড।”
“কল দাও আর এখানে আসতে বলো।”
সুপ্তি ভয়ে ভয়ে আলিয়ারের কথামতো কাজ করলো। তুবাকে কল করে এখানে আসতে বলল। ১০ মিনিট পর তুবা সেখানে এসে হাজির হয়। আলিয়ারকে দেখেই মুচকি হাসে আর আলিয়ার তো ফ্রিজড হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সুপ্তি তুবাকে আলিয়ারের সামনে দাঁড়া করিয়ে দিয়ে নিজে একটু পিছিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“এইতো তুবা।”
আলিয়ার পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“মিস. তুবা?”
“হুম”
“আপনি আমাকে কল করে ডিস্টার্ব করছেন?”
তুবা জোরে জোরে ডানেবামে মাথা নাড়ে। আলিয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“আপনি কেন করেছেন?”
“আমি করিনি।”
“কেন করেছেন?”
“আমি করিনি, সত্যি বলছি।”
আলিয়ার তুবার দিকে একটু ঝুঁকে বলল,
“আপনি করেননি?”
“না, একদম নয়। আমি কেন আপনাকে কল দিবো?”
আলিয়ার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের ফোন বের করে সেই আননোন নাম্বারে কল দেয়। তুবার ফোন বেজে উঠে। আলিয়ার আড়চোখে তুবার দিকে তাকালে তুবা দাঁত কেলিয়ে দৌড় দিতে নিলে আলিয়ার ওকে ধরে ফেলে।
অন্যদিকে,
জিনাত ক্লাসে ঢুকেছে। প্রত্যাশা এসে ওকে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে বলল,
“কালকে আন্টি কল করেছিল।”
“আম্মু?”
“হুম, জানিস কি বলেছে?”
জিনাত কনফিউজড হয়ে বলল,
“কি বলতে পারে?”
“অনেক কিছু বলেছে।”
“যেমন?”
প্রত্যাশা বলা শুরু করে,
“প্রথমে জিজ্ঞাসা করলো তুই কাউকে পছন্দ করিস কিনা। আমি তো প্রথমে বলতে চাইনি, পরে…”
প্রত্যাশা থেমে গেলে জিনাত ওকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“কি বলেছিস তুই?”
“আমি আলিয়ার ভাইয়ের কথা বলেছি।”
জিনাতের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো, পুরোনো সব স্মৃতিগুলো তাজা টগবগে হয়ে গেল। ভালোবাসার অনুভূতিগুলো শিরায়-উপশিরায় ছুটাছুটি করতে লাগলো।
প্রত্যাশা বলল,
“আন্টি জিজ্ঞাসা করেছিল ভাই তোকে পছন্দ করে কিনা?”
“তুই কি বলেছিস?”
“বলেছি খুব পছন্দ করে, তোরা একে অপরকে ভালোবাসিস।”
জিনাত চোখ বন্ধ করে একটা ঢোক গিলে বলে,
“কেন মিথ্যা বললি?”
প্রত্যাশা দেখে জিনাতের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। প্রত্যাশা ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
“কাঁদিস না, আমি অনেক ভেবেই কথাটা বলেছি।”
জিনাত চোখ খুলে ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। প্রত্যাশা ওর হাতে ধরে বলল,
“আলিয়ার ভাইয়ের কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই, তুই তো বলেছিলি?”
“হুম”
“আবার তুই উনাকে পছন্দ করিস।”
“হুম”
“আমার মনে হয় আন্টি তোদের বিয়ের ব্যাপারে ভাবছে। যদি তা না হতো তবে আন্টি তোকে বকাঝকা করতো। যেহেতু তা করেনি, তবে এভাবে বিয়েটা হয়ে গেলে ক্ষতি কি?”
জিনাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এভাবে কি ভালোবাসা পাওয়া যায়?”
“একবার বিয়ে হয়ে গেলে আলিয়ার ভাই তোকে ভালোবাসতে বাধ্য।”
“সত্যি?”
“একদম সত্যি।”
জিনাত মুচকি হেসে বলে,
“তোর কথা যেন সত্য হয়।”
“আরে, অবশ্যই হবে।”
টিচার ক্লাসে ঢুকায় দুজনে চুপ করে।
কিছুক্ষণ পর,
সুপ্তি ভার্সিটিতে চলে গেছে। আলিয়ার ও তুবা পাশাপাশি হাঁটছে। গতকাল আলিয়ারকে বিরক্ত করার শাস্তি হিসেবে তুবাকে ক্লাসে যেতে দেয়নি আলিয়ার।
তুবা বলে,
“আমি আপনাকে বিরক্ত করতেই চাইনি। আসলে আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকে কল করতে চেয়েছিলাম।”
“বয়ফ্রেন্ডটা মে বি আমি?”
“একদম নয়।”
“তবে তোমার বয়ফ্রেন্ডের নাম কি?”
তুবা ভাবছে কি বলবে। মিথ্যা বলার সময় যা হয় আরকি, কথায় প্যাঁচ লেগে যায়। ওর এখন সেই অবস্থা। কোনো ছেলের নামই মাথায় আসছে না।
তুবা দাঁত কেলিয়ে বলল,
“তাজিম”
“তবে ফোনের শুরুতেই কেন বলেছিলে মি. আলিয়ার কিনা?”
তুবা বুঝতে পারছে আলিয়ারের কথার জালে ভালোই ফেঁসেছে সে। আলিয়ার ওর নিরবতা দেখে হাসে।
হাঁটতে হাঁটতে একজায়গার দেখে রাস্তার ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে ভেতরে পরিষ্কার করছে কিছু লোক। আলিয়ার মুচকি হেসে সেদিকে ইশারা করে বলল,
“আপনার নীলনদে পরিচ্ছন্নতা চলছে।”
লজ্জায় তুবার গালদুটো লাল হয়ে যায়। তুবা মনে মনে ভাবে,
“এই লোকটা অনেক বজ্জাত, শান্ত কথায় অপমান করে।”
আলিয়ার আগের মতোই হাঁটছে। তুবা একটা কাশি দিয়ে বলে,
“আজ অফিস নেই?”
“আছে, লাঞ্চের পরে যাবো।”
“বস বকবে না?”
“না”
“কেন?”
“বলবো গার্লফ্রেন্ডের আবদার পূরণ করতে তাকে নীলনদ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম, তবে আর বকবে না।”
তুবা গাল ফুলিয়েছে, কথায় কথায় এমন অপমান কার সহ্য হয়। হঠাৎ মনে পড়ে আলিয়ার একটু আগে ওকে গার্লফ্রেন্ড বলল। তুবা আলিয়ারের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড হলাম কবে?”
“কালকেই তো বলেছিলে।”
“আমি তো দুষ্টুমি করেছিলাম।”
আলিয়ার মুখে টিপে হেসে বলে,
“তোমার ভালোবাসা আমি বুঝতে পেরেছি, প্রিয়তমা।”
তুবার ইচ্ছে হচ্ছে মাটি ফাঁক করে ভিতরে চলে যেতে। আলিয়ার বুঝতে পারে যে তুবা লজ্জা পাচ্ছে। আলিয়ার শান্তসুরে বলল,
“চলুন, রেস্টুরেন্টে যাই।”
“না, আমি সকালে খেয়ে এসেছি।”
“ওহ, তাহলে আপনাকে কি দিয়ে ট্রিট করা যায়?”
“আইসক্রিম”
বলেই মুখে হাত দেয় তুবা।
আলিয়ার হেসে বলে,
“চলুন, আপনাকে আইসক্রিম দিয়েই ট্রিট করি।”
রাতে,
এশার নামাজ পড়ে জিনাত রাতের খাবার তৈরিতে মাকে সাহায্য করছে। মিসেস আছিয়া রান্নাঘরে এসে ওকে দেখে বলল,
“জিনাত মা, যাও তোমার রুমে যাও। এখানে তোমাকে থাকতে হবে না, পড়তে যাও।”
“আচ্ছা, চাচীআম্মু”
জিনাত রুমে চলে যায়। আছিয়া প্লেটগুলো নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রেখে সুলতানাকে বলে,
“তুমি আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছিলে।”
“খুব জরুরি কথা ভাবি। আমি পরে আপনাকে বলবো।”
“এমন কি কথা?”
“জিনাতের বিয়ে নিয়ে ভাবি।”
আছিয়া অবাক চোখে সুলতানার দিকে তাকালে সুলতানা মুচকি হেসে বলল,
“মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে তো দিতেই হবে।”
আছিয়া ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
“এতো চিন্তা কেন করছো সুলতানা? ওদের আব্বু আসুক, কথা বলে সিদ্ধান্ত হবে।”
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি ভাবি। জিনাত একজনকে পছন্দ করে।”
“কাকে?”
“পরে বলছি।”
সুলতানা কাজে মন দেয়। আছিয়া চরম অবাক হয়ে আছে। জিনাত কাকে পছন্দ করে, আবার সেটা সুলতানা জানে?
জিনাত রুমে বসে বই পড়ছে। এমনসময় ওর ফোনে কল আসে। ফোনের স্ক্রিনে ‘প্যারা’ নামটা দেখে বুঝতে পারে মুগ্ধ কল দিয়েছে। জিনাত দাঁতে দাঁত ঘষে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
ফোন রিসিভ করে জিনাত বলল,
“জি, বলুন।”
“এখনো রেগে আছেন দেখছি।”
মুগ্ধের শান্ত কন্ঠে কিছুটা অবাক হলো জিনাত। সেদিন এতোটা অপমান করার পরেও কোনো মানুষ এতো শান্তভাবে কথা বলতে পারে?
মুগ্ধ আবারো বলল,
“এই মেয়ে, চুপ করে আছো কেন?”
“এমনিই, বলুন কি বলবেন?”
“তোমাকে কি নির্দিষ্ট কোনো কথা বলার জন্য কল দিতে হবে?”
“জি, কারণ আমি আপনার বিয়ে করা বউ নই যে যখনতখন কল করবেন।”
“তবে বিয়েটা করেই নিই, কি বলো?”
জিনাত চমকে উঠে, বুকের বামপাশের লাব-ডাব শব্দটা অনেক দ্রুত হচ্ছে ওর। মুগ্ধের কথায় এমন অনুভূতি কেন হচ্ছে জিনাতের? উত্তর যে শূণ্য।
মুগ্ধ বলল,
“কি হলো, জিনু? কথা বলো।”
‘জিনু’ নামটা মুগ্ধের মুখে হয়তো খুব মানিয়েছে। জিনাত মুগ্ধ হয়ে শুনছে। হয়তো মুগ্ধের নামটাও সার্থক, যেকোনো কাউকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে।
“জিনাত?”
“হুম”
“কথা বলবে না? রেখে দিবো?”
“আপনার ইচ্ছা, কল তো আর আমি করিনি।”
“ওকে, ফাইন।”
মুগ্ধ কল কেটে দেয়। জিনাতের অদ্ভুত লাগছে সবকিছু। মুগ্ধের ডাক, কথা সব কানে বাজছে ওর। কেন হচ্ছে এমন? কেন হচ্ছে?
অন্যদিকে,
অনু ও তুবা একসাথে ফিসফিস করে কোনো বিষয়ে কথা বলছে। কেউ সামনে আসলেই দুজন চুপ। তাজিম এসে বলে,
“খাবে না তোমরা?”
“আরে ভাইয়া, টেবিলে সব ঠিকঠাক করে এসেছি। একটু খেয়ে নে না? দেখছিস না কথা বলছি।”
“সারাজীবনেও কথা শেষ হবে না।”
তাজিম খেতে চলে যায়। তওবা ও মহসিনও খেতে বসেছে। তুবা ও অনু কোনোকিছুর হিসাব মেলাতে ব্যস্ত।
তুবা বলে,
“এতো টাকা কে দিবে?”
“আব্বুকে বলি?”
“ছি, ছি, আংকেল কেন দিবে?”
“ধার আনি।”
“তো আংকেলের থেকেই কেন? আব্বুর থেকে নিবো।”
“যদি কারণ জানতে চায়?”
তুবা একটু ভেবে বলল,
“আব্বু-আম্মু জানলে সমস্যা নেই, ভাইয়া না জানলেই হলো।”
“ওক্কে ননদিনী।”
“অন্য নামে ডাকবে আমাকে, সবাই কেন ননদকে ননদিনী ডাকবে?”
“তাহলে আশা বলে ডাকবো। চোখের বালি উপন্যাসের আশা, যার জন্য মহেন্দ্রের মনে ভালোবাসার জোয়ার এসেছিল। অথবা শেষের কবিতা উপন্যাসের লাবণ্য, যাকে অমিত অনেক ভালোবাসতো। তোমার জীবনেও এমন মহেন্দ্র কথবা অমিত আসবে।”
তুবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“তবে তো মহেন্দ্রকে বিনোদিনী অথবা কোনো কেটি এসে অমিতকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে আমার চোখের সামনে থেকে।”
অনু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“এমন কিছুই হবে না। তোমার ভালোবাসা সেই মহেন্দ্র বা অমিতকে আটকে রাখবে।”
তুবা মুচকি হাসে। এখন ওর মনে পড়ছে আলিয়ারকে। আলিয়ারের হাসিমাখা মুখ, বিশেষ করে আলিয়ারের দুষ্টুমি ভরা মুচকি হাসিটা কথা মনে হতেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় তুবা। অন্য ছেলে হলে ঠিকই ও ‘লুচু’ উপাধি দিয়ে দিতো, কিন্তু আলিয়ারের ক্ষেত্রে তেমনটা দিতে ইচ্ছে করছে না ওর। বরং আলিয়ার আরেকটু লুচু হলেই হয়তো ভালো হতো।
অনুর ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ে তুবার। অনু বলে,
“চলো, খেতে চলো।”
“হুম”
“Hurry up.”
তুবা অনুর পিছনে পিছনে ডাইনিং-এ যায়।
.
চলবে….

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com