শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -১৫
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে জিনাত। ধীরে ধীরে চোখ খুলে সে। সুলতানা ওর পাশে বসে আছে, একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে আবারো চোখ বন্ধ করে। সে কোনমতেই চোখের পাতা খুলে রাখতে পারছে না, কি করে পারবে? আলিয়ারের অপমানে আর নিজের প্রতি ঘৃণা থেকে নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। অনেক ভেবেছে, অনেক, অনেক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচানোর আর কোন কারণই খুঁজে পায়না।
তারপর উপায় না পেয়ে মায়ের ওষুধের বক্স থেকে ঘুমের ওষুধ খেয়ে নেয়। একটা দুটো নয়, পুরো দশটা। বেঁচে থাকার কথা নয়, কিন্তু বেঁচে গেছে তাও সেই আলিয়ারের জন্যই। ওর সাথে একান্তে কথা বলার জন্যই ওর রুমে গিয়েছিল আলিয়ার। গিয় ওকে অচেতন অবস্থায় পায়।। তারপরই হাসপাতালে নিয়ে আসে। সময়মত আনতে না পারলে হয়তো জিনাতের নামটা মুছে যেত এই পৃথিবী থেকে। না ঠিক নয়, মানুষটা মুছে যেত, নাম তো অন্যদের মনে থেকে যায়।
জিনাত চোখ বন্ধ করেই নিচু সুরে বলে,
“আম্মু আলিয়ার কোথায়?”
সুলতানা ধমক দিয়ে ওঠে,
“কি করবি তুই ওকে দিয়ে? তোকে হসপিটালে ফেলে চলে গেছে।”
জিনাতের চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।
সুলতানা আবারও ধমকের সুরে বলে,
“বিয়ে যখন করতেই পারবি না, তখন সকলের সামনে কেন বলেছিলি? কেন তোর বাবা আর আমাকে অপমান করলি? এখন আমার মরতে গিয়েছিলি?”
জিনাত কোন উত্তরই দেয় না। কি বলবে? কিছু বলার নেই।
এমন সময় আছিয়া এসে কেবিনে ঢুকে। জিনাতের জ্ঞান আছে দেখে মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে বলে,
“কেন রে মা আমাদের ছেড়ে চলে যেতে নিয়েছিলি? আলিয়ারের কয়েকটা কথায় এত খারাপ লেগেছে যে নিজেকে একবার ভালবাসতে পারলি না?”
জিনাত কোন উত্তর দেয় না৷ চুপচাপ শুয়ে থাকে।
হঠাৎ একটা চেনা কন্ঠ পায় জিনাত,
“যে নিজেকে ভালবাসতে পারে না, সে অন্যকে কি করে ভালবাসবে? আগে নিজেকে ভালবাসতে শেখো, তারপর সকলের সামনে অন্যকে ভালোবাসার কথা বলো।”
জিনাত বুঝতে পারে এই কন্ঠ আলিয়ারের। নিজের অজান্তেই মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। আলিয়ার আবারো বলে,
“উঠতি বয়সি বাচ্চাদের মত কেউ এরকম ভাবে ঘুমের ওষুধ খায়? তারপর মরে যেতে আর পুলিশে ধরে নিতো আমাকে। অবশ্য পুলিশের দরকার কি?”
এটুকু বলে থামে আলিয়ার, আড়চোখে একবার সুলতানার দিকে তাকায়। এ পর্যন্ত সুলতানা ওকে কম কথা শুনায়নি।
এবারে দেখে আসি কি হয়েছিল ঘটনা।
সকলের সামনে স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর এবং আলিয়ারের কাছে বাজেভাবে অপমানিত হওয়ার পর নিজের বাসায় চলে গিয়েছে প্রত্যাশা। সব আত্মীয়স্বজনরা ওদের বাসায় এক রাত থাকবে।
জিনাত চলে যায় নিজের রুমে। রুমের দরজা আটকে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে। গায়ে থাকা গয়নাগুলো খুলে ছুড়ে ছুড়ে ফেলে, মাথার দোপাট্টা খুলে ছুড়ে ফেলে। ড্রেসিং টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা বড় মেকআপ বক্স টা হাতে নিতেই সন্ধ্যার কথা মনে হয় ওর। কি সুন্দর করে সেজেছিল। জেরিন, সামিয়া, প্রত্যাশা ওরা কত হাসাহাসি করছিল, দুষ্টুমি করছিল। নিজের অজান্তেই এগুলো উপভোগ করছিল জিনাত।
কিন্তু সবকিছু অল্প মুহূর্তে পাল্টে গেল। ফ্লোরে শুয়ে পড়ে জিনাত। সিলিঙের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে,
“আলিয়ার যদি এভাবে অপমান করতে পারে তাহলে যেকোনো কেউ আরো জঘন্য ভাবে অপমান করতে পারবে। আজ আমার জন্য সবটা হয়েছে। আমি যদি প্রত্যাশারকে না জানাতাম, আমি যদি বাসায় না জানাতাম, তাহলে এসবের কিছুই হতো না। দায়ী আমি।”
কিছুক্ষণ পর সে আবারো ভাবে,
“এভাবে বেঁচে থাকা যাবে না, পারবোনা। মৃত্যুই আমার জন্য শ্রেয়।”
যেই ভাবা সেই কাজ। চুপি চুপি রুম থেকে বেরিয়ে সুলতানা রুমের দিকে যায়। সুলতানা নিজের রুমে ছিল।
জিনাত গিয়ে বলে,
“আম্মু।”
সুলতানা একবার দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ বলো জিনাত।”
“আমার খুব মাথাব্যথা করছে, ব্যথার ওষুধ লাগবে।”
সুলতানা শুয়েছিল, উঠে ওষুধ দিতে ইচ্ছে হলো না। একে তো মন মানসিকতা ভালো নেই, আবার জিনাত এসেছে। রাগটা তো ওর উপরই বেশি।
জিনাতকে বলল,
“বক্সে আছে, তুমি নিয়ে নাও।”
রুমে ঢুকে বক্স খুলে ব্যথার ওষুধের পরিবর্তে ঘুমের ওষুধ নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। সেখানে গিয়েই এক পাতায় থাকা দশটা ট্যাবলেট খেয়ে নেয় সে। কষ্ট হয়েছে, ছোটবেলা থেকে কখনোই একসাথে একটার বেশী দুটো খেতে চায়নি জিনাত আর আজ? পরিস্থিতি ওকে এমন এক কুলে এনে ফেলেছে যেখান থেকে না পারছে বেরিয়ে যেতে, না পারছে পালিয়ে যেতে।
ফিরে আসি বর্তমানে।
আলিয়ার কেবিনে ঢুকে আছিয়ার সাথে দাঁড়ায়। জিনাতকে দেখে হেসে বলে,
“কি অবস্থা হয়েছিল তোর? একবার খারাপ লাগেনি? গলায় আটকেনি ওষুধগুলো?”
সুলতানা রাগ হচ্ছে আলিয়ার এমন কথায়। ওর জন্যই তো আজ জিনাতের এ অবস্থা তাও ওর এত হাসি সুলতানা আলিয়ারকে বলে,
“বাহ, অনেক হাসি পাচ্ছে। হ্যাঁ, পাবেইতো আমার মেয়ে মরে গেলে তো আরো বেশি হাসি পেত, তাই না?”
আলিয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“ওর মৃত্যুতে যদি খুশি হতাম তবে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে আসতাম না, বুঝলে চাচী আম্মা?”
একটু থেমে আলিয়ার বলল,
“ও বাইরে যাই হোক না কেন, যা খুশি করুক না কেন ও আমার বোন ছিল, আছে, থাকবে।”
বলেই আলিয়া বেরিয়ে যায়। জিনাত একবার চোখ খুলে আলিয়ার এর যাওয়া দেখে।
অন্যদিকে,
রাত প্রায় বারোটা বাজতে চলল। তুবা তাড়াহুড়ো করে ক্যান্ডেলস জ্বালাচ্ছে। অনু এসে একবার উঁকি মেরে বলে,
“আর কতক্ষন লাগবে গো?”
তুবাও ফিসফিস করে বলে,
“এইতো হয়ে এসেছে।”
রাত ঠিক ১১:৫৫,
তাজিমের চোখ বেঁধে রুমে নিয়ে আসে অনু ও তুবা। মহসিন ও তওবা রুমে বসে আছে, ওদেরকে দেখে মুচকি হাসে উনারা।
তাজিম বারবার বলছে,
“কি হয়েছে? চোখ কেন বেধেছো? আরে বাবা ধরে রেখেছো কেন?”
তুবা হেসে বলে,
“যত যাই চেচামেচি করো ছাড়া পাচ্ছ না।”
“কিন্তু কেন?”
“সেটা পরে বলব।”
মুচকি হেসে বলল অনু।
ঠিক রাত বারোটায় তাজিমের চোখ খুলে দেয়া হলো। দুপাশ থেকে দুটো বেলুন ফাটায় তুবা ও অনু। সাথে চিৎকার করে বলে,
“হ্যাপি বার্থডে, তাজিম।”
মহসিন ও তওবা বলে,
“শুভ জন্মদিন বাবা।”
“তুমি ভুলে যেতে পারো, আমরা তো আর এই দিন টা ভুলে যেতে পারিনা।”(মহসিন)
তওবা বলল,
“আমার কোলে প্রথমে এসেছিলে তুমি। মনে আছে আমার এখনো সেই দিনটার কথা, যেদিন তোমার চিৎকারে আমাকে জানান দিয়েছিলে মা আমি এসেছি।”
তুবা লাফিয়ে উঠে বলে,
“ভাইয়া, এইটুকু ছিল।”
হাত দিয়ে আবার ইশারা করে তুবা, সাথে খিলখিল করে হাসে।
তুবার মাথায় একটা গাট্টা দেয় তাজিম, তারপর বলে,
“সবাই কি তোর মতো জিরাফ হয়ে জন্ম নিয়েছে নাকি?”
তুবা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“আমি কি তা বলেছি?”
অনু দুজনের মাঝে এসে বলল,
“এখন কি তোমরা ঝগড়া করবে?”
“না।”
তুবা ডানেবামে মাথা নেড়ে বলল।
তুবা তাজিমের হাতে ছুড়িটা দিয়ে বলে,
“নাও, এবারে কেক কাটো।”
তাজিম মাঝে দাঁড়ায়, ওর দুপাশে মহসিন ও তওবা দাঁড়িয়েছে। অনু তওবার পাশে দাঁড়ায় আর তুবা? সে তো ছবি তোলায় ব্যস্ত।
তাজিমের হাতের উপর দিয়ে হাত দেয় মহসিন ও তওবা। তাজিম কেক কাটলে অনু উপরে পার্টি স্প্রে ছড়িয়ে দেয় আর তুবা স্মরণীয় মুহূর্তগুলো ক্যামেরা বন্ধী করে।
মুগ্ধের বাসায়
১২ টা বেজে গেছে এর অর্থ এতোক্ষণে হয়তো জিনাতের বিয়েও সম্পন্ন হয়েছে। মুগ্ধ একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে সে। হয়তো এই কেড়ে নেয়া ঘুম আর কখনোই ফিরে আসবে না।
মুগ্ধ ভাবে,
“একটুখানি বুঝলে না আমাকে পিচ্চি। কতটা ভালোবেসেছিলাম তোমাকে, একবারও বুঝলে না। কি করে বুঝবে পিচ্চি যে অনেক বড় হয়ে গেছে। তোমাকে আর বিরক্ত করবো না, কখনোই না।”
জিনাতকে বিরক্ত করতে চায় না তাই নিজে নতুন নাম্বার নিয়েছে। মুগ্ধ আলিয়ারের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিবে। কোনো স্মৃতি রাখতে চায় না সে। অস্ট্রেলিয়ায় পাকাপাকিভাবে চলে যাওয়ার ইচ্ছেও আছে। শুভকে একটা সাইড করতে পারলেই বাবা-মাকে নিয়ে সে চলে যাবে অস্ট্রেলিয়ায়। এমন প্ল্যানই করছে সে।
স্মৃতি মুছে ফেলা যায়, কিন্তু ভুলে যাওয়া কি যায়? বিশেষকরে ভালোবাসার মানুষকে।
.
চলবে….
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com