শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -২৮
আলিয়ারের কাছে গেলে আলিয়ার বলল,
“তুমিও বসে পড়ো আম্মু।”
“হুম, বসবো।”
সবাইকে রুটি ও সবজি দিয়ে এসে আলিয়ারের পাশে বসে আছিয়া। আছিয়া ওকে বলল,
“মুগ্ধের আম্মুর সাথে আর কোনো কথা হয়েছিল?”
মুগ্ধের নাম শুনেই একবার আছিয়ার দিকে তাকায় জিনাত৷ আলিয়ার খেতে খেতে বলল,
“হুম, আন্টি (খাবার গিলে নেয়) আন্টি বলেছে মুগ্ধের জন্য খুব ভালো একজন মেয়ে দেখেছে। আন্টি নাকি ওই মেয়ের সাথেই মুগ্ধের বিয়ে দিতে চায়।”
“তাহলে তো খুব ভালো।”
আছিয়া মুচকি হাসে।
“উহু, খুব খারাপ।”
হঠাৎ করেই জিনাত বলে উঠলো।
আলিয়ার ও আছিয়া অবাক হয়ে জিনাতের দিকে তাকায়। আলিয়ার চোখ ঘুরিয়ে একবার সবার দিকে দেখে বলল,
“কেন খারাপ?”
“কেন আবার, শুধু তো মায়ের মত থাকলেই হবে না ছেলেরও থাকতে হবে। নাহলে বিয়ের দিন ছেলে বলবে আমার মত নেই।”
আলিয়ারের মেজাজটা বেশ গরম হয়ে গেছে। যদিও জিনাত ওকে রাগানোর জন্যই কথাটা বলেছে। কারণ ও রাগলেই মুগ্ধের মায়ের কানে এসব কথা পৌঁছাবে।
জিনাত বাঁকা হাসছে৷ আলিয়ার দাঁতে দাঁত ঘসে বলল,
“সব ফ্যামিলি তো এসব নিয়ে সারপ্রাইজ দেয় না।”
বলেই খাওয়ায় মন দেয় আলিয়ার।
ইব্রাহিম বুঝতে পারে কথাটা উনাকেই উদ্দেশ্য করে বলেছে আলিয়ার, তবুও তিনি কোনো প্রতিবাদ করেন না। সুলতানা চোখ রাঙিয়ে জিনাতের দিকে তাকায়, মায়ের চোখে চোখ পড়ে গেলেই চোখ নামিয়ে নেয় জিনাত। মা যে কবে বুঝবে তাই জিনাতের মাথায় ঢুকছে না, অবশ্য দোষটা তো ওরই।
অন্যদিকে,
তুবা ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। এমন সময় অনু এসে রুমে ঢুকে। শান্ত ভঙ্গিতে তুবার পাশে দাঁড়ায়। তুবা একবার ওর দিকে তাকায় তারপর নিজের ওড়না ঠিক করে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
অনু একবার গলা খাকিয়ে বলল,
“কাল রাতে তোমার ভাইয়া কি বলেছে জানো?”
তুবা মুচকি হেসে বলে,
“তোমাদের হাজবেন্ড ওয়াইফের কথা আমার জানা কি দরকার?”
অনু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে,
“আসলে আমি সেরকম কিছু বলিনি, তোমার ভাই বললো সে নাকি অনেক দিন বিরিয়ানি খায়নি।”
তুবা এবারে অনুর দিকে ফিরে ড্রেসিং টেবিলের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“আসলে আমি ও অনেকদিন বিরিয়ানি খাইনি। রান্না করো না কাল?”
বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে উঠে তুবা।
অনু মুচকি হাসে। হাত নাচিয়ে নিচের দিকে ইশারা করে বলল,
“কাল নয়, আজই করব।”
তুবা ঠোঁট উল্টে বলল,
“আজ কেন? আজ তো বৃহস্পতিবার, তুমি বরং কাল করো, কাল শুক্রবার ভাইয়া বাসায় থাকবে।”
অনু ডানে বামে মাথা নাড়ে,
“না, আজই। তোমার ছুটি আজ ১২ টায়, তুমি বাসায় এসে তোমার ভাইয়ের জন্য দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে যাবে।”
তুবা একবার অনুর আপাদমস্তক দেখে ব্যঙ্গসুরে বলল,
“এহ, খেয়েদেয়ে কাজ নেই আমার?”
অনু এবার তুবার কাছে গিয়ে ইমোশনাল ভাব নিয়ে বলল,
“তোমার ভাইয়া তোমার জন্য, আমার জন্য, আব্বু আম্মুর জন্য, আমাদের জন্য এত কষ্ট করছে আর তুমি তোমার ভাইয়ার জন্য এইটুকু কষ্ট করতে পারবে না?”
এমন কথার জন্য তুবা প্রস্তুত ছিল না। অনু যে এতোটা সিরিয়াস হয়ে যাবে তা ও বুঝতে পারেনি।
অনু এবারে কাঁদোকাঁদো ভাব নিয়ে বলল,
“হয়তো তোমার ভাইয়ার রাতেই খেতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু বলেনি। হয়তো আজও ইচ্ছে করছে, কালতো নাও করতে পারে।”
এবারে তুবাও কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়ে, ওর চোখ পানিতে ছলছল করছে। অনু এতক্ষণ এটাই চাচ্ছিলো। তুবা তাজিমের সাথে দেখা করতে অফিসে গেলেই তো আলিয়ারের সাথে দেখা হবে।
তুবা বলে,
“ঠিক আছে, আমি বারোটা বাজে বাসায় এসে লাঞ্চ নিয়ে যাবো। তুমি রেডি রেখো।”
“ওকে।”
মুচকি হেসে বলল অনু।
অনু চলে যেতে নিলে তুবা ওকে ডেকে বলে,
“ভাবি শোনো?”
অনু ফিরে তাকায়,
“হ্যাঁ বলো।”
“আমার লাঞ্চটাও ভাইয়ারটার সাথেই দিয়ে দিও।”
অনু এসে তুবার গাল টেনে নিয়ে বলে,
“ওকে ননদিনী।”
কিছুক্ষণ পর,
তুবা ভার্সিটিতে চলে এসেছে। ভার্সিটিতে ঢুকার সময়ই জিনাতের সাথে দেখা হয় ওর। জিনাতকে দেখেও না দেখার ভাণ করে চলে যায় তুবা।
জিনাতের সাথে থাকা প্রত্যাশা ওকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“চিনিস নাকি?”
“না।”
জিনাত চমকে উঠে বলল।
জিনাত এখন প্রত্যাশার সাথে সব কথা শেয়ার করে না। কেনই বা করবে, ওর পেটে পেটে ওই শয়তানি বুদ্ধির পাল্লায় আর পড়তে চায় না জিনাত।
এমনসময় জিনাতের ফোনে কল আসে। মুগ্ধের নাম্বার দেখে জিনাত প্রত্যাশাকে বলে,
“তুই ক্লাসে যা, আমি পরে আসবো।”
প্রত্যাশা জিনাতের ফোনের স্ক্রিনটা দেখতে চেয়েও দেখতে পারে না। তাই জোরপূর্বক হেসে বলল,
“ঠিক আছে।”
প্রত্যাশা চলে গেলে জিনাত কল রিসিভ করে বলে,
“হ্যালো।”
“জিনাত, তোমার ফ্রেন্ডদের নামগুলো বলো তো।”
জিনাত অবাক হয়ে বলল,
“কেন?”
“এমনিই, বলো না।”
“কোনো সমস্যা? কেউ কি কিছু বলেছে?”
“আরে, না রে।”
“তাহলে এমন প্রশ্ন কেন করছো?”
মুগ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“রাখো তো।”
“কি হয়েছে মুগ্ধ? আমাকে বলো না, আমি কিন্তু এখন কান্না করে দিবো।”
“আহা, আহা, কান্না করো না।”
কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ বলল,
“এখন রাখি, রাতে কথা হবে।”
“ঠিক আছে।”
জিনাত গাল ফুলিয়ে বলে।
মুগ্ধ আসলে তুবার সম্পর্কে জানতে কল দিয়েছিল, কিন্তু জিনাত নাম না বললে ও তুবার নাম বলতে চাচ্ছে না। কে এই তুবা? এমন সাবলীলভাষী মেয়েটাকে তো ভদ্র ফ্যামিলিরই মনে হচ্ছিল।
দুপুরে,
তাজিমের জন্য বিরিয়ানি নিয়ে অফিসে এসেছে তুবা। ওদিকে আবার অনু আলিয়ারকে ম্যাসেজ দিয়েছে,
“তুবা তোমার অফিসে গেছে, কথা বলে নিও।”
ম্যাসেজটা দেখে আলিয়ার খুশিমনে নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। রিসিপশনে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, তাসপিয়া আলম তুবা নামের এক মেয়ে মাত্রই অফিসে প্রবেশ করেছে এবং সে তাজমান আলম তাজিমের সাথে দেখা করতে চায়।
কথাটা শুনে ফোন নামিয়ে নেয় আলিয়ার। তাজিম তুবার কি হয়? এমন প্রশ্নের জবাব পায় না আলিয়ার।
কিছুক্ষণ পর লিফট থেকে তুবাকে নামতে দেখে আলিয়ার। আলিয়ার উল্টোদিকে ফিরে দাঁড়ায়। তুবা এসে তাজিমের কেবিনে চলে যায়।
দুই ভাইবোন একসাথে বসে লাঞ্চ করে, খুনশুটি করে, একে অপরকে খাইয়ে দেয়। আলিয়ার তাজিমের কেবিনের কাঁচের দরজার বাইরে থেকে এই দৃশ্য দেখে। যদিও ভাইবোনের খুনশুটি চলছি, কিন্তু আলিয়ার সেটা স্বাভাবিকভাবে নেয় না। তুবা ও তাজিমকে প্রেমিক-প্রেমিকা ভেবে ভুল করে। কিন্তু অনু যে ওকে জানিয়েছে তুবা এখানে আসবে তা বেমালুম ভুলে গেছে।
খাওয়ার পর তুবা টিফিন বক্স গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক এমনসময় কেবিনে আসে আলিয়ার, এসেই দরজা লাগিয়ে দেয়।
তাজিম দাঁড়িয়ে বলল,
“Hello, sir. She is my…”
আর কিছু বলার আগেই তাজিমের নাকমুখ বরাবর ঘুষি লাগিয়ে দেয়। তুবা তো আলিয়ারকে দেখে একবার অবাক হয়েছে আর দ্বিতীয়বারে অবাক হয়েছে তাজিমকে মারতে দেখে।
তাজিমকে কোনো কথা বলার সুযোগই দিচ্ছে না আলিয়ার। সে তাজিমকে বেধম পেটাচ্ছে।
তুবা আলিয়ারকে থামানোর চেষ্টা করে। তুবা আলিয়ারকে ধরতে গেলে তুবাকে ধাক্কা দেয় আলিয়ার। তুবা একটু পিছিয়ে গেলেও আবারো আলিয়ারকে টেনে সরিয়ে আনে। ইতোমধ্যে তাজিমের ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে, নাক দিয়েও রক্ত পড়ছে।
আলিয়ার তুবার দুগালে চেপে ধরে বলে,
“ভালোবেসেছিলাম কি আজকের এই দিনটা দেখার জন্য? অন্য পুরুষের সাথে প্রেম বিনিময় করার জন্য ভালোবেসেছি তোমাকে।”
তাজিম হাত দিয়ে রক্ত মুছতে ছিল, আলিয়ারের কথা শুনে বোকা বনে গেছে ও। একবার তুবার দিকে তাকিয়ে দেখে তুবার চোখে পানি, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আলিয়ারের দিকে।
আলিয়ার আবারো দাঁতে দাঁত ঘসে কিড়মিড়িয়ে বলে,
“উত্তর দিচ্ছো না যে?”
তুবা একটা ঢোক গিলে আস্তে আস্তে বলল,
“তাজিম, তাজিম আমার ভাইয়া। ও আমার আপন বড় ভাই।”
আলিয়ার একটু পিছিয়ে আসে। তুবা সরে গিয়ে নিজের গালে হাত ঘসতে থাকে। তাজিম তুবার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। তাজিমের দিকে চোখ পড়তেই মাথানিচু করে ফেলে তুবা। ভয়ে কলজে শুকিয়ে গেছে ওর।
আলিয়ার একবার তাজিমের দিকে তাকায়। তাজিম টিস্যু দিয়ে নিজের মুখ মুছে বলল,
“এখন আপনার সাথে আপনার অফিসের কর্মচারী নয়, তুবার ভাই হয়ে কিছু কথা বলি?”
আলিয়ার মাথানিচু করে ফেলে। আসলে কথা বলার ভাষাই ও হারিয়ে ফেলেছে।
তাজিম নাক মুছে বলে,
“কথা না শুনে, ঘটনা না বুঝে কাউকে আঘাত করা উচিত নয়। আর কি বললেন একটু আগে? তুবার সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”
তুবা এগিয়ে এসে বলল,
“ভাইয়া…”
“চুপ।”
ধমকের সুরে কথাটা বলল তাজিম।
তুবা ভয়ে চুপ থাকে। একবার আলিয়ারের দিকে আড়চোখে তাকায়। আলিয়ার তাজিমের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলে,
“আসলে ভাইয়া, ভাইয়া তো সম্বোধন করতেই পারি?”
তাজিম কিছু বলে না, শুধুই উপর নিচে মাথা নাড়ে। আলিয়ার আবারো বলল,
“আর ভুলটা সত্যিই আমার, আমি ঘটনা না জেনেই আপনাকে আঘাত করেছি। আমি আমার ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। (একটু থেমে) আচ্ছা, আমি ভূমিকা বাদ দিই। আপনি আমাদের সম্পর্ক নিয়ে জানতে চাচ্ছেন?”
তাজিম হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। তুবা চোখ বড় বড় করে আলিয়ারের দিকে তাকায়। আলিয়ার পকেটে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“আপনি হয়তো এর মধ্যেই বুঝে গেছেন আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক কি?”
“আমি আপনার থেকে শুনতে চাচ্ছি আর ভণিতা না করে সরাসরি কথা বলুন।”
আলিয়ার তুবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তুবাকে বিয়ে করতে চাই। আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার প্রেয়সী, আমার স্ত্রী, আমার ঘরের রমণী করতে চাই। আশা করি, এর চেয়ে সরাসরি আর কিছুই হবে না।”
তাজিম তুবার দিকে তাকালে তুবা মাথানিচু করে ফেলে। ওর নিরবতা জানান দিচ্ছে ও নিজেও আলিয়ারকে নিজের মনের রাজ্যের একমাত্র অধিপতি ও রাজা করে নিয়েছে। তাজিম চিন্তায় পড়ে যায়, কোনো অফিসের কর্মচারীর বোনের সাথে কি অফিসের বসের বিয়ে সম্ভব?
.
চলবে……
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com