শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -১১
আলিয়ারের কথায় ওর দিকে তাকায় তুবা। আলিয়ারের মুখের দুষ্টুমি ভরা হাসিটা জানান দিচ্ছে ও কি শুনতে চাচ্ছে। তুবা কপাল কুঁচকে মাটির দিকে তাকায়। ওই দুষ্ট মুখটার দিকে তাকানোর সাহস ওর নেই।
মুন্সিগঞ্জ, ব্যস্ত এলাকা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফেরিঘাট এই এলাকায় অবস্থিত, যা সাধারণভাবে মাওয়া ঘাট বা মাওয়া ফেরিঘাট নামে পরিচিত।
আলিয়ার ও তুবা এই ঘাট থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি থেকে নেমেছি। এখানে গাড়ি পার্ক করা জন্য নির্দিষ্ট জায়গা আছে, আলিয়ার সেখানে গাড়ি রেখে আসে।
কিছুক্ষণ আগের কথাটা শুধুই মশকরা করে বলেছিল আলিয়ার। তুবার মন খারাপ, মন ভালো করার জন্য এত তোড়জোড়। অবশ্য তুবার মন খারাপ করার বিশেষ কোনো কারণ নেই, ভয় হচ্ছে তার বাসায় না জানিয়ে আসার ভয়।
আলিয়ার এসে ওর বাম হাতটা ধরে হাঁটতে শুরু করে। তুবাও ওকে অনুসরণ করে। কিছুক্ষণ পর ওরা মূল ঘাটে পৌঁছায়।
আলিয়ার বলল,
“দেখেছ কত মানুষ!”
তুবা আশপাশটা ভালো করে দেখে বলল,
“এতো মানুষ কেন এখানে?”
“সবসময়ই থাকে, তবে এখন দুপুর তাই ভীড় একটু বেশি।”
“একটু না অনেক বেশি।”
আলিয়ার আলতো করে হেসে বলল,
” চলো কিছু খেয়ে নেয়া যাক সকালে তেমন কিছু নাস্তা করিনি।”
“ওমা, আপনি না খেয়ে বেরিয়েছেন।”
“হ্যাঁ, তা বেরিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি যখন ঘুমাচ্ছিলে গাড়িতে, তখন একটা কেক খেয়েছে খেয়েছি।”
“তবে তো এখন অনেক ক্ষুধা লেগেছে আপনার।”
তুবা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে শুধু মানুষ আর মানুষ। ফেরি এসেছে তাই যে যার মতো ফেরিতে উঠায় ও নামায় ব্যস্ত। তুবা ঠোঁট উল্টে বলল,
“এখানে কি খাবার পাওয়া যাবে?”
“এখানেই তো একটা শ্রেষ্ঠ খাবার পাওয়া যায়।”
তুবা খুব উৎসাহ নিয়ে বলল,
“কি সেটা?”
“বলছি, এসো আমার সাথে।”
আলিয়ার হাটা শুরু করল, তুবাও ওর সাথে হাঁটছে। হঠাৎ তুবা বলে,
“শুধু বলবেন? খাওয়াবেননা?”
আলিয়ার ফিক করে হেসে দেয় তারপর দুষ্টুমি করে বলে,
“সামনে এত এত পানি দেখছো, গিয়ে খাও না? নিষেধ করলো কে? নিচে মাছও পেয়ে যাবে, বেড়াল।”
তুবা বেক্কলের মত ফেস করে আলিয়ার এর সাথে একটা হোটেলে ঢুকে। অবশ্য হোটেল বললে ভুল হবে। টিনের ঘর, কাঠের চেয়ার, টেবিল, খুব বেশি আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। বাইরে রোদ, সেই রোদে কাঠের মেঝে প্রচন্ড গরম হয়ে আছে। তুবা একে গ্রামের সাধারণ ঘর বলে আবিষ্কার করে। গ্রামের টিনের ঘর গুলো গ্রীষ্মকালে যে রকম উত্তপ্ত থাকে, এই হোটেলের অবস্থা ঠিক তাই। যদিও বাইরে একে হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট বলা হয়েছে। ভেতরে ঢুকতেই ভাজা ইলিশের ঘ্রাণ নাকে আসে তুবা।
কাঠের চেয়ারে বসলে ওদের কাছে ১৭-১৮ বছরের একটি ছেলে এগিয়ে আসে। আলিয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“কি খাবেন ভাইয়া?”
আলিয়ার তুবার দিকে ইশারা করে বলে,
“এই আপুকে জিজ্ঞাসা করো কি খেতে চায়?”
তুবা তাড়াহুড়ো করে বলে,
“কিছু একটা হলেই হলো, আপনি যা খাবেন তাই।”
“সত্যি?”
মুখে দুষ্টুমি মাখা হাসি রেখে বলল আলিয়ার।
তুবা নিষ্পাপ কন্ঠে বলে,
“হুম, সত্যি।”
“মদ খাবো, খাবে?”
তুবা থতমত খেয়ে বলল,
“আপনি মদ খান, আলি? ছিঃ।”
‘আলি’ নামটাকে এক অসাধারণ রূপ দিয়েছে তুবা। সবার মুখে এই নামটা এতো মানায় না।
আলিয়ার মুচকি হেসে ছেলেটিকে বলল,
“গরম ভাত আর একটা গোটা ইলিশ ভাজা।”
ছেলেটি চলে গেলে তুবাকে বলে,
“তোমার কি সত্যি মনে হয় আমি মদ খাই?”
তুবা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আলিয়ার ওর থুতনিতে হাত দিয়ে ওর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“ওসব জিনিস আমার বাবা খায়নাই, দাদার বাড়ির কেউ খায়নাই, নানার বাড়ির কেউ খায়নাই, আমি খাইয়া মরমু নাকি?”
তুবা হেসে দেয়। আলিয়ারের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকে৷ এই হাসিটা যে আলিয়ারের খুব প্রিয়।
কিছুক্ষণ পরেই ওদের অর্ডার করা ভাত ও ইলিশ ভাজা চলে আসে৷ এতোগুলো ইলিশের টুকরো দেখে তুবার চোখ কপালে উঠার জোগাড়।
তুবা অবাক হয়ে বলল,
“এত ইলিশ কে খাবে?”
আলিয়ার মুচকি হেসে বলল,
“কেন তুমি? বেড়াল কি এমনি এমনি নিয়ে এসেছি নাকি? মাছ খাওয়ানোর জন্যই তো বেড়াল এনেছি।”
তুবা গাল ফুলিয়ে বলে,
“আবার?”
“আচ্ছা সরি। এখন খেয়ে নাও, শুরু করো।”
তুবার প্লেটে ভাত দিয়ে দুইটুকরো ইলিশ ভাজা দেয় আলিয়ার। তুবার ঠোঁট উল্টে বলল,
“আমি না মাছের কাটা বাছতে পারি না, বিশেষ করে ইলিশ মাছের।”
আলিয়ার সবে নিজের প্লেটে ভাত নিয়েছে৷ ওর কথায় অবাক হয়ে তাকায়। এতো বড় মেয়ে এখনো মাছের কাটা বাছতে পারে না?
আলিয়ার জিজ্ঞাসা করে,
“বয়স কত?”
“কার?”
“তোমার?”
“২১।”
আলিয়ার মাথা নিচু করে বড় একটা নিশ্বাস ফেলে আবার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“বাসায় কে খাইয়ে দেয়?”
“ভাইয়া, বাবা।”
“এখানে কি তারা আছে?”
“না।”
তুবা একটু থেমে বাচ্চা বাচ্চা কন্ঠ করে বলল,
“তবে কি এখন আমি খাবো না?”
আলিয়ার হেসে বলে,
“একেবারেই খেতে পারবে না?”
“পারবো কিন্তু গলায় আটকালে তো মরে যাবো।”
আলিয়ারের মেজাজ খারাপ হয় এমন কথায়৷ নিজেই হাত দিয়ে মাছের কাটা বেছে দেয়। তুবা মুচকি হেসে খাওয়া শুরু করে।
অন্যদিকে,
জিনাতের মত মেয়েকে নিয়ে শপিংয়ে সে মুগ্ধ করেছে মহাবিপদে। একে তো জিনাত মুগ্ধকে একা ফেলে নিজে নিজে শপিং করছে, আবার ফিরেও দেখছে না যে ওর সাথে একটা প্রাণী এসেছিল সে আছে কিনা।
মুগ্ধ মনে মনে ভাবে,
“সঙ্গে করে কুকুর বিড়াল নিয়ে আসলেও তো এত খারাপ আচরণ করত না। মেয়েদের মন নাকি নরম হয়, মেয়েরা নাকি অন্যদের ভালো বোঝে, কই এই নিয়ে তো আমাকে বোঝার থাক দূরে আমাকে দামই দেয় না। আমাকে কি মানুষ মনে হয় না নাকি? শুধুমাত্র একটা মেয়ে ফেলে গেলে বিপদ হতে পারে তাই যাচ্ছি না, না হলে পিটিয়ে এখানেই ফেলে রাখতাম।”
পরক্ষনেই আবার মুগ্ধ ভাবে,
“ভালো হোক, খারাপ হোক। এখন তো ওকে ভালোবেসেছি কিছুতো আর করার নেই। ভালো খারাপ সবটাই সহ্য করতে হবে।”
জিনাত এখন শাড়ির দোকানে একের পর এক শাড়ি দেখেই যাচ্ছে, কিন্তু কোনোটাই পছন্দ হচ্ছে না।
মুগ্ধ গিয়ে বলল,
“হেল্প লাগবে?”
“No thanks.”
জিনাত এমন ভাবে কথাটা বলল যেন মুগ্ধ কোন মানুষই না। মুগ্ধ কিছুটা অপমানিত বোধ করে। সে রেগে জিনাতের হাত ধরে টেনে বাইরে বের করে নিয়ে আসে। কিছুটা নিচু স্বরে বললেও, বেশ ধমক দিয়েই বলে,
“কি সমস্যা কি তোমার? তোমার ভাই তোমাকে আমার আমানতে দিয়ে গেছে আর তুমি কিনা আমাকে মানুষ হিসেবেই মূল্য দিচ্ছো না। সমস্যাটা কি তোমার?”
জিনাত দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
“সমস্যাটা? সমস্যাটা তো আপনি।”
“আমি?”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল।
জিনাত বেশ ভাব নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনি আলিকে বলেছেন না যে আপনি আমাকে ভালবাসেন?”
“ভালোবাসি?”
মুগ্ধের কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ে।
“হুম, ভালোবাসেন। তাইতো বারবার কল করেন আর আলিকে বলে আজকে আমাকে নিয়ে এসেছেন। বুঝি বুঝি, সব বুঝি আমি।”
মুগ্ধ ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“সব বুঝো?”
“হুম।”
মুগ্ধ ওর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি এটা কেন বললে?”
জিনাত ঠোঁট বাকিয়ে বলে,
“আমার মতো সুন্দরীকে বারবার কল দিবেন, এখান থেকেই তো ভালোবাসার শুরু হয়।”
মুগ্ধ মুচকি হেসে বলল,
“বারবার কল দেই বলেই ভালোবাসি না, সেটা টাইম পাস। আর রূপের খুব অহংকার দেখছি, সেটা কেবল ৩০ বছর পর্যন্ত টিকবে। দুই বাচ্চার মা হওয়ার পর এই রূপ হারিয়ে যাবে।”
জিনাত কপাল কুঁচকে মুগ্ধের দিকে তাকায়। এই প্রথম কেউ ওর রূপের প্রশংসা করলো না। জিনাতের চেহারা দেখে মুগ্ধ হেসে দেয়।
ওরা দুজনে অন্য একটা দোকানে যায়। মুগ্ধকে কিছুটা চ্যালেঞ্জের সুরেই জিনাত বলল,
“সবচেয়ে সুন্দর সুন্দর শাড়িগুলো বেছে দিন।”
মুগ্ধ কতগুলো শাড়ি বেছে বেছে জিনাতের সামনে দেয়। জিনাত দেখে সবগুলোই খুব সুন্দর। জামদানী শাড়ি সবসময়ই জিনাতের পছন্দ, জিনাত একটা একটা করে শাড়ি দেখছে।
নীল, সবুজ, গোলাপী, হালকা বেগুনি, কফি, অফ হোয়াইট, হালকা হলুদ, লাল-খয়েরী, জলপাই, পেয়াজ কালারসহ অনেক রঙের শাড়ি দিয়েছে জিনাতের সামনে। জিনাত কিছুটা অবাক। একটা ছেলে হয়ে শাড়ি কি করে পছন্দ করতে পারে মুগ্ধ, তাও এতো সুন্দর সুন্দর।
মুগ্ধ ওর পাশে বসে বলল,
“ট্রায়াল নিবেন?”
“ইচ্ছা আছে।”
“বাট আমার নেই।”
জিনাত হেসে বলে,
“আপনাকে কি কেউ নিতে বলেছে?”
“ব্যাপারটা তা নয়।”
“তবে ব্যাপারটা কি?”
মুগ্ধ দোকানদারদের উদ্দেশ্যে বলে,
“সবগুলো প্যাক করুন।”
তারপর জিনাতকে নিয়ে সরে একটু দূরে এসে বলে,
“আপনি কি জানেন এখানে ট্রায়াল রুমে গোপন ক্যামেরা থাকতে পারে? যা আপনার জামা পাল্টানোর…”
মুগ্ধের মুখ চেপে ধরে জিনাত। মুগ্ধ ওর হাতটা ধরে বলে,
“বাহ, আমার মনে হয় আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
“মোটেও না।”
বলেই জিনাত দোকানে ঢুকে যায়। মুগ্ধ হেসে দেয়।
বাসায়,
সুলতানা নিজের রুমে বসে বসে ফোসাচ্ছে। রেগে পুরো মুখ লাল হয়ে আছে। সকাল থেকে কিছুই খায়নি। আহমেদ রুমে এসে বলল,
“সুলতানা? দুপুরের খাবার প্রস্তুত আছে।”
সুলতানা চেঁচিয়ে বলে,
“খাবো না আমি।”
আহমেদ এসে উনার পাশে বসে বলল,
“এতো রাগ কেন দেখাচ্ছো? কার উপর দেখাচ্ছো?”
“আলিয়ার, হ্যাঁ ওই আলিয়ার আমার নিষ্পাপ, সহজ-সরল মেয়েটাকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছে। যতদিন প্রেম করেছে ততদিন সম্পর্ক একদম ঠিক ছিল। যেই বিয়ের কথা উঠল, সেই সম্পর্কটা তেতো হয়ে গেল।”
আহমেদ উনার হাত ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
“আলি তো বিয়ের ব্যাপারটা জানেই না।”
“জানে না? সব জানে, আছিয়া ঠিকই বলেছে। ওই মহিলাকে দেখোনি আমার জিনাতকে পছন্দ করেনি। এমন সুন্দরী মেয়ে ছেলের বউ হিসেবে আর পাবে?”
“আস্তে কথা বলো, শুনতে পাবে।”
আহমেদ ফিসফিস করে কথা বললেও সুলতানা আরো জোরে চেঁচিয়ে বলে,
“শুনলে শুনুক, আমি কি কাউকে ভয় পাই নাকি? আমার মেয়েকে যদি আলি বিয়ে না করে এই বাড়িতে আগুন লাগাবো এই বলে রাখলাম।”
সুলতানা বারান্দায় যেতে নিলে আহমেদ বলে উঠে,
“জোর করে বিয়ে আর ভালোবাসা সম্ভব নয়, সুলতানা। তুমি এমন অবুঝ হলে কবে থেকে?”
“একদম চুপ। আলিয়ারের বিয়ে অন্যকোথাও হলেই এই সম্পত্তিতে অন্য কেউ ভাগ বসাবে, এটা আমি কখনোই মেনে নিবো না। আর জিনাতের কি হবে হুম?”
সুলতানা বারান্দায় চলে যায়। আহমেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কি করে বোঝাবে এই মহিলাকে?
পদ্মাপার,
পুরো ঘাটটা ঘুরে ঘুরে দেখছে দুজনে। তুবার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে আলিয়ার। এখানে ইট, এখানে পাথর, এখানে গর্ত এভাবেই দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তুবাকে। আর তুবা সে তো প্রথমবার নদীর তীরে ঘুরতে এসেছে।
তুবা বাচ্ছাদের মতো ফেস করে বলল,
“সেতু কোথায়?”
“পদ্মাসেতু?”
“হুম”
“সে তো অনেক দূরে।”
“চলুন না দেখে আসি, আমি সেতুতে উঠবো।”
আলিয়ার মুচকি হেসে বলে,
“সেতুতে উঠলে মাথাঘুরে নিচে পরে যাবে।”
“না, পড়বো না। চলুন না, চলুন না।”
“উহু, আমরা এখন স্পিড বোটে করে নদীটা ঘুরে দেখবো।”
“স্পিড বোট? না, আমার ভয় লাগে।”
আলিয়ার ঘাটে নেমে যেতে নিলে তুবা ওর হাত টেনে ধরে। আলিয়ার একবার হাতের দিকে তাকিয়ে তারপর তুবার দিকে তাকায়। তুবা বলে,
“স্পিড বোটে আমার ভয় করে।”
আলিয়ার নদীর দিকে তাকায়। নদীতে অনেক খেয়া নৌকা চলছে। আলিয়ার তুবাকে বলে,
“খেয়া নৌকায় যাবে?”
“ভয় লাগে?”
“উড়ে যাবে?”
তুবা গাল ফুলিয়ে আলিয়ারের হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
“যাবো না আমি।”
আলিয়ার ওকে টান দিয়ে কাছে এনে একহাতে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“এতো ভয়? আজ সব ভয় দূর করে দিবো।”
আলিয়ার একটা খেয়া নৌকা ঠিক করে। ওরা পদ্মাসেতুর কাছাকাছি একটা চড়ে নামবে। আলিয়ার ঘড়িতে দেখে বিকাল তিনটা বাজে। তুবাকে নৌকার একপাশে বসিয়ে আলিয়ার একটু দূরে মাঝামাঝি বসেছে। নৌকায় ওরা দুজন ছাড়া আর কেউই নেই।
তুবা নৌকার একদম একপাশে তাই কিছুক্ষণ পরপর পানির দিকে তাকাচ্ছে। আলিয়ার ওর অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। বাতাসে তুবার শাড়ির আঁচল উড়ছে, কপালের পাশের চুলগুলো উড়ে এসে মুখে পড়ছে বারবার।
আলিয়ার উঠে ধীরে ধীরে গিয়ে ওর পাশে বসে। নৌকা নড়ে উঠায় তুবা ওকে জড়িয়ে ধরে। আলিয়ারও পেছন থেকে একহাতে জড়িয়ে ধরে ওকে।
তুবার যখন খেয়াল হয় আলিয়ারের বুকে মাথা রেখে আছে সে, লজ্জায় পুরো মুখ লাল হয়ে যায়। একহাতে আলিয়ারের শার্টের কলার চেপে ধরে ওর সাথে আরো মিশে যায়।
আলিয়ার পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে তুবাকে বলে,
“শার্টটা খুলে দিয়ে দিই, যতক্ষণ পারো টেনেটুনে আবার দিয়ে দাও।”
তুবা ছিটকে সরে যায়। ছি, ছি, কি বলে এই ছেলে? লজ্জা-শরমের মাথা খেয়েছে নাকি?
আলিয়ার হেসে একহাতে তুবাকে ধরে রাখে আর মুগ্ধকে কল করে। মুগ্ধ রিসিভ করতেই আলিয়ার বলে,
“কিরে দোস্ত, খবর কি?”
“খবর ভালো না, তোর বোন আমাকে তার ড্রাইভার বা বডিগার্ড ভাবছে।”
“আহারে।”
আলিয়ার বেশ ব্যঙ্গসুরেই কথাটা বলল।
মুগ্ধ রেগে বলল,
“শালা, রাখ তোর আহারে। তুই কোথায় রে?”
“আছি এক জায়গায়।”
“জায়গাটা কোথায়?”
একটু থেমে মুগ্ধ বলে,
“গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরতে গেছিস?”
আলিয়ার তুবার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
“গার্লফ্রেন্ড নয়, আমার জীবনটা নিয়ে ঘুরতে এসেছি।”
“শুধু জীবন?”
“হুম, শুধুই জীবন।”
তুবা তাকিয়ে আছে আলিয়ারের দিকে, ওর চোখের দিকে। নাটক বা সিনেমার মতো হয়তো চোখের দিকে তাকিয়ে বাস্তবে ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু তুবার তারই চেষ্টা করছে।
আলিয়ার ভ্রু নাচিয়ে তুবার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে দেয়। মুগ্ধকে বলে,
“রাখছি, সাবধানে থাকিস।”
“দোয়া করিস ভাই।”
আলিয়ার ফোন পকেটে ঢুকিয়ে আবার সোজা হয়ে বসে। তুবা মাথানিচু করি আছে। মাথার উপর দিয়ে, প্রায় মাথা ঘেষে কিছু পাখি উড়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর তুবা বলল,
“আমি নদীর দিকে ফিরে হাত দুদিকে দিয়ে বসবো আপনি পিছন থেকে ছবি তুলবেন, ওকে?”
আলিয়ার বাঁকা হেসে বলে,
“একটা টাইটানিক নয়, পদ্মাকে আটলান্টিকের সাথেও তুলনা করো না। আমি জ্যাক নই আর তুমি তো রোজ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।”
তুবা আড়চোখে আলিয়ারের দিকে তাকায়। আলিয়ার মুচকি হাসে। তুবা গাল ফুলিয়ে রাখে।
প্রায় ১ ঘন্টা পর ওরা সেতুর দেখা পায়। তুবা লাফিয়ে উঠে বলে,
“ওইতো সেতু দেখা যাচ্ছে।”
আলিয়ার ওকে ধরে বসিয়ে একটা ধমক দেয়,
“এক্ষুণি তো পড়ে যেতে।”
তুবা দাঁত কেলায়।
আরো ৩০ মিনিট পর ওরা সেতুর একদম কাছের চরে এসে নামে। ওরা নৌকা থেকে নামে। মাঝিরা নৌকায় অপেক্ষা করবে ওদের জন্য।
তুবা দৌড়ে অনেকদূর চলে যায়। আলিয়ার ওকে পেছন থেকে ডাকছে সেই খবরই নেই ওর। এমন শান্ত আর সুন্দর জায়গা ঢাকায় কি পাওয়া যাবে?
তুবা হাপিয়ে গেলে থেমে যায়। আলিয়ার দৌড়ে এসে ওকে ধরে বলে,
“এরকম দৌড় কেউ খাওয়ায়? বাচ্চা নাকি তুমি?”
তুবা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“আসলে.. জা.. জায়গাটাই অন্যরকম।”
“ধীরে ধীরে হাঁটো, ভালো লাগবে।”
দুজনে পাশাপাশি হেঁটে আবারো নদীর কাছাকাছি চলে আসে। বালুগুলোতে পানি আছড়ে পড়ছে। তুবা হেসে বলল,
“সমুদ্রে যেমন হয়, এখানেও তেমনি হচ্ছে।”
আলিয়ার ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“না, সমুদ্রের ঢেউ অনেক বড় আর অনেকদূর পর্যন্ত আসে, এখানে ঢেউ কম।”
“তবুও তো আছে।”
আলিয়ার মাথানেড়ে ডানদিকে হাত দিয়ে ইশারা করে বলে,
“ওইপাশে তাকাও।”
তুবা সেদিকে তাকিয়ে দেখে মূল সেতু। তুবা এতোক্ষণ খেয়ালই করেনি যে ওরা একদম সেতুর কাছে আছে। আর একটু হেঁটে গেলেই সেতুর পিলারের কাছে চলে যাবে।
তুবা বাচ্চাদের মতো বায়না করে বলে,
“চলো না, সেতুতে হেঁটে আসি।”
আলিয়ার হেসে দেয়। তুবার নাক টেনে বলে,
“বাচ্চাদের মতো বায়না করো না।”
তুবা জুতা খুলে হাতে নিয়ে পানিতে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আলিয়ার ওর একহাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। আজ সারাদিনে আলিয়ারের কেয়ারিং দেখে তুবার মনে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। যদি এই কেয়ারিং, এই অনুভূতি সারাজীবন রাখা যেতো।
শেষ বিকেলের সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। শেষ বিকেলের রোদ এসে ওদের মুখে পড়ছে। হলুদ আভায় মুখটা ছেয়ে গেছে দুজনের।
তুবা আলিয়ারের দিকে তাকায়। চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিতে নিলে আলিয়ার ওর থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা ওর দিকে এনে কবিতা পড়ার মতো করেই বলে,
“তোমার প্রেমে পড়েছি আমি,
দোষ হলে ক্ষমা করে দিও।
যদি নির্দোষ হই তবে ভালোবেসে,
আমার হৃদয় ভরে দিও।”
চলবে…..
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com