শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -২২
ঘড়িটা জানান দিচ্ছে বিকাল ৫ টা। আলিয়ার আজ নিজের রিপোর্টগুলো নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছে। ডাক্তার ওর রিপোর্ট দেখেই মুখ কালো করে ফেলে।
আলিয়ার ডাক্তারের চিন্তিত মুখ দেখে জিজ্ঞাসা করে,
“কি হয়েছে, স্যার?”
ডাক্তার একবার ওর দিকে তাকিয়ে তারপর রিপোর্টগুলো টেবিলের উপর রেখে বলল,
“আমি যা বলবো তা শুনার জন্য আপনি কি মানসিক ভাবে প্রস্তুত?”
আলিয়ার তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
“জি, বলুন।”
ডাক্তার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মি. আলিয়ার, আপনার দুটো কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে। আপনার অবহেলার কারণেই হয়তো হয়েছে৷ কারণ কিডনি এতো তাড়াতাড়ি ড্যামেজ হয় না, অনেক লক্ষণ দেখায়। আপনি হয়তো তাতে গুরুত্ব কম দিয়েছেন।”
একটু থেমে ডাক্তার বলল,
“সিগারেট বা অ্যালকোহলের অভ্যাস আছে হয়তো?”
আলিয়ার মাথানিচু করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“স্যার, আমার তেমন কোনো বদঅভ্যাস নেই। মদ বা সিগারেট কোনোটাই আমি নেই না।”
“ব্যাথানাশক ওষুধ?”
“জি, আমার প্রায়ই মাথাব্যথা করতো তাই পেইন কিলার খেতাম।”
ডাক্তার মাথা নেড়ে বলল,
“এটাই সকলের সমস্যা। মানুষ বুঝতেই চায় না, দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত ব্যথানাশক ওষুধের ওপর নির্ভরতা রক্তচাপ কমিয়ে দেয় এবং কিডনির কর্মক্ষমতা হ্রাস করে।”
আলিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিভাবে ফ্যামিলিকে এই কথা বোঝাবে সে৷ ডাক্তার আবারো বলে,
“কফি বা সফট ড্রিংকসের অভ্যাস আছে খাওয়ার অভ্যাস আছে?”
“জি, অনেক বেশি।”
“এসবে ক্যাফেইন থাকে। অতিরিক্ত ক্যাফেইন শরীরে রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। অতিরিক্ত রক্তচাপ কিডনির ওপরও চাপ প্রয়োগ করে এবং এতে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
আলিয়ার চুপ থাকে। সত্যিই ওর নিজের প্রতি অনেক অবহেলা ছিল। ডাক্তার আবারো বলল,
“রাত জেগে থাকেন?”
“জি, প্রায়ই। অফিসের কাজ থাকে, আবার…”
“মানে কোনো না কোনো কারণে রাত জাগা হয়?”
“জি, স্যার।”
“ঘুমের সময়ই শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর টিস্যুর নবায়ন ঘটে। ফলে ঘুমাতে না পারার সমস্যাটা নিয়মিত চলতে থাকলে কিডনিসহ শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর এই কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে কিডনির স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা কমে যায়। রাত জাগা সব রোগের মূল, শিক্ষিত মানুষ হয়ে এইটুকু আপনার বোঝা উচিত ছিল।”
আলিয়ার এবারেও চুপ থাকে। এতোকিছু ভাবেনি কখনোই, প্রয়োজনও হয়নি। ডাক্তার আবারো বললেন,
“বাইরের খাবার, তেল-চর্বি জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার অভ্যাস আছে?”
“এতোটা হিসেব করে দেখিনি, তবে প্রায় প্রতিদিনই বাইরের খাবার খাই।”
“এসব খাবারেই সমস্যাটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।”
“অসুস্থ হলে বিশ্রাম নেন?”
আলিয়ার মুচকি হেসে বলে,
“বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না৷ এমনিতেই সেরে যায়।”
ডাক্তার একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“কিডনির সমস্যা নিয়ে যারাই আমার কাছে আসে, অনেকেরই অসুস্থতার সময়ে ঠিকমতো বিশ্রাম না নেওয়ার ইতিহাস আছে।”
আলিয়ার চুপ থাকে। ডাক্তার বুঝতে পারে ও আপসেট হয়ে গেছে। ডাক্তার বলল,
“ডায়ালাইসিস বা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে।”
আলিয়ার মুচকি হেসে বলল,
“এখন ডায়ালাইসিস নাকি ট্রান্সপ্লান্ট, কোনটা ভালো হবে?”
“ডায়ালাইসিসের খরচ মাসিক ১৫-২০ হাজার। তাছাড়া এক্ষেত্রে নিজের প্রতি অনেক খেয়াল রাখতে হয় আর বিশ্রামও বেশি নিতে হয়, যা আপনার বয়সের মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তাই আপনি বাসার মানুষের সাথে কথা বলুন আর ডোনারের ব্যবস্থা করুন। তবে এই সপ্তাহে একবার ডায়ালাইসিস করিয়ে নিলেই ভালো হবে। আর এখন আমিষ যত কম খাবেন ততই ভালো।”
আলিয়ার মাথা নেড়ে বলে,
“ঠিক আছে।”
অন্যদিকে,
আজ মুগ্ধ অফিস থেকে বেরিয়েছে একটু তাড়াতাড়ি। আজ ওর বাবা-মাকে বাসায় আনতে যাবে৷ বাইকে উঠতে যাবে এমনসময় জিনাত এসে ওর সামনে দাঁড়ায়।
মুগ্ধ দেখেও না দেখার ভান করে বাইক স্টার্ট দেয়। জিনাত বাইকের সামনে হাত রাখে।
মুগ্ধ কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“কি সমস্যা? আপনি কিছু বলতে চান? বলতে চাইলে বলে বিদায় হন।”
জিনাত একদৃষ্টিতে মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে। এতে মুগ্ধ কপালে আরো কয়েকটা বিরক্তির ভাঁজ পড়ে।
জিনাত শান্ত স্বরে বলে,
“ক্ষমা করে দিবেন?”
মুগ্ধ বাঁকা হাসে। এই হাসিতে ভালোবাসা নেই আছে শুধু তাচ্ছিল্য যা কেবল জিনাতের জন্য। মুগ্ধের নিরবতায় জিনাতের কষ্টটা দ্বিগুণ বেড়ে যায়, সাথে প্রত্যাশার উপর রাগটাও বাড়ে
জিনাত আবারো বলে,
“কেউ ক্ষমা চাইলে, ক্ষমা করে দিতে হয়।”
“ক্ষমা করে দিলাম।”
গম্ভীরমুখে বলল মুগ্ধ।
জিনাত মুগ্ধের হাতে ধরতে নিলেই মুগ্ধ একটা ঝারি দিয়ে ওকে সরিয়ে দেয়৷ ধমক দিয়ে বলে,
“কি চাই আর? যাকে বিশ্বাস করো না, যার চরিত্র সম্পর্কে তোমার মনে এতো সন্দেহ, কি দরকার তার সাথে সম্পর্ক রাখার?”
জিনাত এবারে কান্না করে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আসলে বিশ্বাস করেও তো অনেকে ঠকে যায়, অনেকে বলতে এখনকার সময় ৫০% মানুষই কোনো না কোনোভাবে ঠকে যাচ্ছে। তাই প্রত্যাশা আমাকে ওই বুদ্ধিটা দিয়েছিল।”
মুগ্ধ মাথানিচু করে মুচকি হাসে। তারপর বাইক থেকে নেমে জিনাতের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“প্রত্যাশার কথা খুব মানো?”
“বেস্ট ফ্রেন্ড তো।”
কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ বলল,
“ঠিক আছে, মেনে নিলাম।”
“ক্ষমা করেছেন?”
খুব করুণসুরে কথাটা বলল জিনাত।
মুগ্ধ ওর দুইগালে হাত দিয়ে বলল,
“করলাম ক্ষমা, কিন্তু আমার ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট কই?”
জিনাত অবাক হয়ে তাকালে মুগ্ধ হেসে বলল,
“বাহ রে, আমার চরিত্র পরীক্ষা করতে আমার বাসায় চলে গেলে আর এখন সার্টিফিকেট না দিয়ে কেটে পড়ছো?”
জিনাত মাথা নিচু করে মুগ্ধের কথা শুনছিল। আচমকা মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরে জিনাত। হঠাৎ এমন ঘটনায় মুগ্ধ চমকে উঠে। জিনাত দুহাতে শক্ত করে মুগ্ধকে ধরে রেখেছে। মুগ্ধ আশেপাশে তাকায়, দু-একজন ওদেরকে দেখছে। জিনাতকে কিছুটা জোর করে সরিয়ে দুরে দাঁড় করায় মুগ্ধ। জিনাতও আশেপাশে তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে যায়। মুগ্ধের দিকে তাকাতে পারছে না, আর কোন কথা না বলে জিনাত চলে যায়।
মুগ্ধ কিছুক্ষণ এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। জিনাতকে আবারো সুযোগ দিবে কিনা তাই ভাবছে৷ অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলো শেষবারের মতো একটা সুযোগ জিনাতকে দিবে মুগ্ধ।
রাতে,
প্রতিদিনের মতো আজও আলিয়ার তুবাকে একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে, কিন্তু তুবা রিসিভ করছে না। কয়েকবার কল দেয়ার পর নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। আলিয়ার দুহাতে মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে থাকে। এমনিতেই মানসিকভাবে ও কিছুটা ভেঙে পড়েছে, তারউপর তুবার এমন আচরণে ওর ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে ওর।
জিনাত ওর রুমের দরজায় নক করে বলে,
“আলিয়ার, খাবার বেরেছি।”
আলিয়ার রাগে রি রি করতে করতে বলে,
“আমার ক্ষুধা নেই।”
“সারাদিন কিছু খাসনি, এখন তো খেয়ে নে।”
আলিয়ার বেরিয়ে এসে জিনাতকে ধমক দিয়ে বলল,
“কি বললাম শুনিসনি?”
জিনাত মাথানিচু করে ফেলে। আলিয়ার আবারো ধমক দিয়ে বলল,
“যা”
আলিয়ার দরজা লাগিয়ে দিতে নিলে জিনাত বলে,
“তুই এখনো ওই বিষয়টা নিয়ে আমার উপর রেগে আছিস?”
আলিয়ার এসে জিনাতের গাল চেপে ধরে বলল,
“একদম চুপ। তুই অন্যদের কাছেও আমার নামে মিথ্যাচার করেছিস।”
জিনাত খুব কষ্টে বলে,
“আমি.. আমি কোনো মিথ্যাচার করিনি।”
“তোকে আমি পরে দেখে নিবো।”
“আচ্ছা, দেখিস। এখন আয় খেয়ে নিবি।”
“বললাম তো খাবো না।”
আলিয়ার চিৎকার করে কথাটা বলে। জেরিন নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আলিয়ার একবার জেরিনের দিকে তাকায়। জিনাত ভয়ে প্রায় কাঁপাকাঁপি অবস্থা হয়ে গেছে।
জেরিন এগিয়ে এসে বলল,
“ভাইয়া, চেঁচামেচি করছো কেন?”
আলিয়ার কোনো কথা না বলে ডাইনিং এ চলে যায়। চেয়ারে বসে জিনাতকে উদ্দেশ্য করে রেগে বলে,
“খাবার দিয়ে যা।”
জিনাত জেরিনকে বলে,
“খেতে দে ওটাকে।”
বলেই জিনাত নিজের রুমে চলে যায়।
অন্যদিকে,
তুবা নিজের রুমে আছে। পড়তে বসার ভাণ ধরে বসে থাকলেও পড়ছে না সে। মাথানিচু করে কান্না করছে সে। আলিয়ার ও জিনাতের সেদিনের দৃশ্যটা চোখের সামনে ভাসছে ওর। আলিয়ার কেন ওকে ঠকালো?
অনু এসে রুমে নক করে। তুবা চোখ মুছে গলা ঝেড়ে বলে,
“আমি পড়তেছি, ডিস্টার্ব করো না।”
অনু রুমে ঢুকে বলল,
“পড়তেছো পড়ো, কিন্তু তার আগে ভাত খেয়ে নাও।”
“না, খাবো না।”
অনু তুবার বইটা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“ডাইনিং এ আসো।”
তুবা মাথানিচু করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“তুমি যাও, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
তুবা ওয়াশরুমের দিকে যেতে নিলে অনু ওর কাঁধে হাত দেয়। তুবা ওর দিকে ফিরলেও মাথানিচু করে থাকে। ওর লাল ফোলা ফোলা চোখজোড়া অনুর চোখ এড়ায় না।
অনু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলে,
“কান্না করছো কেন?”
তুবা চমকে উঠে একটা ঢোক গিলে ওয়াশরুমে চলে যায়। অনু বুঝতে পারে কিছু একটা সমস্যা তো হয়েছে, কিন্তু কি হয়েছে তাই বুঝতে পারছে না সে।
.
চলবে….
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com