হঠাৎ বসন্ত । পর্ব - ৭ এবং শেষ
বুলবুলের ভালোবাসা যে সম্পূর্ণ মেকি ছিল তা দু একদিনের মধ্যেই মা বুঝতে পারলো যখন
মায়ের প্রিয় বান্ধবী মনিকা এসে মাকে জানিয়ে ছিল বুলবুল বিয়ে করছে।
মেয়ে বেশ পয়সাওলা ঘরের। নগদ অর্থ সমেত মেয়েটিকে বৌ হিসেবে পাচ্ছে বুলবুল।
মা শুনেছিল। সত্যি না মিথ্যা যাচাই করার জন্য হ্যাংলার মতো তোমার বাবা
বুলবুলের কাছে ছুটে যায় নি রায়মা। অপেক্ষা করেছিল বুলবুলের জন্য ।
শুনতে চেয়েছিল তাঁর মুখ থেকে যে মনিকা যা বলছে তাঁর সবটাই মিথ্যা।
কিন্তু মায়ের সে আশা পূর্ণ হয়নি।
বুলবুল আর রায়মার কাছে আসেনি। এই সময় একদিন মায়ের অফিসের বস অরুণাভ রায়ের
মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে মায়ের সঙ্গে আলাপ হয় আকাশের ।
যিনি ছিলেন তোমার বাবা বুলবুলের অফিসের বস। মা কে দেখেই ভদ্রলোক ভালো
মাহিনার চাকরির অফার দেন। বলেন ঢাকায় হেড অফিস।
তাঁর মতো সুন্দরী স্মার্ট মেয়ে তাঁদের কোম্পানি তে যুক্ত হলে তাঁরা বাধিত হবে।
মা ও রাজী হয়ে যায় টাকার দরকার তখন মায়ের।
মাহিনা যখন ভালো দেবে না রাজী হওয়ার মতো কারণ ও ছিলনা।
অরুণাভ রায়ের বদান্যতায় বা নিজের কর্মদক্ষতায় যা মাহিনা পেত তা দিয়ে মা,
দাদু আর দাদিকে নিয়ে চলে এসেছিল নতুন ভাড়া করা ফ্ল্যাটে। কিন্তু সেখানেও
মায়ের বেশী দিন থাকা সম্ভব হল না, কারণ প্রথমত ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাসিন্দারা মা
আর অরুণাভ রায়কে নিয়ে নানা নোংরা নোংরা কথা বলতে থাকে।
আর দ্বিতীয়ত ফ্ল্যাটের ভাড়াও অত্যাধিক। অগত্যা ফ্ল্যাট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
অপরদিকে বুলবুলের বিয়ের তোড়জোড়ের সবটুকুই কানে আসতে থাকে মায়ের ফ্ল্যাটের
অধিবাসী বা বন্ধু মারফত যা মায়ের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব হয়ে পরলো।।
এরপর হঠাৎ করে দাদু হসপিটালে থাকাকালীন মারা যান।
এমতাবস্থায় মায়ের পক্ষে আর ঢাকায় থাকা সম্ভব হয়ে ওঠেনা।
বাধ্য হয়ে মা দিদাকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে যায় ।
যাওয়ার সময় মা বুলবুলকে আর জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি।
কারণটা তুমি তো পুরোপুরি শুনলে নিল ।
যে পুরুষ তাঁর প্রেমিকার সঙ্গে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে প্রেমের খেলা খেলে
গেল অথচ তাঁকে বিয়ে করার পরিবর্তে তাঁর চরিত্র দোষের তকমা সেঁটে দিল
নিজের জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলতে যে সে কী না অফিসের বস অরুণাভ রায়ের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত আছে । মা এতো কিছু শোনার অবস্থায় আর থাকলো না। কথাবলা তো দূর বুলবুলের
সঙ্গে সম্পর্ক রাখাকেই অযথা নিজের জীবনকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া কিছুই মনে করল না।
যাঁকে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে চেয়ে ছিল সেই বুলবুলের কাছ থেকে ভালোবাসার প্রতিদান
হিসেবে শুধুই অপমান চরিত্র দোষের মত তকমা গায়ে লাগিয়ে মা ঢাকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে
দিদাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে গেল বুকের ভেতর সবটুকু কষ্ট নিয়ে ।
এরপর আকাশের হেড অফিস দচাকরি নেয় মা। বছর চারেক সময় কেটেও যায় তারপর।
মা কে আকাশে খুব পছন্দ হয় বিশেষ করে মায়ের স্মার্ট ঝকঝকে চেহারা
সেই সঙ্গে নিজের কাজের প্রতি একাগ্রতা। যা প্রকৃত পক্ষে অন্যান্য কর্মচারি দের ক্ষেত্রে বিরল।
আর মায়ের ও আকাশের অমায়িক ব্যবহার মুগ্ধ করেছিল।
এবং ধীরে ধীরে রায়মা আর আকাশের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্কও গড়ে ওঠে।
যা এক সময় বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছাপিয়ে আকার নেয় প্রেমের ।
আর তাতে কোনো অসুবিধা বা বাঁধা সেই মুহূর্তে আমার মা রায়মার পক্ষে জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
কারণ মা তখনও জানতো না যে আকাশ বিবাহিত।
তাঁর অসুস্থ স্ত্রী এবং সন্তানেরা সকলেই ঢাকাতে থাকে।
যখন রায়মা সবকিছু জেনেছিল তখন সে অন্তঃসত্ত্বা ।
মা আকাশ কে সেই খবরটা জানাতেই প্রথম সেদিন আকাশ দত্তের কাছে জেনেছিল সে বিবাহিত ।
এবং তাঁর পক্ষে রায়মা কে বিয়ে করা কখনোই সম্ভব নয়। সমাজ অন্যকথা বলবে।
কিন্তু রায়মা নাছোড় । তাঁর সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের প্রয়োজন আছে। কিন্তু এখানেও রায়মা ঠকে যায়।
আমার বাবা আকাশ যাঁর ঔরসজাত সন্তান আমি তিনি সরাসরি জানিয়ে দেন বিয়ে তাঁর পক্ষে করা কঠিন কারণ তাঁর স্ত্রী আছে কিন্তু তিনি অসুস্থ ।
সে কিছুতেই ডিভোর্স দেবেনা। তাছাড়া তাঁর সন্তানেরাও আছে তাঁরা কী বলবে?
তাঁর চাইতে দামি ফ্ল্যাট, গাড়ি সবকিছু দিয়ে সে সুকন্যা কে খুশি করার চেষ্টা করবে এমন কী তাঁর সন্তান
যে সুকন্যার গর্ভে তাঁর প্রতিপালনের ক্ষেত্রেও কোনো ত্রুটি রাখবে না।
শুধু বিয়ে রায়মা কে তাঁর পক্ষে কখনোই করা সম্ভব নয়।
রায়মা তাঁর জীবনে আজীবন থাকবে। শুধু তাঁদের সম্পর্কের কোনো নাম থাকবে না।
রায়মা মেনে নেয়। কারণ তাঁর পক্ষে একাকী একজন মহিলা ঢাকার মতো শহরে বাচ্চার
জন্ম দিয়ে এবং তাঁর প্রতিপালন করা সম্ভব বলে মনে হয়নি তাছাড়া একজন মহিলা
হয়ে আর একজন মহিলার সংসার ও ভাঙতে চায় নি মা। বাধ্য হয়ে মায়ের পরিচয় হল মা আকাশের রক্ষিতা।
অফিস কলিগ সকলের কাছে আকাশের সুন্দরী রক্ষিতা। তোমার বাবা বুলবুল তাঁর কাছেও রায়মা
পরিচিত হল আকাশের রক্ষিতা হিসেবেই ।আমি জানি নীল যাঁর মায়ের শরীরে চরিত্রহীনার তকমা আঁটা তাঁর মেয়ে সমাজের কাছে অচ্ছুত । কিন্তু নীল এটা কী তুমি বা তোমার কেউ ভেবে দেখেছে রায়মা
কেন এই পথ বেছে নিল? জীবনে সে দুজন পুরুষ কে ভালো বেসেছিল।
তাঁর মধ্যে একজন তাঁকে পাঁচ বছরের মতো সময় প্রেমের জালে জড়িয়ে রেখে এক
সময় ছুঁড়ে ফেলে দিল । আর অপরজন হয়তো তা করেনি তাঁকে শাড়ি, গয়না,সুখ সবটুকু
দিয়েছে কিন্তু তাঁর বদলে ব্যবহার করেছে তাঁর শরীর ।
বিয়ে না করে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলে রায়মার শরীরে এঁটে দিল রক্ষিতার তকমা।
ধন্য তুমি পুরুষ জাত ধন্য।” কথাগুলি প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল রিনি।
কিছু সময়ের নীরবতা নেমে এলেছিল রিনি আর নিলের মাঝে।
কেউ যেন একে অপরের সাথে কথা বলাতে লিপ্ত হতে চাইছিল না।
কতোটা সময় পার হয়ে গিয়েছিল তা বলা কঠিন হঠাৎ নীরবতা ছাপিয়ে বেজে উঠেছিল
নিলের মোবাইলের রিং টোন।
নিল দ্রুত প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে টাচ্ করে কানে
ধরতেই অপরপ্রান্তে বড় ভাবি নেহার কন্ঠস্বরে ভেসে এসেছিল কয়েকটি শব্দ
—“নিল তুমি কোথায়? এই নিয়ে চারবার ফোন করলাম । শিগগিরই বাড়ি চলে এসো।
বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরেছেন। হসপিটালে ভর্তি করতে হবে। দেরী করলে বাঁচানো কঠিন হবে।
এখনি চলে এসো।” নেহা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাঁর আগেই নিল বলে উঠেছিল
–” বাবার কী হয়েছে ভাবি।’
—” ডাক্তার এসে দেখে গেছেন। এখনো কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা।
এখনি হসপিটালে ভর্তি না করলে বাঁচানো কঠিন ।
তাই তোমার ভাইয়া হসপিটালে নিয়ে যাবে তৈরি হচ্ছে । তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।
” নেহা কথাগুলি বলে লাইন কেটে দিতেই নিল তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াতেই রিনি নিলের মুখের জিজ্ঞাসু দুটি চোখ মেলে বলে উঠেছিল
–” কী হয়েছে নিল? “
–” বাবা অসুস্থ রিনি। হয়তো প্রেসার বেড়েছে। এখনি বাড়ি চলে আসার জন্য ভাবি ফোন করেছিল। “
—” যাও নিল। তিনি তোমার বাবা। ছেলে হিসেবে তোমার কর্তব্য এই সময় তোমার
বাবার কাছে থাকার। আমি এখন চলি। “
—” কিন্তু রিনি আমাদের সম্পর্ক কী এখানেই শেষ হয়ে যাবে ? তুমি কী কোনোদিন,,, “
প্রশ্নটা নিল করে উঠতেই রিনি মুচকি হাসি হেসে বলে উঠেছিল
—” সেটা ভবিষ্যত বলবে নিল। তবে আমিও মায়ের কাছে সবটুকু শুনে মনস্থির করেছি
যেদিন তোমার বাবা বুলবুল নিজে আমার মায়ের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবেন তাঁর কৃতকর্মের জন্য
সেদিন আমি তোমার হব। তাঁর আগে নয়। ” রিনি এরপর আর দাঁড়ায়নি।
দ্রুত চলে গিয়েছিল ।
মাস ছয়েকের মতো সময় কেটে গেছে। ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাত।
আকাশে মস্তবড় একটা চাঁদ উঠেছে । নববধূ সাজে সজ্জিত রিনি দাঁড়িয়ে আছে পূবের
জানলাটার লোহার নির্মিত গরাদ দুটি ধরে । দৃষ্টি আকাশ পথে। নিল দরজাটা খুব সন্তর্পণে
বন্ধ করে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো রিনির দিকে। মৃদু কন্ঠস্বরে বলে উঠলো-
–” রিনি আজ তোমার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছিনা। কী অপূর্ব লাগছে তোমায়।
—” জানি নিল। আজ আমাকে সুন্দর লাগছে। জানো নিল এই দিনটার জন্য হয়তো আমার মা ও একদিন স্বপ্ন দেখেছিল। সে ও তো চেয়েছিল একটা সুখী গৃহকোণ।
যেখানে তাঁর স্বামী হবে বুলবুল আর ,,,,”
—” আর থাক না রিনি। বাবা তো রায়মা আন্টির কাছে ক্ষমা চেয়েছে করজোড়ে ।
সে যে আজ তাঁর কৃত কর্মের জন্য শাস্তি পাচ্ছে তা তো কাওকে বলার অপেক্ষা রাখে না ।
পরের ওপর নির্ভরশীল এক জড় পদার্থ বিশেষ। বিছানা আর চার দেয়ালের মধ্যে তাঁর দিন
কাটে রাত কাটে। অসহায় হয়ে সে বেঁচে রয়েছে।প্রতি মুহূর্ত মৃত্যুর দিন গুনছে।
সেরিব্রাল অ্যাটাকে তাঁর জীবন টুকু বেঁচেছে কিন্তু বাক্ শক্তি সমেত হাঁটা চলার ক্ষমতা টুকুও সে হারিয়েছে। এখনো কী তাঁকে ক্ষমা করা যায় না?
রিনি স্মিত হাসি হেসে বলে উঠলো
—” তিনি তো আমার দোষী নন নিল। তিনি আমার মায়ের দোষী তিনি রায়মার দোষী।
সে যখন তাঁকে ক্ষমা করেছে আমি ক্ষমা করার কে ? আমার দোষী আমার বাবা আকাশ ।
যাঁর জন্য আমি পৃথিবীতে এসেছি। যাঁর অবিবেচকের মতো আচরণ আমার শরীরে
অবৈধ তকমা সেঁটে দিয়েছে। তাঁকে যে আমি শাস্তি দেবো তাঁরও তো কোনো উপায় নেই।
কারণ তিনি তো সব ধরা ছোঁয়ার বাইরে । শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমার আজ কোনো উপায় নেই। “
—” রিনি আজ আমাদের জীবনের প্রথম রাত আজ ফুলশয্যা ।
আমরা ওঁনাদের দূরে সরিয়ে নতুন পৃথিবী গড়ে তুলি। ভুলে যাই সবকিছু ।”
—” কিন্তু আমার শরীরে অবৈধের তকমা ,,,,,”
আলতো করে কাছে টেনে নিয়ে দীর্ঘ অতি দীর্ঘ এক চুম্বন এঁকে দিল রিনির
কপালে নিল স্মিত হাসি হেসে বললো
—” আমার মা বলে সম্পর্ক আল্লাহ সৃষ্টি করেন। আজ তুমি ভেবে দেখেছ তোমার
আমার সম্পর্ক আল্লাহ আগে থেকেই সৃষ্টি করে রেখেছিলেন তাই তো বুলবুলের
সঙ্গে রায়মকর বিয়ে হয়নি । আর আকাশে? তাঁর ভূমিকা অসীম তিনি যদি রায়মার
জীবনে না আসতেন তাহলে তোমাকে পেতাম কেমন করে? তাই ওদের সকলকে ক্ষমা
করে দেওয়াই ভালো। আজ এই চাঁন্দী রাতে আমাদের নতুন পৃথিবীতে ওঁরা না হয় বাবা,
মা এই সম্পর্কেই থাকুন।
বুলবুল, রায়মা, বা আকাশ দ নয়। “
রিনি পুনরায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলতো করে মাথা রাখলো নিলের বুকে।
নিল গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল রিনিকে।
<>সমাপ্ত<>
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com