শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -০৫
আলিয়ারের ফ্যামিলির সবাই একসাথে রাতের খাবার খাচ্ছে। ইব্রাহীম আলিয়ারকে বলল,
“বাবা আলি?”
“জ্বি, বাবা।”
“আমি একসপ্তাহ ছুটি নিবো। আসলে শরীরটা বেশি ভালো নেই।”
আলিয়ার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে তারপর আবার বাবাকে বলল,
“কি হয়েছে তোমার, আব্বু? ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবো কালকে।”
“না না, সেরকম কিছু না। আসলে প্রতিদিন অফিসে যাওয়া আর সারাদিন এতো কাজ করা এই বয়সে কষ্টকর হয়ে গেছে, আমি চাই তুমি একসপ্তাহ আমার দিকটাও সামলে নাও আর আহমেদ তো আছেই।”
“তবুও তোমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।”
“কি যে বলো তোমরা? আজকালকার জেনারেশনও হয়েছে, ডাক্তার আর ডাক্তার। আরে, পরিবারের কাছেই তো সুস্থ থাকার মহৌষধ আছে।”
আলিয়ার মুচকি হাসে। মিসেস. আছিয়া আফসোসের সুরে বলল,
“হা, বাবার কষ্টটা ছেলেরা বোঝে আর মায়ের হয়েছে যত জ্বালা। এই বয়সে এসেও নাকি চুলোর ধারে পড়ে থাকতে হবে?”
আলিয়ার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। ও জানে এখন ওর মা বিয়ের কথা বলা শুরু করবে আর এই কথা একবার শুরু হলে আজকের মধ্যে শেষ হওয়ার নয়।
জিনাত মুচকি হেসে বলল,
“কেন গো চাচী? ছেলেকে বলো কাজের লোক রাখবে।”
“কাজের লোকে কাজই করবে, মায়ের মতো তো ভালোবাসাতে পারবে না। কাজের লোক তো আমার কাছে এসে বলবে না মা আপনার কি ক্ষুধা লেগেছে?”
আলিয়ার ভাত মুখে পুড়ে বলল,
“সমস্যা নেই, এসব জিজ্ঞাসা করে এমন লোকই এনে দিবো।”
“তারমানে তুই বিয়ে করবি?”
আছিয়ার চোখ চকচক করে উঠে।
আলিয়ার হেসে বলে,
“তা কখন বললাম? আমি তো বোঝালাম আমি ভালো মেইড এনে দিবো।”
“তবুও বিয়ে করবি না, তাই না?”
বলেই খাওয়া রেখে আলিয়ারের পিঠে ঠাস ঠাস করে চাপড় দেয় আছিয়া।
আলিয়ার জোরে জোরে হাসতে থাকে। সবাই হেসে দেয়, তবে জিনাত দেখছে আলিয়ারের অকৃত্রিম হাসিটা। এটাই ওর কাছে বেশি দামী।
অন্যদিকে,
মুগ্ধ শুভকে পড়াচ্ছে। শুভ পড়ায় ফাঁকি দেয়ার হাজার চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হলো তখন পড়ায় মনোযোগ দেয়। এবারে অনার্স ২য় বর্ষে উঠেছে শুভ। পড়াশুনায় ভালো হলেও খুবই অমনোযোগী, তাই তো মুগ্ধের বকা খেয়েই পড়তে বসে।
রাতের খাবারের জন্য ডাক পড়ে ওদের। মায়ের একডাকেই শুভ বই বন্ধ করে উঠে দৌড়। ফাঁকিবাজির এমন সুযোগ কি বারবার আসে?
মুগ্ধ উঠে আগে জিনাতের নাম্বারে মিসড কল দেয় পর পর তিনবার। সবার সামনে তিনবার ফোন বেজে উঠায় সবাই জিনাতের দিকে তাকায়। জিনাত জোর করে মুচকি হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল,
“ফ্রেন্ড, সাজেশনের জন্য কল দেয়ার কথা।”
মুগ্ধ নিজে নিজেই হেসে ডাইনিং-এ যায়। ডাইনিং- এ গিয়ে দেখে আজও তার বাবা এখানে নেই। মুগ্ধ মাথানিচু করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদে যায়।
ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে মুগ্ধের বাবা। মুগ্ধ গিয়ে সিগারেটটা টান দিয়ে নিয়ে পায়ের নিচে পিষে ফেলে। বাবার হাত ধরে বলে,
“তুমি কি আমাদের মাঝে থাকতে চাও না? এমন কেন করো?”
“মুগ্ধ বাবা, এটা আমার নেশা চাইলেই তো আর কাটিয়ে উঠা যায় না।”
“তুমি চেষ্টাও করো না।”
মুগ্ধের বাবা ছেলেকে নিয়ে ছাদেই বসলেন। কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“যখন কলেজে পড়তাম, তখন থেকেই এই নেশাটা হয়েছে। এক বন্ধু একদিন বলেছি এটা টেস্ট করতে, প্রথমদিন ভালো লাগেনি। তারপর আবার একদিন টেস্ট করতে বলে, সেদিন কিছুটা ভালো লেগেছে। এভাবে করেই নেশায় পরিণত হয়ে গেল।”
মুগ্ধ রেগে বলল,
“তা কোথায় তোমার ওই পাকনা বন্ধু?”
“ও তো দুবছর যাবত ক্যান্সারে আক্রান্ত।”
মুগ্ধ ফিক হেসে দেয়। বাবা তাকালে ও বলল,
“শুনলে এবং বুঝলে, কিন্তু শিক্ষা হলো না।”
ওর বাবা চুপ থাকলে মুগ্ধ আবারো বলে,
“বাবা, আমার দিকে তাকাও। (বাবার মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে) তোমার এই বুকটা আমাদের কাছে অনেক দামী, তোমার ছায়াটা আমাদের জন্য দামী, তোমার ভালোবাসাটা আমাদের জন্য দামী। কেন এগুলোকে কেড়ে নিচ্ছো আমাদের থেকে?”
“কিন্তু একেবারে তো ছেড়ে দেয়া সম্ভব না।”
“চেষ্টা করো। তা দিনে কয়টা খাও?”
“১০ টা নিম্নে।”
শুনেই মুগ্ধের মাথা ঘুরছে। এতো সিগারেট কেমনে খায়। নিজেকে সামলে নিয়ে মুগ্ধ বলে,
“প্রতিদিন ৫ টা খাবে। বাকিসময় গুলাতে চুইংগাম, ললিপপ খাবে। চলো।”
বাবাকে নিয়ে ডাইনিং এ চলে আসে মুগ্ধ। যেভাবেই হোক এই অভ্যাসটা ছাড়াতেই হবে বাবার। বাবাকে ছাড়া মুগ্ধের পৃথিবী অচল, শুধু মুগ্ধ বলছি কেন? প্রতিটা সন্তানের জন্য তার বাবা গুরুত্বপূর্ণ, বাবা যেমনই হোক না কেন বাবা মানে বাবাই।
মুগ্ধের মা সকলের জন্য খাবার রেডি করেছে। বাবা ফ্রেশ হয়ে এসে বসে। মা আজ চিকেন তন্দুরি ও তুর্কিস পরোটা বানিয়েছে। মুগ্ধ বসে বলে,
“আজকের মেন্যু চেঞ্জ?”
“হুম”(মা মুচকি হেসে বলল)
“উপলক্ষ্য?”
“বিশেষ কিছু না।”
মুগ্ধে মা-ও খেতে বসে। সবাই খাওয়া শুরু করে, কিছুক্ষণ পর মুগ্ধের ফোনে কল আসে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে জিনাত। মুগ্ধ মুচকি হাসে। শুভ বলে,
“এখন কে ভাইয়া?”
মুগ্ধ ফোনের দিকে তাকিয়েই বলে,
“দরকারি ফোন, তোমরা খাও।”
মুগ্ধ খাওয়া ছেড়ে উঠে যায়। হাত ধুয়ে কল কেটে কলব্যাক করে। জিনাত রিসিভ করে বলল,
“কি সমস্যা? রাতের খাবারের সময় কল দিলেন কেন? সবার সামনে কতটা বিব্রত হয়েছিলাম জানেন?”
“না, জানি না। তবে জানতে চাই, পিচ্চি।”
মুগ্ধের সরাসরি জবাবে চমকে কল কেটে দেয় জিনাত। কেন যেন মুগ্ধের এসব কথায় জিনাতের ভিতরে ধুকপুকানি শুরু হয়।
তিনদিন পর,
জিনাতকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আলিয়ার। অপেক্ষা করছে সেই মেয়েটার। কিন্তু তার দেখা থাকলে তো।
শুভ ভার্সিটিতে ঢুকছিল, আলিয়ার দেখে এগিয়ে এসে বলে,
“আলি ভাইয়া, কেমন আছেন?”
আলিয়ার মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে বলল,
“ভালোই, তা তুমি কেমন আছো?”
“ভালো আছি, ভাইয়া। এখানে কি মনে করে?”
“জিনাতকে দিতে এসেছিলাম।”
“আপু এতোবড় এখনো আপুকে দিয়ে যেতে হয়?”
আলিয়ার মাথানিচু করে একটু হেসে বলে,
“বড় আর হলো কই? বড় হলে তো বিয়ে দিতে হবে।”
শুভও হাসলো। আলিয়ার বলল,
“ক্লাস কখন?”
শুভ হাতের ঘড়িটা দেখে বলে,
“এখনই ভাইয়া। আমি আসি, পড়ে কথা হবে।”
“হুম, আসো।”
শুভ চলে যায়। ভার্সিটিতে ঢুকলেই শুভের শার্টের কলার চেপে ধরে সুপ্তি। শুভ ঢোক গিলে, এই একটা মেয়েকে ও অনেক ভয় পায়। সুপ্তি শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,
“বাইরে যার সাথে কথা বলছিলি, সে কে রে?”
শুভ একটা ঢোক গিলে বলে,
“আ… আমার ভাইয়া।”
সুপ্তি ওকে আরেকটু টেনে ধরে বলল,
“আপন ভাই?”
শুভ ডানেবামে মাথা নাড়ে। সুপ্তি বলে,
“ওই ভাইয়ের নাম আলিয়ার?”
শুভ আবারো উপর নিচে মাথা নাড়ে। সুপ্তি চোখ ছোটছোট করে বলে,
“কথা বলতে পারিস না?”
“পা.. পারি, পারবো না কেন?”
সুপ্তি নিজের ফোন বের করে বলে,
“আলিয়ার ভাইয়ের নাম্বারটা দে তো।”
“কেন?”
“দে, চুপচাপ দিয়ে দে।”
“না, দিবো না।”
সুপ্তি শুভকে একটা চড় দিয়ে বলে,
“দিবি তুই?”
শুভ রেগে গেলেও কিছু বলে না, বরং চুপচাপ নাম্বারটা দিয়ে দেয়। সুপ্তি নাম্বারটা নিয়ে শুভকে বলে,
“যা এখন, ভাগ।”
শুভ মুখ ভেংচিয়ে বলে,
“ডাইনী একটা।”
“কি বললি?”
রেগে বলল সুপ্তি।
শুভ একটা ঢোক গিলে বলল,
“আলিয়ার ভাইকে বলিস না, এটা আমি দিয়েছি।”
সুপ্তি তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
“আচ্ছা, আচ্ছা, এখন যা। যা যা।”
শুভ চলে যায়। কিছুদূর গিয়ে সুপ্তির দিকে ফিরে তাকালে সুপ্তি একটা শয়তানি হাসি দেয়।
১০ মিনিট পর,
তুবা তাড়াহুড়ো করে এসে ভার্সিটিতে ঢুকে। দূর থেকে ওকে দেখে আলিয়ার। তুবাও আলিয়ারকে দেখেছে কিন্তু না দেখার ভাণ করে ভার্সিটিতে ঢুকে যায়।
তুবার সাথে কথা না বলতে পেরে আলিয়ার অফিসের দিকে রওনা দেয়। তুবাকে এভাবে দেখতে পেরেই মনের ভিতরে শান্তি অনুভব করে আলিয়ার। কিন্তু এ অনুভূতির কোনো নাম আলিয়ার দিতে পারে না।
তুবা চুপচাপ ক্লাসে চলে যায়। একই বেঞ্চে স্নিগ্ধা, সুপ্তি ও তুবা বসেছে। টিচার ক্লাসে এসে পড়ানো শুরু করে। সুপ্তি তুবার কানে কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“তোর জন্য একটা গিফট আছে।”
“কি?”
“আছে, বাসায় গিয়ে নিজের ব্যাগটা খুলে দেখিস।”
“আচ্ছা।”
টিচারের ধমক খেয়ে দুজনেই চুপচাপ ক্লাসে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করে।
ক্লাস শেষে আজ আর ক্যান্টিনে যায় না তুবা ও ওর ফ্রেন্ডরা। তুবা বাসায় গিয়ে দরজায় একের পর এক বেল দিতে থাকে। অনু দরজা খুললে কোনো কথা না বলে দৌড়ে রুমে চলে যায় সে। অনু অবাক হয় ওর এমন আচরণে।
অনু তুবাকে ডেকে বলল,
“তুবা, ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো।”
“আচ্ছা।”
তুবা ব্যাগ খুলে একটা প্যাকেট পায়। প্যাকেটটা খুলে একটা কাগজ পায় তুবা। কাগজে লেখা,
“আমাকে ম্যাসেঞ্জারে নক দিস একটা জরুরি কথা বলবো।”
তুবা রাগে কাগজটা মুচড়ে ফেলে। এটা নাকি সুপ্তির গিফট। ফোন বের করে ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ দেয়,
“কুত্তী, বিলাই, হনুমান, শিম্পাঞ্জি, ইন্দুর এই এক টুকরো কাগজ তোর গিফট?”
কিছুক্ষণ পর রিপ্লাই এলো,
“গন্ডার, এতো নাম দেস কেন? গিফট তো অন্যটা।”
“তাড়াতাড়ি বল, কি বলবি?”
একটা নাম্বার ম্যাসেজ দেয় সুপ্তি,
“017********”
“এটা কার নাম্বার?”
“ফোন করে দেখ। এখন আমি ফ্রেশ হবো।”
তুবা ফোনটা রেখে ফ্রেশ হতে যায়। এই নাম্বারটা কার হতে পারে? সুপ্তি দুষ্টুমি করে ঠিকই কিন্তু এধরনের বিভ্রান্তিকর কাজ কখনোই করে না।
চলবে….
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com