Breaking News

শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -২৩



পরেরদিন দুপুরে,
আলিয়ার ডায়ালাইসিস করে বাসায় এসেছে। কাগজপত্রগুলো বেডসাইড টেবিলের উপর রেখে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে যায়। মানসিকভাবে খুব একটা শক্ত অবস্থানে নেই সে।
আলিয়ার ওয়াশরুমে যাওয়ার পর জিনাত রুমে আসে। জিনাত মূলত এসেছে আলিয়ারের রুম পরিস্কার করার জন্য। বিছানা গুছিয়ে টেবিলে হাত যাওয়ার পরই ডাক্তারি কাগজপত্র হাতে পড়ে ওর।
কাগজগুলো তুলে বুঝতে পারে এটা ডায়ালাইসিসের কাগজ, কাগজে স্পষ্ট তা উল্লেখ করা আছে।
“এসব কাগজ কার হতে পারে? আলিয়ারের?”
জিনাত কিছুটা ভয় পেয়ে মনে মনে এসব ভাবে।
আলিয়ার ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে জিনাতকে দেখে রেগে বলল,
“কি করছিস এখানে?”
জিনাত আলিয়ারকে কাগজগুলো দেখিয়ে বলে,
“এগুলো কার?”
আলিয়ার এসে ছোঁ মেরে কাগজগুলো নিয়ে যায়। জিনাত সন্দেহের দৃষ্টিতে আলিয়ারের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোর নয় তো?”
আলিয়ার কাগজগুলো বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে রেখে জিনাতকে ধমক দিয়ে বলে,
“যা, এখান থেকে।”
জিনাত তবুও যায় না। আলিয়ার বারান্দার দিকে চলে যেতে নিলে জিনাত একটু জোরেই বলে,
“যদি ভাবিস আমি এখনো তোকে ভালোবাসি তবে তুই ভুল ভাবছিস, আমি তোকে মোটেও ভালোবাসি না আলি। যা ছিল তা আবেগ, এর চেয়ে বেশি কিছুই নয়।”
আলিয়ার অবাক হয়ে জিনাতের দিকে তাকালে জিনাত ওর দিকে এগিয়ে আসে৷ আলিয়ার চোখ ছোট ছোট করে জিনাতের অদ্ভুত আচরণ পর্যবেক্ষণ করছে।
জিনাত বলে,
“ওই পিচ্চি তুবার সাথে তোর কি সম্পর্ক তা আমি জানি না, তবে যাই থাকুক আমি তোদের মাঝে আসবো না।”
আলিয়ার চুপ করে আছে৷ তুবার কথা জিনাত জানে, তবে জিনাতই কি তুবাকে ওসব কথা বলেছে?
জিনাত আবারো বলে,
“ভার্সিটির সামনে তোদের কথা বলতে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম কিছু তো সম্পর্ক আছে৷ অবশ্য তার অনেক আগেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার মনে তোর জন্য কোনো ভালোবাসা নেই।”
আলিয়ার আবারো অবাক হয়। ওকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে জিনাত বলল,
“আমি তোর ছোট বোন, বোনকে তো বলতেই পারিস ওই কাগজগুলো কার?”
আলিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দার দিকে তাকায়। জিনাত এখনো প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
একটু পর আলিয়ার বলল,
“আগে খাবো, খুব ক্ষুধা লেগেছে।”
“ঠিক আছে।”
জিনাত মুচকি হেসে বেরিয়ে যায়। আলিয়ার সত্য-মিথ্যার দোটানায় পড়ে যায়। জিনাতকে সন্দেহ করবে নাকি ওর কথাই বিশ্বাস করবে? কিছুই বুঝতে পারছে না। জিনাতের কথা শুনে মনে হয় না ও মিথ্যা বলছে, আবার ওকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না আলিয়ার।
খাবার খাওয়ার পর রুমে আসে আলিয়ার। তুবার নাম্বারে আবারও কল দেয়। বেজে কেটে যায়, তুবা রিসিভ করেনা। চার-পাঁচবার কল দিয়ে হতাশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে আলিয়ার।
এমন সময় দরজায় নক করে জিনাত,
“আমি কি ভিতরে আসতে পারি, আলি?”
“হ্যাঁ আয়।”
আলিয়ার শোয়া থেকে উঠে বসে। জিনাত রুমে এসে একটা চেয়ার টেনে খাটের পাশে বসলো।
আলিয়ারকে বলল,
“এখন তো বল কার ওগুলো?”
আলিয়ার একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“ওগুলো আমার।”
“তোর?”
জিনাত চেঁচিয়ে ওঠে।
“হুম, আমার। কি থেকে কি হয়ে গেল আমি নিজেও জানিনা।”
আলিয়ার মাথানিচু করে চাদরে আঙ্গুল দিয়ে অদৃশ্য আঁকিবুঁকি আঁকতে আঁকতে বলল।
জিনাত চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আলিয়ার মিনতি সুরে বলে,
“আম্মুকে এখনই কিছু বলিস না, আসলে আমি চাই না আম্মু টেনশন করুক।”
জিনাত মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক আছে।”
অন্যদিকে,
দুপুরের খাবারের পর ইব্রাহিম ও আছিয়া গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছে। অনেকদিন পর গ্রামে এসেছে এইটুকু বুঝেছে এখন গ্রামের মানুষজন আর আগের মতো সরলসহজ নেই, আগের মতো সাধারণ জীবন অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। এখন গ্রামে মাটির চুলার পরিবর্তে গ্যাসের চুলায় রান্না হয়।
মানুষ নদীতে বা পুকুরে গোসল করার পরিবর্তে শহরের মতো টাইলস করা গোসলখানায় করে। এখন আর গাছতলায় ঘাসের উপর বসে আড্ডা দেয়া হয় না, এখন আড্ডা দেয়ার জন্য দামী সোফা ব্যবহার করা হয়।
মাটির ঘর তো বিলুপ্তপ্রায়, প্রায় সব ঘরই পাকা বিল্ডিং। কোনো কোনো বিল্ডিং তো চার-পাঁচতলাও হয়ে গেছে। টিনের ঘর কিছু কিছু পাওয়া গেলেও তারও ফ্লোর করা আছে।
মহিলারা অবসরে এখন আর বারান্দার চকিতে বসে নকশীকাঁথা সেলাই করে না, তারা অবসরে স্মার্টফোনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরে থাকে। গ্রামের কারো ঘরে এখন আর হারিকেন খুঁজে পাওয়া যাবে না, কুপি বা প্রদীপও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যা পাওয়া যাবে তা মর্ডান যুগের বাতি, যাকে ইংরেজিতে বলে লাইট।
আছিয়া বলে,
“গ্রামের স্বকীয়তা নেই, আগে আমরা কত সুন্দর জীবন কাটাতাম। আর এখন?”
ইব্রাহিম মুচকি হেসে বলল,
“এগুলো প্রযুক্তির বিকাশে হয়েছে বেগম।”
“প্রযুক্তি থাকবে ভালো কথা। মানুষ সেটাকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করবে কিন্তু মানুষ নিজেই তো এখন প্রযুক্তির উপর নির্ভর হয়ে গেছে।”
ইব্রাহিম আছিয়াকে নিয়ে গেছে ফসলের ক্ষেতে। ধান, পাট দেখা যাচ্ছে সেখানে। আছিয়ার মুখে এবারে কিছুটা হাসি ফুটে।
দুজনে ধান ক্ষেতের মাঝে দিয়ে হাঁটছে। আছিয়া বলে,
“কিছু বলার ছিল।”
“বলো।”
আছিয়া একটু থেমে আশেপাশে তাকিয়ে নেয়। তারপর বলে,
“সকালে জিনাত কল করেছিল।”
“ওহ, আমাকে দিলে না?”
“ও আমার সাথে কিছু জরুরি কথা বলার জন্য কল দিয়েছিল আর তোমাকে বলতে বলেছে।”
ইব্রাহিম অবাক দৃষ্টিতে আছিয়ার দিকে তাকায়। আছিয়ার মুখে তেমন কোনো এক্সপ্রেশন খুঁজে পেলেন না ইব্রাহিম, তবে ঠোঁটের কণায় এখনো হাসি ঝুলে আছে।
আছিয়া বলল,
“জিনাত নিজের ভুল স্বীকার করেছে।”
ইব্রাহিম চোখ ছোটছোট করে তাকিয়ে বলে,
“কি সম্পর্কে?”
“ও আলিয়ার আর ওর সম্পর্ক নিয়ে মিথ্যা বলেছিল তাই।”
“তা তো আরো আগেই চেয়েছে।”
আছিয়া মুচকি হেসে বলে,
“সুলতানা এখনো ওদের বিয়ে চায়।”
“খারাপ হবে নাকি?”
“দেখো, আমি বলছি না জিনাত খারাপ মেয়ে। কিন্তু জিনাত আজকে আমাকে অনেককিছু বলেছে।”
“কি বলেছে?”
আছিয়া একটু গলা খাকিয়ে বলে,
“বলেছে আলিয়ারের প্রতি ওর টানটা মনের টান ছিল না, আবেগ ছিল। অনুভূতি আর আবেগের পার্থক্য ও অনেক দেরিতে বুঝেছে। এই কথাটা সুলতানাকে বোঝাতে পারছে না জিনাত।”
ইব্রাহিম দাঁড়িয়ে পড়ে। আছিয়া হাঁটা থামিয়ে বলে,
“কি হলো?”
ক্ষেতের পাশের একটা জাম গাছ দেখিয়ে ইব্রাহিম বলল,
“চলো, গাছের নিচে গিয়ে বসে কথা বলি।”
আছিয়া মুচকি হেসে বলল,
“চলো।”
দুজনে গাছের নিচে গিয়ে বসে। ইব্রাহিম বলে,
“নিজের হাতে এই গাছটা লাগিয়েছিলাম।”
আছিয়া গাছটা দেখতে থাকে। ইব্রাহিম আবারো বলল,
“যা বলছিলে, বলো।”
আছিয়া একবার ইব্রাহিমের দিকে তাকিয়ে আবারো সামনের দিকে তাকায়,
“সুলতানা জিনাতের মতের বিরুদ্ধে আলিয়ারের সাথে ওর বিয়ে দিতে চায় কিন্তু আলিয়ার…”
ইব্রাহিম অবাক হয়ে বলে,
“কি করেছে আলিয়ার?”
“আলিয়ার এক মেয়েকে পছন্দ করে হয়তো।”
“হয়তো?”
“হুম, জিনাত শিউর হয়ে বলতে পারছে না। তবে আমি বলেছি ও যেন জেনে নেয়। আরেকটা কথা বলেছে।”
“কি?”
আছিয়া চুপ করে থেকে বলল,
“বলেছে একজনকে ভালোবেসে মনের বিরুদ্ধে অন্যজনকে বিয়ে করে সুখী হওয়া যায় না। টাকা মানুষকে সুখ দিতে পারে না। মনের বিরুদ্ধের বিয়ে থেকেই পরকিয়ার উৎপত্তি।”
ইব্রাহিমের কপালে কয়েকটা চিন্তার ভাঁজ করে। আছিয়া উনার দিকে তাকিয়ে বলে,
“এসব কথার অর্থ কি হতে পারে?”
“হয়তো আলিয়ার আর ওই মেয়েটার বিয়ের জন্য বলছে।”
“হয়তো।”
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আছিয়া।
সন্ধ্যা ৬ টা,
মুগ্ধের সাথে দেখা করতে এসেছে জিনাত। মুগ্ধ আজ খুবই চুপচাপ। ওর নিরবতা জিনাতকে কষ্ট দিচ্ছে, তবুও জিনাত বকবক করেই যাচ্ছে।
কথা বলার একপর্যায়ে জিনাত বলে,
“আব্বু-আম্মু গ্রাম থেকে ফিরে আসলে তুমি তোমার আম্মুকে নিয়ে আমার বাসায় যাবে।”
মুগ্ধ জানে জিনাত কেন ওকে বাসায় যেতে বলছে। তবুও শান্তসুরে বলে,
“কেন?”
জিনাত চোখ পিটপিট করে মুগ্ধের কাঁধে হাত দিয়ে বলে,
“আসলে তোমার ডান্স আমার ফ্যামিলিকে দেখাবো, এমন ডান্স না দেখালে কি হয়?”
মুগ্ধ রাগী চোখ জিনাতের দিকে তাকালে জিনাত দাঁত কেলায়। মুগ্ধ ওর গাল টেনে দিয়ে বলে,
“তারপর?”
“তুমি কিছু বলো।”
“বলবো?”
“হুম।”
মুগ্ধ জিনাতের কাছাকাছি এসে বলল,
“আজ আপনি ছেড়ে তুমিতে এসেছো, এরজন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
জিনাত সরে যায়। আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
“এটা পাবলিক প্লেস।”
মুগ্ধ বেশ ভণিতা করে বলল,
“সেদিন পাবলিক প্লেসে জড়িয়ে ধরতে পারলে আর এখন পাবলিক প্লেসে কথা বলতে পারবো না।”
জিনাত লজ্জা পেয়ে যায়। মাথানিচু করে আছে সে। মুগ্ধ মুচকি হেসে অন্যদিকে তাকায়।
কিছুক্ষণ পর জিনাত বলে,
“একটা কথা বলার ছিল।”
“বলো।”
জিনাতের দিকে তাকিয়ে বলল মুগ্ধ।
জিনাত ওর গা ঘেসে বসে বলল,
“রাগ করবে না তো?”
“না।”
“কয়েকমাস আগে আমার সাথে একজনের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। যেদিন তোমাকে বলেছিলাম আমার বিয়ে আজ, সেদিন সত্যিই আমার বিয়ে ছিল।”
মুগ্ধ অবাক চোখে জিনাতের দিকে তাকিয়ে আছে। জিনাত কি ওকে ঠকালো? এমন প্রশ্নে নিজেই বিব্রত হতে থাকে মুগ্ধ।
জিনাত একটা ঢোক গিলে বলে,
“তবে সেদিন বিয়েটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। বিয়েটা কার সাথে ছিল জানো?”
মুগ্ধ আমতাআমতা করে বলল,
“কার সাথে?”
“আলিয়ার।”
মুগ্ধ দাঁড়িয়ে যায়। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আলিয়ারের সাথে জিনাতের বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তবে ভাঙলো কেন? কি হয়েছিল সেদিন? হাজারো প্রশ্নে মুগ্ধের হৃদয় প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে।
জিনাত মুগ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি চাই না আমাদের সম্পর্কে আমাদের অতীত নিয়ে কোনো গোপনীয়তা থাকুক। তাই এসব বলা।”
মুগ্ধ বুঝতে পারছে না কি বলবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুগ্ধ বলল,
“জিনাত, বিয়েটা কেন ভেঙ্গে গেল?”
জিনাত ভয়ে ভয়ে একবার মুগ্ধের দিকে তাকায়। তারপর পুরো ঘটনা বিস্তারিত বলতে থাকে।
অন্যদিকে,
তুবা নাস্তা বানাচ্ছে। সমুচা ভাজছে আর অন্য চুলায় চা বসিয়েছে। তওবার শরীরটা বেশি ভালো নেই, পায়ে ব্যথা করছে। অনু তওবার পায়ে অলিভ ওয়েল মালিশ করে দিচ্ছে। যদিও তওবা নিষেধ করছিল, অনু কিছুটা জোর করেই মালিশ করে দিচ্ছে।
তওবা বলে,
“মা, আর লাগবে না। আমি ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেয়ে নিবো।”
অনু গাল ফুলিয়ে বলল,
“আগে যখন আম্মুর পায়ে ব্যথা হতো তখন আমি এভাবে মালিশ করে দিতাম। আম্মু অনেক আরাম পেতো। আপনারও দেখবেন সেরে যাবে।”
“ওষুধ খেলেও তো সেরে যাবে?”
“ওষুধ শরীরের একদিকের ব্যথা সারাবে কিন্তু অন্যদিকের ক্ষতি করবে। ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেলে তো আপনার প্রেসার বাড়ে।”
তওবা মুচকি হেসে বলে,
“এদিকে আসো মা।”
অনু একটু এগিয়ে বসে। তওবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“সব শাশুড়ির ভাগ্যে যদি তোমার মতো বউমা থাকতো, তবে বৃদ্ধাশ্রমে এতো মানুষ থাকতো না।”
অনু মুচকি হেসে তওবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আর সব শাশুড়ি আপনার মতো হলে নারী নির্যাতনও এতো বাড়তো না।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। বুঝলাম।”
তওবা হেসে অনুর কপালে চুমো এঁকে দেয়।
এদিকে তুবার ফোনে কল দেয় সুলতানা। তুবা নাম্বারটা দেখে কল রিসিভ করে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, কেমন আছো মা?”
তুবা একটু চুপ থেকে বলে,
“ভালো আছি, আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও ভালো আছি। তা মা আলিয়ারের সাথে কি তোমার কোনো কথা হয়েছে?”
তুবা চুপ করে আছে। ওর নিরবতায় সুলতানা একটু ঘাবড়ে যায়। নিজে ধরা পড়ে যাবে এমন আশংকায় তটস্থ থাকে।
সুলতানার ভয়কে উড়িয়ে দিয়ে তুবা বলল,
“না, আন্টি।”
“আলিয়ার কথা বলতে চেয়েছিল?”
“হুম, কিন্তু আমি বলিনি।”
সুলতানার প্রশ্নের চেয়ে একলাইন বেশি কোনো উত্তর দিচ্ছে না তুবা। সুলতানা মুচকি হেসে বলে,
“এইতো, গুড গার্ল।”
“জি, আন্টি। আপনার কথা মেনেছি তাই গুড গার্ল আর না মানলে খারাপ, বেহায়া হতাম হয়তো।”
একটুকু বলেই কল কেটে দেয় তুবা। সুলতানা রেগে যায় তুবার এমন কথায়। রাগে রি রি করতে করতে বলল,
“বেয়াদব মেয়ে একটা।”
তুবা ফোন রেগে খুব কষ্টে নিজের কান্না নিয়ন্ত্রণ করে সমুচা ভাজায় মন দেয়। ইতোমধ্যে কথার ঘোরে দুটো সমুচা পুড়েও গিয়েছে।
রাতে,
ঘড়িতে রাত ১২ টা ছুইছুই। অনেকদিন পর ছাদে গল্প করতে এসেছে আলিয়ার ও জিনাত। জিনাত জানে আলিয়ার মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ছে, মন থেকে কোনো জোর পাচ্ছে না, পরিবারের কেউই এসম্পর্কে জানে না বলে ওকে সাহসও দিতে পারছে না।
আলিয়ার আকাশের তারা দেখছে। জিনাত ওকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“কয়টা হলো?”
আলিয়ার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“৫০০০ টা, বিশ্বাস না হলে গুণে দেখ।”
জিনাত ওর পাশে বসে বলল,
“বললি না তো তোর আর তুবার কথা।”
“ওর নাম কি করে জানিস?”
কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে জিনাতের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল আলিয়ার।
জিনাত মুচকি হেসে বলে,
“একদিন তোর আর মুগ্ধের সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম, মনে আছে?”
“হুম।”
“সেদিন ভার্সিটির সামনে হঠাৎ এসে আমার নাম জিজ্ঞাসা করে বসে, বাচ্চা মেয়ে কি ভেবে জিজ্ঞাসা করেছে কে জানে? আমি ওর নাম জানতে চেয়েছিলাম।”
“ওহ।”
কিছুক্ষণ পর আলিয়ার বলে,
“কেউ মিথ্যা বলেছে তুবাকে।”
“কেমন মিথ্যা?”
“বলেছে…”
আলিয়ার থেমে গেলে জিনাত ওর দিকে তাকায়।
চোখের কোণের পানিগুলো স্পষ্ট হয়ে আছে।
আলিয়ার নিজের মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়।
ছেলেরা নিজেদের চোখের পানি কাউকে দেখাতে পারে না।
জিনাত অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে।
এভাবে আলিয়ারকে কখনো কাঁদতে দেখেনি ও।
আলিয়ার নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলে,
“আমি রুমে যাচ্ছি, ঘুমাবো।”
আলিয়ার উঠে চলে যেতে নিলে জিনাত ওর হাত ধরে বলে,
“কি হয়েছে আলিয়ার?”
“জিনাত, কেউ ওকে আমাদের বিয়ের কথা হয়েছিল সেই ঘটনাটা বলেছে কিন্তু অনেক বাড়িয়ে বলেছে, অনেক মিথ্যা মিশ্রণ করে বলেছে।”
জিনাত উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“কি বলেছে?”
আলিয়ার একটু চুপ থেকে বলল,
“বলেছে বিয়ে এখনো ঠিক হয়ে আছে, সামনেই বিয়ে আর আমার মতেই এই বিয়ে হচ্ছে।”
জিনাত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এ কথা কে বলতে পারে? প্রত্যাশা নাকি ওর মা? ছি, নিজের মনকেই ঘৃণা করছে সে। ওর মা আর যাই করুক এসব করবে না আর ওর মা তো তুবার কথা জানেই না। তবে কে করলো?
জিনাতের নিরবতা দেখে আলিয়ার বলল,
“কথাটা কি তুই বলেছিস?”
জিনাত একবার আলিয়ারের দিকে তাকায়, তারপর ডানে বামে মাথানেড়ে বলে,
“না, আমি এসব বলিনি। আর আমি কতবার বলবো যে তোকে আমি ভালোবাসি না।”
“তবে কে বলল?”
“সেটাই ভাবছি। তুবা তোকে বলেনি?”
আলিয়ার হাতদুটো পিছনে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ও হয়তো আমাকে আর সহ্য করতে পারছে না। কলই রিসিভ করে না।”
জিনাত মুখ বাকিয়ে বলে,
“ওর নাম্বারটা একটু দিবি?”
আলিয়ার পকেট থেকে ফোন বের করে জিনাতের দিকে এগিয়ে দেয়। জিনাত তুবার নাম দিয়ে সার্চ করে নাম্বার পায় না। আলিয়ারকে বলে,
“কোথায় নাম্বার?”
আলিয়ার ফিক করে হেসে বলল,
“বেড়াল দিয়ে সেইভ করা।”
“বেড়াল?”
“হুম।”
জিনাত হেসে দেয়। নাম্বারটা নিজের ফোনে সেইভ করে আলিয়ারের ফোন ওর হাতে নিয়ে বলে,
“এই বেড়ালেই কামড় দিয়েছিলো?”
আলিয়ার মুচকি হেসে হালকা মাথা ঝাকায়। জিনাত দাঁত কেলিয়ে চলে যায়।
আলিয়ার ওকে ডেকে বলে,
“আমার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে কিন্তু এখনো ডোনার পাওয়া যায়নি।”
জিনাত ধমকে যায়, হাসিটাও মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যায়। আলিয়ারের দিকে তাকালে আলিয়ার বলল,
“যদি এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাই তবেই তুবাকে সবটা জানাবি তার আগে না।”
জিনাত ওর গাল একটা চড় লাগিয়ে বলে,
“এসব আবোলতাবোল কি বলছিস তুই? কিচ্ছু হবে না তোর, কিডনি ডোনার অবশ্যই পাওয়া যাবে। আমি ফ্যামিলির সবার সাথে কথা বলবো, ডোনার যদি ফ্যামিলি মেম্বার হয় তবেই সবচেয়ে ভালো হবে।”
আলিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“সময়মত ট্রান্সপ্লাট না করতে পারায় তোর নানা মারা গিয়েছিল, ভুলে গেছিস?”
“দেখ আলি, ওটা আরো ১২ বছর আগের কথা। তখন এতো উন্নত চিকিৎসাও ছিল না। এখন তো দিন পালটে গেছে।”
“কিন্তু মৃত্যুকে আটকানোর সাধ্য কি মানুষের হয়েছে?”
আলিয়ারের এমন প্রশ্নে থ মেরে যায় জিনাত। কেন বলছে আলিয়ার এসব কথা, এটাই বুঝতে পারছে না জিনাত। ও শুনেছিল মৃত্যুর আগে নাকি মানুষ এসব আবোলতাবোল বকে, তবে কি আলিয়ার? আর ভাবতে পারছে না জিনাতের ছোট্ট মন।
চলবে…

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com