শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -২০
তুবা মাত্রই দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে আসলো একটু ঘুমানোর জন্য। এমন সময় ওর ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। তুবা সাতপাঁচ না ভেবে রিসিভ করে নেয়,
“আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?”
অপর পাশ থেকে এক নারীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, তোমার নাম কি?”
কিছুটা হকচকিয়ে তুবা উত্তর দেয়,
“আমার নাম না জেনে আপনি আমাকে কল করেছেন?”
“না, আমি তোমার নাম জানি, কিন্তু সিওর হতে চাচ্ছি যে আমি যাকে চাচ্ছি তুমি সেই কিনা?”
তুবা কিছুটা রাগী ভাষায় বলে,
“আপনি কে?”
“আমি আলিয়ারের মা।”
তুবা পড়ে এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। আলিয়ারের মা ওকে কল করেছে, অথচ আলিয়ার আগে থেকে কিছুই জানায়নি। তারউপর একটু আগে উনার সাথে বেশ রাগী গলায় কথা বলেছে।
তুবা বেশ নম্রভাবে বলে,
“আন্টি, আমার নাম তাসপিয়া আলম তুবা।”
অপর পাশ থেকে আবারো বলা হয়,
“কেমন আছো তুমি?”
“জি আন্টি, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ, আমিও ভালো আছি।”
প্রকৃতপক্ষে যে তুবা কে কল করেছে সে আছিয়া নয় সুলতানা। সে নিজের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তুবার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে, কারণ তুবা আলিয়ারের চাচীর থেকে আলিয়ারের মাকে বেশি সম্মান করবে।
সুলতানা অনুরোধের সুরে বলে,
“তোমার কাছে একটা আর্জি নিয়ে কল করেছি।”
“আর্জি কেন বলছেন, আন্টি? আপনি আমাকে আদেশ দেবেন।”
“তুমি যেভাবে নেবে মা।”
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুলতানা।
তুবা নিজের কথায় আরেকটু ভদ্রতা মিশ্রিত করে বলল,
“জি আন্টি বলুন।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুলতানা বলল,
“আলিয়ারের সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক তা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি। তবে আমি তোমাকে একটা অনুরোধ করবো, তুমি আলিয়ারের জীবন থেকে সরে যাও।”
তুবার মনে হলো ওর বুকে হাত দিয়ে কেউ ওর হৃদপিন্ডটাই ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, ও চাইলেও ঠেকাতে পারছে না। তুবা চুপ করে আছে, ওর নীরবতায় সুলতানা আরেকটু আত্মবিশ্বাস পায়।
সে বলল,
“আমি কি বলছি তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?”
তুবা বেশ মিনমিনিয়ে বলে,
“জি আন্টি।”
সুলতানা বাঁকা হাসে। ও বুঝতে পারছে তুবাকে বেশ ভালোই আঘাত করা গেছে। এখন ও ভিতরে ভিতরে পুড়ছে।
সুলতানা অসহায়ভাবে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে, ফোনে হয়তো এত কথা বলাটা হয়তো ঠিক হবে না। তুমি এক কাজ করো, কাল আমার সাথে দেখা করো। আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলবো।”
তুবা আমতা আমতা করে বলে,
“ঠি..ঠিক আছে আন্টি। কোথায় দেখা করতে আসব?”
“সেটা তোমাকে আমি ম্যাসেজ দিয়ে জানিয়ে দেবো। তবে একটা কথা আমি যে তোমাকে কল করেছি, আমি যে তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছি তা যেন আলিয়ার না জানে।”
“ঠিক আছে, কিন্তু আলিয়ার জানলে কি সমস্যা?”
“কারণ আলিয়ার জানলে একটা বিরাট সত্য তুমি জানতে পারবে না।”
তুবা সন্দেহের সুরে বলল,
“মানে ঠিক বুঝলাম না। ঠিক কি রকম সত্য আন্টি?”
“তা কাল আসলেই বুঝবে।”
“ঠিক আছে আন্টি, আপনি যেমনটা বলবেন।”
“আচ্ছা, মা। এখন রাখি?”
“জি, আন্টি। আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
তুবা ফোন রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আলিয়ার ওর থেকে কোন সত্যিটা লুকিয়েছে, যা আলিয়ারের মা ওকে জানাতে চাচ্ছে? তবে কি আলিয়ার ওকে ঠকালো? আজ পর্যন্ত যা হয়েছে সবই কি অভিনয় ছিল? একটা মানুষ এত নিখুঁত আর সুন্দর অভিনয় কি করে করতে পারে তাও বাস্তব জীবনে? তুবা আর ভাবতে পারছে না, মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।
অন্যদিকে,
“তার নাম মুগ্ধ। অনেক আগে থেকেই আমাকে চেনেন, আমিও তাকে চিনতাম তবে শুধুই আলিয়ার বন্ধু হিসেবে। ওই যে বলতাম না এক প্যারার কথা, এই সেই প্যারা। প্যারা থেকে হয়ে গেল আমার মুগ্ধতা, আমার নিশ্বাস।”
জিনাত ফোনে কথা বলছে প্রত্যাশার সাথে। মুগ্ধ আর ওর মাঝে ঘটা পুরো ঘটনাই প্রত্যাশাকে জানিয়েছে। মুগ্ধকে যে চিঠি দিয়েছে তাও জানিয়েছে।
প্রত্যাশা অবাক হয়ে বলে,
“এটাও কি সম্ভব রে?”
“কেন? অসম্ভবও তো নয়।”
“না, কিন্তু তুই যেখানে আলিয়ার ভাইয়ের জন্য পাগল ছিলি সেখানে অন্য একজনকে কি করে ভালোবাসলি?”
জিনাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আলিয়ারকে যদি সেদিন বিয়ে করে নিতাম তবে মনের মাঝে একটা ক্ষত নিয়েই বাঁচতে হতো। আলিয়ার হয়তো ঠিকই বলতো আমি ওকে ভালোবাসিনি। সবটাই আবেগ আর নাহলে মরিচিকা।”
“জিনাত আমার মনে হচ্ছে তুই বুঝতেই পারছিস না তুই কাকে ভালোবাসিস।”
জিনাত ফোনটা কানের কাছ থেকে নামিয়ে মুখের কাছে এনে বলে,
“না রে, আমি বুঝতে পারছি। ভালোবাসার মানুষ তো সে হয় যে ভালো রাখতে জানে, ভালোবাসার মানুষ তো সে হয় যে ভালোবেসে আগলে রাখতে জানে। ভালোবাসা মরিচিকা নয় সেটা কোনো প্রতিচ্ছবিও নয়। কারো মনের কাছাকাছি যাওয়া সহজ নয়। ভালোবাসা কোনো সময় মেপে হয় না। এটা যেকোনো সময় যেকোনো কারো জীবনে চলে আসতে পারে। যেমনটা মুগ্ধ এসেছে। উনার প্রতিটা পদক্ষেপে আমি মুগ্ধ। উনি আমার মুগ্ধতা।”
প্রত্যাশা জিনাতের কথা যত শুনছে ততই অবাক হচ্ছে। আলিয়ারের জন্য পাগল মেয়েটা কি করে মুগ্ধের প্রেমে পড়তে পারে।
জিনাত আবারো বলে,
“আলিয়ারের প্রতি আমার অনুভূতিকে আবেগ, আকর্ষণ অথবা ভালোলাগা নামকরণ করা যেতে পারে। কিন্তু এটা কখনোই ভালোবাসা হবে না। এটা বুঝতে বুঝতেই ১০ টা বছর পেরিয়ে গেছে।”
প্রত্যাশা একটা কাশি দিয়ে বলল,
“মুগ্ধ তোকে কেন এক্সসেপ্ট করলো? তুই তো ওকে কম অপমান করিসনি?”
“এটাই হয়তো ভালোবাসা।”
প্রত্যাশা একটু জোর গলায় বলে,
“অন্ধ প্রেম ভালো নয় জিনাত। তুই যেটাকে ভালোবাসা বলছিস সেটা যদি তোর উপর প্রতিশোধ হয়ে ফিরে আসে? তখন কি করবি? হয়তো মুগ্ধ প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে?”
“তুই বুঝতে পারছিস না প্রত্যু উনি..”
জিনাতের কথার মাঝেই প্রত্যাশা ধমক দিয়ে বলে,
“আবারো বলছি অন্ধ হয়ে যাস না। বুঝলাম আলিয়ারের ভাইয়ের প্রতি আকর্ষণটা ভালোবাসা নয়, তোর প্রতি মুগ্ধের আকর্ষণটা কি ভালোবাসা? এটা আগে পরীক্ষা করে নে।”
জিনাত কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
“কিভাবে পরীক্ষা করবো?”
“আমি তোকে বলছি।”
পরেরদিন সকাল ১০ টায়,
আজ ভার্সিটিতে যায়নি তুবা। ও এসেছে সুলতানার সাথে দেখা করতে। গুলশান লেক পার্কে এসে সে। সকাল হলেও এখানে মোটামুটি অনেক মানুষ আছে।
তুবা এসে লেকের পাশে দাঁড়িয়ে সুলতানাকে কল করে,
“আন্টি আমি লেকের পাশে আছি।”
ওপাশ থেকে সুলতানা বলে,
“তুমি কি রঙের জামা পড়েছো, মা?”
“হলুদ সুতির থ্রিপিজ পড়েছি আন্টি।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই সুলতানা আসে। তুবার কাছে এসে বলল,
“তুমিই তাসপিয়া আলম তুবা?”
তুবা সুলতানার দিকে তাকায়। বাদামী রঙের শাড়ি পড়া মধ্যবয়সী নারীকে দেখে তুবা মিষ্টি করে একটা সালাম দেয়,
“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি। আমিই তুবা।”
সুলতানা মুচকি হেসে বলল,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আমি আলিয়ারের মা আছিয়া।”
তুবা জোরপূর্বক মুচকি হাসার চেষ্টা করে। সুলতানা তুবা হাত ধরে নিয়ে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বলে,
“ওতো রোদে দাঁড়িয়ে থেকে মুখটা পুড়িয়ে ফেলেছো। যদিও তুমি বেশি একটা সুন্দর নও, কালো।”
শেষের কথাটা কিছুটা ব্যঙ্গার্থেই বলে সুলতানা। তুবার বেশ খারাপ লাগে কথাটা, তবুও চুপ থাকে। তুবা মাথানিচু করে আছে।
সুলতানা বাঁকা হেসে বলা শুরু করে,
“আলিয়ারের সাথে হয়তো তোমার পরিচয় বেশিদিনের নয়, আমি কি ঠিক?”
তুবা মাথানিচু করে নিচুস্বরে বলে,
“জি।”
“আলিয়ার কি তোমাকে কখনো বলেছে যে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে?”
তুবা এবারে মাথা তুলে সুলতানার দিকে তাকায়। সুলতানা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তুবা বড়বড় চোখে তাকিয়ে বলে,
“কি বলছেন আপনি আন্টি?”
“হুম, ওর বোন জিনাতের সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আলিয়ার নিজে এ বিয়ের কথা সবাইকে বলেছে। প্রায়শই জিনাতকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিতে যায় আলিয়ার, ছুটির দিনে ওকে নিয়ে বেড়াতেও যায়। ওদের সম্পর্কটা অনেক দূর চলে গেছে।”
তুবার মাথা ঘুরছে, ওর চোখের কোণেও পানি টলমল করছে। আড়চোখে একবার ওকে দেখে সুলতানা। সুলতানার বেশ হাসি পাচ্ছে তুবার চেহারা দেখে।
সুলতানা তুবার হাতে ধরে অনুনয়ের সুরে বলে,
“মা, তুমি তো আমার মেয়ের মতো। আমার ছেলেটার জীবনটা শেষ করে দিও না প্লিজ। চলে যাও ওর জীবন থেকে, জিনাতকে আলিয়ার আর আলিয়ারকে জিনাত খুব ভালোবাসে। দয়া করো মা, ওদের জীবন থেকে সরে যাও।”
তুবা চুপচাপ তাকিয়ে আছে সুলতানার দিকে। যদি আলিয়ার জিনাতকে ভালোবেসে থাকে তবে ওর সাথে কিসের সম্পর্ক ছিল? শুধুই টাইম পাস?
সুলতানা আবারো বলে,
“বলো মা, তুমি কি আমার ছেলেকে সুখী দেখতে চাও না?”
তুবা মাথানিচু করে নিজের হাতটা সুলতানার হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“আমি আলিয়ার জীবন থেকে সরে যাবো আন্টি। চিরকালের মতো চলে যাবো ওর জীবন থেকে।”
তুবা খুব কষ্টে নিজের কান্না নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। সুলতানা মুচকি হেসে তুবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“আমার লক্ষ্মী মা।”
বিকাল ৪ টা,
“আপনি কোথায়?”
“অফিসে।”
“ছুটি হবে কখন?”
“দেরি আছে, কেন? কোনো বিশেষ প্রয়োজন?”
“হুম, এখনই বের হন।”
মুগ্ধ হেসে উঠে জিনাতের কথায়। হাতের কলমটা দিয়ে মাথা চুলকে মুগ্ধ বলল,
“আমার তো আর তোমার ভাইয়ের মতো কোম্পানি নেই যে যখন খুশি বেরবো। এখন বের হলে চাকরী যাবে।”
“ওহ।”
মুগ্ধ ফোন কানে রেখেই নিজের কাজ করছে। জিনাত আবারো বলে,
“আমি আন্টির সাথে দেখা করতে চাই।”
মুগ্ধ শান্তভাবে বলে,
“করতেই পারো কিন্তু আজ নয়।”
“আজ নয় কেন?”
“আজ আম্মু বাসায় নেই, আব্বুও নেই। দুজনে দাদুর সাথে দেখা করতে গেছে।”
জিনাত বাঁকা হাসে। মুগ্ধ আবারো বলে,
“শুভও উনাদের সাথে গেছে, আজ বাসায় একা থাকতে হবে।”
“শুভ কে?”
“আমার ছোট ভাই।”
“ওহ”
কিছুক্ষণ পর জিনাত আবারো বলে,
“রাতে কি খাবেন?”
“আম্মু তরকারি রান্না করে ফ্রিজে রেখে গেছে আর আমি বাসায় গিয়ে ভাত রান্না করে নিবো।”
জিনাত বেশ খুশি খুশি হয়ে বলল,
“আমি রান্না করে নিয়ে আসি?”
মুগ্ধ জোর গলায় বলে,
“না”
“কেন?”
“পিচ্চি, ওসব তুমি বুঝবে না। তুমি আসবে না মানে আসবে না।”
জিনাত ভেংচি কেটে কল কেটে দেয়। মুগ্ধ মুচকি হেসে বলে,
“বাহ রে বাহ, কেটে দিল।”
জিনাত আবারো প্রত্যাশাকে কল দেয়। প্রত্যাশা রিসিভ করে বলে,
“কিরে, ওদিকের কি খবর?”
জিনাত জোরে হেসে বলল,
“খবর ভালো। এতো তাড়াতাড়ি সময় পাবো, তা ভাবতেও পারিনি।”
“কবে?”
“আজ উনি বাসায় একা থাকবেন, আর কেউই নেই।”
“তবে যা হওয়ার আজ রাতেই হবে।”
জিনাত ভয়ে ভয়ে বলে,
“যদি উনি খারাপ হয়?”
“তাতেও সমস্যা নেই, আমি ক্লাসের পুরো গ্যাং নিয়ে আসবো। বাসার কোণায় কোণায় ছড়িয়ে থাকবো আমরা। তুই কোনো চিন্তা করিস না।”
জিনাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“সব যেন ঠিকঠাক হয়।”
“হুম।”
জিনাত ফোন রাখে।
আজ প্রত্যাশার বুদ্ধি অনুযায়ী মুগ্ধের চরিত্র পরীক্ষা করতে যাবে জিনাত। মুগ্ধ কি সত্যিই ওকে ভালোবাসে কিনা তাই যাচাই করবে ওরা। একা বাসায় কোনো মেয়ের সাথে কেমন আচরণ করবে মুগ্ধ এর প্রমাণ চায় ওরা।
কিন্তু এরকম সন্দেহ করে জিনাত কি ওদের সম্পর্কটা নষ্ট করে দিচ্ছে না? অকারণে সন্দেহ করে এমন নোংরা পরিকল্পনা করার মানে কি? আরেকবার প্রত্যাশার পরিকল্পনায় কাজ করতে যাচ্ছে জিনাত।
.
চলবে….
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com