শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -০৩
অনুর কথার কোনো জবাব না দিয়েই অজ্ঞান হয়ে যায় তুবা। অনু ওকে ধরেই বুঝতে পারে গায়ে আবারো ঘুম জ্বর এসেছে তুবার।
অনু তুবাকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠে,
“আম্মু, তুবা অজ্ঞান হয়ে গেছে।”
“তুবা”
তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বেরিয়ে আসে তওবা ও মহসিন।
মহসিন এসে তুবাকে সোফায় বসিয়ে মাথায় পানি দেয়া হয়। পানি খাইয়ে সোফায় শুইয়ে দেয়ার অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে তুবার৷ চোখ পিটপিট করে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারে যে সে বাসায় আসে।
অনু তাজিমকে কল করে বলে,
“তুবামণি বাসায় ফিরে এসেছে, ওর শরীর খুব খারাপ। অজ্ঞান হয়ে গেছে। তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি বাসায় এসো।”
বলেই কান্না করে দেয় অনু।
“আমি আসছি, অনু। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি। তুমি চিন্তা করো না।”
“হুম”
অনু ফোন রেখে তুবার কাছে গিয়ে ফ্লোরে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ওর সন্তান হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে৷
“পানি খাবো।”
তুবার কথা শুনে তাড়াতাড়ি করে ওর হাতে পানির গ্লাস দেয় অনু৷ তওবার কথায় তুবার নাস্তা আনতে রান্নাঘরে যায় অনু।
তুবা পানি পান করে সোফায় গা এলিয়ে দেয়৷ হঠাৎ মনে পড়ে সেই ছেলেটার কথা। ফরমাল ড্রেসে অসাধারণ লাগছিল তাকে, যদিও ঠিকমতো দেখতে পারেনি সে। কত হবে ছেলেটার হাইট? ৫.৫ ফুট নাকি আরো বেশি। তুবা নিজেই তো ৫.৪ ফুট। এটা ভেবে নিজের ভিতর একটু গর্ববোধ করে তুবা৷ একটা ছেলেও ওর সমান হতে পারে৷
কিছুক্ষণ পর তাজিম বাসায় আসে। তুবা সোফায় বসে পরোটা-ডিম খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। তাজিম বাসায় ঢুকে একবার তুবার দিকে তাকায় আর একবার অনুর দিকে তাকায়।
অনু কিছু বলতে নিলেই তুবা বলে,
“ভাবি একটু বেশি বেশি ভাবে৷ আমার তেমন কিছুই হয়নি।”
বলেই এক টুকরা পরোটা মুখে পুরে নেয়।
তওবা এগিয়ে এসে বলে,
“ঘরে ঢুকেই অজ্ঞান হয়ে গেছে৷ কাল থেকে অসুস্থ আর সে বলছে কিছুই নাকি হয়নি।”
তাজিম মুচকি হেসে বোনের পাশে বসে বলে,
“আমার বোনটা এখন বড় হয়েছে। তাই তো সারা রাস্তা একা একা চলে এসেছে, রাস্তায় তো আর পড়ে যায়নি।”
তুবার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেটা যদি আজ বাসায় পৌঁছে না দিতো তবে তো রাস্তায়ই পড়ে থাকতে হতো। ছেলেটা সত্যিই হয়তো বিশ্বাসযোগ্য।
অন্যদিকে,
ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারছে না জিনাত। আজ আলিয়ারের সাথে ভার্সিটিতে এসেছে এটা ভাবতেই শিউরে উঠছে ও। আলিয়ারের বাইকে, ওর পিছনে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে থাকার অনুভূতিটা কেবল জিনাতই জানে। ওর জায়গায় অন্যকেউ হলে তারও কি একই অনুভূতি হবে? না, তা কেন হবে? আলিয়ারকে কি ওর মতো করে কেউ ভালোবাসবে? কখনোই না।
স্যার ধমক দিয়ে বলে,
“জিনাত।”
জিনাত চমকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“জি, স্যার।”
“মনোযোগ কোথায় তোমার?”
জিনাতের ঠোঁট কাঁপছে৷ কি বলবে বুঝতে না পেরে মাথানিচু করে ফেলে জিনাত। স্যার বলে,
“বসো।”
জিনাত চুপচাপ বসে পড়ে। আলিয়ারের সাথে কথা বলার জন্য মনটা উশখুশ করছে ওর। কিন্তু এখন তো তা সম্ভব নয়৷ বাসায় গিয়ে রাতের খাবারের পরেই ওর সাথে কিছুটা ঝগড়া আর কিছুটা খুনশুটি হবে।
দুপুরে,
আলিয়ার অফিসে কাজ করছে, কিন্তু মনোযোগ দিতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। কি করে দিবে আজ সকালেই যে এক অচেনা মেয়ে তার মনে অচেনা অনুভূতি জাগিয়ে দিয়ে গেছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সেই মেয়েটার মুখটা মনে করছে আলিয়ার। অসুস্থ ছিল তবুও তার মুখে কি রাগটাই না প্রকাশ পেয়েছে। কালকে বৃষ্টিতে ভেজা মেয়েটার সাথে আজকের মেয়েটার অমিল ছিল অনেক।
এমনসময় ওর কেবিনে আসে তাজিম। দরজায় নক করে বলে,
“May I come in, sir?”
আলিয়ার চমকে উঠে দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,
“Yes, come in.”
তাজিম কেবিনে ঢুকে আলিয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“স্যার, আজ দ্বিতীয় সেশনে অফিসে এসেছি। এই যে এপ্লিকেশন।”
একটা কাগজ আলিয়ারের দিকে এগিয়ে দেয়। আলিয়ার কাগজটা খুলে পড়তে শুরু করে। পড়া শেষে তাজিমকে বলে,
“তারমানে আপনার বোন অসুস্থ থাকায় আপনি দেরিতে এসেছেন?”
“জ্বি, স্যার।”
“ঠিক আছে, আপনি নিজের কাজে যান।”
তাজিম চলে যায়। আলিয়ার আবারো নিজের কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করে। কঠিন হলেও চেষ্টাটা চালিয়ে যায় সে।
১ মাস পর,
“Phoolon ka taron ka sabka kehna hai
Ek hazaron mein meri behna hai
Saari umar hamein sang rehna hai
Phoolon ka taron ka sabka kehna hai
Yeh na jana duniya ne
tu hai kyon udaas
Teri pyaasi aankhon mein
pyaar ki hai pyaas
Hye yeh na jana duniya ne
tu hai kyon udas
Teri pyaasi aankhon main
pyar ki hai pyas
Aa mere paas aa keh jo kehna hai
Ek hazaron mein meri behna hai
Saari umar hamein sang rehna hai
Phoolon ka taron ka sabka kehna hai”
তুবার মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর গান গাইছে তাজিম। বোনের তো বায়নার শেষ নেই। আজ নাকি ঘুম আসছে না, তাই ভাইকেই দায়িত্ব নিতে হলো ঘুম পাড়ানো। তুবা চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। তাজিম মুচকি হেসে ওর কপালে চুমো দিয়ে উঠে যেতে নিলেই ওর হাত টেনে ধরে তুবা।
চোখ বন্ধ করেই তুবা বলছে,
“ভাইয়া, আমার সাথে থাকো।”
মুচকি হেসে হাতটা ছাড়িয়ে লাইট বন্ধ করে নিজের রুমে যায় তাজিম। ঘুমের ঘোরে ভাইকে ডেকেছে, তা কি ভাই বুঝেনা?
অন্যদিকে,
ছাদে বসে আছে আলিয়ার ও জিনাত। দুজনেই গল্পে মশগুল, গল্পের টপিকে আলিয়ারের অফিস, জিনাতের ভার্সিটির কথাই বেশি। দুজনে প্রতিযোগিতা করে হাসাহাসি করছে।
কিছুক্ষণ পর মায়ের ডাকে উঠে দাঁড়িয়ে আলিয়ার বলল,
“একটু আসছি।”
“হুম”
আলিয়ার নিচে চলে যায়।
এই সময়টাই জিনাত সবচেয়ে বেশি ইনজয় করে। আলিয়ারের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত ওর কাছে আনন্দের লাগে।
আলিয়ার নিজের ফোনটা ছাদেই রেখে গেছে, ফোনে কল আসে। জিনাত ছাদের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে আলিয়ার নেই। ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে ভেসে থাকা ‘Mugdho’ নামটা দেখে ফোন রেখে দেয় জিনাত। বেজে বেজে কলটা কেটে যায়।
কিছুক্ষণ পর আবারো কল আসে। জিনাত দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
“অসহ্য।”
এবারেও কলটা কেটে যায়। আবারো কল করে মুগ্ধ। এবারে জিনাত রিসিভ করেই বলে,
“রিসিভ করা হচ্ছে না তার মানে যাকে কল দিয়েছেন সে বিজি আছে। এইটুকু কথা বুঝতে কতসময় লাগে আপনার?”
হঠাৎ এমন কথা আর এমন কন্ঠে ভ্যাবাচ্যাকা খায় মুগ্ধ। মুগ্ধ একটা কাশি দিয়ে বলে,
“আলিয়ার তো আনমেরিড, তাহলে আপনি কে?”
“জিনাত।”
“ওওও, পিচ্চি।”
“Don’t say picci.”
মুগ্ধ চুপ করে মুচকি হাসছে। জিনাতও চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ নিজে থেকেই বলে,
“আলি কোথায়?”
“চাচীআম্মুর সাথে কথা বলছে।”
মুগ্ধ বেশ ভণিতা করে বলে,
“আলি যদি জানতে পারে তুমি আমার সাথে ঝাড়ি দিয়ে কথা বলেছো, তবে কি হবে?”
“কি হবে?”
“ও তোমার আম্মুকে বলে দিবে আর তারপর…”
বলে মুগ্ধ থামে।
জিনাত একটা ঢোক গিলে বলল,
“তারপর?”
“তারপর তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। কারণ মেয়েরা অবাধ্য হলে আমাদের দেশে এই শাস্তিটাই দেয়া হয়।”
বিয়ের কথা শুনেই ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে জিনাতের। মুগ্ধ বলে,
“আমি না বললে কি জানবে না।”
জিনাত ভয়ে ভয়ে বলল,
“সরি, প্লিজ কাউকে এ ব্যাপারটা বলবেন না।”
“একটা শর্তে।”
“কি?”
“মানতে হবে।”
“আগে বলুন।”
“আমার নাম্বারটা নিজের ফোনে নাও আর আমাকে মিসড কল দাও।”
এবারে জিনাত রেগে যায়,
“কখনোই না।”
“তবে আমি আলিকে বলে দিবো।”
“না, আলিয়ারকে বলবেন না প্লিজ।”
“তবে যা বলছি…”
মুগ্ধের কথা শেষ হওয়ার আগেই কলটা কেটে যায়।
আলিয়ার এসে ছোঁ মেরে জিনাতের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেয়। কিছু রাগীকন্ঠে বলল,
“কি দেখিস ফোনে?”
জিনাত অপরাধীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“মি. মুগ্ধ কল করেছিল। বারবার কল আসছিল তাই রিসিভ করলাম।”
“ওহ।”
আলিয়ার বসে পড়ে। ওর চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে ও প্রচন্ড রেগে আছে। জিনাত ওকে ধাক্কা মেরে বলল,
“কি রে গাল ফুলে আছে কেন?”
আলিয়ার ওর দিকে ফিরে বলে,
“দেখ আমাকে।”
জিনাত ওর আপাদমস্তক দেখে একটা হাই তুলে বলল,
“দেখলাম।”
“আমাকে দেখে কি বুড়া মনে হচ্ছে?”
ওর কথা হো হো করে হেসে দেয় জিনাত। আলিয়ার চোখ ছোটছোট করে তাকায়। জিনাত হাসি থামিয়ে বলে,
“এ কেমন প্রশ্ন?”
“আগে উত্তর দে।”
আলিয়ারের কথায় রাগ স্পষ্ট।
জিনাত মুচকি হেসে জবাব দেয়,
“মধ্যবয়স্ক পুরুষের মতো লাগছে।”
আলিয়ার রেগে ওর গাল চেপে ধরে বলে,
“কি বললি?”
“হু, বয়স তো কম হয়নি তোর।”
জিনাতের গাল ছেড়ে দিয়ে বলে,
“বয়স আমার মাত্র ২৮।”
“২৮, মাত্র? তো বল না তোর বয়স ৮ বছর। না না, ৮ মাস বলতে পারিস। ৮ দিন বললেও বলতে পারিস। আবার ৮ ঘন্টা বা ৮ মিনিটও বলতে পারিস।”
এমনিতেই আলিয়ারের মেজাজ খারাপ, তার উপর জিনাতের এসব আজাইরা আলাপে আরো খারাপ হয়ে গেছে। রেগে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“দেখ জিনাত, আজাইরা পেঁচাল ভালো লাগছে না।”
“কি হয়েছে রে? তুই এমন উদ্ভট প্রশ্ন করলি কেন?”
আলিয়ার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আম্মু আর চাচী মিলে আমার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছে। আচ্ছা বল, এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করে জীবনটা পানি পানি করার কোনো মানে হয়?”
আলিয়ারের বিয়ের কথা শুনেই কিছুটা চুপ হয়ে যায় জিনাত। আলিয়ারের বিয়ে হওয়া মানে ওর থেকে অনেকটা দূরে চলে যাওয়া। তখন আর এভাবে কথা হবে না, গল্প হবে না, খুনশুটি হবে না।
আলিয়ার ওর মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে ওর ভাবনার ছেদ করে। আলিয়ার আবারো বলল,
“আমি তো বলে দিয়েছি জিনাত আর জেরিনের বিয়ে না দিয়ে আমি বিয়ে করবো না।”
জিনাত অসহায় দৃষ্টিতে আলিয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। আলিয়ার জোরে জোরে হাসছে আর জিনাত মুগ্ধ হয়ে সেই হাসি দেখছে। কেন এতো সুন্দর করে হাসছে সে?
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com