এক প্রতিবাদী নারীর জীবন যুদ্ধের গল্প । পর্ব- ৪৩
মৌরি মনে মনে ভাবছে, সবক্ষেত্রে পুরুষের থেকে একটা মেয়েই আরেকটি মেয়ের বড় শত্রু।
ছেলের বৌ যৌতুক আনতে না পারলে স্বামী ছাড়াও শ্বাশুড়ির ও ননদের হাতে বৌকে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতে হয়।
সেখানেও একজন নারী আরেকজন নারীর কাছে অত্যাচারিত হতে হচ্ছে।
একজন মেয়ে অফিসে আদালতে কাজে উন্নত করছে তা দেখে পুরুষ সহকর্মীর থেকে তার অফিসের মেয়ে সহকর্মীটায় হিংসেয় জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায়।
সেক্ষেত্রে নারীই হচ্ছে নারীর শত্রু।
এই সমাজে কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের কাছে একজন মেয়ে যতটা নির্যাতিত হয় তার থেকে বেশি নির্যাতিত হতে হয়, শ্বাশুড়ি,ননদ,ঝা রূপি কিছু নারীদের হাতে।
একজন মেয়ে যতই সাবলম্বী হোক না কেন!
তাকে নির্যাতন সহ্য করতেই হয় এটা যেনো সমাজের নিয়ম হয়ে গেছে।
ছেলে খারাপ সমস্যা নেয় মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছো যেহেতু তাই মানিয়ে নিতেই হবে।
ছেলে নেশা করে বাসায় এসে মারধর করে সমস্যা নেয় ,আরে ছেলে মানুষ একটু আধটু এমন হয় এতে দোষের কিছু নেয়।
তোর বাবাও তো বয়স কালে কতকিছু করেছে আমি মানিয়ে নেয়নি।
আজ যদি তোর মতো ভাবতাম তাহলে তোরা কোথায় থেকে আসতি ভেবেছিস?
আর তোরা কিছু হলেই শুরু করিস ছেলে না, সংসার করবো না এসব না বলে বরং তুইও মানিয়ে নে।
এখানে মায়েদের মূল কথা হচ্ছে, আমি অন্যায় অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে সংসার করতে পারলে আমার মেয়ে হয়ে তুই পারবি না কেনো ?
কিন্তু কিছু কিছু মায়েরা এটা কেন বুঝতে পারে না,তারা নিজেদের অজান্তেই একটা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
আর নির্যাতিত মেয়েটা আস্তে আস্তে বুঝতে পারে মা’কে বাড়িতে বলে লাভ নেয় মা-বাবা তো মানিয়ে নিতেই বলবে।
তাহলে না বলে সে চেষ্টাই করি।
অবশ্য সব মায়েরা এক নয়।
কিছু কিছু মা আছে যারা সন্তানদের ন্যায় দিতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়াই করেন।
আমাদের এই সমাজে,
ছেলে ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার, অভিনেতা , চাকরিজীবী, ব্যাবসায়ী বা যায় হোক না কেন।
তার কাজ নিয়ে কোনো কথা শুনতে হয়না বাড়িতে।
সে রাতে যদি কাজের নাম করে সে বাড়ি না ফিরে তাও সমস্যা নেয়।
উল্টো দেখা যাবে,কাজের নাম করে ছেলে সারারাত আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরলেও তার সেবার জন্য মা বৌ ব্যাস্ত হয়ে পড়বে ।
কিন্তু বাড়ির বৌ’দের কাজের জন্যেও যদি একদিন বাড়ি ফিরতে দেরী হয়।
তাহলে মেয়েটার কপালে জুটে লাঞ্ছনা গঞ্জনা।
মেয়েটিকে শ্বাশুড়ির কাছে থেকে অপমান অপদস্থ হতে হয়।
স্বামী শ্বশুড়ের কাছে থেকে মিলে লাঞ্ছনা গঞ্জনা ।
সেটা হোক উচ্চবিত্ত,মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত সব জায়গাতেই মেয়েদের বৈষম্য শিকার হতে হয়।
অবশ্য এই বৈষম্যের মূলেও একজন নারীই জরিত থাকে।
সমাজের এই বৈষম্যে কখনো বদলানোর সম্ভব নয় যতক্ষণ না আমরা নিজেদের পরিবর্তন করছি।
অবশ্য সমাজের বাস করা সব নারী এক রকম নয়।
সমাজে যেমন,শানের মা,চাচীর ও সাজ্জাদের বৌয়ের মতো মানুষের অভাব নেয়।
তবে এমনও কিছু নারী আছেন যাদের ত্যাগ ও আদর্শের কারণে পৃথিবীতে চির স্মরণীয় হয়ে আছে।
তাছাড়া এই সমাজে কিছু কিছু শ্বাশুড়ি আছে যারা ছেলের বৌকে মেয়ের মতো দেখে ।
সবাই তো আর মৌরির সতীন এবং শ্বাশুড়িদের মতো মানুষ না।
মৌরি কথাগুলো ভাবছিল সে সময়ে সাজ্জাদের বৌ রেবা লিলির উপরে জোরে চিৎকার করে উঠল।
আর মুখে যা আসছে তায় বলে শ্বাশুড়ির সাথেও ঝগড়া করছে।
মৌরি তা দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না।
এই মেয়ে বাড়ির পরিবেশ নষ্ট করছে মৌরি তো তা হতে দিবে না।
ভাগ্যিস মেহরাব বাসায় নেয় , রেশমা ও রোহানের সাথে ঢাকা গিয়েছে।
রেশমা ও রোহানের বিয়ে হয়েছে চার মাস হয়েছে।
রেশমা এখন বেশিভাগ ঢাকা রোহানের বাড়িতে থাকছে।
কারণ রেশমা মনে করে রোহান যেহেতু ওর কথা ভেবে ওদের গ্রামে রেশমার জন্য বাড়ি করছে তাহলে রেশমা ও তো রোহানের কথা ভেবে বাড়ি তৈরি হওয়া না পর্যন্ত রোহানদের বাড়িতে থাকা উচিত।
তাই রেশমা ওর শ্বাশুড় বাড়িতে আছে এখন।আর মেহরাব তো তার মামণিকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হয় আর তার মামণির জান হচ্ছে মেহরাব তাইতো দুটোর কথা চিন্তা করে মৌরি মেহরাবের রেশমার সঙ্গে থাকার অনুমতি দিয়েছে।
তাছাড়া মৌরি হসপিটাল ও এনজিওর কাজে বেশিভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে হয়।
আর এই বাড়িতে কিছু এমন মানুষও আছে যারা সবসময় সুযোগ খুঁজে তার এবং তার পরিবারের ক্ষতি করার।
এটাও একটা কারণ মেহরাবকে রেশমার সাথে যেতে দেওয়ার।
এছাড়া রেশমার শ্বশুড় তো মেহরাবের ভক্ত হয়ে গেছে।
মানুষটা মেহরাবকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে ,খেলা করছে ।
মোট কথা যতক্ষণ বাসায় থাকে মেহরাবকে নিয়ে মেতে থাকে।
এইতো সেদিন আঙ্কেল মানে রেশমার শ্বশুড় মৌরিকে ফোন করে বললেন,মা দাদু সোনা এতো গুছিয়ে কথা বলে যে ওর কথা শুনে আমি ফিদা হয়ে যায়।
তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ওকে এখানে আসতে দিয়েছো সেজন্য।
মৌরি রেশমার শ্বশুড়ের কথা শুনে লজ্জা পেয়েছে, তবে মনে মনে খুশি হয়েছে এ ভেবে মানুষটি কতটা ভালো তা ভেবে।
রেশমা ছোট থেকে যত কষ্ট করেছে তার প্রতিদানে আল্লাহ ওর বোনকে এমন,স্বামী , শ্বশুড় বাড়ি পেয়েছে।
সেজন্য মৌরি মনে মনে আল্লাহকে আবারো শুকরিয়া আদায় করছিল সে সময়ে রেশমার শ্বশুড় বলে উঠল,
মৌরি মা,আমি তো মনে দাদু ভাইকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
তাই মাঝে মাঝে তোমার বাড়িতে এসে হাজির হবো।
তখন এই বুড়ো ছেলেকে একটু জায়গা দিও।
মৌরি রেশমার শ্বশুড়ের কথা শুনে চোখে পানি এসে যায়।
সাথে সাথে বলে, আঙ্কেল মেয়ের বাসায় বাবা আসবে এতে তো মেয়ে খুশিই হবে।
তাই না? কথাটা বলে,
মৌরি মনে মনে ভাবছিল , রিফাত, রোহান ও আঙ্কেলের কাছে থেকে মেহরাব যে আদর পাচ্ছে তা তো শানের পরিবারের কাছে থেকে পাওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু তাদের কাছে থেকে আদর ভালোবাসা তো দূরের কথা একটু ভালো ব্যাবহার ও পায়নি তার ছেলেটা।
অবশ্য সাদ ও শান সব সময় মেহরাবকে আদর করতে মুখিয়ে থাকে মৌরি তাদের সু্যোগ দেয় না।
মৌরি মাঝে মাঝে যখন এটা ভাবে, রিফাতের মতো ভালো ছেলে ওকে এতো ভালোবাসে তা জানা সত্ত্বেও রিফাতের জন্য সম্মান ছাড়া তার মনে আর কিছু নেয়।
মৌরি ভালো লাগে না এটা ভাবলে যে রিফাত ভাই ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে
তা ভেবে ওর ও কষ্ট হয়। মৌরি ভেবেছে, এবার সে দায়িত্ব নিয়ে রিফাত ভাইয়ের জীবনে কাউকে এনে দিবে।
এভাবে আর কয়দিন!
তাছাড়া আর কয়েক মাসের মধ্যে রোহানদের বাড়ি কমপ্লিট হয়ে যাবে।
তখন যা করার করতে হবে।
মৌরি এসব ভেবে মনে মনে নিজেকে বকা দিচ্ছে তার ভাবনা কোথায় থেকে কোথায় গেছে।
তাছাড়া এগুলো নিয়ে পড়ে চিন্তা করবে।
এই মেয়েকে আগে কিছু বলা দরকার।
দু’দিন পর মেহরাব বাসায় আসবে তখন এসব তার ছেলের উপরে খারাপ প্রভাব ফেলবে।
কথাটা ভেবেই মৌরি রেবাকে ধমকে বললো,এই মেয়ে চুপ।
এটা কি মাছের বাজার পেয়েছো সকাল শুরু হলেই প্রতিদিন চেঁচামেচি শুরু করো?
আর এমন করলে, বাসায় থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।
এটা ভদ্র লোকের বাড়ি কথাটা মনে রাখবে।
রেবা মৌরির কথাটা শুনে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে।
রকি জেলে পঁচতেছে শুধু মাত্র এদের জন্য।
বিশেষ করে মৌরি রকিকে যে কেলানি দিয়েছে এবং তার কথাতেই পুলিশ রকিকে ধরে নিয়ে গেছে।
কথাটা ভাবলেই রাগে রেবার রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে।
রেবা এখানে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ,মৌরিকে শেষ করা।
রেবার বাবা ভাইকে ছাড়াতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বুদ্ধি করে তার মেয়েকে এখানে পাঠিয়েছে ।
রেবার বাবা রেবার মাধ্যমে মৌরি বিষয়ে সব খোঁজ খবর নেয় যাতে সময় মতো মৌরিকে কঠিন শাস্তি দিতে পারে তার ছেলেকে জেলে দেবার।
রেবা মনে করে তার ভাইয়ের এমন অবস্থা করেছে যারা তাদের এই পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার নেয়।
তাইতো এখানে আসার পর থেকে লিলির উপরে চড়াও হচ্ছে।
অবশ্য এখানে আসার আগে থেকেই সে প্লান করে এগিয়েছে।
রেবা তো এখানে আসার আগে লিলির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতো।
রেবা লিলিকে বুঝাতো তার স্বামী ও ছেলেরা কষ্ট করে রোজগার করছে।
আর তার ভাসুর সে টাকায় পুরো পরিবার নিয়ে গিলতে থাকলে ভবিষ্যৎ এ তাদের অবস্থান আরও খারাপ হবে।
তাছাড়া মেহরাব যেহেতু শানের সন্তান একদিন না একদিন বাবার কাছে ফিরবে।
তখন মেহরাবের সম্পদের অংশের সুখ তো শান
এবং তার মা বোনরা পাবেন। তখন লিলি এবং তার পরিবারের কী হবে?
তখন যদি শৈলী তাকে বাড়িতে থেকে বের করে দেয় তাহলে সে বয়সে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলবে কোথায়?
সেজন্য এখন থেকে লিলি বেগমকে শক্ত হতে হবে।
নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করতে হবে।
রেবার এমন কঠিন কথা শুনে লিলির পছন্দ হয়। তারপর থেকে লিলি শৈলীর সাথে খারাপ আচরণ করতে থাকে। যা কারণে শৈলী সহ্য করতে না পেরে স্টোক করে বিছানায় পড়ে আছে।
রেবা জানতো লিলি ও শৈলী এক থাকলে সে প্রতিশোধ নিতে পারবে না।
তাইতো লিলিকে তার স্বার্থ দেখিয়ে শৈলী থেকে আলাদা করে দেয়।
এখন শৈলী কে শয্যাসায়ী দেখে রেবা মনে মনে ভীষণ খুশি।
আরোও খুশি সামনে অপেক্ষা করছে, যেদিন লিলির অবস্থাও এমন করবে।
তারপর বাকি থাকবে শুধু মৌরি।
অবশ্য মৌরিকে সে ইচ্ছে করলেও কিছু করতে পারছে না।
এখানে থেকে সে মৌরিকে শায়েস্তা করতে পারবে না তা ভালোই বুঝতে পারছে।।
এটা তার বাবাকেই করতে হবে।
কথাটা ভেবে মুচকি হেসে মৌরির দিকে তাকিয়ে বললো,সরি আসলে আপনাদের কথা খেয়াল ছিল না।
খেয়াল থাকলেও যা বলার রুমেই বলতাম।
কথাটা বলে চলে যায়।
এদিকে মৌরি রেবার মুখে মুচকি হাঁসি দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে,
এই হাসির মাঝে কিছু একটা ছিল যা সে ধরতে পারছে না।
তার মন বলছে এই মেয়ে দেখতে যেমন ভিতরে ভিতরে হয়তো তার থেকে,,,
চলবে….
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com