ভালোবাসি তাই । পর্ব -২০
আজ সকালে আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি।তখনই সায়ন ভাইয়া এলেন।
ওনার যেন এখন এটাইকাজ সবসময় আমার পেছন পেছন ঘুরবেন।
আমি এমানুষটাকে কখনোই ভালোবাসিনি। আমি তো সেইসায়ন ভাইয়াকে ভালোবাসতাম যার
পারসোনালিটিছিল অন্যরকম। আমার পেছন পেছন ঘুরাটা ওনাকেএকদমই মানাচ্ছে না।
কি করবো ওনাকেও তো বুঝতেহবে আমার কতটা কষ্ট হতো যখন ওনি খারাপ ব্যবহারকরতেন আমার সাথে।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিযেন ওনাকে দেখতেই পাইনি। ওনিও আজ কেমনচুপচাপ।
বুঝলাম না ওনার আবার কি হলো? আমারদিকে না তাকিয়েই বলল,
– তোর সাথে যখন আমি খারাপ ব্যবহার করতাম তোরখুব কষ্ট হতো তাই না মালিহা?
ওনার শান্ত গলা শুনে আমার কেমন জানি ভয়লাগলো। এভাবে কেন কথা বলছেন ওনি?
আমি ওনারদিকে একবার তাকালাম। আবার চোখ ফিরিয়েনিলাম। ওনি আবার নিজে থেকে বলতে লাগলো,
– আমি জানি তোর খুব কষ্ট হতো। কারণ আমি আগেযেমন ব্যবহার করতাম তোর সাথে তুই এখন ঠিকতেমন ব্যবহারই করছিস আমার সাথে । আমার খুবকষ্ট হচ্ছে জানিস খুব কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়তোর সামনে আর আসবো না পরক্ষণেই মনে হয় আমিতোকে খুব ভালোবাসি। তুই যতই আমাকে দূরে ঠেলেদিস না কেন আমি তো তোর কাছেই ফিরে আসবো।
ঠিক তুই যেমন আমার জন্য বেহায়া হয়েছিস দরকারপরলে আমিও তেমনি হবো। তবুও আমার তোকেইচাই।
আমি ওনার কথা শুনে কিছুই বললাম না। ওনি আমারহাতটা ধরে বললেন,
– একটা কবিতা শুনাবি মালিহা? তোর ওসব আজগুবিকবিতাই শোনা।
– আমি কি কবি নাকি যে কবিতা শোনাবো?
– নাহ কবি না কোনো কালে ছিলিস ও না। তবে তোরকবিতাগুলো তো আমায় নিয়েই লিখতি তাই না? আজযখন সেই মানুষটাই তাকে নিয়ে লেখা কবিতা শুনতেচাইছে তোর তো উচিত শোনানো তাই না?
– আমার এখন ওসব কিছু লিখার ইচ্ছেও নেই সায়নভাইয়া। সেই মনটা এখন আর নাই। তাই চাইলেওবানাতে পারি না কবিতা।
– তাহলে একটা গান শোনা প্লিজ।
– আপনিও তো গান পারেন আপনিই শুরু করেন।
– আমি শুরু করলে তুই গাইবি আমার সাথে?
– পারলে গাইবো।
– ওকে শুরু করছি তাহলে।
– হুমমম।
” তোমার ইচ্ছেগুলো,, ইচ্ছেগুলো,,,
তোমার ইচ্ছেগুলো ইচ্ছে হলে আমায় দিতে পারো
আমার ভালো লাগা ভালোবাসা তোমায় দেব আরো
( সায়ন ভাইয়া)
তুমি হাতটা শুধু ধরো আমি হবো না আর কারো (।।)
তোমার স্বপ্নগুলো আমার চোখে হচ্ছে জড়সড়।
(আমি)
তোমার ইচ্ছেগুলো,,, ইচ্ছেগুলো
তোমার ইচ্ছেগুলো ইচ্ছে হলে আমায় দিতে পারো
আমার ভালো লাগা ভালোবাসা তোমায় দেব আরো
(সায়ন ভাইয়া)
সায়ন ভাইয়া হঠাৎ গান থামিয়ে আমার হাতটা ধরলো।আমি ওনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই ওনিএকটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, কথা দিয়েছিস কিন্তুআমি তোর হাত ধরলে তুই অন্য কারো হবি না। মানেতুই শুধুই আমার।
ওনার মুখে এমন রোমান্টিক কথা শুনে যেন আমারহার্টবিট একবার মিস করে গেল । ওনি তার মানে ইচ্ছেকরেই আমাকে ফাঁসানোর জন্য গানটা গেয়েছেন।আমি কিছু বললাম না ওনাকে। ওনার দিকে তাকাতেওআমার লজ্জা লাগছে। আমি হাত ছাড়িয়ে রুমে চলেএলাম।।
এর দুদিনপর বিকেলে দেখলাম আমাদের বাসারসামনে একটা ফুসকাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে।
আমি তোআগে থেকেই ফুসকার পাগল। চোখের সামনে ফুসকাদেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না। ব্যালকনিথেকে ফুসকাওয়ালাকে দেখেই দৌড়ে নিচে নেমেআসলাম।
আমার পেছন পেছন আপুও বেরিয়েআসলো আমি কোথায় যাচ্ছি সেটা দেখার জন্য।
আমার সেদিকে আর কোনো খেয়াল নেই। আমিগিয়েই ফুসকা খাওয়া শুরু করে দিলাম।
অনেকদিনপর ফুসকা খাচ্ছি তাই অনেক মজা লাগছে আমার।
ইচ্ছেমত তৃপ্তি মিটিয়ে আমি ফুসকা খেলাম।
পেছনেরদিকে তাকিয়ে দেখি আপু আমার দিকে চোখ বড় বড়করে তাকিয়ে আছে।
আসলে আজকে অনেক বেশিইফুসকা খেয়ে ফেলেছি।
ফুসকাওয়ালা মামাকে টাকাদিয়ে আপুকে কিছু না বলেই রুমে চলে এলাম।।
– মালিহা কই তুই?
সকালে পড়ার টেবিলে বসে আছি তখনই সায়ন ভাইয়াআমার রুমে প্রবেশ করলো। আমাকে ডাকতেডাকতে। আজ এত সকালবেলা আসার কারণবুঝলাম না। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওনার দিকেতাকাতেই ওনি বলতে লাগলেন,
– চল ড্রয়িংরুমে চল।
– কেন?
– সেটা গেলেই দেখতে পাবি।
– আগে বলুন কেন তারপর যাবো।
– ধুর তুই এখানেই বসে থাক। মনে হয় যেন আমিতোকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলবো।
এটা বলেই সায়ন ভাইয়া রুম থেকে চলে গেল। আমিঅবাক হয়ে ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।আজ ওনার এত রেগে যাওয়ার কারণটা বুঝলাম না।সায়ন ভাইয়া যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ভাইয়া রুমেআসলো।
– কিরে তোকে না সায়ন ড্রয়িংরুমে যেতে বলেছে? তুইগেলি না কেন?
– আচ্ছা ভাইয়া তোমাদের হয়েছেটা কি আমাকে একটুবলবে? সবাই আজ আমাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে যাওয়ারজন্য উঠেপড়ে লাগলে কেন?
– কারণ বিষয়টা তোকে নিয়েই। তাই তোকে যেতেইহবে। তুই তাড়াতাড়ি আয় আমরা সবাই তোর জন্যঅপেক্ষা করছি।
ভাইয়া চলে যাওয়ার পর আমিও ভাইয়ার পেছনপেছন রুম থেকে বের হলাম।
আসলে আমার খুবইকৌতুহল হচ্ছে আমায় নিয়ে কি বিষয় সেটা জানতে।রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই আমারচোখদুটো ছানাবড় হয়ে গেল। কারণ আমার সামনেইরাম ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।
তার পাশেই একজনহ্যান্ডসাম পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।
আসলে আমারএক্সিডেন্টের কারণে এ বিষয়টা নিয়ে থানায় একটাসাধারণ ডায়েরি করতে হয়েছে।
পুলিশরা আমায়নানান জিজ্ঞাসা বাদ করেছে আমি কেন ওখানেগেলাম ইত্যাদি জানার জন্য? তখনি ইরাম ভাইয়ারমেসেজের কথা ওনাদের বলেছিলাম। আর এরপরথেকে ইরাম ভাইয়া নিখোঁজ হওয়ার কারণে পুলিশদেরসন্দেহ ওনার উপরেই ছিল।
কিন্তু আমি কখনোইবিশ্বাস করিনা যে ইরাম ভাইয়ার আমার এক্সিডেন্টেরসাথে কোনো সম্পর্ক আছে।
তবে এতদিন যে পুলিশইন্সপেক্টর এই কেসের সাথে জড়িত
ছিলেন আজতিনি না অন্য একজন পুলিশ এসেছেন। দেখেই মনেহচ্ছে ওনি সায়ন ভাইয়াদের বয়সেরই হবেন।
আমারএই ইন্সপেক্টরকে নিয়ে এতকিছু ভাবার কারণ হচ্ছেআপু আর
এই ইন্সপেক্টর সেই কখন থেকেই একেঅপরের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমার মনে হচ্ছে এরাদুজন আগে থেকেই একে অপরকে চিনে। আপুরচোখদুটো ছলছল করছে। কেন সেটা আমার বোধগম্যহলো না। পুলিশ ইন্সপেক্টরের পোশাকে নাম লেখা
মো: মেহরাব। তার মানে এই পুলিশের নাম মেহরাব।
– তুই কেন ঐদিন মালিহাকে পার্কে ডেকেছিলি?
সায়ন ভাইয়ার প্রশ্নে আমি বাস্তবে ফিরলাম।
এতক্ষণপুলিশ আর আপুকে নিয়ে জল্পনা -কল্পনা করছিলাম।ইরাম ভাইয়া ঘাবড়ে গিয়ে বলে উঠলো,
– মানে তুই এভাবে কেন প্রশ্ন করছিস সায়ন? যেনআমি অনেক বড় অপরাধ করেছি?
– তুই যদি অপরাধ নাই করে থাকিস তাহলে কোথায়এতদিন ছিলিস তুই? তোর খবর কেউ জানতে পারলোনা কেন? তোর ফোন বন্ধ ছিল কেন?
– আরে থাম ভাই একসাথে এত প্রশ্ন করলে কোনটারউত্তর দিব হুমম।
– ঠিক আছে তুই নিজে থেকেই তাহলে সব বল।
– আরে ভাই আমি তো মালিহাকে পার্কে ডেকেছিলামবিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য।
ইরাম ভাইয়ার কথা শুনে আমরা সবাই ভ্যাবাচ্যাকাখেয়ে গেলাম। সায়ন ভাইয়া ভ্রূ কুঁচকে বলে উঠলো,
– বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য মানে? তুই তো মালিহাকেভালোবাসতি তাই না? তাহলে বিয়ে কেন ভাঙতেচাইছিলি?
– মালিহাকে আমি ভালোবাসতাম তবে আমি বুঝতেপারতাম যে মালিহা আমাকে ভালোবাসে না। কারণটাআমি জানি। কারণটা হচ্ছে মালিহা অনেকদিন ধরেইতোকে ভালোবাসে।
আমি ইরাম ভাইয়ার কথায় অনেকটাই অবাক হলাম।কারণ ওনার সামনে আমি সায়ন ভাইয়াকে এমন কিছুবলিনি যাতে ওনার মনে হয় আমি সায়ন ভাইয়াকেভালোবাসি। আর সায়ন ভাইয়া আমার প্রপোজ করারবিষয়ে বা আমার বিষয়ে কখনোই ওনাদের কিছু বলেননি তাহলে ওনি এতটা শিওর ভাবে বলছেন কিভাবে যেআমি সায়ন ভাইয়াকে ভালোবাসি? আমাদের কিছুবলতে না দিয়েই ইরাম ভাইয়া আবার বলতে শুরুকরলেন,
– সবার মনে হয়তো প্রশ্ন যে আমি কিভাবে জানলাম?আসলে আমি প্রথমে কিছুটা গেইস করেছিলামএতটাও শিওর ছিলাম না। কিন্তু আমি মালিহা আরসায়নের উপর নজর সবসময়ই রাখতাম।
এংগেজমেন্টের দিনও খেয়াল করেছি যে মালিহাআমার থেকেও বেশি সায়নের দিকেই তাকিয়ে ছিল।
শাড়ি কেনার দিনও সায়নই মালিহাকে শাড়ি চয়েজকরে দিছিলো যদিও সেটা কেউ দেখেনি আমি কিন্তুদেখেছি।
আরও খেয়াল করলাম মালিহা আমারথেকেও বেশি সায়নের সাথে কমপোর্টেবল।
গায়েহলুদের দিন মালিহা আমার দিকে একবারও তাকায়নিসায়নের দিকেই তাকিয়ে ছিল পুরোটা সময়।
আরসবশেষে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম যখনকমিউনিটি সেন্টারের করিডোরে মালিহা আর সায়নএকে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমিসেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম মালিহা সায়নকে খুবভালোবাসে।
আর আমি এটাও জানতাম সায়নওমালিহাকে ভালোবাসে।
কিন্তু সেটা সে ঠিকমত বুঝতেপারছিল না। আমি সাত আটবছর ধরে সায়নকে ছিনি।
ও খুব চাপা স্বভাবের একটা ছেলে। বুক ফেটে যাবেকিন্তু মুখ অত সহজে ফুটবে না।
তাই বারবারমালিহাকে বুঝাতে গিয়েও বুঝাতে পারেনি যে ওমালিহাকে ভালোবেসে ফেলেছে।
তাই তো আমারসাথে মালিহাকে দেখলেই ওর রাগ উঠে যেত। প্রথমেনা বুঝলেও ধীরে ধীরে আমি সবটাই বুঝতে পারি।আমি জানতাম এই বিয়েতে আমি, সায়ন, মালিহা,মারিয়া কেউই সুখী হতো না। তাই আমি মালিহাকেসবটা বুঝিয়ে বলার জন্যই পার্কে আসতে বলেছিলাম।আর এতদিন লুকিয়ে ছিলাম যাতে তুই তোর মনেরকথাটা মালিহাকে জানাতে পারিস। তোরা যেন একহয়ে যেতে পারিস। আমাকে যেন ধরে বেঁধে মালিহারসাথে বিয়ে না দিতে পারিস সেজন্য বুঝলি?
আমি ইরাম ভাইয়ার কথা শুনে হাসবো নাকি কাঁদবোবুঝতে পারছিলাম না। তবে এটা বুঝতে পারছি যেবন্ধুর সুখের জন্য ওনি নিজের ভালোবাসাটা বিসর্জনদিতেও দুবার ভাবেননি। এত ভালো বন্ধু এ যুগেপাওয়া যায় বলে আমার ধারণাতেই ছিল না। ইরামভাইয়া হাসতে হাসতে আবার বলে উঠলো,
– আমি তোর জন্য এতবড় স্যাক্রিফাইজ করলাম আরতুই শালা আমার নামে মামলা করে ফেলেছিস? পুলিশআমাকে ধরে নিয়ে এসেছে। আমি তো প্রথমে কিছুইবুঝতে পারিনি। আসলে আমি জানতামই না মালিহারএক্সিডেন্ট হয়েছে। ঐদিন যখন মালিহা পার্কে আসেনিআমি ভেবেছিলাম ও হয়তো আমার মেসেজদেখেইনি। তাই আমি আর বাসায় না ফিরে অন্যজায়গায় ছিলাম। পুলিশ যখন আমাকে ধরে নিয়েআসলো তখনই সবটা জানতে পারলাম।
সায়ন ভাইয়া এবার গিয়ে ইরাম ভাইয়াকে জড়িয়েধরলো। ইরাম ভাইয়ার পিঠ চাপড়ে বলে উঠলো,
– আমি তোর নামে কোনো মামলা করিনি। পুলিশেরতোকে সন্দেহ হচ্ছিলো তাই তোকে ধরে এনেছে। তুইএরকম কিছু না করলে আমি কখনোই জানতেপারতাম না যে আমি মালিহাকে এতটা ভালোবাসি।থ্যাংক ইউ দোস্ত থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
– ধুর ব্যাটা। বন্ধুত্বেই বেঁচে থাকুক বন্ধুর ভালোবাসা।বন্ধু মানেই স্যাক্রিফাইজ বুঝলি?
– হুমম।
– যাক গে এখন আমি বাসায় যাবো। আজ কদিনএকদম ঠিকমত খেতে পারিনি। বিশ্রাম নিতে পারিনি।আমি বাসায় গেলাম বেস্ট অফ লাক ওকে?
– হুমম যা।
ইরাম ভাইয়া আমাদের সকলের কাছ থেকে বিদায়নিয়ে চলে গেলেন। আমি জানতাম ওনি ঐরকম কিছুকরেননি। সবাই ওনাকে অবিশ্বাস করলেও আমিওনাকে বিশ্বাস করি। আর আমার ধারণাটাই শেষপর্যন্ত ঠিক হলো।।
চলবে,,,,
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com