Breaking News

ভালোবাসি তাই । পর্ব -০৩

খাটে সেই দু ঘন্টা ধরে এপাশ ওপাশ করছি। কিছুতেই ঘুম আসছে না। ঘুমেরা যেন আজ শপথ নিয়েছে তারা আমার চোখে ধরাই দেবে না। না চাইতেও সায়ন ভাইয়াকে নিয়ে আমি বারবার ভেবে ফেলছি। যতই তাকে মন থেকে সরিয়ে ফেলতে চাই না কেন সে যে আমার সবটা জুড়েই বাস করছে। তাকে এত সহজে কি ছেড়ে দেওয়া যাবে? তারপরও সেটা তাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না। আমাকে যে একদিন না একদিন ওনাকে ছাড়াই চলতে হবে। আর সে দিনটাও খুব বেশি দূরে না আপু মত দিলেই ওনাদের বিয়ে হয়ে যাবে। তাও আমার চোখের সামনেই। কিচ্ছু করতে পারবো না আমি কিচ্ছু না। তার চেয়ে ওনার থেকে দূরে সরে থাকাই ভালো। এই রাতটাও যে আমার ওনাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই কেটে যাবে সেটা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি।।
.
এখন সকাল ছয়টা বাজে। খালামণি রান্নাঘরে কাজ করছে।
আমাকে এখনি এখান থেকে চলে যেতে হবে।
যদি সায়ন ভাইয়ার সাথে আমার দেখা হয়ে যায় তাহলে ওনার প্রতি আবার দূর্বল হয়ে যাবো।
ওনাকে দেখলেই আমি দূর্বল হয়ে পড়বো। তার চেয়ে চলে যাওয়াই ভালো।
খালামণিকে বললে এখন কিছুতেই ছাড়বে না।
তাই খালামণিকে কিছু না বলেই লুকিয়ে বেরিয়ে আসলাম বাড়ি থেকে।
এখন ফাঁকা রাস্তায় আমি হাঁটছি। এত সকাল বেলা গাড়ি রাস্তায় কমই চলে।
খালামণির বাসা থেকে আমাদের বাসা এক দেড় ঘন্টার পথ।
কেন জানি গাড়িতে উঠতে ইচ্ছে করছে না। আমার কাছে কোনো টাকাও নাই।
তাই হেঁটে যাওয়াই শ্রেয়। অবশ্য হাঁটতে খারাপ লাগছে না ভালোই লাগছে।
সকালের স্নিগ্ধতায় যেন আমিও স্নিগ্ধ হয়ে উঠছি।
ব্যস্ত শহরের কোলাহল যেন আজ কানে আসছে না। সব যেন নিবিড় নিস্তব্ধ।
এত সকালে রাস্তায় এভাবে কখনোই হাঁটা হয় নাই তাই হয়তো এমন লাগছে।
সায়ন ভাইয়াকে নিয়ে এখন ভাবতে ইচ্ছে করছে না।
তবে স্বপ্ন ছিল কোনো এক সকালে সায়ন ভাইয়ার হাত ধরে সকালের স্নিগ্ধতায় গা ডুবাবো ।
সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। থাক গে এসব ভেবে আর কি হবে?
আমি একাই উপভোগ করি সকালের এ পরিবেশ। আমি হাঁটছি কোনো উদ্দ্যেশ্য ছাড়াই হাঁটছি।
কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই আমার। কখন যে হাঁটতে হাঁটতে মাঝ রাস্তায় চলে এসেছি তার কোনো খেয়ালই নেই।
হঠাৎ একটা টান পড়ে হাতে তাকিয়ে দেখি যে সারা দাঁড়িয়ে আছে।
ও আমায় টেনে আনার একটু পরই একটা গাড়ি চলে গেল।
তার মানে সারা টান না দিলে আমি গাড়ির নিচে চলে যেতাম।
সারা আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
.
– চোখ কি হাতে নিয়ে হাঁটিস তুই? এত বড় একটা গাড়ি তোর চোখে পরলো না?
সুইসাইড করতে গেছিলি কেন সত্যি করে বল।
আমি সারার দিকে অদ্ভুদ চোখে তাকিয়ে আছি।
বলে কি আমি সুইসাইড করতে গেছি?
আমি স্বাভাবিক স্বরে বললাম,
– আমি কোন সুখে সুইসাইড করতে যাবো শুনি?
– সুইসাইড মানুষ সুখে করে না দুঃখে করে । তোর কিসের দুঃখ বল?
– শোন আমার সুখও নাই দুঃখও নাই। কোনো কিছুই নাই। জাস্ট হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় চলে এসেছি। এতটুকুই বুঝলি?
– এত সকাল বেলা বাড়িতে যাওয়ার কি আছে?
– ভালো লাগছিলো না তাই চলে আসছি।
– কিইই! যে সায়ন ভাইয়ার বাড়িতে যাওয়ার জন্য তুই উছিলা খুঁজিস সেই সায়ন ভাইয়ার বাড়িতে তোর ভালো লাগছে না? এ কথাটা আজ আমায় বিশ্বাস করতে হবে?
– শোন তোর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলে করবি না হয় করবি না এটা সম্পূর্ণ তোর ব্যাপার। আমি তোকে কোনোরূপ জোড় করছি না।
.
– এই কি হয়েছে বলতো? এত রেগে যাচ্ছিস কেন?
– জানি না। শুধু জানি আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
– নিশ্চয়ই সায়ন ভাইয়া কিছু বলেছে তাই না? তাই তুই এত সকালবেলা চলে এসেছিস।
– হুমম। আর দরকার নাই ওনাকে জ্বালানোর। ওনি কখনই বুঝবে না রে আমাকে। তাছাড়া কাল ওনি বলেছে যে ওনি আপুকে বিয়ে করতে চান। তাই আমার ওনাকে আর বিরক্ত না করাই ভালো। আমি তো আপুকে খুব ভালোবাসি তাই না। আমি চাই আপু সুখী হোক।
– দেখিস সায়ন ভাইয়া ঠিক একদিন তোকে ভালোবাসবে। তোর ভালোবাসাটা বুঝতে পারবে। তবে সেদিন হয়তো খুব বেশি দেরি হয়ে যাবে।
.
– আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি ওনার জন্য অপেক্ষা করবো।
ওনি যখনই আমার জীবনে আসবে আমি তখনই ওনাকে গ্রহণ করতে রাজি।
আমি তো ওনাকে ভালোবাসি। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ভালোবাসবো।
– তুই আর বদলাবি না। এত ভালোবাসিস বলেই তোকে দাম দেয় না সায়ন ভাইয়া।
– আমি তো আর ওনাকে আমার মনের কথাগুলো জানাতে যাবো না।
এগুলো একান্ত আমার মনের কথা। তোকেই বলেছি। ওনাকে আর কখনো বলতে যাবো না।
– হুমম এখন চল আমাদের বাসায় চল।
– আচ্ছা তুই এত সকালে এখানে কি করছিস?
– এই তো হাঁটতে এসেছি। চল আমাদের বাসায় যাবি এখন। পরে তোদের বাসায় যাবি।
– তোদের বাসায় কেন যাবো? আমি এখন আমাদের বাসায় যাবো।
– আরে বোকা এত সকালবেলা তুই বাসায় গেলে সবাই ভাববে যে কোনো সমস্যা হয়েছে তাই তুই এত সকালে বাড়ি চলে এসেছিস। সবাই যখন প্রশ্ন করবে তখন কি উত্তর দিবি বল?
সারার কথা শুনে মনে হচ্ছে সত্যি আমি বড্ড বোকা। সারার মাথায় বুদ্ধি আছে বলতে হবে।
এ কথাটা তো আমার মাথায়ই আসে নাই।
.
– তোর ভাবনা চিন্তা শেষ হলে কি আমরা যেতে পারি?
– হুমম চল।
সারার বাসায় সবাই আছে এখন। সকালবেলা তাই সবাই এখনো বাসায়।
সবার জোরাজুরিতে আমাকে তাদের সাথেই ব্রেকফাস্ট করতে হলো।
সারার বাসায় আমার খুব কমই আসা হয়।
কারণ সবসময় সারাই আমাদের বাসায় যায়। সারা বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
তার একটা ছোট্ট ছেলেও আছে। তারাও বেড়াতে এসেছে।
আমি সারা রুমে চুপচাপ বসে আছি। তখনি সারার বোনের ছেলেটা আসলো।
সারাকে এসে বলতে লাগলো,
– শালা আমাত তককেত কই?
আমি বুঝলাম ও বলছে ওর চকলেট কই। সারা জবাব দিল।
– সরি আনতে ভুলে গেছি পরে এনে দেব।
এটা শোনে ছেলেটার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তখনি
আমার মনে পড়লো ভাইয়া আমাকে কিছু চকলেট দিছিলো খালামণির বাসায় যাওয়ার সময় সেগুলো খাওয়া হয়নি। তাই আমি বললাম,
.
– এই যে বাবু নাও তোমার চকলেট আমার কাছে আছে।
সে আমার দিকে একবার তাকিয়ে সারার দিকে একবার তাকালো।
হয়তো অপরিচিতকারো কাছ থেকে চকলেট নেওয়া তার বারণ।
ছোটবেলায় আম্মুও আমাকে স্কুলে যাওয়ার সময় বলতো, কেউ চকলেট দিলে যেন না নেই।
আমি মুখে হুমম বললেও মনে মনে বলতাম কেন নেব না ঠিক নেব।
কেউ আমাকে বিনামূল্যে চকলেট দিলে আমি ঠিক নেব।
কিন্তু ভাগ্য খারাপ ছিল তাই এরকম কেউ আমাকে চকলেট দিতে আসেনি। ছেলেটি সারাকে বলল,
– শালা আমি এই আন্তির তককেত নেব?
সারা বলল,
– হুমম নাও।
ছেলেটি আমার থেকে তখন চকলেটগুলো নিলো। তারপর বলল,
– থ্যাংকু আন্তি।
আমার খুব হাসি আসলো। আমি বললাম,
-তোমার নাম কি?
– তিফাত।
– অহহ সিফাত?
– হুমম
– আত্তা আমি আতি।
– হুমম যাও।
.
সিফাত চলে যাওয়ার পর আমি সারা দিকে তাকিয়ে বললাম,
– তুই তো বিয়ের আগেই শালা হয়ে গেছিস।
– হুমম তবে সিফাতের এই ডাকটাই আমার ভালো লাগে। জানিস আমি যখন শুনেছি আপুর বাবু হবে আমার তখন খুব রাগ হয়েছিল। আপুর বাবু হলে তো আমাকে আপু আর ভালোবাসবে না সেটা ভেবেই রাগ লাগছিলো। কিন্তু যখন সিফাত হলো তখন মনে হতে লাগলো ও তো আমার আপুরই অংশ। এখন তো ওকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারি না। আচ্ছা তুই বোস। আমি একটু আসছি।
.
সারা চলে যেতেই আমার মনে হতে লাগলো সত্যিই তো আমিও তো আমার আপুকে খুব ভালোবাসি। আপু সবসময় সুখে থাকুক এটা তো আমিও চাই। তাহলে কেন বারবার সায়ন ভাইয়ার ভালোবাসার জন্য তার পেছন পেছন ঘুরছি। সে যদি আমাকে ভালোবাসতো তাহলে এই বিয়েটা হতো না তখন তো আপু কষ্ট পেত। না আর না আমার আপু সুখে থাকুক সায়ন ভাইয়ার সাথে আমি এটাই চাই। আমি আর স্বার্থপর হতে চাই না।।
.
বাসার সবাই আমাকে বকাবকি করছে। তারজন্য দায়ী ঐ সারা। তোর কি দরকার ছিল বাড়িতে এসে আমার এক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিলো এটা শোনানোর। এখন বাবা, আম্মু, ভাইয়া, সবাই আমাকে বকছে। আর আপু তো মরা কান্না শুরু করে দিয়েছে। এই হলো আপুর একটা অন্যতম সমস্যা। কিছু হলেই আপু ইমোসোনাল হয়ে পড়বে। যেমন এখন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে। ভাইয়া আমাকে বলতে লাগলো,
– চোখ কি তুই হাতে নিয়ে হাঁটিস নাকি? গাড়ি দেখতে পেলি না?
আপু হঠাৎ এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,
– তুই কিভাবে পারলি গাড়ির সামনে যেতে? তুই জানিস না আমরা তোকে কত ভালোবাসি।
– আমি কি ইচ্ছে করে গাড়ির নিচে মরতে গেছি নাকি?
– তুই জানিস না আমরা তোকে খুব ভালোবাসি।
– হুমম জানি তো। কিন্তু তোমার কান্না দেখে মনে হচ্ছে আমি সত্যিই মরে গেছি।
– কি? একদম এসব বলবি না।
– তাহলে তুমি কান্নাটা থামাও দয়া করে।
– আচ্ছা আর কাঁদবো না। তুইও কথা দে তুই ঠিকভাবে চলবি।
– হুমম ঠিকাছে।
সবার কাজ কারবার দেখে আমার মনে হলো সত্যি সবাই আমাকে কত ভালোবাসে। এদের ভালোবাসার কাছে সায়ন ভাইয়ার ভালোবাসার কি খুব দরকার আছে আমার। নাহ যা কিছুই হোক আমার পরিবারের কাউকে আমি কখনো কষ্ট পেতে দেব না।।
.
ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আছি আমি আর সারা।
সেই কখন থেকে সারা অরিজিৎ সিং এর একটা স্যাড সং বাজিয়েই চলেছে বাজিয়েই চলেছে।
এই সাতবার একই গান বাজছে। গানের প্রত্যেকটা ওয়ার্ড আমার মুখস্ত হয়ে গেছে।
আমার মনে হয় আমি যতটা বিরক্ত সারার উপর তার মোবাইলটাও তার উপর ততটাই বিরক্ত।
যদি মোবাইলটা মানুষের মত হতো তাহলে এখন ঠাস করে সারার গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে
বলতো আর কোনো গান চোখে দেখতে পাস না।
কখন থেকে এ গানই বাজিয়ে চলেছিস। কিন্তু মোবাইলটা বাস্তবে সেটা করতে পারবে না।
কিন্তু আমার এখন খুবই ইচ্ছে করছে সারার গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে গানটা বন্ধ করে দেই।
পরেরবার গানটা বাজতে লাগলেই আমি এটা বন্ধ করে দিলাম। সারা বলল,
.
– কিরে গানটা বন্ধ করলি কেন?
– তো কি করবো। এক গান কবার শোনা লাগে তোর?
– আমার না খুব কষ্ট লাগছে।
যদি আমার একটা এক্স থাকতো তাহলে আমি তারজন্য একটু কাঁদতে পারতাম।
– তোর প্রেজেন্টই কেউ নেই আর তুই এক্সের চিন্তা করছিস?
-হুমম রে এক্সের জন্য খুব কষ্ট লাগছে।
সারার এসব বকবকানি আমার খুবই বিরক্ত লাগছে।
এক্সেই নেই তার জন্য নাকি ওর মন খারাপ করছে আজগুবি চিন্তাসব।
তাই আমি চুপ করে বসে রইলাম।
তখনি দেখলাম সায়ন ভাইয়া আর তার বন্ধুরা ক্যান্টিনে এসে আমাদের পাশের টেবিলেই বসেছে।
ইরাম ভাইয়া কি মনে করে একেবারে আমার পাশের চেয়ারে এসে বসলো।
আমি তখন সায়ন ভাইয়াকে আড়চোখে দেখছি।
তিনি মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন। ইরাম ভাইয়া বলতে লাগলেন,
– কেমন আছো মালিহা?
– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি?
– ভালো আছি। আর তোমাকে দেখে আরও ভালো হয়ে গেছি।
– মানে,?
– না মানে তোমাকে দেখলে আমার মনটা ভালো হয়ে যায় আরকি?
হঠাৎ করে দেখি সায়ন ভাইয়া দাঁড়িয়ে গেছে। রাতুল ভাইয়া, মহিন ভাইয়া,
সিনান ভাইয়া আর ইরাম ভাইয়া সবাই একসাথে বলে উঠলো,
– কিরে খাবি না?
– নাহহ আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। তোরা খেয়ে আয়।
তার এ কথা শুনে সবাই এ বলল চল আমারও পরে খাবো তোর সাথে। এরপর সবাই একসাথে চলে গেল।
সারা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– আজ সবাই এমন অদ্ভুদ ভিহেব করছে কেন রে?
– কি জানি। আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।
– হুমম। দাঁড়া অরিজিৎ সিং এর আরেকটা স্যাড সং লাগাই।
– ধুর তোর সং তুই শোন আমি গেলাম।
এটা বলেই আমি বাইরে বেরিয়ে আসলাম। তখনি খেলাম এক ধাক্কা। তাকিয়ে দেখি সায়ন ভাইয়া। আমার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলার আগেই বলতে লাগলেন,
– তাকিয়ে হাঁটতে পারিস না? অবশ্য তোর মত থার্ড ক্লাস মেয়েরা পারেই তো এগুলা। এক ছেলেকে কি তাদের ভালো লাগে নাকি। ছেলে দেখলেই গায়ে ঢলে পড়তে ইচ্ছে করে তাই না?
ওনার কথা শুনে খুব রাগ হলো। তাই আমি ওনার কলার চেপে ধরে বলতে লাগলাম,
.
– কি মনে করেন কি আপনি নিজেকে। মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছেন। আমি না হয় চোখে দেখতে পায়নি আপনার কি হয়েছিল আপনি সরে গেলেই তো পারতেন। নাকি ধরে নেব থার্ড ক্লাস ছেলেদের মত আপনিও মেয়ে দেখলে গায়ে ঢলে পড়তে চান। মনে রাখবেন পুকুরের ওপাশের চোর কিন্তু এ পাশের মানুষকেই চোর ভাবে।
এগুলো বলেই আমি ওখান থেকে চলে এলাম। জানি খুব বেশি বলে ফেলেছি। ওনি যা বলেছেন তার উত্তর এভাবেই দেওয়া উচিত। আমার মুডটাই খারাপ করে দিল। আমাদের ঝগড়া অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কথা নেই বার্তা নেই ওনি আমার সাথে রেগে গেলেন।।
বিকেলবেলা রাস্তার ধারে আমি একটা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে, মাথায় একটা কাঁচা ফুলের গোল বেন্ড পড়ে একটু সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছি কারো অপেক্ষায়। কিন্তু কার অপেক্ষায়? তখনি চোখে পরলো সায়ন ভাইয়া মুখে একটা মুচকি হাসি নিয়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। তবে কি আমি সায়ন ভাইয়ার জন্যই অপেক্ষা করছি? সায়ন ভাইয়াও আমার মত একটা বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবী পড়েছেন। বুকের বা দিকটায় খয়েরী রঙের সুতোর কাজ। ঠিক যেমন আমার শাড়ির আঁচলে কাজ। আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন ওনি। বিকেলের রোদটা ওনার মুখে এসে পড়েছে। তাতে যেন ওনার ফর্সা মুখটা আরো মোহনীয় লাগছে। আমি এক দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। ওনি হঠাৎ আমার একটা হাত ওনার হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটা ধরলেন সামনের দিকে। আমি বললাম,
– কোথায় যাচ্ছি আমরা?
– গেলেই দেখতে পাবি।
– না আগে বলেন কোথায় যাচ্ছি না হয় যাবো না।
– বিশ্বাস নেই আমার উপর?
– আছে তো। আমি নিজের থেকে বেশি আপনাকে বিশ্বাস করি । আমি ভুল করতে পারলেও আপনি কখনো ভুল কিছু করতেই পারেন না।
– এত বিশ্বাস করিস কেন?
– ভালোবাসি তাই।
আমার এ কথাটা শুনে ওনার মুখের মুচকি হাসিটা আরো চওড়া হলো। আমার আজ বিশ্বাসই হচ্ছে না আমি সায়ন ভাইয়ার সাথে হাত ধরে রাস্তায় হাঁটছি। আমি ওনার হাতটা জড়িয়ে ধরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। তখনি পেছন থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর কানে এল। পেছনের দিকে তাকাতেই দেখলাম আপু আমার আর সায়ন ভাইয়ার দিকে এগিয়ে আসছে। তবে কি সায়ন ভাইয়া এখন আমাকে ফেলে চলে যাবে? আমার সাথে আর হাঁটবে না? আপু একেবারে আমার সামনে আসতেই আমি সায়ন ভাইয়ার হাতটা ছেড়ে দিলাম। আপু আমাকে জোরে জোরে ডেকেই যাচ্ছে। কি আজব বিষয় আমি আপুর সামনে দাঁড়িয়ে আছি অথচ আপু এত জোরে জোরে ডাকছে যেন আমি আর আপু বহুদূরে দাঁড়িয়ে আছি।
– এই মালিহা উঠ কিরে সেই কখন থেকে তোরে ডেকেই চলেছি ডেকেই চলেছি ।
আমি লাফিয়ে উঠে গেলাম। এ কী আমার পরনে তো বাসন্তী রঙের শাড়ি ছিল সেটা কোথায় গেল। আর আমি তো সেজে ছিলাম এখন তো কোনো সাজগোজ নেই। আমি তো রাস্তায় ছিলাম খাটে এলাম কি করে?
– কিরে দিনে কেউ রাতের মত ঘুমায়? ভার্সিটি থেকে এসে খেয়ে যে ঘুম দিলি এখনো মরার মত ঘুমাচ্ছিস। আমি সেই কখন থেকে তোকে ডাকছি।
.
এতক্ষণে সব বুঝলাম তার মানে আমি এতক্ষণ ধরে স্বপ্ন দেখছিলাম। সেজন্যই তো সায়ন ভাইয়া আমার সাথে অত ভালো ব্যবহার করছিলেন। বাস্তবে তো সেটা কখনোই সম্ভব হতো না। সত্যি যতক্ষণ আমি জেগে থাকি তখন সায়ন ভাইয়া আমার ভাবনায় থাকে। আর যখন ঘুমাই তখন স্বপ্নে। ওনাকে ছাড়া অন্য কিছু আমার মাথায়ই আসে না।কদিন পর বোধহয় পাগল হয়ে যাবো। কি হতো যদি আমার স্বপ্নটা বাস্তবে ঘটতো।
– কিরে তোকে কি বলছি? দিনে কেউ এভাবে ঘুমায়?
.
– কেউ ঘুমায় কি না জানি না আমি ঘুমাই।
– আচ্ছা বাদ দে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে আমরা একজায়গায় যাবো।
– আমরা মানে বাড়ির সবাই যাবে?
– নাহ শুধু তুই আর আমি।
– কিন্তু যাবোটা কোথায়?
– সেটা তুই গেলেই দেখতে পাবি।
– বলে দিলেই তো হয়।
– নাহ সেটা সারপ্রাইজ। তোকে পনেরো মিনিট সময় দিলাম এর মধ্যে রেডি হবি। ওকে আমি রেডি হয়ে আসি।
আপু যেতেই আমি একটা জামা পড়ে নিলাম। চুলগুলোকে কোনোরকম বেঁধে নিলাম। কোনোকিছু করতেই আমার ভালো লাগছে না। আপু রেডি হয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– মুখটা এরকম করে রেখেছিস কেন? একটু সাজ তাহলে ভালো লাগবে দেখতে।
– আপু প্লিজ আমার একটুও সাজতে ইচ্ছে করছে না।
– একটু কাজল তো দিতেই পারিস।
– না লাগবে না চলো।
– আচ্ছা তোর ইচ্ছে।
.
প্রায় আধাঘন্টা ধরে আমরা একটা রেস্টুরেন্ট এ বসে আছি। এখানে বেশিরভাগ টেবিলেই বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড বসে বসে কথা বলছে। শুধু আমাদের টেবিলেই আমরা দু বোন বসে আছি। আমার খুবই অস্বস্থি হচ্ছে এখানে বসে থাকতে। সবাই যে কারণেই হাসে আমার মনে হয় আমাদের দুজনকে দেখেই হাসছে। কমনের মধ্যে আনকমনটাই সবার চোখে পড়ে। তাই আমার অস্বস্থিটা বেড়েই চলেছে। আপুর দিকে তাকালাম সে ছাদের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। বুঝতে পারলাম ছাদে কি কোনো কমেডি শো চলছে নাকি যা দেখে আপুর হাসি পাচ্ছে। কিন্তু আমি তো কোনো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কি জানি আপুর মাথায় কি চলছে? তবে কারো জন্য যে আপু অপেক্ষা করছে সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। হঠাৎ করে রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে চোখ পড়লো। দেখলাম যে সায়ন ভাইয়া রেস্টুরেন্টে এ ঢুকছে। দুধ সাদা গায়ে কালো শার্ট। এ যেন কোনো রাজপুত্র আসছে। কিন্তু সায়ন ভাইয়া এই রেস্টুরেন্টে কেন এসেছে? আপুর দিকে তাকিয়ে দেখি আপু সায়ন ভাইয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারমানে আমরা এতক্ষণ ধরে সায়ন ভাইয়ার জন্যই অপেক্ষা করছি। সায়ন ভাইয়া আমাকে দেখতে পায়নি। আপুর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
– সরি তোকে না মানে তোমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে ফেললাম।
কথাটা আমার কানে আসতেই আমার খুব কষ্ট লাগলো। সায়ন ভাইয়া তো আপুকে তুই করেই বলতো। তার মানে সায়ন ভাইয়াও আপুর সাথে সম্পর্কটা ঠিক করে নিতে চাইছে। আর আমি কি না কষ্টে দুমড়ে দুমড়ে মরছি। আচ্ছা আপু তো জানতো সায়ন ভাইয়া আসবে তারপরও আমাকে কেন নিয়ে এল? আমি যদি জানতাম আপু সায়ন ভাইয়ার সাথে দেখা করতে আসবে আমি তো কখনই আসতাম না। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য কারো সাথে কেউই শেয়ার করতে পারে না। সেখানে আমি নিজের বড় বোনের সাথে সায়ন ভাইয়াকে মেনে নেওয়ার হাজার চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু বারবার আমি ওনার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছি।
আপু কেন আমাকে এখানে নিয়ে এলো। এখন তো আমার অস্বস্থিটা আরো দ্বিগুণ হয়ে গেল। আমি কি ওনাকে আপুর সাথে সহ্য করতে পারবো তো? সায়ন ভাইয়ার হঠাৎ করেই আমার দিকে চোখ পরলো। এতক্ষণ তো চোখই পড়েনি আমার দিকে। আমাকে দেখেই ওনার চোখদুটো লাল হয়ে গেল। আমি বুঝতে পেরেছি যে ওনি আমাকে দেখে রেগে গেছেন। ওনি আপুকে বলতে লাগলেন,
– মারিয়া! মালিহা এখানে কেন? আমি তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছি মালিহার সাথে না? আমি বুঝি না যেখানে একজন তার হবু বরের সাথে দেখা করতে এসেছে সেখানে আরেকজন কেন এসেছে? প্রাইভেসি বলতে কি কিছুই নাই? কমনসেন্সের ও তো একটা বিষয় আছে। সেই কমনসেন্সটাও নেই। ড্যাং ড্যাং করে চলে এসেছে বড় বোন আর তার হবু জামাইর মাঝখানে। লজ্জারও তো একটা বিষয় আছে।
.
আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি কথাগুলো ওনি আমাকেই বলছেন। আমি ওনার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। এই সে সায়ন ভাইয়া যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম এবং এখনো বাসি। চোখের পানিটা মুছে নিলাম। আপু সায়ন ভাইয়াকে বলতে লাগলো,
– আপনি ভুল করছেন। মালিহা আসতে চায়নি আমার সাথে আমিই ওকে জোড় করে ওকে নিয়ে আসছি। তাছাড়া ও জানতই না যে আমি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। আপনি প্লিজ শান্ত হোন। এখানে তো মালিহার কোনো দোষ নেই। আপনি শুধু শুধুই রেগে যাচ্ছেন।
হঠাৎ দেখি ইরাম ভাইয়া কোথা থেকে এসেছেন। সায়ন ভাইয়াকে বলতে লাগলেন,
– আরে সায়ন তুই এখানে? আর এটা কে?
– আমারও তো একই প্রশ্ন তুই এখানে কি করছিস?
– আমি তো এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম তোর বাইকটা রেস্টুরেন্টের বাইরে তাই ভাবলাম তুই ভেতরে আছিস সেজন্য চলে এলাম। এটা কি মারিয়া? তোর উডবি ওয়াইফ?
– হুমমম।
..
– অহহ আমি গেস করলাম। আপনি তো বোধহয় মালিহার বড় বোন তাই না?
– জ্বি আসসালামুআলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। তা কেমন আছে?
– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
– আমিও ভালো আছি।
– হাই মালিহা তুমি কেমন আছো?
– জ্বি ভালো আছি আপনি?
– আমিও ভালো আছি। তা তুমি এখানে কি করতে এসেছো? মানে তোমার বোন তার উডবি হাজবেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছে তুমি কি করতে এলে?
সায়ন ভাইয়া বলে উঠলেন,
– কেন আবার অন্যের প্রাইভেসি নষ্ট করতে।
এবার আর আমি নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। এতক্ষণ ওনি যা বলেছেন সব মুখ বুজে সয়ে নিয়েছি কিন্তু এবার ওনি লিমিট ক্রস করে ফেলেছেন। ইরাম ভাইয়া একটা বাইরের মানুষ। তার সামনে এভাবে না বললেও পারতেন। ওনার সামনে এসে বলতে লাগলাম,
.
– আমি কারো প্রাইভেসি নষ্ট করতে আসিনি। আমি জানতামই না আপনি এখানে আসবেন। জানলে আমি মরে গেলেও এখানে আসতাম না। আপু তো বার বার আপনাকে এ কথাটাই বলছে কিন্তু আপনি বুঝতেই চাইছেন না যে আমি জানতাম না আপু এখানে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। এতক্ষণ আমাকে অনেক অপমান করেছেন কিছু বলিনি। কিন্তু একটা বাইরের মানুষের সামনে এভাবে না বললেও পারতেন।
একটু জোরে জোরেই কথাগুলো বললাম। সবাই আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। বাঙালীর এই এক সমস্যা যেখানেই ঝগড়া দেখবে সেটাই দল বেধে দেখতে আসবে যেন এখানে কোনো শুটিং হচ্ছে। আপু আমাকে থামানোর অনেক চেষ্টা করলেও আমি থামিনি। সব কথা বলে থেমেছি। ইরাম ভাইয়া হঠাৎ আমার হাত ধরে বললেন,
– তুই মারিয়ার সাথে কথা বল। আমি মালিহাকে নিয়ে যাচ্ছি। তোর প্রাইভেসি কেউ নষ্ট করবে না ওকে।
সায়ন ভাইয়া ইরাম ভাইয়ার হাতের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে রইলেন যে হাতে ইরাম ভাইয়া আমার হাত ধরে আছে। কিন্তু ওনার রেগে যাওয়ার কারণ কি বুঝলাম না। ওনি সেদিকে তাকিয়ে থেকেই আপুকে বললেন,
– আমি আসছি কথা বলতে ভালো লাগছে না।
.
বলেই সায়ন ভাইয়া রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বাইকটা হাই স্পীডে বাড়িয়ে চলে গেলেন। ইরাম ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে সায়ন ভাইয়াকে ডাকতে ডাকতে চলে গেলেন। আপু আমাকে এসে বলতে লাগলো,
– তুই এভাবে রিয়েক্ট না করলেও পারতি। তুই তো জানি ওনার অনেক রাগ।
– ওনি লিমিট ক্রস করে ফেলেছিল তাই না বলে থাকতে পারলাম না। তোমার আমাকে নিয়ে আসাটাই ভুল হয়েছে।
রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। তখনি সায়ন ভাইয়ার নাম্বার থেকে একটা কল এল। সায়ন ভাইয়া এত রাতে কল দেওয়ার কারণ বুঝলাম না। কল ধরতেই অপরিচিত গলায় কেউ বলতে লাগলো,
– আপনি কি মালিহা?
– জ্বি আপনি কে বলছেন? এটা তো সায়ন ভাইয়ার নাম্বার ওনি কোথায়?
– আসলে ওনার একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি ওনাকে সিটি হসপিটালে নিয়ে এসেছি। আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন।
– এক্সিডেন্ট হলো কিভাবে?
– ওনি খুব জোরে বাইক চালাচ্ছিলেন তাই একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে এক্সিডেন্ট হয়ে যায়।
এটা বলেই লোকটা ফোন কেটে দিল। আমার যেন পুরো পৃথিবীই ঘুরছে। কি দরকার ছিল আপনার এত জোরে বাইক চালানোর? সব আমার জন্যই হয়েছে। আমি ওনাকে রেগে অনেককিছু বলে ফেলেছি। তাই ওনি রেগে এরকম করেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে এসে সবাইকে জানালাম। এরপর সবাই মিলে সিটি হসপিটালে চলে গেলাম।।
চলবে…

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com