ভালোবাসি তাই । পর্ব -১৩
আমি কত বোকা। সায়ন ভাইয়া তার কাঁধে মাথারাখতে বলেছে বলে আমি ভেবেছিলাম ওনি হয়তোআমাকে ভালোবেসে মাথা রাখতে বলেছেন। কিন্তুআমার ভাবনায় তিনি এক বালতি পানি ঢেলে দিয়েবললেন ওনি নাকি এমনিই একথাটা বলেছেন। আরআমিও সেটাই বিশ্বাস করে ফেললাম। আমি একটাকথা বারবার ভুলে যাই যে সায়ন ভাইয়া আমাকেকখনোই ভালোবাসতে পারবেন না। আর এবার থেকেআমিও আর ওনার ভালোবাসার জন্য পথ চেয়ে বসেথাকবো না। যেটা ওনি সহজে পারবেন না কি দরকারজোর করে সেটা ওনার থেকে আদায় করার।আজকের পর থেকে এসব থেকে আমি দূরেই থাকারচেষ্টা করবো। বিশেষ করে সায়ন ভাইয়ার থেকে দূরেথাকবো।।
সকালবেলা আপুর রুম থেকে সবার কথার আওয়াজশোনা যাচ্ছিলো। আমি দেখার জন্য আপুর রুমেগেলাম। গিয়ে দেখি বাবা, আম্মু, ভাইয়া, আপু সবাইকোনোবিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। আমাকে দেখেইসবাই চুপ করে গেল। আমি সবার দিকে জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকাতেই বাবা বলে উঠলেন,
– এই তো এবার মালিহা ও চলে এসেছে। এবারতোদের দু বোনকে একসাথেই কথাটা বলতে পারবো।
আমি অবাক হয়ে বাবাকে বললাম,
.
– কি কথা বাবা? দুজনকে একসাথেই বলতে হবে?
– দেখ মা মেয়ে হয়ে জন্মেছিস যখন পরের বাড়িতেতো যেতেই হবে তাই না? তোদের দু বোনেরএংগেজমেন্টও হয়ে গেছে সেটা তোরা জানিস।তোদের দু বোনের এংগেজমেন্ট যখন একসাথে হয়েছেআমাদের সবার ইচ্ছে তোদের বিয়েটাও একসাথেইদিবো কি বলিস তোরা?
আমি কিছু বলবো তার আগেই আপু বলে উঠলো,
– এটা তো খুব ভালো হবে। আমার সাথে সাথেমালিহাও পরের বাড়ি চলে যাবে। আমার আর একটুওহিংসে হবে না। না হলে তোমরা সবাই এখানে একসাথেথাকবে আমি একা একা খালামণির বাসায় থাকবোএটা কি হয় নাকি? এবার ঠিক হয়েছে মালিহাও এবাড়িতে থাকবে না আমিও থাকবো না।
আপুর কথা শুনে আমি আরকিছুই বললাম না। বাবাআবার বলে উঠলেন,
– তোদের না জানিয়ে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েফেলেছি ।
আমি বললাম,
– কি সিদ্ধান্ত বাবা?
– তোদের বিয়ের ডেট শুক্রবারেই। মানে আজ শনিবারশুক্রবারে তোদের দু বোনের বিয়ে।
আমি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম,
– মানে! এত তাড়াতাড়ি কীসের বিয়ে বাবা?
ভাইয়াও বলে উঠলো,
– দেখুন বাবা মারিয়ার বিয়ে শুক্রবারে হোক সমস্যানেই। কিন্তু মালিহার বিয়ে শুক্রবারে হওয়ার পক্ষেআমি নেই।
আমি ভাইয়ার কথায় খুশি হয়ে গেলাম। কিন্তু আপুকাঁদো কাঁদো ফেস বানিয়ে বলল,
– অহহ তোর তো সব মায়া মালিহার জন্যই তাই না?আমি তো তোর কেউ না। আমার বিয়ে হয়ে গেলেই তুইখুশী। তোরা দুই ভাই -বোন একসাথে থাকবি আমি নাথাকলেও সমস্যা আছে নাকি? এজন্য আমার বিয়েহয়ে গেলে তোর কোনো সমস্যা নেই।
.
– না আমি সেটা বলতে চাইনি। তোর মায়া কাটানোরজন্যই তো মালিহাকে প্রয়োজন। তোরা দুই বোনএকসাথে এ বাড়ি থেকে চলে যাবি আমার কি একাএকা ভালো লাগবে এখানে?
ভাইয়া – আপুর এসব কথাবার্তা শুনে ভাইয়া বাবা বলেউঠলেন,
– কিন্তু মিহির বাবা আমি তো ইরামের আম্মুকে কথাদিয়ে ফেলেছি। এখন সেই কথা ফেরাবো কিভাবে?ইরামের আম্মু কি ভাববেন আমাকে? একবার কথাদিয়ে আবার সে কথা ফিরিয়ে আনাটা কি ঠিক হবে?
– অহহ বাবা তুমি কথাও দিয়ে ফেলেছো এরমধ্যে?
– হুমম আমি ভাবলাম আজ নয়তো কাল মালিহাকেওবিয়ে দিতেই হবে তাই যদি দু বোনেরই একসাথে বিয়েহয়ে যায় বিষয়টা ভালো হবে না?
– হুমম তোমার যা ভালো মনে হয় আরকি।
কিন্তু মালিহা আর মারিয়াকে আমি সত্যিই খুব মিসকরবো।
আমি এবার বলে উঠলাম,
.
– হুমম হয়েছে তুই আর মিস এত বহু দূরের কথা। তুইকরবি আমাকে মিস এ কথাটাও আমাকে বিশ্বাসকরতে হবে? শোন আমি সায়ন ভাইয়ার সাথেখালামণির বাসায়ই থাকবো। তুই যদি সত্যিই আমাকেমিস করিস তাহলে আমাকে খালামণির বাসায় গিয়েদেখে আসিস।
আমার কথা শুনে ভাইয়া আমার দিকে হ্যাবলার মততাকিয়ে আছে। তারপর আমার মাথায় একটা চাটিমেরে হো হো করে হেসে বলে উঠলো,
– কদিন পর তোর বিয়ে আর তুই এখনো নিজেরহাজবেন্ডের নামটাও মনে রাখতে পারিস না? ওটাসায়ন হবে না ইরাম হবে বুঝলি?
আমি এবার বুঝতে পারলাম আমি কোথায় ভুলকরেছি। সায়ন ভাইয়াকে যতই আমি ভুলে যাওয়ারচেষ্টা করি না কেন ঘুরে ফিরে সেই ওনার নামটাইআমার মুখে আসে। তবে ভাগ্য ভালো যে কেউ কিছুমনে করেনি আমার কথায়। সবাই ভেবেছে আমি মজাকরে বলেছি। আমি আর কিছুই বললাম না। বাবাআবার বলে উঠলেন,
– তাহলে সবাই বুঝতেই পারছো আমাদের হাতে আরবেশি সময় নেই। এখন থেকেই সব প্রস্তুতি নিতে হবে ।আর একটা কথা কাল বিকেলে ইরাম আর সায়নরাশপিংমলে থাকবে। কালকেই সব শপিং শেষ করেফেলতে চাইছে সবাই। তাই তোরা দুই বোন রেডিথাকিস। অবশ্য আমরা সবাই এ যাবো শপিংমলে।তোদের আগে থেকেই জানিয়ে দিলাম আরকি। আচ্ছাআমি একটু আসছি হুমম।
.
এরপর বাবা চলে গেলেন। ধীরে ধীরে আমরা সবাইনিজেদের রুমে চলে গেলাম।।
রাতে ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েআছি।
আজ আকাশে একটা চিকন করে চাঁদ উঠেছে।এতদিন আকাশে চাঁদের কোনো চিহ্নই ছিল না।
এইচাঁদটা পুরোপুরি গোল হতে আরো অনেকটা সময়লাগবে।
আজকে চাঁদের আলোটা একেবারেই কম। কিন্তু যখন এটা পুরোপুরি গোল হয়ে যাবে
তখন পুরোপৃথিবীতে রাতে একটা মিষ্টি আলো ছড়িয়ে পড়বে।
তখন যদি সব জায়গায় একসাথে লোড শেডিং হয়তাহলে সবাই চাঁদের এই মিষ্টি আলোটা উপভোগকরতে পারবে। রাতে তো আমরা সবাই কৃত্রিমআলোতে নির্ভর হয়ে পড়ি।
আমরা কেউ ভাবি নাবাইরের পৃথিবীতে একটা চাঁদ তার মিষ্টি আলোছড়াচ্ছে।
কিন্তু কারো সে মিষ্টি আলো উপভোগ করারসময় নেই। সবাই যে বড্ড বেশি ব্যস্ত।
সারাদিনের কাজ-কর্মে সবাই এতটাই ক্লান্ত থাকে যে রাতের আকাশদেখার মত কারো সময় বা ইচ্ছেই থাকে না। আমারআবার ছোট থেকেই আকাশ আর চাঁদ দেখতে ভালোলাগে।
ছোটবেলায় একবার শীতকালীন ছুটিতে আমরাখালামণিরা সবাই মিলে নানুরবাড়ি গেছিলাম ছুটিকাটাতে।
তখন আমি মাত্র সিক্সে পড়ি।
সায়ন ভাইয়াতখন মোটামুটি বড় হয়ে গেছে যেহেতু ওনি আমার ছয়বছরের বড়।
নানুরবাড়িতে থাকাকালীন একদিন রাতেআকাশে অনেক বড় একটা চাঁদ উঠেছিল।
বোধহয়সেদিন পূর্ণিমা ছিল। আমার যেহেতু আকাশ দেখতেভালো লাগে ।
বিশেষ করে রাতে।তাই সেদিনও আমিনানুদের উঠোনে বসে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম।
সবাই ঘরেই ছিল। সেদিন অনেক ঠান্ডাপরছিলো।
যেহেতু শীতকাল তার উপর গ্রাম শীতটাঅনেক বেশিই পরছিল।
তারপরও আমি শীত উপেক্ষাকরে উঠোনে বসে বসে আকাশ আর চাঁদ দেখছিলাম।
তখনি সায়ন ভাইয়া কোথা থেকে এসে আমার মাথায়একটা চাটি মেরে বলল,
.
– কিরে কবি হবি নাকি? আকাশের দিকে তাকিয়েকবিতার ছন্দ বানাচ্ছিস নাকি?
আমি ওনার দিকে বিরক্ত চোখে একবার তাকিয়েবললাম,
– তাতে আপনার কি হুমমম? আপনি এখানে কিকরছেন? যান ঘরে যান।
– শোন তোকে আমায় জ্ঞান দিতে হবে না। ঠান্ডায় তোপুরো জমে গেছিস সে খেয়াল আছে?
এখানে বসেবসে আকাশ দেখছে। যেন ওনি কবি সাহেবা।
– শোনেন আকাশ দেখলেই মানুষ কবি হয় না। এরকমহলে তো সবাই আকাশ দেখেই কবি হয়ে যেত।
– হুমম এ বয়সেই তো তুই খুব পাকা পাকা কথা বলতেশিখে গেছিস দেখছি।
তোকে তো বিয়ে দিয়ে দেওয়াদরকার।
সায়ন ভাইয়া বুঝতে পেরেছিল তার এ কথা শুনেআমি রেগে গেছি। তাই ওনি এ কথা বলেই দৌড়দিলেন।
আমিও উঠে ওনার পেছন পেছন দৌড়াতেলাগলাম।
ওনি অন্ধকারে কোথায় জানি লুকিয়েগেলেন। আমি অনেক খুঁজেও ওনাকে আর পেলামনা।
পরে ঘরে চলে গেলাম শুতে। তখনি ওনি কোথাথেকে এসে আমার মাথায় একটা চাটি মেরে দৌড়দিয়ে আবার পালিয়ে গেলেন। আমিও খালামণিরকাছে ওনার নামে বিচার দিয়ে এসে শুয়ে গেলাম। মনেযা আসলো তা বলে ওনাকে অনেক বকলাম।।
.
সত্যি সে দিনগুলো কত মজার ছিল। সেদিনও আমিজানতাম না কোনো এক সময়ে সেই সায়ন ভাইয়ারজন্যই আমি চোখের পানি ফেলবো। যে আমাকেমারতো বলে আমি কত বকা -ঝকা করতাম। সবসময়চাইতাম সে মানুষটা যেন আমার সামনে না আসে।কারণ আসলেই তো সে আমাকে মারবে। এ ভয়ে তখনআমি ওনাকে এড়িয়ে যেতাম। হুমম আজও আমিওনাকে এড়িয়ে যেতে চাই ওনি আমাকে মারবেন সেভয়ে না যদি ওনার মায়ায় পড়ে যাই সেই ভয়ে।মানুষের জীবন যে কখন বদলে যায় সেটা সে নিজেওজানে না। এ কথাটা আজ আমি পুরোপুরি বিশ্বাসকরি। কারণ আমি নিজেই যে এর জলন্ত প্রমাণ। আজখুব ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে কোথাও লুকিয়েযাই। সবাই তখন বুঝবে জীবন থেকে একটা মানুষহারিয়ে গেলে কত কষ্ট হয়। আর সে যদি হয়ভালোবাসার মানুষ তাহলে কেমন লাগে।।
বাইরে ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। গ্রীলের ফাঁক দিয়ে সেবাতাস এসে আমাকে স্পর্শ করছে। চোখ বন্ধ করেআমি শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছি। বাতাসে কেমন জানিএকটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ। আমার লম্বা খোলা চুলগুলোবাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে মনের আনন্দে নাচছে।একটা গান খুব মনে পড়ছে।
” খোলা জানালা দখিনের বাতাসে
ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে
কখন তুমি এসে হেসে এসে বলে দাও
তোমার পাশে ।
বহুদূর পথ ভীষণ আঁকাবাঁকা
চলতে ভীষণ ভয়
তুমি এসে বলে দাও
আছি আমি পাশে
করো না কিছুতেই ভয়।
কখনো ভাবিনি চলে যাবে তুমি
আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে ,,,,
কখনো বুঝিনি ফিরে আসবে না
আমার পৃথিবী রাঙিয়ে।।।
গানটা গাইতে গাইতেই চোখ থেকে আবার নোনা স্রোতশুরু হলো।
জানি না আমি ইরাম ভাইয়াকে বিয়েকরতে রাজি হয়ে ঠিক করছি নাকি ভুল করছি।
তবেআমি এটা জানি আমার পুরো মন জুড়ে শুধু সায়নভাইয়ারই পদচারণা রয়েছে।
সেখানে অন্য কারোপ্রবেশ যে নিষিদ্ধ। এ রাতের মতই আমি কেমননিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি ঠিক ভুলের দন্ধে পড়ে।
জানি নাআমার জীবনটা আবার আগের মত হবে কি না।
তবেআমি মনে প্রাণে চাই সায়ন ভাইয়া খুব ভালো থাকুক।আপুর সাথে খুব ভালো থাকুক।
আর এটা আমিসবসময়ই চাইবো।।
চলবে,,,,,
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com