তোমাকে ঘিরে আমার অনুভূতি। পর্ব -০২
আদ্র অনুর দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,
–হ্যা আমার সামনে ড্রেস চেঞ্জ করলে তোর প্রবলেম কি?
আমার সামনেই ড্রেসটা চেঞ্জ কর। আমি দেখেও না দেখার ভান করে থাকবো। আই প্রমিজ।
অনু অবাক হয়ে আদ্রকে বলল,
–কি বললে তুমি? আমি তোমার সামনে ড্রেস চেঞ্জ করবো আর তুমি দেখেও না দেখার ভান করবে?
অনু রেগে আদ্রের দিকে তাকাল। সুইজারল্যান্ডে থেকে এই আদ্রের যে লজ্জা বলতে কিছু নেই তা অনু বুঝতে পারল। অনু ড্রেসটা বিছানার একপাশে রেখে চারপাশে কিছু খুঁজতে লাগল। সামনে কাছেই একটা বালিশ পেয়ে অনু আদ্রকে বালিশ ছুঁড়ে মারল। আদ্র সাথে সাথেই বালিশটা ধরে ফেলে অনুকে বলল,
–বালিশ ছোড়াছুড়ি করছিস কেন অনু? এই বালিশটা কি দোষ করলো?
অনু রাগী স্বরে আদ্রকে বলল,
–তুমি এখনই এই রুম থেকে বের হয়ে যাবে।
আদ্র অনুর দিকে এগোতে এগোতে বলল,
–আমি যদি না যাই তাহলে কি করবি?
অনু ভয় পেয়ে বিছানা থেকে নেমে দেয়ালের একবারে কোণায় গিয়ে দাঁড়াল।
আদ্রের দিকে আঙুল তুলে কাঁপা স্বরে অনু বলতে লাগল,
–একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবে না।
তোমাকে আমার ভীষণ ভয় করছে আদ্র ভাইয়া। তুমি দূরে থাকো আমার কাছ থেকে।
আদ্র অনুর একদম কাছে চলে আসলো।
অনু ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে কাঁপতে লাগল।
আদ্র দেয়ালে এক হাত রাখল। আদ্র আর অনুর মধ্যে দূরত্ব এখন নেই বললেই চলে।
আদ্র অনুকে নেশা ভরা কন্ঠে বলল,
–তোর কাছ থেকে দূরে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। একদমই অসম্ভব অনু। তোর এই ভয়, বোকামিগুলোই তো আমার বেশি ভালো লাগে। আর তোর মধ্যে কি যেন আছে যা আমাকে বার বার তোর কাছে টানে।
অনু দুই হাতে আদ্রের বুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
–চুপ করো। আমার মধ্যে কিছুই নেই।
আদ্রকে অনু ধাক্কা দিলেও আদ্র এক ইঞ্চিও পেছনে গেল না। আদ্র নিজের দুই হাত দিয়ে অনুকে আঁকড়ে ধরে বলল,
— না অনু। তুই ভুল বলছিস। যদি বলি তোর মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না। তোর মধ্যে এমন কিছু আছে যেটা শুধু আমিই দেখতে পাই। শুধু এবং শুধুই আমি।
অনু নিজেকে আদ্রের কাছ থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–তুমি আমাকে ছাড়ো আদ্র ভাইয়া। আমার হাতে ব্যথা লাগছে।
আদ্র এবার রেগে গিয়ে অনুর দুই হাত আরও জোরে চেপে ধরে বলল,
–আর আমার যে এই বুকে ব্যথা লাগছে সেইটা কি তুই দেখতে পাচ্ছিস না?
অনু ভয় পেয়ে কাঁপা গলায় শান্ত স্বরে আদ্রকে বলল,
–তুমি মিথ্যা কথা বলছো। তুমি আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এসব নাটক করছো। আমি বুঝতে পারছি। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা ভুলেও করবে না আদ্র ভাইয়া। আমাকে তুমি বোকা ভেবো না।
আদ্র চিৎকার করে অনুকে বলল,
–এই মেয়ে একদম চুপ কর। আমি তোকে মিথ্যা কথা বলছি? আমি তোর সাথে নাটক করছি? আরে আমি যদি তোকে মিথ্যা কথাই বলতাম আর তোর সাথে যদি নাটকই করতাম তাহলে তোকে কখনই বিয়ে করে আমার নিজের করতে চাইতাম না।
আদ্রের মুখে বিয়ের কথা শুনেই অনু শুকনো ঢুক গিলে কাঁপতে লাগল। অনু মনে মনে বলল,
–এমন রাগী, মাতাল, গুন্ডা, অসভ্য ছেলেকে আমি কি করে বিয়ে করতে পারি? আমি কখনই আদ্র ভাইয়াকে বিয়ে করতে পারব না। আগেও করতে চাই নি। এখনও করতে পারব না।
আদ্র গম্ভীর স্বরে অনুকে বলল,
–কিরে অনু কি ভাবছিস? মনে পড়ে কিছু? পুরনো কথা কিছু কি মনে পড়ে তোর? তুই ভালো করেই জানিস অনু তোকে আমি কেন কৌশলে এই সুইজারল্যান্ড এনেছি। ভুলেও না জানার ভান করবি না।
অনু আদ্রের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল। আদ্রকে এভাবে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনু ভীষণ ভয় পাচ্ছে। তারপরই অনুর চোখের সামনে ভেসে আসলো আদ্রের সাথে দেখা হওয়া সেই অদ্ভুত অতীত। যেই অতীতের কথা ভাবলেই অনু ভয় পায়।
মা-বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে অনু। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান অনু। কলেজের গন্ডি পেড়িয়ে সবে ভার্সিটিতে উঠেছে। অনুর মনটা সারাদিন খারাপ থাকতো। কারণ কোনো ভাইবোন না থাকায় একা একা সারাদিন বাসায় বসে থাকতো। মা-বাবা কেউই অনুর সাথে তেমন গল্প করতো না। অনুও কারও সাথে সহজে মিশতে পারে না। তাই অনু নিজের সাথে নিজেকে মানিয়েও নিয়েছিল। একদিন অনু পড়ার টেবিলে বই পড়ছিল। তখনই অনুর রুমে আরমান রহমান আসেন। অনু বাবাকে রুমে আসতে দেখে হেসে বলল,
–আব্বু কিছু বলবে?
আরমান রহমান হাসিমুখে অনুকে বলল,
–অনু মা জানিস? আমার বন্ধু আনোয়ার হোসেনের ছেলে সুইজারল্যান্ড থেকে পড়াশোনা করে কিছুদিন আগে দেশে ফিরেছে।
অনু আনোয়ার হোসেনকে শান্ত স্বরে বলল,
–ভালো তো আব্বু। এটাতে এতো খুশি হওয়ার কি আছে? আমি তো বুঝলাম না।
আরমান রহমান অনুকে বলল,
–খুশি হবো না? আদ্রকে সেই কত বছর আগে দেখেছিলাম। গতকাল আনোয়ারের সাথে দেখা হয় আর তখনই জানতে পারি আদ্র সুইজারল্যান্ড থেকে কিছুদিন আগে দেশে ফিরে এসেছে। কাল আমার বন্ধুর ছেলে আদ্রের জন্মদিন। আমাদের সবাইকে কাল আদ্রের বাসায় যেতে হবে।
অনু আরমান রহমানকে জিজ্ঞেস করল,
–আব্বু তোমার বন্ধুর ছেলের নাম আদ্র?
আরমান রহমান অনুকে হেসে বলল,
–হ্যা মা। আমার বন্ধুর ছেলের নাম আদ্র।
অনু আদ্রের নামটা মনে মনে আওড়ালো। কোনো অনুষ্ঠানে যেতে অনুর ভালোই লাগে। কিন্তু অনুর বাবা কখনো অনুকে ও তার মাকে কোনো অনুষ্ঠানে নিয়ে যায় না। অনু আরমানকে রহমানকে বলল,
–আব্বু তুমি তো আমাকে আর আম্মুকে কোনো অনুষ্ঠানেই নিয়ে যাও না। যখনই তোমাকে কোনো অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে বলি তখনই তুমি বলো যে সেখানে অনেক মানুষ থাকে তাই যাওয়ার লাগবে না। তাহলে হঠাৎ আজকে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যেতে বলছো?
আরমান রহমান অনুকে শান্ত স্বরে বলল,
–কারণ তোর আংকেল আনোয়ার হোসেন তোদের নিয়ে যেতে আমাকে অনেক জোর করেছে। তাই আমি আমার বন্ধুকে আর না করতে পারি নি। কাল তুই আর তোর মা রেডি হয়ে থাকবি। আমরা একসাথে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাবো। ঠিক আছে?
অনু তো মনে মনে ভীষণ খুশি। কোনোদিন কোনো জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অনু যায় নি। তাই অনু হাসিমুখে আরমান রহমানকে বলল,
–ঠিক আছে আব্বু।
আরমান রহমান খুশিমনে অনুর রুম থেকে চলে গেলেন।অনু তখনও জানতো না অনুর জন্য ঠিক কি অপেক্ষা করছে। পরদিন দুপুরে অনুর মা আমেনা বেগম এবং অনু রেডি হলো। আরমান রহমানও রেডি হয়ে অনু এবং আমেনা বেগমের আসার জন্য ড্রইং রুমে অপেক্ষা করছেন। অনু একটা লাল রঙের গাউন ড্রেস পড়েছে। অনু এবং আমেনা বেগম রেডি হয়ে ড্রইং রুম আসলে আরমান রহমান তাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
অবশেষে অনু টেক্সি থেকে আদ্রের বাসার সামনে নামলো। বাসার সামনে অনু নেমেই বিশাল বড় বাড়িটা দেখে হা করে তাকিয়ে রইল। এতো বড় বাড়ি অনু নিজের চোখে জীবনেও দেখে নি। অনু অবাক হয়ে আরমান রহমানকে জিজ্ঞেস করল,
–আব্বু এটা আনোয়ার হোসেন আংকেলের বাড়ি?
আরমান রহমান অনুকে বলল,
–হ্যা মা এটাই আনোয়ারের বাড়ি। আমি বাড়ির ভিতরে গেলাম। তুই তোর আম্মুকে সাথে নিয়ে ভিতরে আয়।
অনু আরমান রহমানকে বলল,
–ঠিক আছে আব্বু তুমি যাও। আমরা আসছি।
আরমান রহমান বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। অনু অবাক হয়ে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়েই বাড়িটা দেখতে লাগলো। আমেনা বেগম অনুকে বলল,
–কিরে অনু হা করে তাকিয়েই থাকবি নাকি বাড়ির ভিতরে ঢু্ুকবি?
অনু আমেনা বেগমকে হাসিমুখে বলল,
–উফফ মা বাড়িটা কি সুন্দর দেখেছো? আমি তো চোখই সড়াতে পারছি না।
আমেনা বেগম অনুকে শান্ত স্বরে বলল,
–দেখা হলে এবার ভিতরে তো চল।
আমেনা বেগম সামনে এগিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়লেন। বাড়ির সামনে অনেক বড় সিঁড়ি। অনু সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উঠতে লাগল। কিন্তু পায়ে হাই হিল পড়াতে অনুর ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে। অনু মনে মনে বিরক্ত হয়ে বলল,
–ধুর কেন যে হাই হিল পড়তে গেলাম! ভালো করে হাঁটতেই পাড়ছি না। তারওপর আবার এতো লম্বা গাউন পড়েছি। জীবনটা ত্যানা হয়ে গেল আমার।
অনু সিঁড়ি বেয়ে উঠে মেইন দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো। বাড়ির ভিতরে ঢুকে অনু আরও অবাক হলো। কারণ বাড়িটা রাজপ্রাসাদের মতো। বিশাল বড় বাড়ির চারিদিকে এতো সুন্দর করে সাজানো। লাইটের এতো আলোয় অনুর চোখ জ্বলে যাচ্ছিল। চারদিকে প্রচুর লোকজন। অবশ্য জন্মদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজনে এতো লোকজন থাকাও স্বাভাবিক। অনু বেখেয়ালিভাবে হেঁটে একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।যে মেয়েটির সাথে অনু ধাক্কা খেল তার নাম সুমি। অনুকে মাটিতে পড়তে দেখে সুমি হাসতে হাসতে বলল,
–আহারে বেচারি মেয়েটা ঠিকমতো হাঁটতেও পারে না।
সুমির কথা শুনে সবাই অনুর দিকে তাকালো। অনুকে মাটিতে এভাবে বসে থাকতে দেখে সেখানে উপস্থিত সবাই হাসতে লাগল। অনুর খুব কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু কাঁদতে পারছিল না। পায়ে অনু ভীষণ ব্যথাও পেয়েছে।
আদ্র সোফায় বসে ফোন টিপছিল। নিজের জন্মদিনের প্রতি আদ্রের কোনো আগ্রহ নেই। নেহাতই আদ্রের বাবা- মা আদ্রের জন্মদিন পালন করতে আদ্রকে এতো জোর করলো। তাই আদ্র বাধ্য হয়ে মেনে নিল। মেইন দরজার কাছে এতো ভীড় আর মানুষের হাসাহাসি দেখে আদ্র বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর সেখানে গিয়ে অনুকে মাটিতে বসে থাকতে দেখে আদ্র কিছুক্ষণ অনুর দিকে তাকিয়ে রইল। অনু মন খারাপ করে মাথা নিচু করে মাটিতে বসে আছে। সবাই এখনও হাসছে। তাই আদ্র রাগী স্বরে সবাইকে বলল,
–সবাই এভাবে হাসছো কেন?এখানে এতো হাসাহাসির কি আছে?
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com