ডাক্তার জরিনা। লেখাঃ আজিজুল হক শাওন
গ্রামটি থেকে সরকারী হাসপাতালের দূরুত্ব প্রায় ২০ কি.মি।
রোগীদের হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পথে কত ভোগান্তি পোহাতে হয়, তা গ্রামবাসীই জানে।
এ গ্রামে একটা হাসপাতাল গ্রামবাসীর চির চাওয়া। কিন্তু কোনো ভালো ডাক্তার গ্রামমুখী হতে চায়না বিধায়,
সে গ্রামটি এখনো হাসপাতালবিহীন। স্বাধীনের পর থেকে এখনো অবধি দশহাজার মানুষের একটা গ্রামে একটা হাসপাতাল নেই তা অনেক কষ্টের ও লজ্জার বিষয়। তবে, দুঃখের দিন শেষ গ্রামবাসীর।
আরেকদিন পর গ্রামের প্রথম ডাক্তার হবে জরিনা। ডাক্তার জরিনা শুনলেই হাসি আসে।
জরিনা নামের কেউ ডাক্তার হয় না-কি? কিন্তু অসম্ভবটাই সম্ভব হচ্ছে আগামীকাল।
তাই চোখে-মুখে খুশির অন্ত নেই গ্রামের মানুষের। গ্রামের মানুষ নিজেদের অর্থে প্রথম ডাক্তার তৈরি করেছে।
যা ইতিহাসে বিরল। জরিনাকে ডাক্তার বানাতে তারা নিজেরা মাসিক চাঁদা দিয়ে তার ডাক্তারি পড়ার খরচ চালিয়েছে। ফলস্বরুপ আজ তাদের মধ্যে একজন ডাক্তার তৈরি হয়েছে।
রাতে রমিজা খালা তার অটিস্টিক সন্তান ফরিদকে বলেন, ” খোকা! তোর আর চিন্তা নাই৷
আমাগো করিমউদ্দিনের মাইয়া জরিনা কাল ডাক্তার হইয়া আয়তাছে।
দেখবি তুই আবার হাঁটতে পারবি। তুই আমারে আম্মাজান কইয়া দৌড়াইয়া আইসা ধরতে পারবি।
নিজের হাতে খাবার খায়তে পারবি, বাজান। আরেকটু কষ্ট কর বাজান! আরেকটু!”
রমিজা খালার চোখ থেকে টুপটাপ অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। তবে তা আনন্দের।
ডাক্তারদের উচ্চবিল ও উচ্চ চিকিৎসার অভাবে ছেলেটা পড়ে আছে বিছানায়৷
নিজের সন্তানকে বিছানায় শায়িত দেখা যে কত কঠিন,
তা কেবল অটিস্টিক মা-বাবারাই বুঝেন। পৃথিবীর কষ্ট একদিকে তাদের কষ্ট অন্যদিকে৷
মানুষের বাড়িতে কাজ করে যে অর্থ পায়, তার কিয়দংশ ঢেলে দিত, গ্রামের প্রথম ডাক্তার বানানোর কাজে।
রাত বুঝি শেষ হবে এবার।
পাশের বাসার সলিম মোল্লার স্ত্রী অসুস্থ। তিনিও স্বপ্ন দেখান মাঝরাতে।
আলতভাবে অসুস্থ বউয়ের পাশে বসে বলেন,” বউ! তোর পেটের ব্যথার আর যে টেনশন নাই।
আমাগো জরিনা ডাক্তার যে হইতাছে। উনি কইছেন, তোর চিকিৎসা উনি সবার আগেই করবেন।
দেখিস! তুই আবার ভালা হইয়া যায়বি। আমার সাথে ঝগড়া করতে পারবি।
তোর ঝগড়া যে আমি মিস করি, বুঝলা বউ।”
মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠে সলিম মোল্লার বউয়ের। এ হাসি যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য ;
যা দেখে মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায় না।
জরিনা যখন প্রাইমারিতে পড়ে তখন থেকে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকত সে।
প্রিন্সিপাল যখন একদিন ওকে জিজ্ঞাস করেছিল, সে কী হতে চায়? তখন সে ফটাফট উত্তর দিয়েছিল,
” স্যার! আমি ডাক্তার হতে চাই!” মহোদয় কারণ জিজ্ঞাসা করতেই জরিনা জানায়,
” গ্রামে যে কোনো ডাক্তার নেই। একজন ডাক্তার বড়ই দরকার এলাকায়।
” সে এ-ও জানায়, সে ডাক্তার হলে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেবে তাদের।
আর, ও গ্রামে রবে কখনই শহরমুখী হবে না। কথাটাশুনে স্যার হেসেছিলেন।
কারণ, গরিবের মেয়েরা কি ডাক্তার হতে পারে? বলা আর হওয়া যে অনেক তফাত।
সাইন্স নেয়া ও টিউশনি করার সামর্থ্য নেই যার, সেখানে ডাক্তার তো অনেক দূরের বিষয়।
আর জরিনা ডাক্তার শুনতেও বিদঘুটে লাগে। তাই স্যারের মুখে বিদ্রুপ হাসি।
নাক বেয়ে যার সর্দির পানি গড়িয়ে পড়ছে, আর সে হবে ডাক্তার! বিষয়টা বড়ই হাস্যকর।
তবুও স্যার হাসি থামিয়ে জবাব দিলেন, হুমম! ইচ্ছা থাকলে সব সম্ভব।
যদিও স্যার মনেমনে ভাবেন, ইচ্ছা থাকলে অনেককিছুই সম্ভব না।
যেমন, একটা মানুষ ইচ্ছাকরে জীবনেও ডিমপাড়তে পারবে না। তিনি তা ভেবে আবারও হেসে উঠেন।
তবে, স্যারের মুখের পারবে কথাটি, জরিনাকে অনেক কনফিডেন্স এনে দিয়েছিল সেদিন।
সেখান থেকে সে আরো বেশি পড়ালেখা করতে থাকে।
সেখান থেকেই তার পরিশ্রম শুরু। দিনরাত এক করে পড়তে থাকে, ও।
পড়াশুনার পাশাপাশি সবাইকে আশ্বস্ত করে, গ্রামবাসী অচিরেই চিকিৎসার চিন্তা থেকে বাঁচবে।
সবাই বিশ্বাস করে নেয় তাকে। তার জন্য দুয়া করতে থাকে নামাজেও।
সব জায়গায় রেজাল্টে সে থাকত শীর্ষে।
কিন্তু ডাক্তার হলে তো হবে না, লাগবে গ্রামে একটা চিকিৎসালয়। গ্রামে যে হাসপাতাল নেই। তাই জরিনা ডাক্তারিতে চান্স পাওয়ার সাথে সাথেই, গ্রামবাসী হাসপাতাল বানানোর কাজ শুরু করে দেয়। রমিজ মিঁয়া হাসপাতালের জন্য জায়গা দান করে। সে জায়গায় গ্রামের সবাই বিনামূল্যে কাজ করতে থাকে। সারাদিন কাজ চলতে থাকে। আপন মনের ভালোবাসার পরিশ্রম দিয়ে গড়তে থাকে হাসপাতালের। প্রতিটা ইটের গাঁথুনি পেল সুখের ও ভালোবাসার ছোঁয়া। কেউ কেউ তো সারাদিন অন্যের কামলা দিয়ে, অর্জিত অর্থ দিয়ে ও নিজের শ্রম দিয়ে রাত্রিবেলা হাসপাতাল বানানোর কাজ করতে থাকে। অন্যখানে যখন ওরা কাজ করত, অল্পতেই তারা ক্লান্ত হয়ে যেত। কিন্তু খুবই অদ্ভুত ব্যাপার, সারারাত হাসপাতালের কাজ করেও তাদের পরিশ্রমে ক্লান্ত অনুভব হয় না। এলাকার ছোট-বড়, পুরুষ-মহিলা সকলে সেখানটাই কাজ করে। মা-বাবা, তাদের সন্তানকে বলে,” যা বাজান! হাসপাতালের কাজে যা!” এমন অপরুপ দৃশ্য কম দেখতে মেলে আজকাল।
দেখতে দেখতে হাসপাতালের কাজও শেষ হয়। সবাই হাসপাতালের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকে, সুন্দর ভোরের। যে ভোর দূর করবে রাত্রির অন্ধকার।
এখন শুধু জরিনা আসার বাকি।
গ্রামের সকলে সিদ্ধান্ত নেয়, জরিনা যখন ডাক্তারি পাশ করে গ্রামে ঢুকবে, গ্রামের প্রবেশ পথে বড় আয়োজনে বরণ করে নিবে। তাই তাদের সে-কি তড়িগড়ি সাজসোজ্জা। পুরো গ্রামকে সাজিয়েছে আপন মহিমায়।
আগামীকাল গ্রামবাসীর মহেন্দ্রক্ষণ। তাই গ্রামে উৎসবের আমেজ। সবাই ঈদের ন্যায়, নতুন জামা কাপড় পরেছে। শানাই-এর বাঁশি বাজছে, যেন আজ গ্রামে কোনো বধূ বরণ। দূরপাল্লার মানুষও ভিড় করেছে ডাক্তার দেখার। ডাক্তার দেখেনি যে তা নয়; কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে ডাক্তার দেখেনি কেউ।
সবাই ডাক্তার জরিনাকে দেখার জন্য বরণ ঢালা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে আসার। রাস্তার দু’পাশে হাতে রজনিগন্ধা ফুলের থালি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে অধির আগ্রহে কেউ কেউ। দূরে একটা সাদা গাড়ি দেখা যাচ্ছে। সবাই চোখে দৃশ্যটি পড়তেই ফেটে পড়ে আনন্দে।
করিম উদ্দিন জোরেশোরে শানাইওয়ালাদের বলতে থাকে,
” আপা মনি আসতাছে। যত শক্তি আছে তত জোরে
তোরা শানাই বাজারে।”
কথা বলতে দেরি কাজ করতে দেরি নেই ওদের।
ছোট ছোট বাচ্চারা রাস্তার মধ্যে লাইন হয়ে দাঁড়ায় ফুলের মালা হাতে। নামলে পরিয়ে দিবে তাকে। রাহেলা খালা মিষ্টির থালা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। কারণ, মেহমানকে মিষ্টি মুখ করানো সওয়াবের কাজ।
সাদা গাড়িটি এলার্ম বাজিয়ে আসছে। হু আ হু আ করে। কেউ কেউ বলল, এটাত এম্বুল্যান্স। ডাক্তার আসছে এম্বুলেন্স করে?
সবাই না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। সবার নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত আছে। যদি জরিনা আপা রাগ করে???
কিছুক্ষণ পর গাড়িটি সবার সামনে দাঁড়াল। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল গাড়ির দরজায়।
উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে গোমটা টেনে সরল মহিলারা। জরিনার ভাই ইসমাইল কান্না মাখা চোখে দরজা খুলল।
সকলে তার কান্না দেখে শোরগোল বন্ধ করে দিলো। দূরে মেঘের গর্জনও শুনা যাচ্ছে।
যেন বৃষ্টি আসবে। ইসমাইল চিৎকার দিয়ে বলল, আপা আর নাই। একটা গাড়ি আপা মনির জীবন নিয়া গেছে। “
সবাই মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে,” আপা রে…!
পুরো গ্রাম একসাথে ভেঙ্গে পড়ে কান্নায়।
ফরিদ তার মাকে আঁচল টেনে বলে, মা! আমি কি ভালা হুমু না….?
ডাক্তার জরিনা গ্রামের হাসপাতালে বসা হলো না আর।
হাসপাতালের উঠোনে জায়গা হলো সাড়ে তিন হাত মাটির।
সে থেকে আজো বন্ধ হাসপাতালটি। একটি সড়ক দূর্ঘটনা শুধু একটি পরিবারকে শেষ করে দেয় না।
মাঝে মাঝে একটি জনগোষ্ঠিকেও শেষ করে দেয়।।
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com