গোধূলীর আলোয় । পর্ব -৩৫
লাল গমের ময়দা মুখে মেখে বসে বসে প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করছে সুমনা। ময়দা শুকিয়ে মুখে টান লাগছে এখন অবশ্য।কিন্তু সুমনা টান-টুনকে পাত্তা না দিয়ে পড়েই যাচ্ছে তাও আবার উচ্চস্বরে।যে প্যারাগ্রাফটা এত মনোযোগ দিয়ে পড়ছে সুমনা সেই প্যারাগ্রাফের নাম হলো,’population problem’!এখন এইটা মুখস্ত করে তবেই উঠবে এই বলে পণ করেছে সুমনা।
নিপাও পড়ছে,ওর কাল একটা ক্লাস টেস্ট আছে।নিপা পড়তে পড়তে এখন সুমনার পড়ার জন্য আর পড়তে পাড়ছেনা।সে দাঁত-মুখ খিঁচে সুমনাকে বললো,
“ওই ভূতনি,আস্তে পড়!রুমের মধ্যে নার্গিস,আইলা,সাইক্লোন,সিডর সবগুলারে এক করেছিস।আমি পড়তে পারছিনা।”
সুমনা পড়েই যাচ্ছে,দুলে দুলে পড়ছে সে এখন।নিপা এবার চিল্লিয়ে বললো,
“সুমনারররর বাচ্চিইইইই আস্তে পড়!”
সুমনা বিরক্ত হয়ে মুখে ‘চ’মত করে বললো,
“উফ,নিপাপু,আমাকে পড়তে দাও।ডাকাডাকি করো না।”
“আস্তে পড়,কানের পদ্মা ফাটিয়ে দিসনা আর আমাদেরো পড়তে দে।”
“আস্তে পড়লে তাড়াতাড়ি মুখস্ত হবেনা।আমাকে মুখ ধুতে যেতে হবে।মুখ ধোওয়াটা আমার জন্য ফরজ হয়ে গেছে তার আগে এটা মুখস্ত করে নিই।”
“আইসা কি তোর মুখস্ত করা হবেনা।আগে মুখ ধুয়ে আয় যা হাঁট!”
“না,যত কষ্টই হোক, আমি শেষ করেই উঠবো।”
“ততক্ষণে তোর গাল আর ঠোঁট আলাদা হইয়া যাইবো।”
“উফ,তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে দেরিই হয়ে গেলো।এখন আমাকে মুখটাই আগে ধুতে হবে।আর পারছিনা,চলো আমার সাথে।”
“পারবোনা।আমি তোর ‘চাকর’ না।”
“চাকর না হবে ‘চাকরানি’।”
“কি শুরু করলে তোমরা?চুপ করো।”
মিথিলা বিরক্ত হয়ে বললো।সুমনা মিথিলাকে বললো,
“আপু চলোনা একটু আমার সাথে।মুখ ধুবো আর চলে আসবো।”
“বাইরে মিতু ফোনে কথা বলছে,ওকে বল তোর সাথে যেতে।”
সুমনা বাইরে চলে গেলো।মিথিলা নুসরাতকে বললো,
“নুসরাত তোর সাথে কথা ছিলো।”
“বল!”
“বাইরে চল,নিপা আপু পড়ছে,ওর ডিস্ট্রার্ব হবে।”
মিথিলা আর নুসরাত বাইরে বের হলো।বারান্দায় অনেকে আছে দেখে ওরা সিঁড়ির কাছে আসলো।সিঁড়ির ওপর বসে মিথিলা নুসরাতকে বললো,
“কথাটা কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিনা,তারপরও বলছি,রাগ করবিনা তো?”
“কি কথা?”
“আসলে ব্যাপারটা হলো,আমার চাচাতো ভাই নিলয় আছেনা,দেখেছিসতো তুই?”
“হুম,কি হইছে?”
“অনেক কিছুই হয়ে গেছে।আমার নিলয় ভাই তোর প্রেমে পড়ে মাঝ সুমুদ্দূরে হাবুডুবু খাচ্ছে।”
“কিহ!”
“হুম,ওর বাসাতেও তোর কথা জানিয়েছে।পাগল হয়ে গেছে তোর জন্য একদম।”
“কি বলছিস?”
“ঠিকই বলছি।”
“আমার অতীত তাকে বলিসনি?”
“সব বলেছি।
“তারপরও?”
“হুম!লাভেরিয়া রোগ তাকে এমনভাবে অ্যার্টাক করেছে কি বলবো।”
“সমস্যা নাই,দুইদিন পর ভালো হয়ে যাবে চিন্তা করিসনা।”
“তোর কি মত?”
“আমার আবার কি মত,কোন মত নাই।”
“নিলয় ভাইয়া তোর ফোন নাম্বার চাচ্ছে!”
“দেওয়ার দরকার নাই।”
“নিলয় ভাইয়া ভালো ছেলে নুসরাত।একটু যদি ভেবে দেখতি ওর ব্যাপারে।”
“ওনার বাসার সবাই রাজি মানে আমার ব্যাপারে সব জানে?”
“হ্যাঁ জানে।বড় আম্মু মানে নিলয় ভাইয়ার মা একটু গাইগুই করছে।তবে সমস্যা নাই,ঠিক হয়ে যাবে।”
“কিছুই ঠিক হবেনা।আমার মত ডিভোর্সি মেয়েকে কেউ অবিবাহিত ছেলের জন্য বউ করে নিবেনা,এটা জানা কথা তাই এই ব্যাপারে প্রসঙ্গ বাদ।চল ঘন্টা বাজাচ্ছে, খেতে যাবো।”
নুসরাত উঠে দাঁড়ালো,পড়নের কামিজটা ঠিক করে হাত বাড়ালো মিথিলার দিকে।মিথিলা কিছুক্ষণ নিরবভাবে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে থাকলো।ইলেকট্রিক লাল বাল্বের হালকা আলোয় নুসরাতের মুখটাকে বড় ই অসহায় দেখালো মিথিলার চোখে।
“চল।”
নুসরাতের কথায় নুসরাতের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো মিথিলা।মিথিলা রুমে এসে বললো,
“আমার তো মিল দেওয়া নাই।তোরা যা খেয়ে আয়,আমি একটু ভাত ওয়াটার হিটারে বসিয়ে দিই।আম্মা তরকারি দিয়েছে।হাঁসের গোশত।সবার প্লেট নিয়ে আয় তোদের প্লেটে দুই পিস করে দিই।”
নুসরাত ওদের চারজনের চার প্লেট ধুয়ে ফ্লোরে রাখলো,মিথিলা সবার প্লেটে তরকারি তুলে দিয়ে বাকিটুকু নিজের জন্য রেখে দিলো।
সুমনা চুল থেকে শুকিয়ে যাওয়া ময়দা টেনে টেনে বের করতে ব্যস্ত ছোট আয়নার সামনে।মিথিলা বললো,
“খেতে যাবি না?”
“যাবো একটু পর।”
“খেয়ে আয় আগে,এসে যা করার করিস! আগে খেতে না গেলে বসার জায়গা পাবি নাতো।দাঁড়িয়ে খাওয়া লাগবে।”
সুমনা নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আজ কি দিবে জানো?”
নুসরাত সুমনার প্লেট সুমনার পাশে রাখতে রাখতে বললো,
“ডিম আর আলুর ঘাটি।”
“ডিম আর আলুর ঘাটি,চলো খাইয়া আসি।”
সায়নের জ্বর কখনো কমছে তো কখনো আবার বেশি হয়ে যাচ্ছে।মুখে একদম স্বাদ নেই।বেচারা একদমি খেতে পারছেনা।ঔষুধ খাওয়ার জন্যই যা একটু জোড় করে খাচ্ছে।আয়মানেরা রাতে আবার এসেছে সায়নের বাসায়।সবাই সায়নের রুমে বসেই আড্ডা দিচ্ছে।সায়ন বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে হয়ে আছে।
আয়মান কথার মাঝখানে আফসোসের সুরে বললো,
“তোরা আর যাই করিস স্টুডেন্ট,পড়ালেখা শেষ হয়নি এমন মাইয়ারে বিয়া করিসনা।”
“ভাবি নাই বাসায়?”বললো নিবিড়।”
“নাহ,আজকেই হোস্টেলে চলে গেছে।”
“ওহো,দুঃখ করিসনা।”
“দুঃখ করছিনা দোস্ত,এমনি এমনি চইলা আসতাছে।মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ হইয়া যাইতাছে তাই তোদের বলছি,খবরদার স্ট্যাডি করে এমন মাইয়াদের জান থাকতে বিয়া করবিনা।”
ইসতিয়াক বললো,
“আমি তো ভাবতাছি,স্কুলে পড়ে এমন মেয়েরে বিয়া করবো।এইট,নাইনে পড়ে এমন।”
আয়মান বিরক্ত হয়ে বললো,
“এইট,নাইন ক্যান,থ্রি,ফোরে পড়ে এমন পুচকি মাইয়ারে বিয়া করিস শালা!”
আয়মানের কথায় সব হো হো করে উঠলো শুধু সায়ন ছাড়া।সায়ন আছে নিজের জগতে।
কম,বেশি প্রত্যেকটি মানুষের আলাদা একটা জগৎ থাকে,সায়নেরো আছে সেরকম এক বিশাল জগৎ।যেই জগৎটাতে কারো প্রবেশ করার অনুমতি নেই একমাত্র অনুর ছাড়া।সেই জগতে সায়ন একটা ঘর বানিয়েছে অনেক আগেই।ছোট্ট একটা ঘর,ছোট্ট একটা বারান্দা।বারান্দায় রয়েছে নানারকম ফুলের গাছ।সেই বারান্দা থেকে রাতের অন্ধকারে আকাশের রুপালী চাঁদটা অনায়াসেই দেখা যাই।সায়ন মাঝেমাঝেই অনুকে নিয়ে সেই বারান্দায় পাশাপাশি বসে চন্দ্রবিলাশ করে।সেসময় সায়নের মনে একটা ইচ্ছা জাগে,ছোট্ট একটা ইচ্ছা!ইচ্ছাটা হলো অনুর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নেওয়া।কিন্তু হাত ধরার অধিকার সায়ন পাইনি তাই সে তার মনের সেই ইচ্ছাটাকে গোপনেই ভাসিয়ে দেয় দিঘির জলে।হ্যাঁ, দিঘির জল।সায়নের সেই কল্পনার জগৎএ একটা দিঘি আছে।নিরব,শান্ত একটা দিঘি।সেই দিঘিতে আছে কত শত পদ্মফুল।আছে ছোট্ট একটা নৌকা।যেই নৌকায় মাঝেমাঝেই সায়ন অনুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াই দিঘির এমাথা থেকে ওমাথা।নৌকায় দুজনে পাশাপাশি বসেনা,বসে সামনাসামনি।সামনাসামনি বসার কারণ একটাই,সেসময় সায়ন অনুকে মন ভরে দু’চোখ মেলে দেখে।আর অনু তখন ব্যস্ত থাকে দিঘির জল নিয়ে খেলা করতে।
“সায়ন?কিরে কি ভাবছি?”আয়মানের ডাকে হুশ আসে সায়নের।
“কিছুনা,বল!”
“বের হচ্ছি আমরা।তুই রেস্ট নে। কষ্ট করে হলেও ঔষুধ খেয়ে নিস,আসি আমরা।”
সবাই সায়নের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।সায়ন আবার তার নিজস্ব কল্প জগতে প্রবেশ করলো।যেই জগতে সে অনুর সাথে বাস করে,তার সাথে সময় কাটায়।
অনুর আজ ভিষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।মিথিলা ছিলো,একটু হলেও কথা বলার মানুষ পাচ্ছিলো।এখন মিথিলা নাই তাই কথা বলার মানুষ ও নাই।
অনুর বাবাও আজকাল আর বাসায় থাকে টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখছেনা।কেমন মনমরা হয়ে ঘরের কোণে বসে থাকে।কিসব ভাবে।অনু চুপিচুপি দেখে আর নিরবে চোখের জল ফেলে।সাথে নিজেকে দোষারোপ করে।ওর দাদিও নাই বাসায়।অনুর ছোট ফুপু সাথে করে নিয়ে গেছে তার বাসায়।বাসায় এখন অনু,আয়মান আর ওদের বাবা-মা।মিথিলা,আয়না,আজমিরা,অহনা আর ওদের ছেলেমেয়ে চলে যাওয়ার কারণে বিকাল থেকেই বাড়িটা গুমট ধরে আছে।অনুর দম বন্ধ লাগছে,ছাদে যেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু বসার ঘরে আয়মান বসে টিভি দেখছে যার কারণে অনু ছাদে যেতে পারছেনা।রাতও অনেক হয়েছে,এসময় ছাদে যেতে দেখলে আয়মান এমনি রেগে আছে আরো রেগে যাবে তার উপর।
অনু কি করবে বুঝতে পারছেনা।ফোন টিপতেও ইচ্ছা করছেনা।সে আবার উঠে দরজা দিয়ে উকিঁ দিয়ে দেখলো আয়মান আছে কি না!
নাহ নাই,চলে গেছে আয়মান তার ঘরে।অনু এই সুযোগে পা টিপে টিপে ছাদে আসলো।ছাদে এসে প্রথমে বুক ভরে শ্বাস নিলো কতক্ষণ।এবার শান্তি লাগছে তার।আকাশে আজ তারার মেলা।অনু এক মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো।তারাদের মাঝে হঠাৎ চাঁদের মত অনুর চোখে দেখা দিলো সজলের সুন্দর মুখটা।হুম সুন্দর মুখ কিন্তু ভিতরটা একেবারে যার কালো অন্ধকার,পচা,দুর্গন্ধময়।অনু চোখ বন্ধ করে নিলো,সাথে সাথে চোখ দিলো গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা অস্রু।বুকের চাপা ব্যাথাটাও জেগে উঠলো মুহূর্তেই।অনু বসে পড়লো ফ্লোরে।বুকে হাত দিয়ে কষ্টটাকে রোধ করতে চাইলো কিন্তু পারছেনা।আরো যেনো কষ্ট হচ্ছে।খোলা আকাশের নিচেও দমটা আবার বন্ধ হতে চাচ্ছে।
অনু শুয়ে পড়লো ছাদের ফ্লোরে।গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে শুরু করলো।পারছেনা সে সজলের দেওয়া কষ্টটা সহ্য করতে।কাঁটার মত বিঁধে আছে যেনো কষ্টটা।
চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো অনু।রাতের আঁধারে সেই কাঁন্নার আওয়াজ মিলিয়ে গেলো রাস্তা দিয়ে যাওয়া গাড়ির শব্দের সাথে।
থামছেনা অনুর কাঁন্না,পারছেনা ভূলতে সজলের মুখটা সাথে ওদের সুন্দর মুহূর্তের স্মৃতিগুলো।সব যেনো দল বেঁধে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনুর চোখের সামনে।
বিষাদের আগুনে পুড়তে থাকা অনু এক সময় কাঁদতে কাঁদতে ছাদের মেঝেতেই নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়লো।কেউ জানলোনা মেয়েটা এখন কোথায়,কি করছে,কেমন আছে।
চলবে….
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com