গল্পঃ তুমিহীনা । নাজমুল হুদা
আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বেশ খানিকটা অবাক হলাম। আমার গলায় বেশ কয়েকটা কামড়ের দাঁগ। স্পষ্ট ভাবে দাঁগ গুলো তাকিয়ে আছে।
আয়ান শুধু আমার ঠোঁট দুটো স্পর্শ করেছে। কিন্তু গলায় কামড়গুলো কখন দিলো?আয়ান শুধু আমায় আকড়ে ধরেই ছিলো। তবে আয়ান ভালোমতই আমায় স্পর্শ করতে চেয়েছে। কিন্তু আমার বারন করাতে আয়ান আর কাছে আগায় নি।
ভোর বেলায় আয়ান আমার বাসা থেকে বের হয়ে চলে গেছে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়েই আয়ান আমার রুমে ঘাপটি মেরে ছিলো। কিভাবে রুমে এসে পালিয়ে ছিলো আমি ঠিক জানি না। আমার রুমটা পাঁচতলার এক কর্নারে। কোনো কিছু বেয়ে উঠার সিস্টেমও নেই।
আমি এখন বাসায় সবার সামনে যাবো কিভাবে? সবার চোখ তো যাবে আমার গলার দিকে। নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে আমার।
আয়ান ফাজিলটা কখন আমায় গলায় কামড় বসিয়ে দিলো? আমি তো আয়ান না যাওয়া পর্যন্ত জেগেই ছিলাম।
‘আজ থেকে তিন বছর আগে ট্রেইনে করে নানা বাড়ি থেকে আমার বাসায় ফিরছিলাম। কেবিনের পাশের সিটে বসে ছিলো শান্তশিষ্ট একটি ছেলে।
খুব শান্তশিষ্ট ভাবেই আমার পাশে বসে আছে। কানে এয়ারফোন গুজে চোখ দুটি বন্ধ করে গান শুনছি। জানালার পাশে হেলান দিয়ে বসে আছি। এটাই ছিলো আমার একার প্রথম ভ্রমন। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি ছেলেটি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমার চুল গুলো উড়ে ওর মুখের উপরে পড়ছে। হাত দিয়ে বার বার চুল সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু চুল গুলো বেহায়ার মত আবারো ওর মুখের উপরে পরছে।
আমি শুধু ‘স্যরি’ বলে চুল গুলো পেঁচিয়ে নিলাম।
মিটমিটিয়ে হাসছে পাশে বসা ছেলেটি। আমার কিছুটা লজ্জাও লাগছে।
ফোনটা হাতে নিয়ে ফেইসবুকিং করছি, ম্যাসেজ চেক দিয়ে দেখি হিমেল বেশ কয়েকটা ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছে। আমি হিমেলের সাথে কথা বলে কয়েকটা সেল্ফি তুলে পাঠিয়ে দিলাম।
পাশের সিটে বসা ছেলেটি আমায় বললো…
– মেয়েরা প্রচুর সেল্ফি খোর। যেখানেই যাক না কেনো পিক তুলতে হবেই?
– কি বললেন?
– কই কিছুই তো বলিনি।”
– আপনি আমায় কি জেনো বলছেন! কি বলছেন আবার শুনি?
– আরে কিছুই না। কি নাম আপনার?
– নাম যেনে কি করবেন? আমার কোনো নাম নেই।
– আচ্ছা? নাম না হয় না’ই বললেন। কিন্তু এটা তো বলেন আপনি এত বোকা কেনো?
– হোয়াট? আমি বোকা হতে যাবো কেনো?
– আপনি যে তড়িঘড়ি করে ট্রেইনে উঠে পরলেন, আপনার হ্যান্ডব্যাগটা কোথায়?
– অফস্! ব্যাগটা আমি স্টেশনে রেখে এসেছি। এখন কি হবে আল্লাহ!
– কি হবে? আপনার জরিমানা হবে।
– কেমন?
– আপনার ব্যাগটা কুড়িয়ে যে আমি নিয়ে এসেছি এজন্য তো জরিমানা হবে।
– থ্যাংকস। কি জরিমানা চান?
– আপনার হাতে এককাপ চা।
– মেয়ে পটানোর ধান্দা বুঝি? কোনো ভাবেই সম্ভব না।
– আপনার উপকার করলাম,সেই স্বরূপ এককাপ চায়ের আবদার তো করতেই পারি,তাই না?
– তা ঠিক,কিন্তু আসলে তো এটা কোনো ভাবেই সম্ভব না।
– আপনি চাইলে সম্ভব।
– কীভাবে?
– আপনার বাসায় দাওয়াত দিবেন।
– অপরিচিত একজনকে বাসায় দাওয়াত দিবো কি কারনে?
– ‘এই নিন আপনার ব্যাগ।’
বলেই ছেলেটি আমার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিলো।
ছেলেটি কেবিন থেকে বের হয়ে পরের স্টেশনে নেমে গেলো।
হিমেল গাড়ি নিয়ে আমার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছে। স্টেশন থেকে নেমেই হিমেলের হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিলাম। গাড়িতে করে নামিয়ে দিলো আমার বাসার কিছুটা দূরে।
আজ হিমেলের সাথে আমার সম্পর্ক নেই তিন বছর হলো।আয়ানের ভালোবাসা আমায় মুগ্ধতায় ভরে রেখেছে। হিমেল মাঝে মধ্যে আমায় ফোন দেয় বা যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে।
হিমেলের সাথে বিচ্ছেদ হওয়ার গল্পটা না হয় পরে এক সময় শুনাবো।
রুম থেকে বের হতে অনেকটা ভয় লাগছে। যদি কেউ দেখে ফেলে বাসার সবাই কি বলবে? দাঁতের যে স্পষ্ট দাগ গুলো পরে আছে। সবার মনে প্রশ্ন জাগবে কিভাবে গলায় কামড়ের দাগ আসলো।
আমি আয়ানকে ফোন দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু রিসিভ করছে না। ভোরেই বের হয়ে চলে গেছে আয়ান। সারারাত দুজনের কেউ ঘুমাতে পারিনি। আয়ান হয়তো বাসায় গিয়ে ঘুমুচ্ছে। আমি আর ফোন না দিয়ে বিছানার মাঝে গুটিসুটি হয়ে বসে আছি। কি করবো বুঝতে পারছি না।
গলায় কোনোমতে ওড়নাটা পেচিয়ে ডাইনিং টেবিলে গেলাম। খাবার কোনো ভাবেই গলা থেকে নামছে না। খাবার নাড়াতে নাড়াতে ওভাবে ফেলে রেখেই আমার রুমে চলে আসলাম।
আয়ান আমাকে যেদিন সর্ব প্রথম স্পর্শ করে সেদিন জেনো আমার মাঝে শীতল বইয়ে গিয়েছে। সেদিন আয়ান আমায় জড়িয়ে ধরে বলেছিলো ‘তুমিহীনা আমার বেচে থাকা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে মিলি। আমি তোমাকে ছাড়া কিছুই করতে পারছি না। যেদিকে তাকাই সেদিকেই তোমাকে অনুভব করছি।’
আমি জবাবে বলেছিলাম,
– “একটা জব করেই তো আমায় তোমার বউ বানিয়ে নিতে পারো। এমন নয় যে আমার কথা আমার ফ্যামিলি মানবে না। কিন্তু তোমার এই বেকার অবস্থায় কিভাবে তোমার কথা আমার বাসায় বলি?”
– আমি তো চেষ্টা করছি কিছু একটা করার। এমন নয় যে চেষ্টা করছি না। আর তাছাড়া আমার পড়া লেখাও শেষ হয়নি। আমি আমার বাবা মাকেও কিছু বলতে পারছি না বিয়ের ব্যাপারে।
– তুমি একটা জব করে আমার বাসায় প্রস্তাব পাঠাও। আমার বিয়ে নিয়েও ছেলে দেখা শুরু করে দিয়েছে।
– কি বলো এসব?
– হ্যাঁ আয়ান সত্যিই। তোমায় প্রেশার দিতে চাইনি বলেই এসব লুকিয়েছি। আমি শুধু তোমায় জবের ব্যাপারেই বলছি।
– মিলি তোমাকে আমি খুব কাছে চাই। বুঝো না কেমন করে চাই তোমায়?
– ঠিক আছে। আমায় বিয়ে করেই কাছে নিও। আমি তো আর নিষেধ করছি না। বলো! আমার কি তোমায় ছাড়া একটুও ভালো লাগে?
আজ প্রায় ছয়মাস হয়ে গেলো আয়ানের জব মিলাতে পারছে না। আমাকেও বাসা থেকে খুব করে বিয়ের প্রেশার দিয়ে যাচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যায় আমি আয়ানকে ফোন দিয়ে কেঁদেই দিয়েছিলাম। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার কান্না দেখেই হয়তো আয়ান লুকিয়ে আমার বাসায় এসেছিলো।
আয়ান আমাকে ফোন দিয়েছে,
– কি ব্যাপার মিলি এতবার ফোন যে?
– তোমায় মিস করছিলাম। সারাটা রাত আমার কাছে কাটিয়ে দিলে, আমার এখন আর ভালো লাগছে না।
– ও এই বুঝি? ভালোবাসো খুব?
– বুঝো না কতটা ভালোবাসি?
– বুঝি তো মিলি। আমারও তো ভালো লাগছে না।
– আয়ান রাতে আমায় স্পর্শ করতে বারন করার পরেও এভাবে স্পর্শ করতে হলো?
– কেমন স্পর্শ করেছি ময়না। তুমি যেমন ভাবে চেয়েছো সেভাবেই তো তোমায় স্পর্শ করলাম?
– কিছুনা। আচ্ছা তুমি নাস্তা করে নাও। আমারও একটু কাজ আছে।
আমি আয়ানের কাছে কথাটা আড়াল করে ফোনটা কেটে দিলাম।
হিমেল ছিলো আয়ানের ঠিক উলটো। বিভিন্ন ভাবে হিমেল আমায় কাছে পাওয়ার আবদার করতো। ফোনে বা ম্যাসেজে উল্টাপাল্টা কথাও বলতো। যেটা ছিলো আমার সব চেয়ে বিরক্তিকর। এই একমাত্র কারনেই হিমেলের কাছ থেকে আমার দূরে সরে যাওয়া। কিন্তু হিমেল বেশ কেয়ারিং ছিলো। খাবার-দাবার নিয়ে বেশ সিরিয়াস থাকতো। হিমেল যে বড়লোকের ছেলে তার বিন্দুমাত্র ছাপ ছিলো না ওর মাঝে।
খানিক বাদেই আয়ান আমাকে আবারো ফোন দেয়,
– মিলি কি হয়েছে বলো তো? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
– তুমি এভাবে কামড় দিয়ে গলায় দাগ বসিয়ে দিলে কেনো? আমি এখন সবার সামনে যাবো কিভাবে?
– মিলি আমি তো তোমায় জড়িয়ে ধরেই অচেতন অবস্থায় ঘুমিয়েছিলাম। ভোর হওয়ার আগেই চলে এসেছি। কখন দিলাম ময়না? আমার তো মনে পরছে না।
– আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না।
– আচ্ছা তুমি একটু সামলাও। আমি হয়তো ঘুমের ঘোরেই কামড়টা দিয়েছিলাম।
– বাদ দাও।তোমার সম্পত্তি যেভাবেই চাইবে সেভাবেই তো পাবে,আমি তো তোমারই সম্পত্তি। কি করছো?
– রেডি হচ্ছি। একটু বাহিরে বের হতে হবে।
– আচ্ছা ঠিক আছে। আমারও একটু পড়ার বাকি আছে৷
– ওকে।
আয়ান ফোনটা কেটে দিলো। এভাবে আর আয়ানকে আমার বাসায় আসতে দেওয়া যাবে না। আগেও দুইবার এসেছে। তবে আমার সাহায্যেই আসছিলো। কিন্তু আর না।
মাথাটা প্রচুর পরিমানে ব্যথা করছে। এত্ত পরিমান মাথা ব্যথা শুরু করছে যে মেঝেতেই বমি করে দিয়েছি। কোনো ভাবে ছোট ভাবিকে ডাক দিলাম। সে এসে আমার এমন অবস্থা দেখে সবাইকে চিল্লানি দিয়ে ডাক দিলো।
কিছুক্ষন পরে কিছুটা স্বাভাবিক হলাম। কিন্তু কারো চোখ থেকে এড়িয়ে যায়নি আমার গলার দাগটা। ছোট ভাইয়া সবার মাঝেই বলে উঠলো,
– তোর গলায় কি হয়েছে?
– এলার্জিতে চুলকিয়ে এমন করে ফেলছি।
– দেখতে তো কোনো কিছুর কামড়ের মত।
– কি জানি আমি খেয়াল করিনি। কামড় আসবে কোত্থেকে?
কেউ আর কথা না বাড়িয়ে আমার পাশেই বসে রয়েছে সবাই। আমি বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে আর দুই ভাইয়ের একমাত্র ছোট বোন।
ম্যাসেঞ্জারের টুং শব্দে মোবাইলটা ভাইয়া হাতে নিলো।
হাতে নিয়েই হিমেলের পাঠানো ভিডিওটা চালু করলো। চালু করতেই জেনো আমার মাথার রগ গুলো ছিড়ে গেলো…..
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com