Breaking News

গোধূলীর আলোয়। পর্ব -৩৩



ঘর অন্ধকার করে বারান্দায় বসে সিগারেট টানছে আয়মান।কয়েকটা আগেই শেষ করে ফেলেছে,এখনো চলছে!যতক্ষণ না মিথিলা রুমে আসবে ততক্ষণ সিগারেট একটার পর একটা সে টেনেই যাবে এটাই আয়মানের আজকে রাতের সিদ্ধান্ত।মিথিলা যখন ঘরে আসবে তখন সে মিথিলার একদম কাছে গিয়ে সিগারেট টানবে আর সিগারেটের যত ধোঁয়া সব মিথিলার মুখের ওপরে ছাড়বে।মিথিলার ওপরে রেগে গেলে এতদিন কল্পনায় আয়মান এই কাজটা করতো আজ সরাসরি করবে,করবেই।
মিথিলা এখনো আসছেনা দেখে আয়মানের রাগ আরো মগ ডালে চলে যাচ্ছে।রাগে তার কান লাল হয়ে গেছে।আয়মান মনে মনে বললো,
“কেমন মেয়ে বিয়ে করলাম আমি?এ মেয়েতো আমাকে মানেই না!আমি যে তার স্বামী,এত বড় ঘরটাই একাই আছি অথচ তার আসার নামই নাই।স্বামীকে একটু সময় দিতে হয় সেটা ভাবেইনা।নগদ দেন মোহর দিয়ে এ আমি কি করলাম আল্লাহ!”
মনে মনে কথা বলার মাঝেই আয়মানের কান খাড়া হলো দরজার খোলার শব্দে।খট করে উঠলো দরজাটা।মিথিলা এসেছে।আয়মানের নগদ দেনমোহর দেওয়া বউ,’গোধূলীর আলোয়’দেখা কমলা পরিটা এসে হাজির হয়েছে আয়মানের ঘরে।আয়মান উঠে দাঁড়ালো,দরজার ফাঁক দিয়ে অন্ধকার ঘরের দিকে তাকালো।জানালা খোলা থাকায় আর বারান্দা খোলা থাকায় একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে নাই ঘরটা।জোৎস্নার একফালি আলোয় আলোকিত হয়ে আছে হালকা হালকা।আয়মান মিথিলার ছায়া দেখে বিরবির করে বলতে শুরু করলো,
“জোৎস্না রাতে,চাঁদের আলোর ফাঁকে,
হারিয়ে যাবো দুজন দুজনাতে…!”
“না না,জোৎসা রাতে, চাঁদের আলোর ফাঁকে,সিগারেটের ধোঁয়া উড়াবো তোমার ওই চাঁদপানা মুখখানেতে!তুমি কাশবে আমি দেখবো,মজা লুটবো,আহা!মজা লুটবো।তোমার চোখ দিয়ে পড়বে পানি,নাক দিয়ে পড়বে পুটা…ইয়াক কি ভাবছি,ছিঃ!”
মিথিলা সুইচবোর্ডটার কাছে গিয়ে লাইট অন করলো।সাথে সাথেই সাদা আলোয় ঘরটা ঝকঝক করতে শুরু করলো।মিথিলা দেখলো ঘরে আয়মান নাই!বিছানা ফাঁকা,সোফা ফাঁকা।সারাঘরের কোথাও আয়মান নাই।
মিথিলা যখন ঘর খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত ,সেসময় আয়মান ব্যস্ত ঝকঝকে সাদা আলোর মাঝে দাঁড়ানো সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি পড়া মেয়েটাকে দেখতে।শাড়িটায়,সবুজের সাথে,সাদা,কালোও আছে,টানা টানা চোখ দুটোয় গাঢ় কাজল,ঠোঁট রক্তজবার মত লাল,হাতে সবুজ,সাদা,কালো কাঁচের চুড়ি।চুলগুলো খোলা।মিথিলা ফ্যান ছাড়লো,সাথে সাথে তার খোলা চুলগুলো উড়তে শুরু করলো হালকা দোলায় ফ্যানের বাতাসে।আয়মান নিনির্মেষ ওই কাজল চোখের তাঁতের শাড়ি পড়া মেয়েটিকে দেখে যেতে থাকলো দরজার ফাঁক দিয়ে।আয়মান বিরবির করে বলে উঠলো,
” ও মাই গড!এ কে?আমার নগদ দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করা ওই বউটানা!মেয়ে তুমি কি আমাকে এই রাত দুপুরে পাগল করার জন্য এই পাগল করা সাজ সেজেছো!তুমি জানোনা,তোমার এই সাজ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই।হারিয়ে ফেলি নিজেকে,তাহলে কেনো আজ রাতে এই সাজে আসলে আমার ঘরে?কেনো আসলে, তোমার বদ স্বামীর কাছে?আজ তো তুমি শেষ প্রিয়তমা,তোমার আরো একবার সর্বনাশ হবে আজ আমার কারণে।আমিতো তোমাকে অন্য শাস্তি দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।এখন,এখন যে…”
মনের অজান্তেই আয়মান হাতে থাকা সিগারেটটা ফেলে দিলো,এক’পা দু’পা করে এগিয়ে আসলো মিথিলার কাছে।মিথিলা বিছানা ঠিক করছিলো উল্টো হয়ে!আয়মান মিথিলার কাছে এসে মিথিলার বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরালো মিথিলাকে।মিথিলাকে কিছু বলতে না দিয়েই,মিথিলার অবাক হয়ে যাওয়া ভয়ার্ত কাজল কালো চোখে চোখ রেখে বলতে শুরু করলো আয়মান সাদাত হোসাইনের ‘কাজল চোখের মেয়ে’কবিতা।
“শোনো,কাজল চোখের মেয়ে,
আমার দিবস কাটে,বিবশ হয়ে,
তোমার চোখে চেয়ে।”
এতটুকু বলে থামলো আয়মান,মিথিলার কপালে উড়ে আসা ছোট ছোট চুলগুলোকে মিথিলার কানের পাশে গুজে দিয়ে, কপালে ভালোবাসার চুম্বন এঁকে দিয়ে, মিথিলার গালে হাত দিয়ে আবার বলতে শুরু করলো ,
“দহনের দিনে,কিছু মেঘ কিনে,
যদি ভাসে মধ্য দুপুর,
তবু মেয়ে জানে,তার চোখে মানে,
কারো বুক পদ্মপুকুর।
এবার মিথিলাকে জড়িয়ে ধরলো আয়মান খুব সাবধানে,যত্ন করে।এরপর মিথিলার কানের কাছে মুখ নিয়ে আয়মান বললো,
“এই যে মেয়ে,কাজল চোখ,
তোমার বুকে আমায় চেয়ে
তীব্র দাবির মিছিল হোক।
মিথিলা আয়মানের বুক থেকে মুখ তুলে আয়মানের দিকে তাকালো,আয়মান তখন মিথিলার চোখে ডুবে আবারো বলতে শুরু করলো,
“তাকাস কেন?
আঁকাস কেন বুকের ভেতর আকাশ?
কাজল চোখের মেয়ে,
তুই তাকালে থমকে থাকে,
আমার বুকের বাঁ পাশ।
মিথিলা আবার মুখ লুকালো আয়মানের বুকে।আয়মান মিথিলার লুকানো মুখটা দুই হাতে তুলে ধরলো তারপর বললো,
“অমন কাজল চোখে তুমি চেয়ো রোজ,
ওই চোখে জীবনের হিসেব সহজ।
মিথিলা চোখ নামিয়ে নিলো।আয়মান মিথিলার চোখে ভালোবাসা এঁকে দিয়ে বললো,
“তোমার চোখ চেয়েছি বলে,এমন ডুবল আমার চোখ,
অমন অথৈ জলে রোজ,আমার ডুব সাঁতারটা হোক।
শোনো,কাজল চোখের মেয়ে,আমি তোমার হবো ঠিক,
তুমি ভীষণ অকূল পাথর,আমি একরোখা নাবিক।”
মিথিলা তাকালো আয়মানের চোখে।আয়মান একটু থেমে আবার বলতে লাগলো,
“শোনো,জল ছলছল কাজল চোখের কন্যা সর্বনাশী,
আমি তোমায় ভালোবাসি।”
‘আমি তোমায় ভালোবাসি’কথাটা শুনতেই মিথিলা মুখ লুকালো আবার আয়মানের বুকে।আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরলো আয়মানকে।আয়মানও দেরি করলোনা,সেও ভালোবাসার চাদর দিয়ে ঢেকে নিলো মিথিলাকে।
ফ্যানের শন শন শব্দের ভিড়ে মিশে গেলো দুই নর-নারীর নিঃশ্বাস আর নিঃশ্বাসের শব্দ।মিশে গেলো ওরা দুজন দুজনের বাহুডোরের মধ্যে।
এদিকে তাদের ঘরের ‘ডোর’ যে খোলা সেদিকে খেয়াল নাই দুজনের একজনেরো।দুজন দুজনের মাঝে এমনভাবেই হারিয়ে গেছে যে কোন দিকে হুঁশ নাই তাদের।
আয়মান মিথিলার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
“বলবেনা,ভালবাসো আমাকে এই কথাটা?”
“সব বলবে,আগে দরজা লাগা হারামজাদা।”অহনার গলার আওয়াজ পেয়ে মিথিলা আর আয়মান দুজন দুজনকে ছেড়ে দুইদিকে ছিটকে সড়ে গেলো।অহনা বললো,
“দরজা খুলা রেখেই দুজনে সিনেমা শুরু করে দিয়েছিস।আব্বা-আম্মা দেখলে কি হতো?দরজা লাগা।ভাগ্যিস আমি পানি নিতে নিচে নেমেছিলাম।”
আয়মান মাথা চুলকাতে শুরু করলো,মিথিলা ওর নখ খুটতে শুরু করলো।
অহনা দুজনের লজ্জ্বায় রাঙা হওয়া মুখটা দেখে মুচকি হেসে চলে আসলো।অহনা যেতেই আয়মান তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা লাগালো।দরজা লাগানো শেষ করে মিথিলার দিকে চেয়ে একটু দুষ্টু হাসি দিলো আয়মান।মিথিলা আয়মানের দুষ্টু হাসি দেখে আয়মানকে একটা ভেংচি দিলো তারপর ঘুরে দাঁড়ালো,তখনি আয়মান এসে মিথিলাকে কোলে তুলে নিলো।মিথিলাও আচমকা এমন হওয়ায় ভয় পেয়ে আয়মানের গলা জড়িয়ে ধরলো।গলা জড়িয়ে ধরার পর বললো,
“নামান এখন,রাত হয়েছে অনেক,ঘুমাতে হবে তো।”
“আবার ঘুমের কথা বলছো?কাল রাতে আমাকে রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছিলে আজ আবার বলছো!”
“তো কি করবো না ঘুমিয়ে?”
“করার অনেক কিছুই আছে।যতক্ষণ না ঘুম আসে ততক্ষণ গল্পও করা যাই।অবশ্য আজ মুখে গল্প হবেনা। অন্যভাবে আজ গল্প হবে।”
“ধূর!”
“ধূর!”
ভোরের আলোয় পৃথিবী যখন নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত,পাখিরা যখন দলে দলে আহারের সন্ধানে যেতে ব্যস্ত সেসময় সায়ন ব্যস্ত ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে। সায়নের জ্বরটা ছেড়েছে অনেক আগেই।ফজরের নামাজও পড়েছে তারপর ছাদে এসে এখন আকাশ দেখছে।শরীরটা দূর্বল,শরীরে,জোড় নাই,মুখে স্বাদ নাই,মনে শান্তি নাই তারপরো চোখটাকে একটু প্রশান্তি দিতে,শরীরে ভোরের সতেজ হাওয়া মাখতেই ছাদে আসা সায়নের।
আকাশ দেখতে বরাবরি পছন্দ করে সায়ন।সাথে অনুকে দেখতেও।সরাসরি অনুর চোখে কখনো চেয়ে থাকা হয়নি তার তবে লুকিয়ে লুকিয়ে বহুবার সে দেখেছে অনুকে। সায়নের খুব ইচ্ছা ছিলো,
কোন এক ভোরে,শিশির ভেজা ঘাসের ওপরে পা দিয়ে সে অনুর চোখে চোখ রাখবে।অনুর ওই গাঢ় গভীর চোখে খুঁজে দেখবে নিজের কোন অস্থিত্ব আছে কিনা!
আজ আর সেই আশা করেনা সায়ন।আজ সে চেষ্টায় আছে ‘অনু’ নামের মেয়েটাকে ভূলে যাওয়ার।সারাজিবনের জন্য তার মনের সমস্ত অনুভূতিকে বালু চাপা দেওয়ার।
কি হবে মনে রেখে,অনুভূতিকে পুষে রেখে।লাভ তো নাই।তাহলে মনে রেখে যন্ত্রণায় দগ্ধ হওয়ার কোন মানেই নাই।
এক তরফা ভালোবাসার কখনো জয় হয়না এই গল্প বহুবার শুনেছে সায়ন তারপরও ভালোবেসে গিয়েছিলো সে অনুকে এক তরফা ভাবে।লাখ লাখ স্বপ্ন সাজিয়েছিলো মনের ছোট্ট ভুবনে।কত রকমের স্বপ্ন।স্বপ্নগুলো অবশ্য ‘কমন’।ওমন স্বপ্ন সবাই দেখে তার মনের মানুষকে নিয়ে।
‘মনের মানুষ’!সায়ন মুচকি হাসলো।শুকনো ঠোঁটে হাসিটা বেমানান ছাড়া আর কিছুই না।এই হাসি যে সুখের হাসি না!এই হাসি হলো,যন্ত্রণার হাসি,কষ্টের হাসি,ব্যর্থতার হাসি।
‘ব্যর্থতা’!জিবনে এভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে কোন কাজে সায়ন কি তা ভেবেছিলো কখনো?ভাবলে কি আর ভালোবাসতো সে ওই ‘হৃদয়হীনা’মেয়েটিকে!যে মেয়ে কখনো বুঝলোইনা সায়নকে।মেয়েরা নাকি ছেলেদের চোখ দেখলেই বুঝে ফেলে ছেলেদের মনের কথা।তাহলে অনু কেনো বুঝলোনা?সায়নের প্রশ্ন নিজের মনের কাছেই।এই প্রশ্নটা সায়ন নিজের মনকে অনেক বার করেছে।তার মন সঠিক উত্তর দেয়নি।মনের কাছে প্রশ্ন করেও সায়ন বার বার ব্যর্থ হয়েছে।কত শত বার সায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে আর আপন মনে বলেছে,
“হায়রে ব্যর্থতা,হায়রে ব্যর্থ ভালোবাসা,হায়রে ব্যর্থ জীবনটা।”
আবার জ্বর আসছে,হু হু করে উঠলো সায়নের শরীর জ্বরে।সাথে মনটা অনুর জন্য হু হু করে কেঁদে উঠছে।সায়ন আর দাঁড়ালোনা ছাদে।রুমে এসে শুয়ে পড়লো কাঁথামুরি দিয়ে।
সায়নের মা সায়নের রুমে আসলো খানিক পরে।সায়নের কপালে হাত দিয়ে বুঝলো আবার সায়নের জ্বর এসেছে।
“সায়ন?”
“হুম!”
“আবার তো তোমার জ্বর এসেছে আব্বু,আমাকে ডাকোনি কেনো?”
সায়নের কথা আসছেনা।ভিষণ ঠান্ডা লাগছে ওর।
“ঔষুধ খেতে হবে,আমি তোমার জন্য সুপ আর ঔষুধ নিয়ে আসি কেমন।”
সায়নের মা চলে আসলো সায়নের রুম থেকে।সায়নের রুম থেকে বের হয়ে সায়নের মা সামিরের রুমে গেলো।সামির অংক করছিলো বসে বসে,সায়নের মা গিয়ে সামিরকে বললো,
“সামির,আব্বু!তোমার ভাইয়ার রুমে গিয়ে অংক করো।জ্বর এসেছে আবার সায়নের,আমি ওর জন্য সুপ করে নিয়ে আসি।”
“আচ্ছা আম্মু,যাচ্ছি।”
চলবে…

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com