প্রিয় বান্ধবী । পর্ব -০৪
সাকিব এতোটাই তৃপ্তি করে খাচ্ছে যে দেখে খুবেই শান্তি লাগছে।
ওর খাওয়া দেখে ওর সামনে থেকে চলে আসলাম।
যদি খেয়াল করে দেখে আমি তাহলে আর খাবে না তাই।
বাইরে এসে দাঁড়াতেই মনটা আরো বেশী খারাপ হয়ে গেল!
বাহিরে কি সুন্দর চাঁদের আলো সাথে হাল্কা বাতাস!
বাতাস টা এতোটাই ঠান্ডা যে মন-প্রাণ জুড়ে যায়।
এই মূহুর্তে যদি ভালোবাসার মানুষটা পাশে থাকতো, তাহলে তার কাঁধে মাথা রেখে জ্যোৎস্না বিলাস করা যেত!
কিন্তু আমার কপালটা এতোটাই খারাপ যে আজ আমার বাসর রাত হবার পর ও আমার স্বামী আমার পাশে নেই।
আচ্ছা আমাদের গল্পটা তো অন্য রকম ও হতে পারতো।
যদি সেদিন সাকিব মৌকে না ভালোবেসে আমাকে ভালোবাসা তো!
তাহলে হয়তো আজ মৌ আমাদের সাথেই থাকতো।
মৌ বেঁচে থাকলে না জানি আমার বিয়ে নিয়ে কতোটা মাতামাতি করতো!
আমাদের তো কতো পরিকল্পনা ছিলো আমার বিয়ে নিয়ে!
কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল!
সকাল থেকে না খেয়ে থাকায় প্রচন্ড খুদা লেগেছিল তাই কোন দিকে না তাকিয়ে পছন্দের পাস্তা পেয়ে গপাগপ করে খেয়ে নিতেই খেয়াল করলাম পাশে মৌ নেই।
আর তার ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা ও নেই।
তাহলে এই পাস্তা কে রান্না করে দিলো?
নিশ্চয়ই অহনা?
মৌয়ের প্রিয় বান্ধবী হাওয়াতে আর আমার সাথে ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকায় অহনা স্বাভাবিক ভাবে আমার সব পছন্দ, অপছন্দ সম্পর্কে ভালো করেই জানে।
কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার না?
সামান্য পেটের দায়ের কাছে আমি আমার বউয়ের হাতে রান্না স্বাদ ভুলে গেলাম?
আমি কিভাবে বুঝতে পারলাম না এটা মৌয়ের হাতের রান্না না!
তাহলে কি সবার বলা কথাই সত্যি হতে যাচ্ছে!?
সময়ের সাথে সাথে আমি মৌকে ভুলে যাবো!
না এইটা কিভাবে সম্ভব!?
আমি কিভাবে ভুলি সেই দিনের দেখা বোচা নাকের মেয়েকে!
এই তো সেদিন, বছর পাঁচেক আগের কথা।
আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে-
আমি তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি।
ছুটিতে গ্রামে আসায় বন্ধুর সাথে বন্ধুর বোনকে আনতে গার্লস স্কুল এর সামনে যাই।
আর তখনি দেখি ৫ফুট ১/২ ইঞ্চির একটা ফর্সা বোচা নাকের সাথে ছোট, ছোট চোখের অনেকটা জাপানি মেয়েদের মতো দেখতে একটা মেয়ে।
সব বড় বড় কবিরা মেয়েদের বড় বড় হরিণের মতো চোখ নিয়ে কবিতা লিখেছে।
তাদের বড় চোখে সবাই আটকে গেছে।
আর আমি সেই সব কবিদের উল্টা পথে হাটলাম।
আমি এই ছোট ছোট চোখে আটকে গেলাম প্রথম দেখায়।
যাকে বলে “Love at first sight”.
আমার মনে হতে লাগলো যে এই মেয়ে ছাড়া আমার জীবনের বাকি পথ চলা সম্ভব না।
১ম দেখায় তার মায়াতে আটকে গেলাম।
পড়ালেখা, খাওয়া-আড্ডা বাদ দিয়ে আমি সেই সকালে থেকে গার্লস স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
যদি ১বার তার দেখা পাই।
তার পিছে পিছে তার বাড়ি পর্যন্ত যেতাম শুধুমাত্র তার গলা স্বর শুনার জন্য।
যদি ও সে কথা কম বলতো।
কি এক অজানা মুগ্ধতা আমাকে বার বার টানতো।
সে বয়সে অনেক ছোট ছিলো তাই তাকে আমার ভালোবাসার কথা এতো তাড়াতাড়ি জানাতে চাইনি।
১ম থেকে চেয়েছি তার ওপর কোন জোর খাটাবো না।
আমি আমার অনুভূতি গুলা তাকে জানাবো আর সে যদি রাজি হয় তাহলে তার হাত ধরে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবো।
আর যদি রাজি না হয় তাহলে কোন দিন আর সামনে আসবো না কিন্তু দূর থেকে দেখে যাবো।
তাকে ছাড়া এই জীবনে অন্য কারো সঙ্গ আমার চাই না!
বন্ধু থেকে শুরু করে সবাই আমাকে পাগল বলতে লাগলো।
সবাই বললো এটা মহো কিছু দিন পর কেটে যাবে।
তখন আর ভালো লাগবে না।
তাই এই সব পাগলামি ছাগলামি ছেড়ে ক্যারিয়ারে ধ্যান দেই।
নেশা কেটে গেলে আরো ভালো কিছু পাবো।
এই সব কথা গুলো আমার কাছে বিষাক্ত লাগতো।
কাউকে সত্যি করে ভালোবাসলে আবার ভালোবাসা কিভাবে কমে?
আমি তো এই জাপানি মেয়ের নেশা সারাজীবন থাকার জন্য রাজি ছিলাম।
প্রেমে শুরুর দিক থেকে তার নামে অনেক কিছু শোনা শুরু করলাম!
যখন আমি পড়ালেখা জন্য আমার শহরে ফিরে গেলাম তখন তার নামে কতো উড়োচিঠি আসতো।
সে নাকি অপবিত্র, চরিত্রহীন সহ অনেক কিছুই শুনছি।
কিন্তু আমি কিছুই বিশ্বাস করিনি।
কারণ আমি তাকে ১ম থেকে দেখেছি সে কতোটা বোকা, সহজ-সরল আর পবিত্রতার প্রতিমা।
যে মেয়ে ভালোবাসি কথাটা বলতে ভয়ে কান্না করে, সে মেয়ে নাকি অপবিত্র।
শুনেছি তার কাছে ও নাকি আমার নামে ও উড়োচিঠি গেছে।
ভেবেই নিয়ে ছিলাম আমার বা তার পরিবারের কেউ এই উড়োচিঠি গুলা পাঠাতো যাতে আমরা আলাদা হয়ে যাই।
তাই সবাইকে উত্তম জবাব দেয়ার জন্য পড়ালেখার পাশাপাশি একটা ছোট চাকরি খুঁজে নেই।
যাতে আমি তার সব দায়িত্ব না নিতে পারলে ও মোটামুটি ভাবে তার দায়িত্ব নিতে পারি।
তারপর বাসায় জানাই আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।
কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ২ পরিবার কোন ঝামেলা ছাড়া আমাদের বিয়েতে রাজি হয়ে যায়।
কিন্তু শর্ত থাকে ১টা যতোদিন আমার পড়ালেখা শেষ না হবে আর ওর উচ্চমাধ্যমিক না শেষ হবে ওতোদিন ও ওর বাবা বাসায় থাকবে।
আমি মাঝে-সাঝে যেয়ে দেখা করতে পারবো।
যদি ১টা শর্তের মাধ্যমে সারাজীবন এর জন্য তাকে পাওয়া আমার নিশ্চিত হয়ে যায় তাহলে আমি কেন সেই শর্ত মেনে নিবো না!?
তাই বিয়েটা করেই ফেলি।
এই বিয়ে যেন আমাদের ভালোবাসার গভীরতা আরো বাড়িয়ে ছিলো।
একে অপরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান হাজার গুন বেড়ে গেল।
২জন ২জনকে কাছে পাবার জন্য ভালোমতো শর্ত পূরণ করে তাকে আমার কাছে নিয়ে আসি।
চাকরি সুবাদে আমার ঢাকায় আসা আর এখানে তাকে নিয়ে এসে আমাদের ছোট সংসার শুরু করি।
এই সংসারে প্রতিটা জিনিস ওর নিজের হাতে কেন।
প্রতিটা জিনিস ও খুটিয়ে খুটিয়ে, যাচাই-বাছাই করে দেখে শুনে কিনেছে।
সব কিছু নিখুঁত ভাবে যত্নসহকারে সাজিয়েছে।
ঘুম থেকে ওঠা থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত তাকে ঘিরে আমার সব কিছু।
যতোটুক সময় অফিসে থাকতাম শুধু ছটফট করতাম।
কখন বাসায় যাবো আর তাকে দেখবো।
কিছু দিন না যেতেই সে আমাকে সুসংবাদ দেয় আমি নাকি বাবা হতে যাচ্ছি!
আহা সে কি অনুভূতি বাবা হবার।
সেদিন তাকে জড়িয়ে কেঁদে ছিলাম। আমি বাবা হবো আর আমার ছোট বাচ্চা বউটা নাকি মা হবে ভেবে।
তার মেয়ে বাচ্চা চাই- চাইইইইইই।
তাই শুধু আল্লাহ্ এর কাছে চাইতাম যেন আমাদের ১ম বাচ্চা যেন মেয়ে-ই হয়
বাচ্চা হবে জানতে পারার পর থেকে সে কি আমাদের পাগলামী।
যে মেয়েটা কোন দিন নিজের যত্ন নিতো না, সে তার বাচ্চার জন্য নিজের যত্ন নেয়া শুরু করলোম
প্রতি মাসে আমরা বাচ্চার জন্য টুকটাক জিনিস কিনতাম।
বাচ্চাকে নিয়ে আমাদের কতো স্বপ্ন ছিলো,
কতো গল্প ছিলো।
আমি তো তাকে বলেই দিয়ে ছিলাম আমাদের বাবুর জন্য আর একটা ভাই/ বোন বাবু দ্রুত নিয়ে আসবো।
সব মিলে আমাদের কি সুখ।
সে গর্ভবতী হাবার পর থেকেই আমার মা, শাশুড়ী মা বা অহনা আমাদের বাসায় ছিলো সব সময়।
কারণ আমি ভয় পেতাম একা বাসায় তার যদি কিছু হয়ে যায়!
সবাই তাকে নিয়ে যেতে চাইলে ও আমি তাকে ছাড়া থাকতে পারবো না সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম।
আমার জেদ আর পাগলামির কাছে হার মেনে ২ মা-ই কষ্ট করছে।
সাথে অহনা ও অনেক কষ্ট করছে।
ওকে দেখা শোনার জন্য এই ৩ জন ঘুরে ফিরে আমাদের সাথে থাকতো।
যখন ও ৯ মাসে পা দিলো তখন আমি ও চাকরি ছেড়ে বাসা থাকা শুরু করলাম।
যদি ওর কষ্ট হয়, ব্যাথা উঠে আর মারা বা অহনা ওকে সময় মতো হাসপাতালে না নিতে পারে এই ভয়ে।
আমার পাগলামি দেখে ও শুধু হাসতো আর বলতো পরে যদি চাকরি না পাও তখন কি খাওয়াবে আমাদের বাচ্চাকে?
আমি শুধু বলতাম রিজিকের মালিক আল্লাহ্।
এখন যে জমানো টাকা পয়সা আছে তা দিয়ে কয়েক মাস খেতে পারবো।
শুনেছি মেয়ে বাচ্চা নাকি বরকত নিয়ে আসে।
পরী ও তা করেছে আমাদের জন্য।
পরীর জন্মের কিছুদিন পর অফিস থেকে আবার আমাকে চাকরিতে জয়েন করতে বলা হয়।
আমাদের সংসার জীবন সব মিলে ১ বছর ৭ মাসে মতো।।
আর এই ১ বছর ৭ মাসে ও আমাকে সব দিয়েছে।
সুন্দর গোছানো একটা সংসার, বাস্তব জীবনে একটা পরী।
আমাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে।
কিন্তু সে?
সে আমাদের ফাকি দিয়েছে।
পরীর হবার কিছু দিন পর থেকে অজানা কোন রোগে আক্রান্ত হয় সে।
সারাদিন কিছু খেতে পারতো না।
যদি ও কিছু খেতো তাহলে কিছুক্ষন এর মধ্যে বমি করে ফেলে দিতো।
এমন কোন ডাক্তার, হসপিটাল, টেস্ট বাকি ছিলো না।
সব কিছু ভাজা ভাজা করা হয়ে গিয়ে ছিলো কিন্তু কোন ডাক্তার-ই ওর কোন রোগ ধরতে পারেনি।
আস্তে আস্তে না খেতে খেতে ওর শরীর দূর্বল হতে থাকে।
আর আমি চোখের সামনে দিয়ে তাকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখি।
আমার ও আমাদের পরিবারে সব ভালোবাসা, প্রার্থনা তাকে সুস্থ করতে পারে না।
তাকে আগলে রাখার সে কি চেষ্টা আমার!
আমার সব চেষ্টা, ভালোবাসা, দোয়া কে ব্যর্থ প্রমান করে দিয়ে একদিন সন্ধ্যায় চলে যায় আমাকে আর আমার মেয়ে রেখে পরপারে।
আমি নিজের চোখে শুধু তাকে আস্তে আস্তে আমার থেকে দূরে যেতে দেখেছি কিন্তু তার জন্য কিছুই করতে পারিনি।
আমি শুধু ব্যর্থ স্বামী হিসেবে বেঁচে আছি।
সে আমাকে পরিপূর্ণ করছে কিন্তু আমি তার জন্য কিছুই করতে পারিনি।
যদি জানতাম পরী হবার পর তার এই অবস্থা হবে তাহলে আমি কোন দিন বাবা হতে চাইতাম না।
সারাজীবন শুধু তাকে নিয়ে থাকতাম।
যদি ও সে মৃত্যুর আগে আমাকে বলেছে তার মৃত্যুর জন্য আমি পরীকে কোন ভাবে দায়ী করি আর যদি পরীকে কোন অবহেলা করি তাহলে সে কোন দিন আমাকে মাফ করবে না।
হায়াত-মউত এর মালিক আল্লাহ্।
তাকে আল্লাহ্ যতোটুকু হায়াত দিয়ে পাঠিয়েছে ততোদিন সে বাঁচবে।
আর পরীর মধ্যেই নাকি আমি তাকে খুঁজে পাবো!!!
কিন্তু আমার যে সেই গানের মতো করে বলতে ইচ্ছে করে—–
বড় ইচ্ছে করছে ডাকতে
তার গন্ধে মেখে থাকতে
কেন সন্ধ্যে-সন্ধ্যে নামলে সে পালায়?
তাকে আটকে রাখার চেষ্টা
আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে তেষ্টা
আমি দাঁড়িয়ে দেখছি শেষটা জানলায়
চলবে....
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com