এ শহরে বৃষ্টি নামুক । পর্ব-৩৭
ময়ুখমালী বিদায় নিয়েছে একটুক্ষণ আগেই। সূর্যশূণ্য আকাশটা কে পূর্ণ করতে উঠেনি স্বার্থপর চাঁদ।
শুক্ল মেঘমেদুরে আচ্ছাদিত হয়েছে গোটা গোধুলীসন্ধ্যা।
বর্ষণপূর্ব মেঘমোহে মায়া লেগে যাচ্ছে জগতের অঙ্গে অঙ্গে।
মৃদুতা মারুতে দোদুল্যমান গোলাপি পুষ্পপাপড়ি।
ড্রইংরুমের সাজবাতির আলোতে বসে আছে সবাই। হাসিমাখা আদরে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে গোটা বাড়িটা।
মধ্যমনি রাত্রিকে ঘিরেই যেনো সবকিছু। নিভ্রান চুপচাপ বসে আছে পাশে।
চোখের দৃষ্টি প্রথম থেকেই ফোনের স্ক্রিনে। রাত্রি জোরজবরদস্তি তাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
এতো রংমহলের সবকিছুর মাঝেও কোথাও যেনো একটা বিষাদের আভা।
দুজনকে বিদায় দেবার আগমূহুর্তে নওশাদ সাহেব বললেন,”আবার নিয়ে এসো ওকে।”
নিভ্রান কিছুক্ষণ মৌন থেকে জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে গম্ভীর গলায় উওর দিলো,”আসবোনে।”
ব্যস, এতেই হাসি ফুটলো রাত্রির মুখে।
এতবছরের অভিমান তো আর একদিনে ভাঙবেনা। একটু একটু করেই না হয় ভাঙুক।
রাস্তায় আজ চরম আলোর ঘাটতি। প্রকৃতিকে ঘন ঘটার আশঙ্কা নাকি শুভ্র
কিছুর আবেদন জানা নেই নিভ্রানের। বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম।
পিচঢালা রাস্তার ধুলোমাটির অস্তিত্ববিনাশ। রাস্তার মোড় ঘুরতেই রাত্রি চেঁচিয়ে উঠলো,
—“ইশশ! দেখেন কত কদম!”
নিভ্রান একপলক দেখলো। কদম ছাপিয়ে নজর কাড়লো কমনীয় অঙ্গনার শোভিত রুপ।
কাঁধ থেকে সরে যাওয়া আচঁল। অলঙ্কারহীন বৃষ্টির ছাঁটওয়ালা সিক্ত গলদেশ।
চোখের পাপড়ির মৃদু কম্পন। রাত্রি গাড়িতে উঠেই গয়নাগাটি খুলে ফেলেছে।
আচঁল আর কোমড়ের কাছের সেফটিপিন খুলে আরাম করে বসেছে।
পলক পড়লোনা। নামলোনা চোখের পাতা। তীর্থ হলো মন। বিক্ষিপ্ত হলো হৃদয়।
নিভ্রান গাড়ি থামালো। দরজা খুলতে খুলতে হাল্কা গলায় বললো,”এনে দেই।”
রাত্রি আবারো চেঁচিয়ে উঠলো। পাগল লোকটা। এই বৃষ্টিতে নাকি ফুল আনতে যাবে।
হায়! একহাতে কোমড়ের শার্ট টেনে ধরে সে বললো,
—“নাহ্, ভিজে যাবেন। দরকার নেই।”
নিভ্রান আলতো করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। নরম গলায় বললো,”চুপ করে বসে থাকো।
“বলে একমূহুর্ত দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো সে। রাত্রি চিৎকার করলো ভেতর থেকেই,” লাগবেনা তো।
আপনি ভেতরে আসেন। উফফ”।
নিভ্রান শুনলোনা কিছুই। ঝপাঝপ পা ফেলে ভিজতে ভিজতে ছিঁড়ে নিলো পাঁচ ছটা ফুল।
গায়ের শার্ট ভিজে লেপ্টে গেলো মূহুর্তেই। রাত্রি মাথা বের করলো।
চিৎকার করে বললো,”আপনি আসবেন নাকি আমিই নামবো?”
নিভ্রান এদিক ওদিক তাকালো। রাস্তায় মানুষ ভরা। নির্জন হলে সে নিশ্চিত বাঁধা দিতো না।
কিন্তু এখন অসম্ভব। বৃষ্টিসিক্ত রাতের সৌন্দর্য শুধু যে উপভোগ করবে আর কেউ নয়।
ফুলগুলো একহাতে মুঠ করে ধরে রাত্রির পাশের দরজা খুললো সে।
রাত্রি হাত বাড়িয়ে নিলো। মাথা বের হওয়ার চুলের সামনের অংশ ভিজে গেছে তার।
টপটপ করে পানি গড়িয়ে ঠোঁটের কাছে জমা হচ্ছে। রাত্রি মুছেছে হয়তোবা।
গাঢ় লিপ্সটিক ছড়িয়ে গেছে। নিভ্রান চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
একাধারে সেই ঠোঁটের ভাঁজে। সরে যাওয়া আঁচলের খুব গভীরে।
রাত্রি মুখ খোলার আগেই সে হাত ধরে টেনে বের করে দ্রুত পিছনের দরজা খুলে ভেতরে বসিয়ে দিলো।
ঢুকে গেলো নিজেও। রাত্রি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,”কি হ..”
কথা সম্পূর্ণ হলোনা। তার আগেই হাত বাড়িয়ে ওপাশের জানালার কাঁচ উঠিয়ে দিয়ে অধরে অধর ছুঁয়ে দিলো নিভ্রান। জানলার কাঁচে ঠেকে গেলো রাত্রির মাথা। কদমগুলো পড়ে গেলো নিচে।
নরম হাতদুটো আঁকড়ে ধরলো পিঠ। গাড়ির ইনার লাইট নিভানো তখন।
আধো আলোয়ই পিপাসায় কাতর নিভ্রান মত্ত হয়ে উঠলো।
বাড়লো ছোঁয়ার প্রগাঢ়তা। অনুভূতিতে পিষ্ট হলো রাত্রি। ঠোঁটের কাছ থেকে গলায় গেলো স্পর্শ।
নেমে গেলো আচঁল। সংবেদনশীল স্হান শিরশির করে নিস্তেজ হলো।
নরম ভাবটা সরে হঠাৎই হিংস্র হয়ে উঠলো মোলায়েম আদর। নিভ্রান যেনো হুঁশে নেই।
রাত্রি কাতরে উঠলো। পিঠ থেকে হাত সরিয়ে নিভ্রানের গালে রেখে আর্তনাদ করে বললো,
—“শান্ত হন।”
নিভ্রান শান্ত হলোনা। উন্মাদ হয়ে উঠলো আরো। হঠাৎ একটা আগ্রাসী কামড়ে চোখের জল ছেড়ে দিলো রাত্রি। একহাত দিয়ে বুকে ঠেস দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
—“ব্যাথা পাচ্ছি।”
নিভ্রান থেমে গেলো। একফোঁটা চোখের পানি টুপ করে পড়লো তার ঘাড়ে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো তীব্র অনুশোচনা। সে কি করছে? ছিহ্! ঠোঁট সরে গেলো। নিভ্রান স্হির চেয়ে রইলো ভেজা গালে। রাত্রি মাথা নিচু করে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছলো।
কান্নাভেজা কন্ঠেই অপরাধীর মতো ক্ষীণ গলায় থেমে থেমে বললো,”সরি আমি…সত্যিই ব্যাথা পাচ্ছিলাম। নয়তো আপনাকে বাঁধা দিতাম না।”
নিভ্রান নমনীয় চোখে চাইলো। সরি তো তার নিজের বলা উচিত। উল্টো মেয়েটা নাকি সরি বলছে। মাথার পিছে হাত রেখে রাত্রিকে কাছে টেনে নিলো সে। কপালটা নিজের কাঁধে ঠেকিয়ে চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে কোমল গলায় বললো,
—“বেশি লেগেছে রাত?”
রাত্রি কোমড়ের শার্ট মুচরে ফুঁপিয়ে উঠলো। মানুষটা কাছে এলেই কেনো সব ভেস্তে যেতে হবে? কেন সে একটু সহ্য করতে পারলোনা? কেনো ব্যাথা পেতে হলো? কেনো আটকে দিতে হলো?
নিভ্রান দীর্ঘ: শ্বাস ফেললো। চোখ বুজে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। অত: পর নম্রভাবে বললো,”আচ্ছা, কাঁদেনা। দেখি, কোথায় লেগেছে? ওষুধ লাগিয়ে দেই, আর জ্বলবেনা।” বলে বাহু ধরে সরাতে নিলো সে। রাত্রি সরলোনা। হাতদুটো দিয়ে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ভেজা বুকের সাথে লেপ্টে রইলো।
নিভ্রান গাঢ় রাশভারি কন্ঠে বললো,
—“আমি তোমাকে চাইছি রাত। এক্ষুণি চাইছি, এ মূহুর্তেই চাইছি। খুব করে চাইছি। কিন্তু, এভাবে নয়। তোমাকে যন্ত্রনা দিয়ে নয় অবশ্যই। তোমার অনুমতি ছাড়া, শতভাগ সম্মতি ছাড়া আমি হাজারবছরও অপেক্ষা করতে রাজি।”
রাত্রি মিনমিন করে বললো,”আমি তো আপনারই।”
নিভ্রান নিশব্দে হাসলো। মাথার তালুতে ছোট্ট চুমু খেয়ে প্রসন্ন স্বরে বললো,
—“আচ্ছা, ছাড়ো। আমি ভিজে আছি। জড়িয়ে ধরে তুমিও ভিজে যাচ্ছো। জ্বর বাঁধবে।
ছাড়োনারে বাবা।”
রাত্রি ছেড়ে দিলো। নিভ্রান শাড়ির আচঁল তুলে দিলো কাঁধে।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ফুলগুলো কুঁড়িয়ে দিলো হাতে। রাত্রি ইততস্ত ভঙ্গিতে কি যেনো দেখলো।
বামহাতটা একটু উঠিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নিভ্রানের ঠোঁটের কাছটায় মুছে দিলো।
আঙ্গুলে লেগে গেলো গাঢ় লিপস্টিক। মুছে যাওয়ার বদলে আরো ছড়িয়ে গেলো ঠোঁটের কোঁণে।
নিভ্রান হেসে ফেললো। বারকয়েক ঘষে ঘষে মোছার চেষ্টা করে বললো,”গেছে?”
রাত্রি দু’পাশে মাথা নাড়ালো। নিভ্রান হাল ছেড়ে বললো,
—“থাক, সমস্যা নেই।”
বাসায় এসে শাওয়ার নিয়ে, খাওয়া দাওয়া করে রুবিনার কোলে মাথা রেখে বহুক্ষণ শুয়ে রইলো রাত্রি। মাথায় ঝট পাকিয়ে আছে গোলমেলে অনুভূতি। হচ্ছে তীব্র চিনচিনে ব্যাথা। রুবিনা মেয়ের ভেজা চুলের গোছা ছড়িয়ে দিচ্ছে বারবার।
হঠাৎই চোখ পড়লো ঘাড়ের লাল হয়ে আসা অংশে। ভ্রু কুঁচকে গেলো।
পরক্ষণেই মুখে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি। মেয়ের সুখের সংসার দেখাই যেনো সবচেয়ে সুখের।
কিন্তু মেয়েটা এমন গোমড়া মুখে শুয়ে আছে কেনো? ও বাসায় কি কিছু হয়েছে?
হলে তো নিশ্চয়ই বলতো তাকে। নিভ্রানের ডাক শোনা গেলো।
উচ্চশব্দে রাত রাত করে চিল্লাচ্ছে সে। রাত্রি ঝটপট উঠে বসলো।
“আসি” বলে হাঁক ছেড়ে মা কে ঘুমাতে বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।
ঘরের বাতি নিভানো। ব্যালকনির কাঁচ সরানো। বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে সাড়াঘরে।
নিভ্রান বালিশের সাথে হেলান দিয়ে কোলের উপর ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে।
স্ক্রিনে হয়তো লাল রংয়ের কিছু বের করা। সেই লাল আলোর আভায় সুদর্শন চেহারার আকর্ষন বেড়ে গেছে।
কপালে পড়ে আছে কিছু চুল। রাত্রি মুগ্ধ হয়ে দেখলো।
নিভ্রান ল্যাপটপের দিকে চেয়েই একহাতে পাশের জায়গাটায় দুবার হাতের বারি দিয়ে ইশারা করে বললো,” শুয়ে থাকো এখানে, ভালোলাগছেনা আমার।”
রাত্রি তার বাচনভঙ্গি শুনে হেসে ফেললো।
দ্রুত বিছানায় উঠে বসে নিভ্রানের বাহুর নিচ দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে বুকে মাথা রাখলো।
পেট জড়িয়ে ধরলো। নিভ্রান অবাক হলেও কিছু না বলে ভালোকরে আগলে নিলো।
রাত্রি দু’তিন সেকেন্ড মনিটরের দিকে চেয়ে থেকে বললো,
—“অফিস না আপনার নিজের? তো আপনি এতো কাজ করেন কেনো?”
—“আমার দেখেই তো কাজ বেশি।”
রাত্রি প্রত্যুওর করলোনা। ল্যাপটপের স্ক্রীনের উপরে সময় দেখা যাচ্ছে।
বুকের বামপাশটায় কান পেতে সে হৃদস্পন্দন গুনলো পুরো একমিনিট। ১০৩, ১০৪, ১০৫।
রাত্রি আৎকে উঠলো। সাধারণত হার্টবিট থাকে ৬০-১০০। ১০০ ও উঠেনা সচরাচর।
আর এই লোকের নাকি একশোর বেশি তার সাথে এতো জোরে জোরে স্পন্দিত হচ্ছে।
চোখেমুখে আশঙ্কা নিয়ে মাথা তুললো সে। কপালে গলায় এলোমেলো হাত ছুঁইয়ে বললো,
—“আপনি ঠি ক আছেন? হার্টবিট এত বেশি কেনো? একশো পাঁচ প্রতিমিনিটে। শরীর খারাপ লাগছে?”
নিভ্রান ভ্রু কুঁচকে বললো,”মানে? আমার হার্টবিট কতো তুমি কেমনে জানলে?”
—“গুনলাম তো মাত্র।”
নিভ্রান ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বললো,
—“তুমি হার্টবিট গুনছিলে? আর আমি ভাবলাম ভালোবেসে বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে বউটা আমার। আহা! এজন্যই তো হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো হু হু করে।”
—“উফফ! আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
—“পাওয়াই তো উচিত। তোমার জন্যই তো হার্টবিট বেড়ে গেলো। এখন এটা তো তোমারই কমাতে হবে।”
রাত্রি কপালের চুল কানের পিছে গুঁজতে গুঁজতে বললো,
—“পারবোনা। সরুনতো, মাথা রাখতে দিন।”
—“এখানে যে ঘুমাবে…স্ক্রীনের আলোতে ঘুম আসবে?”
রাত্রি চোখ বুজে বললো,
—“খুব আসবে।”
নিভ্রান একহাত দিয়ে চোখের উপরটা ঢেকে দিলো। আলোর প্রবেশপ্রথ বন্ধ হয়ে যেতেই মুচকি হাসলো রাত্রি।
এতো ভাগ্য তার? এতো সুখ কপালে?
নিভ্রান পাঁচআঙ্গুলে ল্যাপটপের কি- বোর্ড এফোড়ওফোড় করে কাজ শেষ করলো আধঘন্টার মধ্য। ল্যাপটপটা বন্ধ করে কোলের উপর থেকে সরাতেই রাত্রি হাল্কা গলায় বললো,”শেষ?”
নিভ্রান সচকিত গলায় বললো,
—“ঘুমাওনি?”
—“উহু। ঘুম পাচ্ছেনা।”
নিভ্রান ল্যাপটপটা বেডসাইড টেবিলে রাখলো। মৃদু শব্দ হলো। গায়ের ব্ল্যাঙ্কেটটা ঠি ক করলো। আধশোয়া শরীর সোজা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে বললো,
—“কেনো ঘুম পাচ্ছেনা?”
রাত্রি হরিণীর মতো চোখদুটি মেলে চেয়ে রইলো নির্নিমেষ।
লাজলজ্জা ভেঙে আচমকাই একটু উঠে গিয়ে চোখ মেলালো চোখে চোখে।
কপাল ঠেকালো কপালে। ক্ষণিকসময়ের নিরব কথোপকথন শেষে যা বোঝার বুঝে গেলো নিভ্রান।
তৃপ্ত হেসে দু’হাতে কোমড় জাপটে ধরে বললো,”রাত?”
রাত্রি চোখ নামিয়ে নিলো। উষ্ণ অনুভূতিতে তপ্ত হলো আশপাশ।
বৃষ্টির গতিকের সাথে তাল মিলিয়ে চললো এতদিনের অপেক্ষার অবসান।
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com