গোধূলীর আলোয় । পর্ব -৩৭
ইদানিং মিথিলার শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। তেমন কিছু খেতেও পারছেনা।বেশিরভাগ খাবারই গন্ধ লাগে।মাছ,ডিম এগুলোতো সহ্যই করতে পারছেনা।যা খাচ্ছে তাই বমি হয়ে উঠে যাচ্ছে।চোখ-মুখ কেমন যেনো হয়ে গেছে।এদিকে পরীক্ষাও শুরু হয়ে গেছে।শরীর খারাপের জন্য পড়াতেও মনোযোগ দিতে পারছেনা।বেশ কিছুদিন আগে থেকেই এমন হচ্ছিলো কিন্তু মিথিলা তেমন পাত্তা দেয়নি।এখন দিনকে দিন আরো বেশিই খারাপ করছে।কি হচ্ছে কিছুই সে বুঝতে পারছেনা।কাউকে এতদিন জানায়নি তবে আজ আয়মানকে না জানিয়ে থাকতে পারলোনা।সকাল থেকে মাথা অতিরিক্ত ঘুরছে সাথে বমি।
মিথিলা এমন অসুস্থ আর আগে কেনো সে আয়মানকে জানায়নি শরীর খারাপের কথা এটা শুনে আয়মান প্রথমে একটু রাগ দেখিয়ে পরে বললো সে আজ রাতেই রাজশাহী আসবে এবং আগামীকাল ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবে।মিথিলা নিষেধ করেছে,আসার প্রয়োজন নাই এই বলে কিন্তু আয়মান শুনলেতো।এমনিতে সে তার বউটার চাঁদমুখখানা দেখতে পারছেনা দূরে থাকার কারণে তার ওপর অসুস্থ!কিভাবে থাকবে আয়মান দূরে,পারবেনা সে থাকতে।
প্রয়োজনীয় কিছু কেনার জন্য নুসরাত গেছে নিউমার্কেটে। সাথে আছে সুমনা। সেও কেনাকাটা করবে। সবজির দোকানে গিয়ে নুসরাত সবজির দোকানদারকে বললো,
“মামা আলু দেনতো এক কেজি।”
“এক কেজিতে হয় নাকি পাঁচ কেজি নাও।”নিলয় পাশ থেকে বললো নুসরাতকে।প্যান্টের দুই পকেটে দুই হাত রেখে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে নিলয় নুসরাতের দিকে। নুসরাত নিলয়কে দেখে প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে চিনতে পেরে বললো,
“আপনি এখানে?”
“চিনতে পেরেছো তাহলে! যাক,আমাকে বেশি খাটাখাটনি করতে হলো না চিনানোর জন্য।”
সুমনা বললো,
“আপনি মিথিলা আপুর ভাইয়া তাইনা?”
“হুম আর তোমার দুলাভাই।তোমার নুসরাত আপুর ভবিষ্যৎ জিবনসঙ্গী।”
সুমনা মুচকি হাসলো।নিলয়কে বললো,
“আপনি ঢাকায় থাকেননা?”
“থাকতাম।এখন থেকে রাজশাহীতেই থাকবো আর তোমাদের দেখাশোনা করবো।”নুসরাতের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বললো নিলয়।
দোকানদার নুসরাতকে এক কেজি আলু একটা পলিথিন ব্যাগে দিলো। নুসরাত বললো,
“কাঁচা মরিচ দেন ২৫০ গ্রাম।ডিম দেন এক হালি।”
সব নেওয়া শেষ হলে,সুমনারও সব কেনা হলে দুজনে চলে আসছিলো তখন নিলয় ওদের আগ ঘিরে নুসরাতের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বললো,
“এখনি চলে যাবে? আরেকটু থাকোনা।”
নুসরাত কিছু না বলে চলে আসছিলো সুমনার হাত ধরে নিলয়কে পাশ কাটিয়ে তখন নিলয় আবার নুসরাতের সামনে আসলো।নুসরাতের চোখের দিকে তাকিয়ে সুমনাকে বললো,
“সুমনা,এখানে হালিম পাওয়া যাই,খেতে ভালোই চলো টেস্ট করা যাক সাথে টং দোকানের চা।”
সুমনা নুসরাতের দিকে তাকালো তারপর বললো,
“আপু যদি যাই তাহলে আমার কোন আপত্তি নাই কারণ হালিম খেতে আমার খুব ভালো লাগে।”
“যাবে তোমার আপু,তুমি আসো আমার সাথে।”
“নিলয় সামনের দিকে পা বাড়ালো,সুমনাও পা বাড়াচ্ছিলো নিলয়ের সাথে যাওয়ার জন্য কিন্তু যেতে পারলোনা।নুসরাত সুমনার হাত শক্ত করে ধরে নিয়ে টেনে একটা রিকশার কাছে এসে বললো,
“মামা, মহিলা কলেজে যাবেন?”
“যাবো।”
“নুসরাত রিকশায় উঠলো।সুমনা একবার পেছন ফিরে নিলয়কে দেখলো। নিলয় যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো ওখানেই আছে। সুমনা রিকশায় উঠে আবার নিলয়ের দিকে তাকিয়ে হাত ঝাকিয়ে ‘বাই’ বললো।
“কিভাবে জানলো আমরা নিউমার্কেট আসছি?”নুসরাতের গলা অন্যরকম শোনালো।
সুমনা নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
“জানিনা।”
“কে জানে?”
“আমি কিভাবে বলবো কে জানে?তুমি আমাকে রাগ দেখাচ্ছো কেনো?”
“তোরা সবাই ওর দিকে হয়েছিস আর মিথিলাতো আছেই আগে থেকে। এসব করে কোন লাভ হবেনা মনে রাখিস।”
সুমনা আর কিছু বললোনা।রিকশা কলেজের সামনে থামতেই নিলয়ও একটা বাইক নিয়ে এসে দাঁড়ালো গেইটের কাছে।সুমনাকে বললো,
“এখানে পাঁচটা আইসক্রিম আছে তোমাদের জন্য।”
সুমনা আইসক্রিমগুলো নিয়ে হাসি মুখে বললো,
“থ্যাংঙ্কিউ ভাইয়া।”
নিলয় মুচকি হেসে বললো,
“ওয়েলকাম।”
নুসরাত নিলয়কে দেখেই তাড়াতাড়ি গেইটের ভিতর গিয়ে সুমনার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো।সুমনা আসতেই আবার হাঁটা শুরু করলো।রুমে এসে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো সুমনা।শুয়ে থেকেই মিথিলাকে বললো,
“মিথিলা আপু,নিলয় ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছিলো।নিলয় ভাইয়া রাজশাহী এসেছে,এখন থেকে সে এখানেই থাকবে।”
“জানি।”
“আর হ্যাঁ,এই যে আইসক্রিম আমাদের সবার জন্য দিয়েছে।সুমনা উঠে নিপার হাতে একটা,মাইশার হাতে একটা,মিথিলার কাছে গিয়ে মিথিলাকে একটা,মিতুকে একটা সব শেষে নুসরাতকে দিতে গেলো আইসক্রিম।
“আপু নাও।”
“আমি খাবোনা, তুই খেয়ে নে।”
“কেনো খাবেনা? নিলয় ভাইয়া দিয়েছে তাই?শোনো, খাওয়ার জিনিসে কখনো না করতে নাই।”
মিথিলা বললো,
” নিয়ে নে না নুসরাত,এমন করিস ক্যান? আমার ভাইটা কত ভালোবেসে দিয়েছে।”
“আমি নিউমার্কেট গেছি এই কথা তোর ভাইকে বলতে গেছিস ক্যান?”
“জানতে চাইলো তাই।বললো,”মিথিলা তোমার ভাবি কি করে?” আমি বললাম,”ভাবি এখন নিউমার্কেট যাবে তাই বের হচ্ছে!”তখন ভাইয়া বললো, “তাহলে তো এই সুযোগে একবার তোমার ভাবির সাথে দেখা করতে হয়!”আমি বললাম,”হ্যাঁ যাও,দেখা করো।সবজির দোকানের কাছেই পাবে।”
“এসব করে কিছু হবেনা মিথিলা।তোর ভাইকে ভালোভাবে বুঝা।”
“তোকে কে বললো বোঝাচ্ছিনা?বোঝাতেই আছি কিন্তু পাগল শুনলেতো।”
সুমনা এখনো আইসক্রিমটা ধরে নুসরাতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।নুসরাত রাগি চোখে সুমনার দিকে তাকিয়ে বললো,
“খাবোনা বললাম না! যা আমার সামনে থেকে।”
সুমনা চলে আসলো নুসরাতের কাছ থেকে।দুই হাতে দুই আইসক্রিম নিয়ে বসলো খাটের ওপর পা ভাজ করে তারপর দুইটা আইসক্রিমে একে একে বাইট দিতে দিতে বললো,
“আহ,আইসক্রিমটা সেই গো।প্রাণটা জুড়িয়ে যাচ্ছে।আহা,আহা।”
আয়মান আজ মিথিলাকে নিয়ে এসেছে ডাক্তারের কাছে।ডাক্তার মিথিলার কাছে সব শুনে কিছু টেস্ট করতে দিলো এরপর টেস্ট করানো শেষ হলে ডাক্তার আয়মানকে বললো বিকেলে এসে টেস্টের রিপোর্টগুলো নিয়ে যেতে। আয়মান মিথিলাকে নিয়ে চলে আসলো ডাক্তারের চেম্বার থেকে।মিথিলা চেম্বার থেকে বের হয়ে আয়মানকে বললো,
“গতকাল চলে যাবেন?”
“হ্যাঁ, সামনে আবার অনুর বিয়ের জন্য ছুটি নিতে হবে।”
“ওহ।”
“হুম।”
আয়মান বাইকে বসে বাইক স্টার্ট দিলো।মিথিলা বাইকের ব্যাক সিটে বসে আয়মানকে শক্ত করে ধরলো।পেছনে ঘাড় ঘুড়িয়ে আয়মান মিথিলাকে বললো,
“পরশু যে পরীক্ষা আছে ওই বইটা আর যা যা লাগে কাউকে গেইটের কাছে আনতে বলো,তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো।”
মিথিলা বললো,
“নিয়ে এসেছি।ব্যাগে আছে ।”
আয়মান বাইক চালাতে চালাতে মিথিলার কথা শুনে জোড়ে ব্রেক মেরে গাড়ি থামালো।মিথিলার দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে বললো,
“আমার বউ তো খুব ফার্স্ট দেখছি।আমার মনের কথা আগেই বুঝে গেছে।”
মিথিলা মাথা নিচু করে মিটিমিটি হেসে বললো,
“কার বউ দেখতে হবে তো।”
“হুমমম,রাস্তা না হলে এখন তোমাকে যে কি করতাম গো জান,চলো তাড়াতাড়ি বাসায় যাই।”
আয়মান আবার বাইক স্টার্ট দিলো।বাসায় এসে পৌঁছাতেই দেখলো,মিথিলার শ্বাশুড়ি,দাদি শ্বাশুড়ি আর অনু বসার ঘরে বসে ওদের জন্য অপেক্ষা করছে।মিথিলাকে ওর শ্বাশুড়ি কাছে টেনে নিয়ে পাশে বসিয়ে বললো,
“আমার মায়ের যে শরীর খারাপ আগে আমাদের জানাওনি কেনো মা?”
“আপনারা টেনশন করবেন তাই।”
আয়মানের দাদি বললো,
“চোখ-মুখের কি হাল করেছিসলো দাদি?তোর চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুই পেট বাঁধিয়ে বসে আছিস।বমি,মাথা ঘুরা এইসব তার জন্যেই হচ্ছে।”
আয়মানের দাদির কথা শুনে সবাই ওনার দিকে তাকালো।আয়মান ওর দাদির পাশে বসতে বসতে বললো,
“পেট বাঁধানো কি দাদি?নতুন কোন রোগ?”
“আরে না ছুড়া।পেট বাঁধানো মানে তোর বউ ‘পুয়াতি’ এমন মনে হচ্ছে আমার।”
আয়মান আবার প্রশ্ন করলো,
“পুয়াতি কি দাদি?”
আয়মানের দাদি এবার আয়মানের দিকে কটমট করে তাকালো।তারপর দাঁত পিষে বললো,
“গর্ভবতীরে হারামজাদা।ইংরেজিতে পেগনেন না কি বলে ওইটা।”
“প্রেগন্যান্ট?”
“হয় ওইটায়।”
আয়মানের মা বললো ওর শ্বাশুড়ীকে।
“আমারো তাই মনে হচ্ছে মা।আল্লাহ দিলেই হতো।”
আয়মানের দিকে তাকিয়ে আয়মানের মা বললো,
“ডাক্তার কি বললো?”
“বিকালে রিপোর্ট দিবে।কি হয়েছে ওর তখনই জানা যাবে।”
বিকালবেলা আয়মান রিপোর্ট নিয়ে এসে বাড়িতেই সবার সামনে দেখলো।দেখার পর আয়মানের খুশি দেখে কে।খুশিতে আটখানা হয়ে সবার সামনেই মিথিলার কাছে গিয়ে বললো,
“মিথিলা,আমার নগদ দেনমোহর দেওয়া বউ,আমার জান,আমার কলিজা,আমার পরাণপাখি, তোমারে আমি কই রাখি,কিভাবে আদর করি! তুমি সত্যিই গর্ভবতী।”
আয়মানের দাদি পাশ থেকে বললো,
“আমি আগেই বলেছিলাম না,আমরা আগের মানুষ চোখ-মুখ দেখেই বলতে পারি।”
আয়মান ওর দাদির কাছে গিয়ে ওর দাদিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমিও বাপ হয়ে গেলাম দাদি।”
ওর দাদিকে ছেড়ে ওর মায়ের কাছে গিয়ে বললো,
“আম্মা তুমি এবার দাদি হয়ে গেলে।”
ওর আব্বাকে বললো,
“আব্বা তুমি দাদা হয়ে গেলে।”
অনুর কাছে গিয়ে অনুকে বললো,
“তুইতো ফুপি হয়ে গেলিরে।শোন তোকে তোর শ্বশুরবাড়ি থেকে এক বছরের জন্য নিয়ে এনে এখানে রাখবো।আমার বাচ্চার ত্যানা ধোয়ার জন্য।”
“আমি ত্যানা ধুবো?”
“হ্যাঁ,ফুপু না তুই।”
“আমার বাচ্চা হলে তাহলে তোকে দিয়ে ধোয়াবো।হাজার হলেও একমাত্র মামা হবি তুই।”
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com