তোমাকে ঘিরে আমার অনুভূতি। আনিকা ফাহমিদা
আদ্র ভাইয়া তুমি কেন আমাকে জোর করে সুইজারল্যান্ড এনেছ? আমি কি দোষ করেছি? কেন আমাকে আমার আম্মু আব্বুর কাছে যেতে দিচ্ছো না?
অনুর কথা কানে যেতেই আদ্র অনুর দিকে তাকালো।আদ্র রুমের জানালার গ্রিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রের ডান হাতে মদের বোতল। মদ খেয়ে আদ্রের চোখ দুটো যেন আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। অনু বিছানার এক কোণায় ভয়ে বসে আছে। অনুর হাতের মধ্যে লোহার শিকলের বাঁধন লাগানো। আদ্র রাগী স্বরে অনুকে বলল,
–তুই কি করেছিস তুই জানিস না?
অনু ঘাবড়ে গিয়ে আদ্রকে বলল,
–না, জানি নাতো। আমাকে দেশে ফিরে যেতে দাও আদ্র ভাইয়া। আমি আম্মু আব্বুর কাছে যাবো। আজ তিনদিন হয়ে গেল আম্মু আব্বুর সাথে আমার কথা বলা হয় না। নিশ্চয়ই আম্মু আব্বু আমার জন্য খুব চিন্তা করছে।
আদ্র মদের বোতলটা টেবিলে রেখে দিয়ে রেগে অনুর কাছে এগিয়ে এসে বলল,
–চুপ। একদম চুপ৷ তুই কোনো কথা বলবি না। তোকে আমি কোথাও যেতে দিবো না।
অনু বিরক্ত হয়ে আদ্রকে বলল,
–আরে সমস্যা কি তোমার? আমার আব্বুকে বলেছিলে আমাকে তুমি ভার্সিটিতে পৌছে দিবে কিন্তু তুমি কি করলে? ভার্সিটি পৌঁছে দেওয়ার নাম করে আমাকে অজ্ঞান করিয়ে বিদেশে নিয়ে এসেছ আবার তুমিই বলছো আমাকে চুপ করে থাকতে? আমি চুপ থাকবো না। তুমি আমাকে জোর করে বিদেশে এনেছ।
আদ্র রাগী স্বরে নিজের চোখ বন্ধ করে অনুকে বলল,
–বেশ করেছি তোকে জোর করে বিদেশ এনেছি। এটাই তোর সাথে হওয়ার ছিল।
অনু রেগে গিয়ে আদ্রকে বলল,
–কি? তুমি বেশ করেছো?আমার জ্ঞান ফেরার পর আমি চেষ্টা করেছিলাম পালানোর জন্য কিন্তু তোমার কাছ থেকে পালাতেও পারি নি। তুমি খুব খারাপ। এতো শক্ত শিকল হাতে বেঁধে রাখলে কেউ কি করে পালায়? তুমি আমার পায়ের মধ্যেও তো শিকল বেঁধেছিলে যাতে আমি হাঁটতে না পারি। এতো অনুরোধ করার পর একটু পায়ের শিকলটা খুলেছো। এবার আমার হাতের শিকলগুলোও একটু খুলে দাও?
আদ্র গম্ভীর স্বরে অনুকে বলল,
–তোর হাতের শিকল খোলা যাবে না অনু। শিকল খুললেই তুই পালানোর চেষ্টা করবি। আর একটা কথা ভালো করে শুনে রাখ তোকে আমার সাথে এই সুইজারল্যান্ডেই থাকতে হবে। পালানোর চেষ্টা ভুলেও যদি করিস তাহলে তোর কপালে শনি আছে।
অনু রাগী স্বরে চিৎকার করে আদ্রকে বলল,
–তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছো আদ্র ভাইয়া? নেহাতই তুমি আমার আব্বুর প্রিয় বন্ধুর ছেলে। নাহলে তোমাকে আমি উচিত শিক্ষা দিয়ে দিতাম।
আদ্র হেসে অনুকে বলল,
–তোর আব্বুর বন্ধুর ছেলে যদি আমি না হতাম তাহলে তুই আমাকে কি শিক্ষা দিতি?
অনু চিৎকার করে আদ্রকে বলল,
–কি শিক্ষা দিতাম জানতে চাও? তোমাকে আমি খুন করে ফেলতাম। একবার আমার হাতের শিকলগুলো খুলে দাও তারপর বুঝিয়ে দিচ্ছি এই অনু কি জিনিস আর কি কি করতে পারে। তোমাকে আমি মেরেই ফেলবো। আমার হাতের শিকলগুলো খুলে দাও বলছি।
আদ্র সাথে সাথে এগিয়ে এসে অনুর হাতের লোহার লিকলের বাঁধনগুলো খুলে দিল। অনু কল্পনাও করে নি আদ্র অনুর হাতের বাঁধনগুলো এতো সহজে খুলে দিবে। অনুর দুই হাত এখন খুব হালকা লাগছে। এতোক্ষণ হাতগুলো লোহার শিকলের ওজনে ভারি হয়ে ছিল। অনু অবাক হলো। খুশি হয়ে অনু আদ্রকে বলল,
–এতো সহজে আমার হাতের বাঁধন তুমি খুলে দিলে?
আদ্র অনুর কপালের সামনে পড়ে থাকা অল্প চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
–হ্যা খুলে দিলাম। তুই না আমাকে খুন করবি? এবার আমাকে খুন কর ৷ আমি দেখতে চাই তুই আমাকে কিভাবে মারতে পারিস।
অনু থমকে গেল। আদ্রকে খুন করার কথা বলেছিল তো রেগে গিয়ে। এখন অনু আদ্রকে কি বলবে? কি বলা উচিত? অনুর মাথায় কোনো উত্তর আসলো না। আদ্র অনুকে জিজ্ঞেস করল,
–কি হলো শুরু কর।
অনু বুঝতে না পেরে আদ্রকে কাঁপা গলায় বলল,
–কি শুরু করব?
আদ্র হেসে অনুকে বলল,
–আমাকে খুন করার কাজটা শুরু কর।
অনু আদ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। কি যেন আছে আদ্রের চোখে। আদ্রের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকালে অনুর মনে যেন কেমন একটা ঝড় বয়ে যায়। কেন এমন হয় তা অনু জানে না। অনু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে আদ্রকে বলল,
–আমি সিরিয়াসভাবে তোমাকে কথাটা বলি নি। রেগে গিয়ে বলে ফেলেছিলাম।
আদ্র অনুর গালে আলতো করে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলল,
–আমি জানতাম তুই আমাকে মারতে পারবি না। যা করতে পারবি না তা বলিস কেন?
অনু মন খারাপ করে আদ্রকে বলল,
–তুমি আমার সাথে এমন করছো কেন? আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমার এই বিদেশে খুব ভয় লাগছে। বুকের ভিতর ব্যথা করছে।
অনুর কথা শুনে আদ্র হঠাৎই অনুকে জড়িয়ে ধরল ৷ আদ্র জড়িয়ে ধরায় অনুর বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। বুকের ধুকপুকটা যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল। কিন্তু আস্তে আস্তে অনু যেন শান্ত হয়ে গেল। আদ্র অনুর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
–এখন কি তোর ভয় লাগছে?
অনু আদ্রকে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বলল,
–অদ্ভুত! আদ্র ভাইয়া আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরার পর আমার ভয় চলে গেল কেন?
অনু চেয়েছিল আদ্রকে নিজের কাছ থেকে সরাতে কিন্তু আদ্র অনুকে এতোটাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে যে অনু আর ছাড়াতে চেষ্টা করল না।
অনু তবুও শান্ত স্বরে অসস্থি নিয়ে আদ্রকে বলল,
–আমাকে ছাড়ো আদ্র ভাইয়া। তুমি মদ খেয়েছো। আমার ভয় লাগছে তোমাকে।
আদ্র সাথে সাথেই অনুকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
–আমাকে তোর ভয় লাগছে? কি ভাবছিস এই বিদেশে এনে আমি তোর ক্ষতি করবো? আমি মদ খেলেও মাতাল হই নি। চিন্তা নেই তোর ক্ষতি আমি করবো না।
অনু কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে আদ্রকে বলল,
–আমি আম্মু আব্বুর কাছে যাবো। আমাকে আম্মু আব্বুর কাছে নিয়ে যাও।
আদ্র এবার রেগে গেল। অনুর গাল ডানহাতে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–তোর কানে কি কথা যায় না? কি বলেছি তোকে আমি? তুই কোথাও যেতে পারবি না৷ আংকেল আর আন্টির কাছে তোকে আমি যেতে দিবো না৷ আমার সাথেই তোকে থাকতে হবে।
অনু আদ্রের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বলল,
–আমি কি তোমার বিয়ে করা বউ নাকি যে আমি তোমার সাথে থাকবো? আমার পড়াশোনা আছে। সামনে আমার অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা আর তুমি আমাকে সুইজারল্যান্ড তুলে নিয়ে আসলে? আমার পড়াশোনার তুমি বারোটা বাজিয়ে দিলে! আদ্র ভাইয়া তোমার তো পড়াশোনা কমপ্লিট হয়ে গেছে। তুমি এই সুইজারল্যান্ড থেকে এতো ভালো রেজাল্ট করেছো। তুমি আমার কষ্টটা বুঝবে না। কখনই বুঝবে না।
অনুর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল। রাগে অনু ঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগল। আদ্র অনুর কান্না দেখতে লাগল। আদ্রের খুব ইচ্ছে করছে অনুর চোখের জল মুছে দিতে কিন্তু আদ্র নিজের ইচ্ছে মনের মধ্যেই দমে রাখল। আদ্র টেবিল থেকে মদের বোতলটা নিয়ে আসলো। মদের বোতলে এখনও অর্ধেকটা মদ আছে। তারপর কিছুক্ষণ আদ্র মদের বোতলটার দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে হাসলো। অনু কাঁদছে তাই অনু খেয়াল করে নি আদ্র কি করছে। আদ্র মদের বোতলটা খুলে অনুর মাথায় পুরোটা মদ ঢেলে দিলো। অনু কান্না বন্ধ করে আদ্রের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
–এটা তুমি কি করলে আদ্র ভাইয়া? আমাকে মদ দিয়ে তুমি ভিজিয়ে দিলে? ছিঃ মদের কি বাজে গন্ধ!
মদের গন্ধে অনুর বমি চলে আসতে লাগল। কিন্তু অনু বমি করতে পারলো না। আদ্র অনুকে বলল,
–কাঁদতে কাঁদতে তোর মাথা আগুন হয়ে গেছে। তাই তোর মাথায় আমি মদ ঢেলে দিলাম। অবশ্য তোর মাথায় পানি দেওয়া যেতো কিন্তু মদের সাথে তোর ভালো সম্পর্ক আছে। তাই মদটাই তোর জন্য ভালো।
অনু অবাক হয়ে বিরক্তি স্বরে আদ্রকে বলল,
–মদের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক আছে? মানে? কি বলতে চাইছো তুমি?
আদ্র অনুর পাশে বসে অনুকে বলল,
–হ্যা তোর সাথে মদের খুব ভালো সম্পর্ক আছে। তুই জানতি না নিশ্চয়ই? এখন তো জানতে পারলি।
অনু গম্ভীর স্বরে আদ্রকে বলল,
–তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছো আদ্র ভাইয়া। খুব বেশি অপমান করছো।
আদ্র অবাক হওয়ার ভান করে অনুকে বলল,
–কি বলছিস তুই অনু? আমি তোকে অপমান কেন করবো? তোকে আমি অপমান করি নি। আচ্ছা এটা বল মদের মধ্যে একটা জিনিস আছে সেটা কি?
অনু বিরক্তি স্বরে আদ্রকে বলল,
–আমি কি মদ খেয়েছি নাকি যে জানবো মদে কি আছে? তুমি মদ খাও তুমি ভালো করে জানো।
আদ্র শান্ত স্বরে অনুকে বলল,
–মদে নেশা বলে একটা জিনিস আছে। সেই নেশাটা তোর মধ্যেও আছে অনু।
আদ্রের কথা শুনে অনুর মাথা ঘুরতে লাগলো। শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল। অনু ভয় পাওয়া দৃষ্টিতে আদ্রের দিকে তাকালো। অনু আদ্রের কাছ থেকে অনেক দূরে গিয়ে বসলো। আদ্র মুচকি হেসে অনুকে বলল,
–আরে আরে ভয় পেলি নাকি? ভয় পাওয়ার মতো তো আমি কিছু বলি নি। যা সত্যি তাই তো বললাম।
অনু কিছু বলল না। কিন্তু মনে মনে অনু আদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
–এই আদ্র ভাইয়াটা খুব অদ্ভুত মানুষ। এই সুইজারল্যান্ডে থেকে পড়াশোনা করে হয়তো আরও অদ্ভুত হয়েছে। আদ্র ভাইয়াকে পুরোপুরি বুঝতেও পারছি না৷ এই ছেলের মাথায় সারাদিন কি চলে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না। আমার কি আর বাংলাদেশে যাওয়া হবে না? আচ্ছা এই আদ্র ভাইয়া কি আমাকে সত্যি সত্যি যদি কোনো গুন্ডার হাতে তুলে দেয় তখন আমার কি হবে? আমি তো পুরো শেষ হয়ে যাবো।
অনুর জানালার বাইরে তাকালো। এখন রাত। আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। অনুর নিজের শরীর নিজেই দুই হাতে জড়িয়ে ধরল। রুমের মধ্যে এসির ঠান্ডা হাওয়া বইছে। অনুর মাথায় আদ্র মদ ঢালাতে অনুর শরীরটাও ভিজে গেছে। এখন এসির শীতল আবহাওয়া অনুর শরীরকে ঠান্ডায় বরফ বানিয়ে দিচ্ছে। অনু শীতে কাঁপতে লাগল। আদ্র অনুর দিকে তাকিয়ে দেখল অনু শীতে কাঁপছে। আদ্র অনুর কাছে এগিয়ে এসে হাত দিয়ে অনুর কপালে এবং গলায় ছুঁয়ে দেখল অনুর শরীর সত্যি সত্যি অনেক বরফ হয়ে গেছে। আদ্রের হাতের প্রতিটা ছোঁয়া কপালে এবং গলায় পেয়ে অনু কেঁপে উঠল। অনু ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আদ্র তাড়াতাড়ি করে রিমোট দিয়ে এসি অফ করে দিল। আলমারি খুলে আদ্র একটা লাল ড্রেস বের করল। তারপর অনুর মুখের উপর লাল ড্রেস ছুঁড়ে দিয়ে আদ্র রাগী স্বরে বলল,
–এখনই তাড়াতাড়ি তোর ড্রেস চেঞ্জ কর অনু।
আদ্রের কথা শুনে অনুর আত্মা ভয়ে কেঁপে উঠল। চোখ বড়বড় করে অনু আদ্রকে বলল,
–এসব তুমি কি বলছো আদ্র ভাইয়া? আমি তোমার সামনে ড্রেস চেঞ্জ করবো? পাগল হয়ে গেছো তুমি?
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com