Breaking News

দ্বিতীয় বসন্ত । পর্ব – ০৪

কাঁচের স্বচ্ছ জানালা দিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই কতোগুলো পাইন গাছ,দু’টো জোড়া
রাধাচূড়া আর কয়েকটা নারকেল গাছ দেখা যাচ্ছে।সবচেয়ে কাছের নারকেল
গাছটায় একটা কাকের বাসা দেখা যাচ্ছে।
বাসাটা খালি।দৃষ্টিটা আরেকটু প্রখর করতেই অদূরে কয়েকটা পুরোনো বাড়িও লক্ষ্য করা যায়।
এরমধ্যে একটা বাড়ি একতলা বাকিগুলো তিন,চার তলা সামনে কয়েকটা টিনের ঘরও দেখা যাচ্ছে।
তবে রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে না।দৃষ্টিটা ঘুরতে ঘুরতে আকাশে গিয়ে ঠেকলো।
আজ আকাশ পরিষ্কার,পরিচ্ছন্ন।বৃষ্টির ‘ব’ ও নেই।একটি রৌদ্রময় দিন।
সূর্য মাথার ওপর আজ চড়াও হয়ে উঠেছে।

নিজের বিছানা থেকে অহি সামনের জানালা দিয়ে এতক্ষণ এগুলোই পর্যবেক্ষণ করছিলো।
হঠাৎ তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে অহর্নিশ ঘরে এসে বলল,’
অহি,আমি হাসপাতালে যাচ্ছি।আপনার কিছু প্রয়োজন পড়লে আম্মুকে বা মনিষার মা কে বলবেন।’
অহর্নিশের কথাগুলো শুনলেও অহি অহর্নিশকেই লক্ষ্য করছিলো।
দেখতে সুপুরুষই বটে,চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ।ফর্মাল
পোশাকে আরো সুন্দর লাগছে।কিন্তু সে হাসপাতালে যাবে কেনো?অহির মনে
কৌতুহল জাগলো।কৌতুহল চেপে রাখা বড় দায়!তাই অহি জিগ্যেস করেই ফেললো,’
আচ্ছা আপনি হাসপাতালে যাচ্ছেন কেনো?’
অহর্নিশ ঠোঁট প্রশস্ত করে হেসে বলল,’আমি ডাক্তার।আর রবিবার ছাড়া প্রতিদিন
সকাল নয়টা থেকে আমার ডিউটি আছে তাই আমাকে এই সময়টায় রোজই আমাকে হাসপাতালে যেতে হয়।’

‘ওহ!আবার আসবেন কয়টায়?’
‘সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই চলে আসবো।’
‘আচ্ছা।’
‘জ্বি,আর শুনুন আপনার বোধহয় বিরক্ত লাগতে পারে একা বসে থাকতে।তাই আমার ট্যাব টা দিয়ে গেলাম।যেকোনো মুভি,ড্রামা বা অন্যকিছু দেখতে পারেন।’
অহর্নিশ অহিকে নিজের ট্যাবটা দিয়ে দিলো।অহি ডানহাতে সেটা রাখলো।ডান হাত ছাড়া শরীরের আর কোনো অঙ্গই ও নাড়াতে পারে না।খুব অসহায় লাগে নিজেকে!
অহির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অহর্নিশ চলে গেলো।ও চলে যেতেই অহি আবারও বাইরের দিকে
তাকালো তবে এবার আর বাইরের কিছুতেই ওর মনোযোগ নেই এবার ও
ভাবছে নিজের কথা।কে ও?কোথা থেকে আসলো?আর এই ছেলেটাই বা এতো
সেবা করছে কেনো ওর?এসব কিছুই ভাবছে অহি কিন্তু এসব ভাবনার কোনো আদি বা অন্ত নেই।
জৈষ্ঠ্যমাসের দুপুরের কড়া রোদে মানুষের প্রাণ জেরবার হয়ে যাওয়ার মতো
অবস্থা।যেনো সূর্য মাথার এক হাত ওপরে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।

এসির মধ্যেও গরম লাগছে অহর্নিশের।মাত্রই বায়ান্ন নাম্বার ওয়ার্ডের
রোগীকে চেক-আপ করে নিজের কেবিনে ফিরলো।গদিতে আরাম করে
বসে মা’কে ফোন দিলো।দু তিন বার ফোন হতেই মিসেস অনামিকা রিসিভ করলো।
‘হ্যালো মা,খেয়েছো তোমরা?’
‘হ্যাঁ তুই খেয়েছিস?’
‘না এখন খাবো।শোনো অহিকে খাবার দিয়েছো?’
‘অহিকে?’কিছুটা উৎসুক্য হয়ে বললেন মিসেস অনামিকা।
‘আরে ওই যে অচেনা মেয়েটা!ওর নাম অহি দিয়েছি।যেহেতু ওর কিছু মনে পড়ছে না সেহেতু এখন ডাকার জন্য আপাতত এই নামটাই রেখেছি।’

‘ওহ!হ্যাঁ তোমার অহিকে খাবার দেওয়া হয়েছে।’মিসেস অনামিকার গলায় তাচ্ছিল্যের ভাব স্পষ্ট।
অহর্নিশ সেটা বুঝেও কিছু বলল না।মিসেস অনামিকাই আবার বললেন,’শোনো অহর্নিশ এবার একটু অতি পরোপকারী ভাবটা বাদ দাও।দু’দিন বাদে তোমার বিয়ে দিবো আমরা।নিজেকে গোছাও।’
‘মা দয়া করে এখন বিয়ে বিয়ে করে মেজাজের হালুয়া করে দিও না।আমার যখন মনে হবে বিয়ে করা প্রয়োজন আমি তোমাদের বলবো।আর সবে মাত্র একবছর হলো জয়েন করেছি।এখনই এতো প্যারা দিও না।’

‘আচ্ছা যা ভালো বোঝো করো কিন্তু পরে যেনো আফসোস না হয়।আর জলদি খেয়ে নিও।’
‘আচ্ছা।’
বলেই অহর্নিশ ফোনটা রেখে দিলো।প্রতিদিন এসব কথা শুনতে শুনতে প্রায় বিরক্ত সে।তবুও ওর বিরক্তিটা কারো চোখেই পড়ে না সবাই নিজেরদের মতো প্যারা দিয়েই যাচ্ছে।অহর্নিশ বিড়বিড় করতে করতে খাওয়া শুরু করলো।

ডান পাশে কাত হয়ে অহি শুয়ে আছে না ঘুমিয়ে আছে একটু আগে দুপুরের খাবার খেয়েই ঘুমিয়েছে।খাবারটা মনিষার মা খাইয়ে দিয়েছে।যাবার সময় অবশ্য অহর্নিশ ওকে বলে গিয়েছিলো।অহর্নিশ যাবার পর একবার মনিষার মায়ের সাহায্যে ওয়াশরুমে গিয়েছিলো অহি।তারপর আবার ওনার সাহায্যেই বিছানায় এসেছে।এই বাড়িতে অহর্নিশ আর এই মনিষার মা’কেই দেখেছে অহি ও হ্যাঁ সকালে একবার অহর্নিশের মাও এসেছিলেন তবে এরপর আর তার ছায়াও পড়ে নি এ ঘরে।

অহি মনোযোগ সহকারে একটা উপন্যাস পড়ছিলো অহর্নিশের ট্যাব থেকে।ও এতোটাই মনোযোগী ছিলো যে কখনো অহর্নিশ এসে পাশে বসেছে সেদিকে খেয়াল নেই।হঠাৎ পড়তে পড়তেই খেয়াল হলো পাশে কারো উপস্থিতি।বই থেকে চেখ তুলে তাকাতেই দেখলো অহর্নিশ স্মিত হেসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ওকে হাসতে দেখে অহি জিগ্যেস করলো,’হাসছেন কেনো?’
‘আপনার মনোযোগ দেখে।প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে আমি বসে আছি আর আপনার এখন খেয়াল হলো।’
অহর্নিশের কথা শুনে অহি একটা লজ্জা পেয়ে বলল,’আসলে উপন্যাসের ক্লাইমেক্সে ছিলাম তো তাই খেয়াল করি নি!’

‘তাই!আচ্ছা কোন উপন্যাস পড়ছেন।একটু নামটা বলুন।’
‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সোনালী দুঃখ।’
‘বাহ!তো এখন কাহিনির কোথায় আছেন?’
‘একটা ক্রিটিকাল জায়গায় আছি।ত্রিস্তানের অসুখ হয়েছে এখন কি রাজকুমারী সোনালী আসবে না ওর কাছে?জানেন আমার এই জায়গায় খুব খারাপ লাগছে।যদি রাজকুমারী সোনালী না যায়?
‘কি মনে হয় যাবে?’অহর্নিশ অহির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো।
‘জানি না।ভালোবাসা সত্যি হলে যাবেই।’অহি দৃড়কন্ঠে বলল।
‘আর যদি না যায় তাহলে কি ভালোবাসা সত্যি না?’
অহি মরিয়া হয়ে বলল,’প্লিজ এভাবে বলবেন না।’
‘আচ্ছা বলবো না।পরে কি আমাকে জানাবেন কিন্তু!’
‘আচ্ছা।’

এরপরই কিছু একটা মনে হতেই অহি আবার জিগ্যেস করলো,’আপনি কখন এলেন?’
‘এইতো পনেরো মিনিট হয়েছে।’
‘ওহ!’
‘হ্যাঁ।আপনার জন্য একটা জিনিস এনেছি।’
‘কি?’
অহর্নিশ অহিকে অপেক্ষা করতে বলে নিজের ঘরে গেলো।পাঁচ মিনিট পর একটা দু’টো ক্রাচ নিয়ে এসে বলল,’এখন থেকে এগুলো তে ভর দিয়ে অল্প অল্প করে হাটার চেষ্টা করতে হবে।প্রতিদিন হাঁটলেই আপনি আবার আগের মতো হাটতে পারবেন।’
‘কিন্তু আমি তো।হাত পা ই নাড়াতে পারি না।’
‘পারবেন।চেষ্টা করলে সবই সম্ভব।’
অহর্নিশ ক্রাচগুলো দেয়াল সাথে দাড় করিয়ে রেখে অহির পাশে গিয়ে বসল।তারপর বলল,’এখন থেকে আমরা সন্ধ্যার ব্যায়াম করবো আর সকালে হাঁটতে বের হবো।’
‘আচ্ছা।’অহি সৌজন্য হেসে জবাব দিলে।
‘তাহলে এবার শুরু করা যাক।’

এটা বলেই অহর্নিশ অহির বাম হাত মুভ করানো শুরু করলো।হাতের কব্জিতে হালকা একটু চাপ দিলেই অহি ব্যাথায় চোখ মুখ খিঁচে ফেলে।অহর্নিশের খারাপ লাগে তবুও স্বাভাবিক হতে হলে এগুলো সহ্য করতেই হবে।ঘন্টাখানেক হাতের ব্যায়াম করে।রাতের খাবার খাইয়ে অহির ঔষুধগুলো খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেতে গেলো।খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে গিয়ে অহির লকেট’টা সাথে নিয়ে আবারো অহির ঘরে গেলো।অহি এখনো ঘুমায় নি চুপচাপ শুয়ে ছিলো অহর্নিশকে দেখে উঠতে নিলেই ও থামিয়ে দিয়ে বলল,’ওঠা লাগবে না।’

এটা বলেই অহির লকেট’টা ওর হাতে দিয়ে বলল,’দেখো তো কিছু মনে পড়ে কি না।’
অহি লকেট’টা হাতে দিয়ে দেখলো লকেটের একপাশে ওর ছবি আরেকপাশে একটা মহিলার ছবি।অহি চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলো।কিন্তু না আবদ্ধ চোখের নিচে সবই অন্ধকার।কিছুই দেখা যাচ্ছে না।অহি চোখ খুলে ফেললো।চিন্তিত মুখে বলল,’না আমার কিছুই মনে পড়ছে না।’
‘সমস্যা নেই।আস্তে আস্তে মনে পড়বে।এতো চাপ নেওয়ার প্রয়োজন নেই।’
অহি কিছু বলল না।লকেট’টা অহর্নিশকে দিয়ে দিলো।ক্রমশ চিন্তারা দলা পাকিয়ে মেঘের মতো কুন্ডলী করে মাথার চারদিকে ঘুরছে।নিজেকে নিজেই চিনতে না পারাটা কতোটা যাতনার সেটা অহি বুঝতে পারছে।

অহি ঘুমিয়ে গেছে ভেবে অর্হনিশ লাইট বন্ধ করে চলে গেলো।অহর্নিশ চলে যেতেই অহি আবারও চোখ খুললো।অন্ধকারে চোখ মেলেই শুধুই অন্ধকার দেখলো।
ভোর ছয়টা বাজে।অহর্নিশ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো।তারপর জগিং স্যুট পরে অহির ঘরে আসতেই দেখলো অহি বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে।অহর্নিশ ঘরে এসেই বলল,’আরে!তুমি কখনো উঠলে?’
‘এই তো পাঁচ/সাত মিনিট হবে।’স্নিগ্ধ হেসে জবাব দিলো অহি।
‘আচ্ছা তাহলে ফ্রেশ হয়ে চলো আমরা বের হই।’
অহি মাথা নেড়ে সায় দিলো।অহর্নিশ ওকে উঠতে সাহায্য করলো।বলতে গেলে অহির শরীরের প্রায় সমস্ত ভরই অহর্নিশের হাতে।অহির ডান হাতে একটা স্কেচ দিয়ে বাম হাতটা অহর্নিশ নিজের কাধে নিয়ে একহাতে অহির কোমর চেপে ধরলো।

চলবে…..

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com