Breaking News

গোধূলীর আলোয় । পর্ব -৪১



“মিষ্টির বদলে এগুলো কি জান? শেষ পর্যন্ত বমি….ইয়াক!”
“আমি বলেছিলামনা, জোড় করে আমাকে খাওয়াবেননা। শুনেননি তো; তারপর মাছ, ডিম। মাছ আর ডিমের গন্ধই তো সহ্য হচ্ছেনা আমার।”
“থাক, বাদ দাও। ঘুমিয়ে পড়ো, আমি সব ক্লিন করে দিয়েছি।”
“আপনার মাথাটা মুছেন ভালো করে। চুল থেকে পানি পড়ছেতো।”
“মুছছি। তোমার পেটে এইডা যে কি আসছে আল্লাহ জানে, এখনি এত ভোগাচ্ছে! পৃথিবীতে আসার পর আরো না জানি কি করে।”
“বেশি কিছু করবেনা তবে আপনার রাতের ঘুমটা হারাম করে দিতে পারে।”
“কেনো?”
“প্যা, পু করে কাঁদবেনা! তখন ঘুমাবেন কিভাবে?”
“প্যা, পু করলে সোজা আব্বা-আম্মার রুমে চালান করে দিবো।”
“কেনো? নিজের বেবির একটু প্যা, পু সহ্য করবেননা?”
“করবো, বেশি বাড়াবাড়ি যখন করবে তখনকার কথা বলেছি।”
“হু বুঝছি। আপনি বাপ হওয়ার যোগ্য না।”
“মানে?”
“মানে কিছুনা, আমি ঘুমালাম।”
“আরে আমাকেও নাও তোমার সাথে।”
আয়মান শুয়ে পড়লো মিথিলার পাশে।
“স্নেহা মেয়েটা দেখতে কোনদিক দিয়ে খারাপ ছিলো সায়ন?”
“কোন দিক দিয়েই না আম্মু।”
“তাহলে পছন্দ করলিনা কেনো?”
“এতদিন পর এসে নতুনভাবে ওই টপিক আসছে কেনো?”
“স্নেহাকে আমার, তোর আব্বু এমনকি সামিরেরও পছন্দ হয়েছিলো। মনে মনে কত স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলাম, মেয়েটা আমার বড় ছেলের বউ হবে, আমার বৌমা হবে কিন্তু তুই সব ভেস্তে দিলি।”
“আমি এখন বিয়ে করতে চাচ্ছিনা আম্মু।”
“কেনো? আয়মান বিয়ে করেছে, নিবিড়ের সামনে বিয়ে বাকিরাও খুব শিঘ্রই করে ফেলবে তোর সমস্যাটা কোথায় বিয়ে করতে?”
‘নিবিড়ের বিয়ে’! নিবিড়ের বিয়ে শব্দটা শুনে অনুর মুখটা জ্বলজ্বল করে সায়নের চোখের তারায় ভেসে উঠলো। চোখ বন্ধ করে ফেললো সায়ন।
“ঘটক সাহেব আরেকটা মেয়ে দেখেছে। আমাদের দেখতে যাওয়ার কথা বলছে। আজ বিকালে যেতে চাচ্ছি; রেডি থাকবি।”
সায়ন চোখ খুললো। জানালা দিয়ে খোলা আকাশে চোখ রেখে বললো,
“বিকালে আমার কাজ আছে। আমি যেতে পারবোনা।”
“কাজ পরে হবে। আজকে আমরা যাচ্ছি ব্যস।”
সায়নের মা চলে গেলো সায়নের রুম থেকে।
বিকালের আকাশটা আজ কেমন ঘোলা ঘোলা। পরিবেশটাও কেমন ঝিমিয়ে আছে। কালো রঙের পাঞ্জাবী পরা সায়ন গাড়ি থেকে নামতেই চোখ পড়লো সামনের একতলা রঙিন বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ানো একদল তরুণীদের দিকে। সায়নকে তাকাতে দেখতেই সবাই খিলখিলিয়ে হেসেই পড়িমরি করে ঘরের ভিতরে চলে গেলো।
সায়নরা আজ এসেছে শহর থেকে কিছু দূরের একটা গ্রামে মেয়ে দেখতে। গ্রাম হলেও এখানকার বাড়িগুলো অনেক আধুনিক স্টাইলেই করা। রাস্তাঘাট পাকা। সায়নের জন্য যে বাড়িতে মেয়ে দেখতে আসা হয়েছে সে বাড়িটা পাকা রাস্তার কোল ঘেসেই একদম। বাড়ির পাশে বড় বড় আম, কাঁঠালের গাছ আছে। ছিমছাম একটা পরিবেশ। রাস্তায় তেমন গাড়ি টাড়ি নেই শহরের মত। ক্ষাণিক দূরে একটা বাঁধায় করা পুকুর দেখা যাচ্ছে।
ঘটক সাহেব সবাইকে তাড়া দিলেন ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। আজকে সায়নের বাবা, মা, সামির আর সায়নের খালা, খালু এসেছে মেয়ে দেখার জন্য সাথে সায়ন তো আছেই।
বেশ বড়সড় এক ঘরে সায়নদের বসতে দেওয়া হয়েছে। মেয়ের বাবা একটার পর একটা মেয়ের প্রশংসা করেই যাচ্ছে সায়নের বাবার পাশে বসে।
“আমার মেয়ে ভাই লেখাপড়া, রান্নাবান্না,ঘর গোছানো সবই পারে। মানুষের মেয়ের মত হ্যালহ্যাল, ক্যালক্যাল একদমি করেনা। বাড়ির বাইরেও তেমন যাইনা। সারাক্ষণ বাড়িতেই থাকে। বাইরে যাওয়া বলতে কলেজ এই আরকি।”
সায়নের খালু বললেন,
“মেয়েকে আসতে বলেন ভাই। এমন গুনবতি মেয়েকে আমরা আর না দেখে থাকতে পারছিনা।”
মেয়ের বাবা একজন মহিলাকে বললেন,
“যা, লাবন্যকে নিয়ে আয়।”
বেশ কিছু সময় পর লাবন্যকে নিয়ে আসা হলো সায়নদের সামনে। লাবন্যকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে থরথর করে কাঁপছে। পাশে থাকা মহিলা লাবন্যকে ধরে আছেন।
সায়নের মা বললেন,
“বসো মা।”
লাবন্য বসলো একটা সিঙ্গেল কাঠের চেয়ারে। কাঁপাকাঁপা গলায় সবাইকে সালাম দিলো।
সায়নের খালা বললেন,
“ঘোমটাটা তুলো মামণি, তোমাকে দেখি।”
লাবণ্যের সাথে আসা মহিলাটি লাবণ্যের মাথার ঘোমটাটা তুলে দিলেন; তখনি একটা মিষ্টি, লাবন্যময় চেহারা বেড়িয়ে আসলো ঘোমটার তল থেকে। সায়নের মা লাবন্যের চেহারা দেখে বলে উঠলেন,
“মা শা আল্লাহ! মা শা আল্লাহ! ভাই মেয়ে তো আপনার ভারি মিষ্টি।”
লাবন্যের বাবা খুশিতে টগবগ টগবগ করতে করতে বললেন,
“মেয়ে আমার শ্যামলা হলেও দেখতে ভারি মিষ্টি তাইতো তার নাম আমি লাবন্য রেখেছি ভাবি।”
সায়নের বাবা বললেন,
“মেয়ে যেমন মা শা আল্লাহ! নামটাও মা শা আল্লাহ।”
ঘটক বললেন,
“সায়ন বাবাজির সাথে বেশ মানাবে তাইতো মেয়েটাকে দেখা মাত্রই আপনাদের খবর দিয়েছি।”
সায়নের খালা বললেন,
“কিসে পড়ো মা?”
লাবন্য আস্তে করে তার মিহি গলায় বললো,
” ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে।”
“কোন বিষয়ে?”
“সাইন্স।”
“বেশ বেশ।কোন কলেজে মা?”
” রাজশাহী নিউ গভঃ ডিগ্রি কলেজ।”
“আমাদের সায়নও নিউ ডিগ্রি ছাত্র ছিলো ইন্টারে। বাড়ি থেকেই যাওয়া- আসা করো না মেসে থাকো?”
“বাড়ি থেকেই যাওয়া-আসা করি।”
সায়ন এই অব্দি একবারও লাবন্যকে দেখেনি। দেখবেওনা। বিয়েই করবেনা যখন, তখন দেখে কি লাভ।”
সামির সায়নের কানে কানে বললো,
“ভাইয়া তোমার পছন্দ হয়েছে? আমার কাছে খারাপ লাগছেনা। স্টুডেন্ট হিসেবেও ভালো।”
“চুপ করে সোজা হয়ে বসে থাক।”
সামির ঠিকঠাক হয়ে বুকটান করে বসলো।
সময় কখনো কারো জন্য বসে থাকেনা, থাকবেওনা। দেখতে দেখতে অনুর বিয়েটা ঘনিয়ে আসলো। আর মাত্র দুইদিন পরেই অনুর বিয়ে। এর মধ্যে দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়-স্বজনরা চলে এসেছে অনেকেই। মিথিলার মা, মাশফি আর আয়মানের ছোট খালা আর সাদাফও চলে এসেছে। মিথিলার বাবা আর খালু আসবে আগামীকাল। মিথিলা এতদিন পর তার মাকে পেয়ে খুব খুশি, খুশি মাশফিও আয়মানকে পেয়ে। মাশফির খুশি যেনো ধরেনা। সাদাফ আর সে এখন সারাক্ষণ আয়মানের বডিগার্ড হয়ে আয়মানের সাথেই থাকছে আসার পর থেকে।
বাড়ি ভর্তি মেহমানে ভরপুর হওয়াই কোন জায়গাতেই শান্তিমত বসার জায়গা পর্যন্ত নেই। আরো তো আসবেই। শেষ সন্তানের বিয়ে; তারওপর আয়মানের বিয়েতে কোন অনুষ্ঠান করতে পারেনি তাই অনুর বিয়েটা অনেক ধুমধামের সাথেই দিতে চাচ্ছে আয়মানের বাবা-মা। দূরের কাছের আত্মীয়, তিন মেয়ের শ্বশুরবাড়ি সহ একমাত্র ছেলে আয়মানের শ্বশুরবাড়ির মানুষ কাউকেই দাওয়াত করতে বাদ রাখেনি আয়মানের বাবা-মা। মিথিলার হোস্টেলের চার রুমমেট মিতু, নুসরাত, সুমনা এবং মাইশাও নিমন্ত্রিত। মিথিলার চাচাতো ভাই নিলয়কেও বাদ দেয়নি। অনুর ফ্রেন্ড সার্কেল, আয়মানের ফ্রেন্ডদের ওদের পরিবার সবাইকে দাওয়াত করা হয়েছে।
অনুদের বাড়িটা যেহেতু বড়ই তাই বিয়ের সব আয়োজন বাড়িতেই হবে। কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করেনি।
সন্ধ্যা হতে না হতেই মরিচ বাতিতে ঝলমলিয়ে উঠলো অনুদের বিশাল দোতলা পুরনো বাড়িটা। চারদিকে আলো আর ফুলে ফুলে ঝলমলিয়ে আছে সবদিক। ছাদেই গাঁয়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। আগামীকাল গাঁয়ে হলুদ, পরশু বিয়ে।
এত আলোর মাঝেও অনুর মনটা কেমন ঝিম ধরে আছে। বার বার অতীত এসে নাড়া দিচ্ছে অনুর মনের আনাচে কানাচে। এক একটা মিনিট যাচ্ছে সাথে সজল নামের অভিশাপটাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করছে অনু। যেমনই হোক না সজল; ভালোতো বেসেছিলো অনু সজলকে। হাজার হাজার স্বপ্ন দেখেছিলো সে সজলকে নিয়ে। সব কেমন শেষ হয়ে গেলো এক নিমেষে।
অনু এখনো ভেবে কুল পাচ্ছেনা সে নিবিড়কে কিভাবে স্বামী হিসেবে মেনে নিবে। কিভাবে থাকবে সে নিবিড়ের সাথে একই ছাদের নিচে, একই বিছানায়! মন থেকে সে মেনে নিতে পারছেনা। অনুর কখনো, সখনো মনে হচ্ছে পালিয়ে যেতে। দূরে, অনেক অনেক দূরে। বিয়ে করতেই হবে এমন তো কথা নেই। বহুদূরে গিয়ে অচেনা মানুষদের সাথে, অচেনা পরিবেশে জিবনটা কাটালে সমস্যা কি! পরক্ষণেই মনে করে, বাবা, মা, ভাই, বোন ছেড়ে কিভাবে থাকবে সে, তার থেকে বিয়ে করে নিবিড়ের সাথে সংসার করাটাই ভালো হবে।
লাবন্যের সাথেও বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে সায়ন। ওর এক কথা, এখন সে বিয়ে করবেনা। কখনো সময়, সুযোগ হলে সে নিজে থেকেই জানাবে বিয়ে করার কথা। এখন সে বিয়ে নামের বন্ধনে নিজেকে আটকাতে রাজি নয়। সায়নের বাবা, মা ও আর জোড় করছেনা; তবে আন্দাজ করতে পারছে সায়নের কিছু একটা হয়েছে, কোন একটা ব্যাপার নিয়ে সায়ন খুব মনঃকষ্টে ভুগছে। অপেক্ষায় আছে কখন সায়ন নিজে থেকে বলবে সায়নের কি হয়েছে।
দুই পক্ষ থেকেই সায়ন এবং সায়নের পরিবারের দাওয়াত। অনুর পক্ষ থেকেও, নিবিড়ের পক্ষ থেকেও অথচ সায়ন কোন দিকেই যাচ্ছেনা। বেশিরভাগ সময় বন্ধ ঘরে নিজেকে বন্ধ করে রাখে।
আজ সন্ধ্যায় নিবিড় আর অনুর গাঁয়ে হলুদ। আয়মান এবং নিবিড় দুজনই সায়নকে ফোন করতে ব্যস্ত আর সায়ন ব্যস্ত বন্ধ ঘরে নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়তে। ধোঁয়ার সাথে সাথে জিবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাকে উড়িয়ে দিতে। বুকের ভিতরে জমে থাকা কষ্টগুলোকে বালুচাপা দিতে।
“তুমি না ডাকলে আসবো না
কাছে না এসে ভালোবাসবোনা
দূরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
নাকি চলে যাওয়ার বাহানা বাড়ায়?
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরনো,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি
এটাকি ছেলেখেলা আমার এই স্বপ্ন নিয়ে
চাইলে ভেঙে দেবে গড়ে দেবে ইচ্ছে হলে হলে,
আমি গোপনে ভালোবেসেছি,
বাড়ি ফেরা পিছিয়েছি
তোমায় নিয়ে যাবো বলে।
একবার এসে দেখো,
এসে বুকে মাথা রেখো
বলে দেবো চুলে রেখে হাত
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরনো,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি
ভোর না হতে হতে তোমাকেই দেখার আলায়
শেষ ছবিটা দেখি বারে বারে আহা! দেখি,
আমি গোপনে ভালোবেসেছি,
বাড়ি ফেরা পিছিয়েছি
তোমায় নিয়ে যাবো বলে।
একবার এসে দেখো,
এসে বুকে মাথা রেখো
বলে দেবো চুলে রেখে হাত
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরনো,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি..
অটোতে বসে গানটা মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে এসে পৌঁছালো সায়ন অনুদের বাড়ির সামনে। আয়মানের অতিরিক্ত ফোন কলের অত্যাচারে নিজেকে আর ঘরের মধ্যে আটকে রাখতে পারেনি সায়ন। বাড়ি থেকে বের হয়েই উশকোখুশকো চেহারা নিয়েই অটোতে উঠে সোজা চলে এসেছে সে আয়মানদের বাড়িতে।
বিয়েবাড়ির ভিতরে এসেই সায়ন মুখোমুখি হলো সেই মুখটার; যে মুখটা দেখে সে পার করতে চেয়েছিলো বাকি জিবনটা।
চলবে…

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com