থার্টি ফার্স্ট নাইট । পর্ব - ১০
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সূর্য অস্ত গেল।প্রকৃতির অবিনশ্বর নিয়মে সূর্য উদয় হলো।সময় কারো জন্য থেমে থাকে না।ক্ষমতা দিয়ে সমস্ত অন্যায় কাজ উসুল করে নিলেও সময় কখনো কিনে নেওয়া যায় না।
কেটে গেল সপ্তাহ খানেক সময়।অনাহিতা জীবনটা নিজস্ব গতিতে রুপান্তর করেছে।ছক সাজিয়েছে নিজের মতো করে।যদিও মানব জাতি কখনোই ছক অনুযায়ী চলতে পছন্দ করে না।
রেশমি দর্পণের সামনে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে তৈরি হচ্ছে।রুপম রাতে পার্টির আয়োজন করেছে।পার্টি দেওয়া মূল কারণ হলো তাদের ব্যবসায় আজ বড়সড় লাভ হয়েছে।এজন্য রুপম তার বিজন্যাস পার্টনার,বন্ধু-বান্ধব অনেক’কেই দাওয়াত করেছে।
রেশমির খুশির বড় কারণ হলো সে তৃতীয় বারের মতো মা হতে চলেছে।গত দু’দিন থেকেই সে বেশ খুশি।আর আজকেই রুপমের খুশিটাও সে দ্বিগুণ করতে চায়।
কথায় আছে “old is gold”.কিন্তু মানুষ যতবেশি নতুন কিছুর প্রতি আগ্রহ দেখায় ততবেশি অনাগ্রহ দেখায় পুরাতন বস্তুর প্রতি।কিন্তু গুরুত্ব কমে যায় না,আগ্রহ কমে যায় কিন্তু গুরুত্ব একই থেকে যায়।সেটা কোনো জিনিস হোক কিংবা সম্পর্ক।তবে কোনো নারী যতবারই ‘মা’ হয় ততবারই নতুন করে আনন্দ পায়।
রেশমি পলক ফেলে নিজ হাতের দিকে তাকিয়ে হতাশ হলো।রুপমের সেদিনের গিফট করা ব্রেসলেটটা দুই দিন পরই হারিয়ে গেছে।এই কথা মুখ ফোটে সে রুপমকেও জানায়নি।কে জানে ব্রেসলেটটা কীভাবে হারালো!
রেশমির সাজগোছ যখন শেষের দিকে তখন তার তিন বছরের ছেলেটা এসে বলল,” মা,তলো তলো।মানুষ এতেতে।”
রেশমি তার বাচ্চার কথা শুনে হেসে তাকে কোলে তুলে নিলো।দুই থেকে পাঁচ বছরের বাচ্চাগুলোকে অনেক বেশিই ভালো লাগে।
রেশমি হল রুমে এসে দেখলো পার্টি প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছে।দাওয়াত করা সব লোকজন এসে পড়েছে।অথচ পার্টি শুরু হওয়ার কথা ছিল আরো রাতে।ঐ যে মানুষ ছক অনুযায়ী কোনো কিছু করে না।রেশমির চোখজোড়া রুপমকে খুঁজতে লাগলো।এপাশ ওপাশ লক্ষ্য করতে দেখলো তার স্বামী বন্ধুদের মাঝে রয়েছে।ছেলেকে সাথে নিয়েই সে এগিয়ে গেল।
রুপমের বন্ধুমহল বেশ বড়সড়।এদের মধ্যে কয়েকজনের নাম মনে আছে তার।রেশমিকে দেখে রুপমের বন্ধু সজীব বলল,”আরে রেশমি,বাচ্চাকে সাথে নিয়েই এলে?”
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।কথাটা রেশমি গায়ে মাখলো না।নদী নামের মেয়েটা তার ছেলেকে কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো।তখন রেশমি তার হাত লক্ষ্য করে দেখলো সেম ব্রেসলেট নদী পড়ে আছে।এক ধ্যানে সে ব্রেসলেটের দিকে তাকিয়ে রইলো।
.
সূর্য হো হো করে হেসেই যাচ্ছে।নিশি প্রথম কয়েক সেকেন্ড রেগে গেলেও,এমন মধুর কণ্ঠস্বর শুনে সে আর রাগতে পারলো না।চোখের পাতা বন্ধ করে সে অনুভব করলো হাসির শব্দ।ইশ!এত আকর্ষণীয় কেন সূর্যের সবকিছু!
এক সময় সূর্য হাসি থামিয়ে বলল,”তুমি তাহলে সিওর যে আমাকে ভালোবাসো না?”
দৃঢ়তার সাথে নিশি উত্তর দিলো,”কতবার একই উত্তর দিবো?”
সূর্য ফোনের ওপাশে আবারো হেসে উঠলো।নিশি মনে করার চেষ্টা করলো,কখনো কী সূর্যকে বলে দিয়েছে তাকে ভালোবাসে?কখনো কথায় কথায়?নাহ!নিশির কিছুতেই মনে পড়ছে না বলেছে কি’না।
মনে ফন্দি আঁটে নিশি বলল,”কেন?আমি কখনো বলেছি নাকি ভালোবাসি?”
সূর্য উত্তর দিলো,”বলতে হয় না ম্যাডাম।আপনার কর্মে বুঝা যায়।”
-“আমি কী এমন কাজ করেছি,যেটা দ্বারা বুঝেছেন?”
-“অনেক কিছু।লিস্ট করতে গেলে কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে।হা হা হা!”
নিশি চুপ করে রইলো।অনুভূতি কখনো লুকিয়ে রাখা যায় না।মন নামের বস্তু দ্বারা বিপরীত জন ঠিকই বুঝে নেয়,কার মনে কী চলছে!
সূর্য ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,”আমার শুটিংয়ের সময় হয়ে গেছে।আজকে নাইটে শুটিং।”
নিশির চিমটি পরিমাণ অভিমান হলো।মাত্র দু’তিনটে কথা বলেছে ওমনি শুটিং?অভিমান নিয়েই সে বলল,”ঠিক আছে।”
-“টাটা।গুড নাইট।”
-“হুহ্।”
নিশি ফোন কেটে দিতে চাইলে ওপাশ থেকে বলে উঠলো,”নিশি শোনো?”
স্বাভাবিকের চেয়ে নিশির হার্টবিট কয়েকগুণ বেড়ে গেল।এইভাবে ডাকে কেন ছেলেটা?
সূর্য থেমে থেমে বলল,”কয়েকদিন পরই আমি বিয়ের সম্বন্ধ পাঠাবো।রাখছি।”
নিশি কিছুক্ষণ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইলো।এই মাত্র কী বলল সূর্য!তার কানে বার বার সেই একই কথা বাজছে।
নদীর বাহুজোড়া বেশ জোরেই ধরলো রুপম।ব্যথা পেয়ে নদী রাগান্বিত স্বরে বলল,”আহ,রুপম!কী করছিস তুই?ব্যথা পাচ্ছি।ছাড় আমায়।”
রুপম আরো রেগে বলল,”তুই কী করেছিস?বার বার বলেছি ব্রেসলেটটা পড়বি না।তাও পড়েছিস কেন?”
নদী ফিসফিস করে বলল,”তোর বউ কী এত মানুষের মধ্যে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকবে নাকি?”
-“ও যথেষ্ট তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমাত্তার মেয়ে।চারপাশের সবকিছু খেয়াল রাখে।”
-“ওহ হো,বউয়ের খুব প্রসংশা করছিস দেখি।আমাকে আর ভালো লাগে না।তাই না?”
-“চুপ নদী।তুই ব্রেসলেটটা খুলে ফেল।না-হয় ও দেখে নিবে।”
-“দেখলে কী হয়েছে?তুই তো এমনিতে ও কে ডিভোর্স দিবি।”
-“সবকিছুর সময় থাকে নদী।তুই দয়া করে ব্রেসলেট খুলে ফেল।”
-“ঠিক আছে,ঠিক আছে।”
নদী ব্রেসলেট খুলে নিজের হ্যান্ডব্যাগে নিয়ে নিলো।ব্রেসলেটটা গতবছরই তার জন্মদিনে রুপম গিফট করেছিল।কিন্তু কয়েকদিন আগে রেশমিকে দেখাতে হবে বলে নিয়ে গেল।আবার দু’দিন আগে ফেরত দিলো।
পার্টি তখন প্রায় শেষের দিকে।রেশমি তার ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে নিচে এসে দেখে রুপম তার বান্ধবী নদীর সাথে রাগারাগি করছে।তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে রেশমি প্রশ্ন করলো,”তোমরা এভাবে ঝগড়া করছো কেন?”
নদী স্পষ্ট উত্তর দিলো,”আমাকে বাসায় ড্রপ করে দিতে বলছি।কিন্তু এই বুদ্ধু সেটা শুনছেই না।তার নাকি বউয়ের আঁচলেই বেঁধে থাকতে হবে।”
রেশমি কিঞ্চিত লজ্জা পেলো।রুপমের জন্য সে পুরো রুমটা সাজিয়ে রেখেছে।তাকে দ্বিতীয়বার বাবা হওয়ার সংবাদটা জানাবে বলে।এখন চলে গেলে আবার কখন ফিরবে?
রেশমির কাজটা সহজ করতে সজীব এগিয়ে এসে বলল,”নদী চল,তোকে আমি ড্রপ করবো।”
রেশমি তখন হেসে বলল,”সজীব ভাইয়া সাবধানে গাড়ি চালাবেন।”
তখনই রেশমি লক্ষ্য করে দেখলো নদীর হাতটা ফাঁকা।আশ্চর্য!ব্রেসলেটটা গেল কোথায়?
প্রেমশা আর্ট খাতা নিয়ে আঁকিবুঁকি করছে।পাশে পড়ে রয়েছে হোমওয়ার্ক করা খাতাটি।অনাহিতা তাকে এক নাগাড়ে বকে যাচ্ছে।বকার মূল কারণ হলো আজকে ক্লাসে প্রেমশা হোমওয়ার্ক না করার জন্য শাস্তি পেয়েছে।গতরাতে হোমওয়ার্ক করার কথা জিজ্ঞেস করলে প্রেমশা উত্তর দিয়েছিল সব করে নিয়েছে।আসলে সে কিছুই করেনি।
অভিনব তাদের মা-মেয়ের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।প্রেমশাও মাঝেমধ্যে জবাব দিচ্ছে আবার হাসছে।
অনাহিতা বলে উঠলো,”ম্যাডাম অনেক ব্যস্ত।হোমওয়ার্কটুকু করার সময় পায় না।আজকে থেকে তোমার টিভি দেখা বন্ধ।”
প্রেমশা বলল,”আমি তো টিভি একটু দেখি শুধু।”
-“একটুও দেখবে না।বাবার ফোন টাচই করবে না।”
-“আচ্ছা।”
-“কী আচ্ছা?হোমওয়ার্ক শেষ হয়েছে?”
-“হুম।”
মুখ চেপে হেসে প্রেমশা খাতা এগিয়ে দিলো।অনাহিতা বেশ আগ্রহ নিয়ে হোমওয়ার্ক দেখছে।এক পর্যায়ে অভিনব খিলখিল করে হাসতে লাগলো।অভিনবে পরে প্রেমশা,তারপর অনাহিতা।তিনজনই রুম কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো।
রোমিলা বেগম রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,”এত হাসাহাসি হচ্ছে কোন আনন্দে?”
প্রেমশা বলল,”আমি স্কুলে শাস্তি পেয়েছি,সেই আনন্দে। হা হা হা!”
হাসি আসলেই ছোঁয়াছে রোগ।কারণ ছাড়াই রোমিলা বেগমও হাসিতে যোগ দিলো।ফলাফল ঠোঁট বেয়ে পানের পিক পড়তে লাগলো।উনার মুখের ভেতরের পুরো অংশ লাল বর্ণ হয়ে পড়েছে।তা দেখে প্রেমশা বলল,”দাদু,আমিও পান খাবো।জিহ্বা লাল করবো।”
অনাহিতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,”না পিচ্চি মা,দাদুকে ভালো দেখাচ্ছে না।তুমি বরং ফুফির বানানো রেড আইসক্রিম খাবে।ঠিক আছে?”
প্রেমশা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো।রোমিলা বেগম বললেন,”অনি,কাল তোমার মা আসছে বললা।উনি কী ভোরে আসবেন?”
অনাহিতা উত্তর দিলো,”না মা।এগারোটার দিকে আসবে।রান্না করার কথা জিজ্ঞেস করছেন?”
-“হ্যাঁ।”
-“আমি ভোরে উঠে রান্না করে ফেলবো।”
বিপত্তি সৃষ্টি করে রোমিলা বেগম বললেন,”না না,রুমিই রান্না করবে।না-হয় আমি করলাম।”
মিষ্টি হেসে অনাহিতা বলল,”মা আমার হাতের রান্নায় খেতে পছন্দ করে।আপনি চিন্তা করবেন না।আমার কষ্ট হবে না।”
বেশ কিছুক্ষণ পর রোমিলা বেগম সম্মতি জানালো।তিনি নিশির রুম পার করতে গিয়ে দেখলেন তার মেয়ে অস্থিরতা নিয়ে রুমে পায়চারি করছে।অদ্ভুত তো!নিশিকে কখনোই তিনি অস্থির হতে দেখেননি।শুধুমাত্র তার বাবার মৃত্যুর সময় প্রথমবার অস্থির হয়েছিল।এক ফালি বিস্ময় নিয়ে তিনি রুমে প্রবেশ করলেন।
নিশি তার মা’কে দেখে বলল,”মা মা,ঘটনা ঘটে গেছে।”
রোমিলা বেগম টেবিলে রাখা ঝুড়ি থেকে কলা তুলে নিলো।রাতে গভীর ঘুমের জন্য কলা বেশ উপকারী।খোসা ছাড়িয়ে তিনি কলা মুখে দিয়ে বললেন,”কী ঘটনা ঘটালি আবার।”
-“সূর্য বিয়ের প্রস্তাব দিছে।”
রোমিলা বেগম চোখ বড়ো বড়ো করে মুখে দেওয়া কলাটা গিলে ফেলতে গিয়ে বিস্ময় খেল।নিশি বিরক্তি নিয়ে জল এগিয়ে দিয়ে বলল,”মা,কী করছো?”
পানি খেয়ে রোমিলা বেগম বললেন,”সূর্য আহমেদ তোকে?তোকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে?”
-“হ্যাঁ রে মা।”
বিড়বিড় করে রোমিলা বেগম বললেন,”বেচারার মাথা আউট হয়ে যায়নি তো?সুখে থাকতে ভূতে ধরেছে।”
নিশি সবটা শুনতে পেয়ে বলল,”বাজে কথা বন্ধ করো মাদার বিডি।আমার বিয়ের গোছগাছ শুরু করে দাও।”
রোমিলা বেগম সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,”দেখি,মেসেজ দেখি।”
-“কিসের মেসেজ?ফোনে বলেছে ও।”
-“মিথ্যা বলছিস তুই।লাস্ট মেসেজ দেখি।”
নিশি ভেবাচ্যাকা খেয়ে বলল,”মা তোমার লজ্জা করে না?নিজের মেয়ের হবু জামাইয়ের মেসেজ দেখতে চাও।”
-“তোর লজ্জা করে না?প্রেমিকের সব কথা আমার সাথে শেয়ার করিস।”
-“কোনো প্রেমিক-টেমিক না।যাও তো তুমি,নিজের কাজে যাও।”
ভেংচি কেটে রোমিলা বেগম রুম ত্যাগ করলেন।নিশি মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।এতক্ষণ কথাটা কাউকে বলে শান্তি হয়েছে।অবশ্য তার জীবনের সব ঘটনা তার মা-ই জানে।মা ছাড়া তার আর কোনো ভালো বন্ধু নেই।মা-ই তার ভালো বন্ধু।ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Best Friend’।
রেশমি মনে মনে অনেক কথা সাজিয়ে রেখেছিল।কিন্তু রুপমকে কিছুই বলতে পারছে না।অথচ রুপম একাধারে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে ‘রুমকে এত সাজিয়েছো কেন?’।রেশমি চোখের পাতা বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলল,”আমি প্রেগন্যান্ট রুপম।তুমি…তুমি বাবা হচ্ছো।”
তারপরের পরিবেশটা থমকে গেল।রেশমি চোখ খুলে রুপমের ভাব-ভঙ্গি দেখতে চাইলে অবাক হয়।রুপম নজরে কোনো সুখ-দুঃখ নেই।আজিব মানুষ তো!
রেশমি তার স্বামীর হাত ধরে বলল,”তুমি শুনেছো কী বলেছি?”
ধীর গতিতে রুপম তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,”আমি এত তাড়াতাড়ি সন্তান চাই না।”
বিনা মেঘে রেশমির মন আকাশে বজ্রপাত পড়লো।অবাক কণ্ঠে সে বলল,”মানে?”
-“মানে এবরশন করিয়ে ফেলো।একটা সন্তানই যথেষ্ট আমার কাছে।”
চলবে...
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com