বিষন্ন রাত । পর্ব -০৭
ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নিলো দুজন। রাত জামা কাপর গুলো ব্যগে নিচ্ছে একে একে। পাশ থেকে বৃষ্টি বলে উঠে,
– জামা কাপর ঘুচিয়ে কোথায় যাচ্ছো?
– কেনো বাড়ি যেতে হবেনা?
– একটা অনুরুধ করি?
– কী?
– গত কাল থেকে এখন পর্যন্ত সময়টা আমার জীবনের বেষ্ট সময় ছিলো তুমি পাশে ছিলে বলে। আর বাসা থেকে দুদিনের কথা বলে বেড়িয়েছি। এখনো একদিন বাকি। চলে গেলেই তো সব আগের মতো হয়ে যাবে। আজকের দিনটাও আমি তোমার সাথে কাটাতে চাই। না করোনা প্লিজ,,,,
অবশেষে বৃষ্টি করুন আবদারের কাছে হেরে গেলো রাতের চিন্তাধারা।
রাত বাইরে গিয়ে কিছু জামা কাপর কিনে আনলো বৃষ্টির জন্য।
রাত বৃষ্টিকে নিয়ে পার করে দিলো আরো একদিন। যতই রাতের কাছে থাকছো ততোই লোভের পাল্লা ভারি হচ্ছে বৃষ্টির। এটা লোভ নয় এক প্রকার নেশা। রাতের সাথে থাকার নেশা।
রাতের কাছেও এই দু,দিনের জন্য মনে হয়নি বৃষ্টি তার অন্যকেও। মনে হয়েছিলো খুবই কাছের কেও বৃষ্টি।
বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছে তারা। বৃষ্টির মুখ জুরে অভিমানের ছাপ। কেনো রাত তাকে বাড়ি দিয়ে আসছে? আরেক দিনের জন্য নিজের পাশে রাখলে কি হয়? রাত কেনো বুঝেনা? কেনো তার কাছে থাকার জন্য নানান অজুহাত খুজি বুঝেনা সে? তার কাছে থাকলে আমার পুরু পৃথিবিটাই আপন লাগে তা কি বুঝেনা?
চলে যাচ্ছে তারা, সারা রাস্তা চুপটি মেরে বসে আছে বৃষ্টি।
পাশ থেকে রাত বলে উঠে,
– মন খারাপ?
– উহু।
– তাহলে চুপ করে আছো যে?
– এমনি ভালো লাগছেনা।
– ভালো না লাগার কারণটা কি আমি?
– নাহ্
– তাহলে?
– কিছুনা এমনি।
আর কিছু বললো না রাত। বৃষ্টির নিরবতার ভাষা টা কিছুটা বুঝতে পারছে সে।
বাসায় পৌছে গেলো তারা। বৃষ্টিকে নামিয়ে দিয়ে বিদায় দিলো রাত। বৃষ্টি কিছুক্ষন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো রাতের দিকে। কিছুক্ষন নিরবতায় কাটলো তাদের মাঝে। মনে হচ্ছে মুখে নয় চোখে চোখে কথা হচ্ছে তাদের।
তার পর বিদায় নিয়ে ভিতরে চলে গেলো বৃষ্টি। রাতও বিদায় দিয়ে রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। কেমন একটা শুন্যতা অনুভব করছে রাতের। মনে হচ্ছে খুব কাছের কিছু একটার মাঝে আবার দুরুত্ব বেড়ে গেলো।
বাসায় প্রবেশ করতেই সোফায় গা এলিয়ে দিলো রাত। রুদ্র চৌধুরি তখন অফিসে। পলি চৌধুরির চেচামেচি কানে আসছে রাতের। মনে হয় রাতকে নিয়ে খেপেছে সে। কিন্তু আসতে না আসতে কি এমন করে ফেললো যার জন্য পলি চৌধুরি এমন চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিলো?
পলি এগিয়ে এসে দুটু সিগারেটের পেকেট ছুরে দিলো রাতের সামনে।
– এ কেমন অসভ্যতা রাত? এতো দিন জানতাম বাইরে নেশা করতে। এখন দেখি ঘরের মাঝেও এসব হাবিজাবি। সাহস দিন দিন আকাশ ছুয়ে যাচ্ছে তোমার। কয়দিন পরতো আমাদের সামনে বসেই এসব শুরু করবে।
পলির কথা শুনেও চুপচাপ বসে আছে রাত। সব সময় তর্ক করার মুড থাকেনা মানুষের। ব্যাগ নিয়ে চুপ চাপ নিজের রুমে চলে গেলো সে।
পলি চৌধুরির মুখে এর চাইতেও বেশি কথা শুনতো। যখন সে আরো ছোট ছিলো। কিন্তু এখন তো সে বড় হয়েছে। ভালো মন্দ বুঝার বয়স হয়েছে তার। তাও পলির এমন আচরণ। এটা নিয়ে মাঝে মাঝে অবাক হয় রাত। মাঝে মাঝে এসব কথার প্রতিবাদ করে উঠলেও সেটা তর্ক হয়ে যায়। আর সেই তর্ককে ন্যাশেনাল নিউজ বানিয়ে পরিবেশন করে তার বাবার কাছে।
মাঝে মাঝে রাতের ইচ্ছে হয় এসব ঝামেলা ছেরে অনেক দুরে চলে যেতে। যেখানে এসব কিছুই থাকবেনা।
রাতে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে পলি চৌধুরি। পাশ থেকে কাজের মেয়েটা বলে উঠে,
– খালাম্মা, ভাইজান মাত্র বাসায় আসছে। এসব কথা তো পরেও কইতে পারতেন তাইনা? আর ভাইজান এখন বড় হয়েছে তার সাথে এভাবে আচর করাটা উচিৎ না।
পলি রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিওলির দিকে।
– তোর কাছ থেকে এখন সব শিখতে হবে আমার? ওকে কখন থেকে এসব নিয়ে পড়াবি বল? কাজের সাথে এক্সট্রা টিওশনির মাইনেও পাবি।
– না খালাম্মা আমি অইডা কই নাই। আর এইডা কইতে পারি আপনের শিক্ষা ধিক্ষা কিছুটা থাকলেও জেনারেল নলেজের অভাব আছে আপনার।
– তোর তো দেখি খুব সাহস বেরে গেছেরে শিওলি। আমার মুখে মুখে কথা বলছিস, তাও আবার জ্ঞান নিয়ে। তোর আর এই বাসায় কাজ করতে হবেনা। কাল থেকে তোর আর আসতে হবেনা।
– আমিও আর আপনের কাজ করতে চাইনা। সারাদিন কুত্তার মতো আচরণ করেন আমার লগে। যদিও আমরা কাজ করে নিজের পেট চালাই, কিন্তু আমাগোও একটা সম্মান আছে। কারণ আমরাও মানুষ। হয়তো আপনাগো মতন এতো বিশাল অট্টালিকা নাই। কিন্তু আমরা মানুষদের সম্মান করতে জানি। আমরা কাম করে খাই, ভিক্ষা করে খাইনা। আর কারো কর্মকে ছোট করে দেখবেন না।
– তোদের মতো মেয়েদের দু,দিন কাজে রাখলেই শরিলে পাখা গজিয়ে যায়। কাজ করতে না চাইলে এখনো দাড়িয়ে আছিস কেনো। যা বের হ, গেট আউট ফ্রম মাই হাউজ।
– চলে জামু আমি। থাকতে আসিনাই এইখানে। মাসের অর্ধেকের চেয়ে বেশি চলে গেছে, আমার কামের টাকাটা দেন আমি চলে যাচ্ছি।
– এক টাকাও তুই পাবিনা। আমার সাথে তর্ক করার সাহস হয় কি করে তোর? যে বের হ এখান থেকে।
উপর থেকে সব কিছু দেখে যাচ্ছে রাত। সোজা বাবার রুমে গিয়ে আলমারি থেকে কিছু টাকা নিয়ে এসে শিউলির দিকে বাড়িয়ে দেয় রাত।
– এই নাও এখানে পুরু এক মাসের টাকা আছে। আর শুনো যে তোমার কাজকে সম্মান করতে জানেনা, তাকেও তোমার সম্মান করার দরকার নেই। যে তোমার সাথে কুকুরের মতো আচরণ করবে তাকে তুমিও ঘোরার মতো পিছ পা দিয়ে লাত্তি দিবে অন্য কোথাও কাজ খুজে নিবে। এতেই তোমার সম্মানটা বেচে থাকবে।
শিউলি টাকা নিয়ে চলে গেলো আর পলি অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে রাতের দিেকে। সেদিকে কোনো পাত্তা না দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো রাত।
বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এখন গেম খেলছে রিদ। পাশে এসে দাড়ায় বৃষ্টি।
– এই রিদ ধর আমার বিকাশ নাম্বারে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে আয় তো।
– এতো টাকা বিকাশ করে কি করবি তুই?
– মাঝে মাঝে ফোনে রিচার্জ দিতে হয়। এতো কথা কলিস না তো যা রিচার্জ দিয়ে আয় আর এই একশ টাকায় তুই কিছু খেয়ে নিস।
– যা তো আপু বিরক্ত করিস না। দেখছিস না গেম খেলছি। পরে দিবো।
– এখন যা তুই। আর গেম খেলতে হবে না। দেখি ফোনটা আমাকে দে।
বিরক্তি মনে বেড়িয়ে পরলো রিদ। সন্ধা অব্দি বসে আছে বৃষ্টি, ফোনে টাকা আশার কোনো নাম গন্ধও নেই। বৃষ্টি অপেক্ষায় আছে রাতের সাথে খথা বলতে। ফোনেও ব্যলেন্স নাই। এদিকে রিদেরও কোনো খোজ নেই।
সন্ধার পর বাড়ি এলো রিদ। বৃষ্টি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কিরে কোথায় ছিলি এতোক্ষন?
– ওইতো আমার বন্ধু সামি আছেনা। ওর সাথে ছিলাম।
– তো ফোনে টাকা আসেনি কেনো?
– কিসের টাকা?
– তোকে যে বললাম বিকাশ রিচার্জ দিতে সেই টাকা।
– কখন বললি? একটু আগে তো তুই বললি, এই নে ধর তোর নাকি টাকা লাগবে এগুলো রাখ।
– কিহ্, তুই ফোনে টাকা দিস নি?
– তুই আমায় টাকা দিলি হাত খরচের জন্য, আর সেগুলো আমি তোর ফোনে ভরে দিবো। মগের মুল্লুক নাকি?
– ফোনে পাঠাতে হবেনা তুই আমার টাকা দে আগে।
– নেই।
– নেই মানে?
– নেই মানে নেই, আমাদের স্কুলের মাঠে একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট হচ্ছে। সেখানে ৪ হাজার দিয়ে একটা টিম দিয়ে এসেছি। আর সামির সাথে একটু ঘুরাফিরা করলাম খেলাম এই আরকি। পাঁচশ টাকার মতো আছে এখন। সেগুলো নিবি? আচ্ছা বাদ দে এই পাঁচশ নিয়েও আর কি করবি, এগুলো না হয় আমার কাছেই থাক।
বলেই নাচতে নাচতে উপরে চলে গেলো রিদ। বৃষ্টি রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিদের দিকে। জেনে শুনে শিয়ালের কাছে মুর্গি জমা রাখলো আজ।
রাত তখন গভির,
ঘুম নেই বৃষ্টির চোখে। আর রাত তো এমনিতেও দেরি করে ঘুমায়।
মনের মাঝে একটা শুন্যতা কাজ করছে দুজনেরই। গত দু,দিন একসাথে ছিলো দুজন।
আর আজ ভিন্ন জায়গায়।
রাতের চোখে বার বার ভেসে উঠছিল বৃষ্টির ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরার মুহুর্তটা।
ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টিকে আলতে করে বুক থেকে সরানোর মুহুর্তটা।
আজ আর কোনো কিছুতেই মন বসছেনা রাতের। শুধু বৃষ্টির শুন্যতা অনুভব করে যাচ্ছে সে।
আর ওপাশে ছটপট করছে বৃষ্টি। রাতকে না বলা কথাটা আর জমিরে রাখতে পারছেনা বুকে।
বার বার মুখ ফুটে বেড়িয়ে আসতে চায়।
রাত ফোন হাতে নিলো। আজ বৃষ্টি একবারও ফোন করেনি।
হয়তো তার ফোনেরই অপেক্ষা করছে। বৃষ্টিকে ফোন দিতে যাবে তখনই দেখে ওপাস থেকে ফোন দিলো বৃষ্টি। উত্তেজিত হয়ে ফোনটা রিসিভ করলো রাত।
কারো মুখে কোনো কথা নেই শুনে চলছে একে অপরের নিশ্বাসের শব্দ। নিরবতা ভেঙে রাত বলে উঠে,
– কেমন আছো?
– ভালো, তুমি?
– আলহাম্দুলিল্লাহ্।…….. কিছু বলছোনা যে?
– কি বলবো?
– তাহলে ফোন দিলে যে?
– তোমার ভয়েজ শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিলো।
– ওহ্। আর?
– খেয়েছো?
– হুম।
শিউলি চলে গেলো তাই আজ পলি চৌধুরি রান্না করেছে সব,
আর এতো কিছুর পর ও সেই খাবার নামবে না রাতে গলা দিয়ে।
তাই রেস্টুরেন্ট থেকেই খেয়ে এলো সে।
সকালের ওই বেপার আর এই ব্যাপার নিয়ে ভালোভাবেই নালিশ দিলো পলি চৌধুরি।
কিন্তু পলির কথায় কোনো কান দিলোনা রুদ্র। ইদানিং পলির থেকে দুরে দুরেই থাকছে রুদ্র।
দিন দিন এতো অভিযোগ তার সহ্যের বাইরে। অসহ্য।
কিছুক্ষন ফোনালাপ করে করে শুয়ে থাকলো দুজনই। কারো চোখে ঘুম নেই কিন্তু মনে অদ্ভুত প্রশান্তি।
রাফিরা তাদের ফেলে চলে যাওয়ার পর রাত ভেবেছিলো তাদের পেলে আগে কোনো কথা ছারাই ইচ্ছে মতো ধোলাই করবে। কিন্তু চিন্তা বাবনার বেতিক্রম ঘটলো খুব সহজেই।
মার দেওয়া ও থ্যাংস দেওয়ার মাঝামাঝি অবস্থায় আছে সে। যাই হোক ভালোই হয়েছে।
,
,
পরদিন কলেজ ছুটির পর মাঠের মাঝখানে দাড়িয়ে আছে বৃষ্টি ও রাত। সবাই চলে গেছে এতোক্ষনে।
রাফিরা সবাই বসে আছে একটু দুরেই, কলেজ বারান্দায়।
মাথার উপর দিয়ে বয়ে চলছে ভারি বর্ষন। কাক ভেজা হয়ে যাচ্ছে দুজন।
কিন্তু তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই বৃষ্টি। তার আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা মনের কথাটা খুলে বলবে রাতকে।
যাই হয়ে যাকনা কেনো আজ আর কোনো বাধা মানবেনা সে।
এক হাটু মাটিতে ফেলে বসে পরে বৃষ্টি। তাকিয়ে আছে রাতের চোখের দিয়ে।
রাতও যেনো অধিক অপেক্ষায় রয়েছে। বৃষ্টির মুখ থেকে সেই না বলা কথাটা শুনার জন্যে।
প্রেম ভালোবাসাকে সবসময় ঘৃনা করা মানুষ গুলোও এক সময় কাওকে খুব ভয়ঙ্কর ভাবে ভালোবেসে ফেলে।
যেনো এটা একটা নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছে।
চলবে..
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com