শুন্যতা । পর্ব- ১৮
ডিসি স্যার বলেছে আপনাদেরকে ১০ মিনিট সময় দিতে। আপনারা দেখা করুন।
বলেই তিনি আরেকজন পুলিশকে বললেন আমাদেরকে ভেতরে নিয়ে যেতে।
তিয়াস চোখ বড় বড় করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
সে এতক্ষণে বুঝে গেছে আমরা কোন লায়লা আফরোজের কথা বলছি,
কিন্তু তার কথা বলার শক্তি লোপ পেয়েছে এবং সে হাঁটতে পারছেনা,
কেমন যেন উদাস দেখাচ্ছে তাকে।
রায়ান হাত দিয়ে টেনে টেনে তিয়াসকে সামনে নিয়ে যাচ্ছে।
হাঁটার মধ্যে তিয়াস দুলছিল।
তারপর আস্তে আস্তে আমরা শিকের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার আগেই পরিশ্রান্ত,
শুকনো মুখো, রোগা শরীরের একজন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
আমি তিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললাম,
উনিই সেই লায়লা আফরোজ, যাকে ভালোবেসে তোমার ছোট পাপা আত্মহত্যা করেছিলো।
তিয়াস এতক্ষণ স্বাভাবিক ছিল, হঠাৎ করেই সে সেটার বাইরে থেকে হাত বাড়িয়ে গর্জন করে করে বলতে লাগলো,
তুই, তুই?
তোর জন্যই তো আমার ছোট পাপা মারা গেছে,
মনে আছে জুলহাজ হাবিবের কথা?
উনি আমার চাচা হন। যাকে তুই আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছিলি।
আমি নিজ চোখ উনাকে মরতে দেখেছি!
আর তাই তোকে আমি নিজ হাতে মারতে চাই। নিজ হাতে!
ভয় পেয়ে উনি একপাশে গিয়ে জুবুথুবু হয়ে তাকিয়ে আছেন।
পেছন থেকে রায়ান আর একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
সবাই মিলে তিয়াসকে বাইরে আনলাম।
এক বোতল পানি হাতে দিলাম,
তিয়াস ঢকঢক করে সবটা পানি খেয়ে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে।
রায়ান ভাইয়া আস্তে আস্তে বললো,
তিয়াস শান্ত হও। যারা অপরাধী তারা ঠিকি শাস্তি পায়,
আগে হোক কিংবা পরে।
উনি উনার স্বামীকে নিজ হাতে খুন করে গুম করে রেখেছিলেন ৯ দিন।
খুন করার কারণ ছিল তিনি নিজের স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সাথে পরকীয়ায় ছিলেন,
যার জন্য তার স্বামী জবাবদিহিতা চেয়েছেন।
প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হলেও শেষ পর্যন্ত উনি খুনের মতো একটা জঘন্য অপরাধও করেছেন,
সেটাও নিজ হাতে। তবে খুন উনি বহু আগেই করেছেন,
কিন্তু পরোক্ষভাবে ছিল। তোমার চাচা জুলহাজ হাবিবকে উনিই মরতে বাধ্য করেছিলেন।
আমি তোমাকে নিয়ে এখানে এসেছি কারণ আমি চাই তুমি সেই আত্মহত্যার বিষয়টাও আদালতে তুলো,
উনার কঠিন শাস্তি দাবী করো। এমনিতেও উনার ফাঁসি না হলেও যাবৎজীবন কারাগারে থাকার দন্ড ঠিকি হবে।
তিয়াস কেমন যেন স্বচ্ছ একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। সেই নিঃশ্বাসে ছিল এক আকাশ প্রশান্তি। সে হাসছে, অযথা পাগলের মতো হাসছে। আমি আর রায়ান অবাক হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।
তারপর তিয়াস হুট করেই উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
প্রীলি এখন আমাকেও পুলিশে ধরিয়ে দাও প্লিজ। আমিও তো অনেক অপরাধ করেছি।
তোমার সাথে করেছি, দীপ্তির সাথে করেছি, আরো অসংখ্য মেয়ের সাথে করেছি।
আমি এবার শাস্তি পেলেও, এমনকি মৃত্যু এলেও একটুও কষ্ট পাবোনা।
আমি আমার ছোট পাপাকে বলতে পারবো,
দেখো তোমার খুনি আজ শাস্তির অভিমুখে দাঁড়িয়ে আছে, সেও তিলে তিলে শূন্য হয়ে মরবে,
তুমি খুশি তো ছোট পাপা?
তোমার খুশিতেই তো আমি খুশি!
এর মধ্যে পেছন থেকে একটা হর্ণ বাজলো । আমি তাকিয়ে দেখলাম দিশা এসেছে।
তিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললাম,
তিয়াস, দিশা লায়লা আফরোজের ভাসুরের মেয়ে।
তিনি যেমন তোমার চাচাকে মেরেছে, এমনভাবেই তার চাচাকেও মেরেছে।
দিশা তোমাকে ভালোবাসে , সেদিন ফোনে আমাকে সব বলেছিলো।
কিন্তু সেটা আমি আগে ভয়ে বলিনি,
কারণ তুমি যদি জানো লায়লা আফরোজের সাথে ওর
কোনো সম্পর্ক আছে তাহলে আরো রেগে যেতে পারো।
কিন্তু এটা তো সত্য তুমি তার জীবনটাই বদলে দিয়েছো,
তাকে সুন্দর করে বাঁচতে শিখিয়েছো,
তাই তোমার প্রতি তার সম্মানবোধের সিমান্তটা অনেকদূর ।
তুমিই বলো যে সম্পর্কে সম্মানবোধ বেশি সেই সম্পর্কটাই সুন্দর না?
আর দিশার রক্তে লায়লা আফরোজের কোনো ছিঁটাও নেই, সেও ঠিক তোমার মতো!
তাই তুমি দিশাকে বিয়ে করো,
আমি জানি তুমি চাইলেই একদম ঠিক হয়ে যাবে, সবার মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে,
দিশা তোমার পাশে থাকবে।
আর দেখো যেটাতে বহুবছরের ঘৃণা ছিল, সেটা কিন্তু ভালোবাসা নয় বন্ধুত্বে রূপ নিতে পারে।
আমি আর রায়ান ভাইয়া সবসময় তোমার সাথে বন্ধুর মতো থাকবো।
তিয়াস হেসে বললো,
দিশা তুমি আমাকে কেন বলোনি? আর প্রীলি তোমার কি মনে হচ্ছে আমি এখনো ঠিক নেই?
আমি তো শাস্তির দরজায় সেই পাপী মুখটা দেখার পরেই নিজের পাপগুলির প্রায়শ্চিত্ত করে ফেলেছি,
আমি টের পেয়েছি আমিও এতদিন ভুল করেছি।
এগুলো করা আমার উচিত হয়নি। আমার আজ ভীষণ ভালো লাগছে!
দিশা এগিয়ে এসে তিয়াসের আঙুল আঁকড়ে দাঁড়ালো।
এটা দেখে আমি আর রায়ান ভাইয়াও কাছাকাছি ঘেঁষে একটু হাসলাম।
সব শূন্যতা আজ পূরণ হয়েছে, বদল হয়েছে অস্তিত্ব!
সত্যি আমরা চাইলেই অস্তিত্বের রূপভেদ করে আবার নতুন অস্তিত্বে বেঁচে থাকতে পারি।
কিন্তু শূন্যতায় নিজেকে ঠেলে দিয়ে জীবন মরণের প্রশ্নতে আকিঁবুকিঁ টানি!
যা নিঃসন্দেহে মারাত্মক ভুল এবং তাতে আমাদের সুন্দর জীবনের ক্ষতি ছাড়া কিছুই পাওয়া সম্ভব হয়না।
১১ মাস পরের কথা।
গতকাল থেকে বাড়িতে ঈদের আমেজ।
কারণ আমার সারাজীবনের স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে।
আমার বাবা গ্রামের সবাইকে বিরিয়ানির দাওয়াত দিয়েছেন,
মসজিদে মিলাত পড়িয়েছেন। বাবা মা দাদুর মুখ থেকে হাসির রেখাটা যেন থামছেইনা।
অন্যদিকে আমি রায়ান ভাইয়ার ব্যপারেও সব জানিয়েছি।
আজকে উনাদের বাসা থেকে মানুষ আসছে, আংটি পরিয়ে বিয়ের তারিখ পাকা করবে।
রায়ান ভাইয়ার কথামতো আজকে উনার পছন্দের একটা শাড়ী পরেছি।
উনার মা-বাবার সামনে বসে আছি, এদিকে উনি উনার বোনকে এগিয়ে আনতে আমার বাড়ির পেছনের রাস্তায় আগাচ্ছেন। উনারা একসাথে মিলিয়ে আসতে পারেননি কারণ উনার হাসবেন্ড চাকরির ডিউটি থেকে সোজা এখানে আসতে হচ্ছে।
এদিকে রায়ান ভাইয়ার মা আমার সাথে কথা বলছেন।
বাবা কোনো একটা কাজে এদিকে আসছিলো। তখনই আমি কোনো একটা প্রসঙ্গ তুলে বললাম,
হ্যাঁ বিয়ের পরে আমার পরিবার আমার সাথেই থাকবে।
আমরা সবাই মিলেমিশে থাকবো।
আমার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই রায়ান ভাইয়ার মা-বাবা একে অপরের দিকে তাকিয়ে উনার মা বললেন,
সে-কি উনারা তো এখানেই ভালো আছেন।
তাছাড়া গ্রাম থেকে গিয়ে শহরে খাপখাওয়াতে পারবেন না। এসব ঝামেলা না?
আমি টের পাচ্ছিলাম আমার পুরো রক্ত মাথায় চড়ে উঠেছে। তারপরও কিছুটা শান্ত গলায় বললাম,
আমি উনাদের এবং আপনাদেরকে নিয়েই একসাথে থাকতে চাই। তাছাড়া আমি তো..
আমি কথাটা বলার আগেই বাবা সেখান থেকে একদৌড়ে ভেতরে চলে গেলেন।
আমি উনাদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা রাগ মিশ্রিত চেহেরায় বললাম,
আমি যেখানেই থাকবো আমার পরিবার নিয়ে থাকবো।
আপনারা রাজী না হলে বিয়ে বাতিল করে দিতে পারেন।
আমি এতে কোনো পরোয়া করিনা।
কিন্তু আমার বাবা-মা কিংবা পরিবার কখনো কষ্ট পেলে সেটাকে বরদাস্ত করবোনা।
আজকের আমিটাকে গড়তে গিয়ে আমার বাবার রক্ত পানি হয়েছে,
চামড়া পুড়েছে, হাতে পায়ে ফোসকা পড়েছে।
আর সেগুলোকে আস্তে আস্তে আমিই সারিয়ে নিবো, এবং সেই দায়িত্ব আমারই!
আমি কথা না বাড়িয়ে বাবার পেছন পেছন ছুটলাম।
গিয়েই দেখি বাবা বসে কাঁদতেছে।
আমাকে দেখতে পেয়েই উনি চোখের পানি আড়াল করে আস্তে আস্তে বললেন,
লিয়া মা তুই এখানে? দেখ সব মেহমান বোধহয় চলে আসছে। তুই যা মা।
আমি বাবার পাশে বসে কেঁদে কেঁদে বললাম,
আমি সব ছেড়ে দিতে রাজী বাবা।
দুনিয়ার সবকিছুর বিনিময়েও আমি তোমাদের চোখের পানি সহ্য করতে পারবোনা।
দরকার হলে সারাজীবন বিয়ে বিহীন কাটিয়ে দিবো।
বাবা বিশ্বাস করো তোমরা থাকলে আমাকে কোনো শূন্যতা ঘিরতে পারবেনা,
আমি নিজেকে হাজারবার সার্থক ভাব্বো নির্দ্বিধায়। বাবা তুমি বিয়ে ভেঙে দাও।
যেখানে তোমাদের অস্তিত্ব মূল্যহীন করবে সেখানে আমি সবকিছু পেয়েও শূন্য হয়ে যাবো বাবা।
আমি বিয়ে করবোনা!
বাবা ডুকরে কেঁদে উঠলেন আর মাথায় হাত রেখে বললেন,
লিয়া, বাবা মায়েরা সন্তানের সাফল্যেই খুশি হয়। তারা আর কিছুই চায়না।
আমরা তো এখানে বেশ আছি, আর থাকবোও।
তোর বাবা সারাজীবনের কষ্টের প্রতিদান পেয়েছে এটাই কম কি বল?
লোকে আমাকে শ্রদ্ধা করবে, তারা আমাকে দেখিয়ে কাউকে অনুপ্রেরণা দিবে,
তোর নাম করে নিজের সন্তানের ভেতর স্বপ্ন জাগাবে,
এর বেশি একটা বাবার কি চাওয়া থাকে বল তো?
এখন তোর দাদুকে শেষ পর্যন্ত যত্ন করে দিতে পারলেই আমার আরেক সার্থকতা নিহিত হবে।
তারপর তোর ভাইটা যদি কোনো একটা ধারায় যায় তাহলে তোর মা আর আমি টেনেটুনে সুন্দর চলে যাবো।
আমি বাবাকে চুপ করিয়ে বললাম,
বলছিনা আমি কোথাও যাবোনা। গেলে তোমাদের নিয়েই যাবো।
এতদিন তুমি আমাকে একটু একটু করে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছো,
এবার আমিও সযত্নে তোমাদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আগলে রাখবো। আমি বিয়ে করবোনা বাবা।
তখনই দরজার ওপাশ থেকে রায়ান ভাইয়ার গলা শুনে ফিরলাম। উনি বলছে,
প্রীলিয়া তুমি আমার মায়ের কথা শুনে বিয়ের ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছো?
একবারও আমাকে জিজ্ঞাসা করলেনা আমি কি চাই?
আরে আমি তো তুমি না বললেও তোমার বাবা মাকে নিজের
মা বাবার মতো আগলে রাখতাম। তাদের জন্যই তো আমি তোমাকে পেয়েছি।
আর এই যে আমার মা। আচ্ছা আম্মু বলোতো তুমি আমাকে এই আশাতেই এতদূর এনেছোনা?
যে একসময় তোমার ছেলে তোমাদের দায়ভার কাঁধে নিবে, তোমাদেরকে যত্ন করবে।
তেমন তো প্রীলিয়ার মা -বাবাও করেছে।
সে একটা মেয়ে বলে নিজের বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখতে পারবেনা?
মেয়েরা কি দায়িত্ব নিতে জানেনা?
সব মা-বাবা সন্তানের সুখে সুখ পেলেও তারা তাদের গড়ে তোলা
সন্তানের থেকে শেষ পর্যন্ত ভরসা চায়।
তাদের কাছে থেকে,
আদর যত্নে নিজের শেষ সময়টাও সুন্দর দেখতে চায়। তুমি এটা কেন বললে মা?
রায়ান ভাইয়ার মা কিছুটা নরম স্বরে বললেন,
রায়ান আমি আসলে বুঝতে পারিনি। আমার ভুল হয়ে গেছে,
সত্যিই কথাটা ভীষণ খারাপ ছিল! লিয়া তুমি আমাকে..
আমি এগিয়ে উনার হাতে ধরে অল্প হেসে বললাম,
আরে না না আপনি একি করছেন? তাছাড়া আমার মা বাবার সাথে মিশে দেখুন,
তারপর উনাকে বেড়াতে আসতেও দিতে চাইবেন না!
বাবা এবার একটু হাসলেন। মা কাজ সামলে এসে বুঝতে পারলেন না,
এখানে কি হয়েছে! বাবা ইশারা করছে যেন না বলি। আমিও মাথা নাড়লাম।
বিয়ের তারিখ পাকা হয়ে গেলো।
কয়েকদিনের মধ্যে বিরাট আয়োজনে বিয়েটাও হয়ে গেলো।
বিয়ে পড়ানো শেষ হলে যেখানে মেয়েরা একা তার শ্বশুর বাড়ি যায় সেখানে আমরা পুরো পরিবার যাচ্ছি।
বড় দেখে নতুন একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি।
গাড়ীতে বসে আমি উনার কাঁধে মাথা রাখলাম।
উনি আস্তে আস্তে মাথায় হাত রেখ বললেন,
প্রীলিয়া আমাদের দুজনের মধ্যকার অস্তিত্বটা আজ একরকম।
এখানে তো আর কোনো শূন্যতা নেই তাইনা?
আমি মুচকি হেসে বললাম,
উমম!এখানে আর কোনো শূন্যতা নেই, যা আছে সব পূর্ণতা!
এভাবেই মিশে থাকবো আমরা ।
তবে আপনাকে মাঝে মাঝে ভাইয়া ডাকবো, রাগ করবেন না কিন্তু!
উনি আমার কথা শুনে রাগী চেহেরায় অদ্ভুতভাবে হেসে জড়িয়ে ধরলেন!
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com