এক রক্তিম শ্রাবণে । পর্ব -৪১
আকাশ কাঁপিয়ে জলধারা নামে আজকাল।মেঘে মেঘে বিস্তর রেশারেশি করে পরিশেষে অভিমানগুলো বৃষ্টিরূপে ঝরে পরে যায় ধরণীর গায়ে।ধরিত্রীমাতা তা সাদরে বরণ করে নেয় দুহাত মেলে।প্রকৃতি ভিজে উঠে।কাঁটা মাটির গন্ধ,পিচঢালা রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা জলরাশি,চকচক করে উঠা সবুজ গাছটার মগডালে সরু সোনালী রোদরশ্মি,সবটা যেনো এই চিরচেনা প্রকৃতিটাকে নতুন করে একেবারে শুদ্ধতম রূপে ভালবাসতে শেখায়।শ্রাবণ মানেই তো বৃষ্টি আর বৃষ্টি মানে প্রেম।সুতরাং এই শ্রাবণের সব বর্ষণের অপরিবর্তিত এক নাম “প্রেমবর্ষণ”।
মায়ের ঘরের বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে তোহা।তাকে বসিয়ে রেখে কাঠের আলমারি হা করে খুলে আধঘন্টা যাবত খোজাখুজি করছে আতিয়া।মাঝেমধ্য দু একবার বিরবির করে “রাখলাম কোথায়?”,”পাচ্ছিনা কেনো?” এই ধরণের স্বগতোক্তি আওড়াচ্ছে।তোহা চোখমুখ পুতুলের ন্যায় শান্ত,নিশ্চল।কিছু বলতে গেলেই তাকে মৃদু ধমকের স্বরে চুপ করিয়ে দিচ্ছে আতিয়া।
ড্রইংরুম থেকে ছেলেদের হাসি ঠাট্টার শব্দ কানে আসছে।তার খালুরা,ভাইরা সবাই বসেছে ড্রইংরুমে।কাবিন হবে আগামীকাল মানে শুক্রবারে।আগে বিয়েটা পরিয়ে রেখে তারপর বাদবাকি হলুদ বিয়ের আনুষ্ঠানিক জমকালো আয়োজন শুরু হবে পরের সপ্তাহে।আদরের ছোট মেয়ের বিয়ে বলে কথা।আরমান সাহেব পারলে মাসখানেক আগে থেকেই বাড়িঘর সাজিয়ে ফেলেন।কিন্তু তা করলে লোকে তাকে পাগল বই কিছু বলবেনা।
আতিয়ার হাতে তার বিয়ের ওড়নাটা।সিঁদুর রঙা ওড়নায় সোনালী কাজ করা পাড়।সেই পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগের যুগেও আরমান সাহেব বেশ রুচিশীল ছিলেন।বিয়ের শাড়ি-গহনার সাথে এই ওড়নাটাও দিয়েছিলেন।দামি দামি শাড়ি গহনার ভিড়ে এই ওড়নাটাই বেশি মনকেড়ে ছিলো যুবতী আতিয়ার।
ওড়নাটা এতকাল বেশ সযত্নে তুলে রাখা ছিলো আলমারির নিরাপদ এককোঁণে।নিশার বিয়ের সময় অবশ্য বের করেছিলো আতিয়া।কিন্তু নিশা সাফ মানা করে দিয়েছিলো যে সে এসব পুরনো যুগের ওড়না পরবেনা।কষ্ট পেলেও আতিয়া জোর করেনি।হাতের পাঁচআঙ্গুল তো আর সমান হয়না।তখন এটা আবার তোহার জন্য যত্ন করে তুলে রেখেছিলেন উনি।তোহা যেন বিয়ের দিন তার মায়ের ওড়না মাথায় দেয় এমন একটা সুপ্ত ইচ্ছা তার আছে।যদিও সে জোর করবেনা তবে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছোট মেয়ে মায়ের ইচ্ছার মান রাখবে।
পরাই?
কিছুক্ষণের জন্য একরকম মোহে চলে গেলো তোহা।মায়ের এমন কন্ঠ সে আগে শোনেনি।খানিকবাদে নিজের গায়ের ওড়না দিয়ে টানা ঘোমটা টা নামিয়ে মাথা নুয়ালো সে।মেয়ের সম্মতি বুঝতেই ঠোঁটে প্রগাঢ় হাসির ঝলক খেলে উঠলো আতিয়ার।চোখের কোঁণায় চিকচিকে অশ্রুকণা নিয়ে ধীর গতিতে ওড়নাটা তোহাকে পরিয়ে দিলো আতিয়া।মুখ নামিয়ে মনভরে তোহাকে দেখে নিয়ে কপালে স্নেহের চুমু খেয়ে বললো,”মাশাআল্লাহ্”।
তোহা হাসলো।এ হাসিতে যেনো মুক্ত ঝরে।মা মেয়ের এহেন মূহুর্তে বাঁধা হয়ে স্বশব্দে দরজা খুলে ভেতরে আসলো স্বর্ণালী।বললো,”খালুর চশমা কোথায় খালামনি?খালু চাচ্ছে”।আতিয়া উঠে দাড়ালো।খুব সন্তর্পনে চোখের জলটা মুছে নিয়ে গলা ঝেড়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে উওর দিলো,”কোথায় যে রেখেছে?আচ্ছা,তুই যা,আমি খুঁজে আনছি।”স্বর্ণালী চলে গেলো।তবে দরজাটা অর্ধেক না ভিড়িয়েই।
এখান থেকে ড্রইংরুমের সব স্পষ্ট দেখা যায়।তোহার দৃষ্টি মুখ বরাবর রাখা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে।নিজেকে কেমন নতুন নতুন লাগছে।একদম অচেনা,স্নিগ্ধ একটা শোভা।
ড্রইংরুমের কোঁণার সোফায় বসে কথাবার্তায় নিবিষ্ট ছিলো তিহান।নিতান্তই বেখেয়ালিতে হঠাৎ পাশের রুমের দিকে চোখ পড়লেও পরমূহুর্তেই তার সকল খেয়াল যেয়ে স্তূপআকারে জমা হলো সেখানে।
তিহান বশীভূত হলো।বিয়ের লাল ওড়না মাথায় দেয়া মেয়েটার এই আশ্চর্য অপার সৌন্দর্য তার তুচ্ছ চোখজোড়া ধারণ করতে পারছেনা।তবুও সে তা চেষ্টা করলো তা সহ্য করে নেয়ার।।চেয়ে রইলো মুগ্ধ,নিষ্পলক নয়নে।
মিনিট পার না হতেই চারচোখ এক হলো।চট করে দৃষ্টি নামালো তোহা।সেই গালের রক্তিম আভাযুক্ত অপার্থিব সৌন্দর্যের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিলো তিহানের ধূসর মনি।ধীরগতিতে সেও চোখ ফিরিয়ে নিলো।
সন্ধ্যা সাতটা।
তিহানের মুখশ্রী থমথমে।ক্রোধে ফেটে পরছে লালাভ চোখদুটো।ফর্সা চেহারায় ফুটে উঠা ঝাঁঝালো রাগটা লুকানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলোনা সে।শুধুমাত্র বিয়ের ভরা বাড়িতে উচ্চবাক্য আগ্রাসি আচরণ করা দৃষ্টিকটু দেখা যাবে ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে আছে।খানিকবাদে রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই তা সহ্য করতে না পেরে আরমান সাহেবকে ড্রইংরুম থেকে ডেকে রুমে নিয়ে গেলো তিহান।দরজা ভিড়িয়ে স্পষ্টভাষায় বললো,
অনন্ত এখানে কেনো এসেছে খালু?আপনি মানা করেননি কেনো?”
আরমান সাহেব টের পেলেন তার সামনে দাড়ানো যুবকটি আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলজ্বল করছে।যদিও ভদ্রতার খাতিরে দৃষ্টি নামিয়ে রেখেছে তবুও বোঝা যাচ্ছে সেই চোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝড়ছে।সেই আগুনের তাপে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।
আরমান সাহেব হাল্কা কাঁশলেন।বললেন,
নিশা তো তোহার বড় বোন।ওকে তো আমি বিয়েতে আসতে মানা করতে পারিনা।তাইনা?”
আমি নিশার কথা বলিনি খালু।অনন্তের কথা বলেছি।আর আপনি অবশ্যই অবগত আছেন আমি কেনো বলছি কথাটা।”তিহানের নামানো কন্ঠেও প্রগাঢ়তার তীব্র ছাঁপ।
আরমান সাহেব এগোলেন।তিহানের কাঁধে একহাত রেখে বললেন,”শান্ত হও বাবা,আমি শুধু নিশা আর সৌহার্দকেই আসতে বলেছিলাম।অনন্ত কেনো এলো আমার জানা নেই।আর এতক্ষণ ছেলেটার আচার-আচরণ দেখে মনে হয়না সে পূর্বের মতো কাজ আবারো করার সাহস করবে।সৌহার্দ্য বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানুষ।অবশ্যই নিজের এমন ভাইকে সে এমনি এমনি নিয়ে আসবেনা।এখন বাসায় আশেপাশের ফ্ল্যাটের মহিলা মানুষ আছে।আমার মনে হয় এ বিষয়ে রাতের বেলা খোলাখুলিভাবে কথা বলা যাবে।”
তিহান মৌনমুখে মাথা নাড়ালো শুধু।এমুহূর্তে কথা বাড়িয়ে শুধু শুধু খালুর সামনে বেয়াদবি করতে চাচ্ছেনা সে।
রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলোনা।সন্ধ্যার একটু পরে অন্য ফ্ল্যাটের মহিলারা চলে গেলে সৌহার্দ্য সময় সুযোগ বুঝে নিজ থেকেই বললো,”বাবা,আপনি হয়তো ভাবছেন আমি ওই ঘটনার পরও কেনো নির্বোধের মতো অনন্তকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।তাইতো?”
বসার ঘরে তখন পরিবারের বড়রা উপস্থিত।তিহানও আছে অবশ্য।অনন্ত নতমুখে বসে আছে।চোখেমুখে হয়তো অনুশোচনার রেখা।আরমান সাহেব বিচলিত হলেন না,ঠান্ডা স্বরে উওর দিলেন,
সেরকম ভাবাটাই তো স্বাভাবিক।”
অনন্ত তোহার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে বাবা।সেই অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য সে অনুশোচিত।”
তিহান তেজস্বী গম্ভীর গলায় ফোঁড়ন কাটলো,
—“তাই নাকি?হঠাৎ আজকে কেনো তার ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে হলো দুলাভাই?সেই ঘটনার তো অনেক অনেকদিন হয়ে গেছে।এতদিন পর আজ তার অনুশোচনা হলো?”
তাকে থামিয়ে দিলেন আরমান সাহেব।স্ত্রীর দিকে চেয়ে বললেন,”তোহাকে ডেকে আনো।সে যেহেতু ক্ষমা চাচ্ছে তাকে তা করার সুযোগ দেয়া হোক।”
তোহা এলো।অনন্ত ক্ষমা চাইলো।সে পায়ে পরতেও রাজি।তবে পায়ে পরতে হলোনা তাকে তার আগেই তোহা মিনমিনে কন্ঠে তাকে ক্ষমা করে দিলো।পরিস্থিতি তখন শিথিল হয়েছে।তোহা বসার ঘর থেকে সরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই তিহান সকলের অগোচরে তার কব্জি ধরে আটকিয়ে চাপা স্বরে বললো,
—“রাতে একটু সাবধানে থাকবে।”আজকের সকাল টা ভিন্ন।বছরের পর বছর অপেক্ষার পর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।তোহার হাতভর্তি লালরঙা মেহেদি উঁকি দিচ্ছে।গতকাল রাতে সে মেহেদী পরেছে।কোনো অনুষ্ঠান করেনি ইচ্ছে করেই।সারা বাড়িতে ব্যস্ততারা ছুটে বেরাচ্ছে হইহই করে।শুধু কাবিনের অনুষ্ঠানেও আশেপাশের ফ্ল্যাটের সবাইকে দাওয়াত করেছে আরমান সাহেব।ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয়রা তো আছেনই।
তোহা অবশ্য কাবিনটা ছোটখাটো করে করার কথা বলেছিলো কারণ আবার পরশুদিনই বিয়ের মূল অনুষ্ঠান হবে কমিউনিটি সেন্টারে।এত খরচা করে কি লাভ?কিন্তু আরমান সাহেব তার প্রস্তাবটা মুখের উপর নাকচ করে দিয়েছেন।
জুম্মার পর কাজি আসবে।বিয়ে পড়ানো হবে তাদের।’কবুল’ ‘কবুল’ ‘কবুল’ এরপর কেবলই পবিত্রতা।
তোহার পরণে তিহানের দেয়া লাল বেনারসি।মুখে অল্পবিস্তর সাঁজ।রেশমকালো চুলগুলো পিঠের উপর লুঁটোপুঁটি খাচ্ছে।নিশা আর আতিয়া স্বর্ণের গহনাগুলো পরিয়ে দিলো তাকে।চুল বাঁধার আগেই বাইরে থেকে ডাক পরলো।বিয়ে বাড়ি।হাঁকডাক হওয়া স্বাভাবিক।আতিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো।খানিকবাদে আবারো সৌহার্দ্যর ডাকে”তুই বস,আমি একটু শুনে আসি”বলে নিশাও বেরিয়ে গেলো।একা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে রইলো তোহা।আনমনে আতিয়ার বিয়ের ওড়নাটা মাথায় দিলো একবার।নাহ,এবার সত্যিই সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।
গেট খোলার শব্দ।তোহা না তাকিয়েই বললো,”আপু,চুলটা বেঁধে দাও তাড়াতাড়ি।আজান তো দিয়ে দিবে একটু পর।বাইরে এতো শোরগোল কেনো?কাজি কি আগেই এসে পরেছে?”বলে মাথার ওড়নাটা নামিয়ে রাখলো সে।উঠে দাড়িয়ে খোলা চুল সামলাতে সামলাতে পেছনে ফিরতেই ‘ধক’ করে একটা ধাক্কা লাগে বুকের মধ্যিখানটায়।আপনাআপনিই দু’পা পিছিয়ে যায় সে।ড্রেসিং টেবিলের সাথে পা ঠেঁকে যেতেই থেমে থেমে ভীত গলায় বলে,
আপনি এখানে কেনো এসেছেন?বের হন।আমি তৈরী হচ্ছি।”
অনন্ত হাসলো।সেই পুরনো বিশ্রি হাসিটা।গা রি রি করে উঠলো তোহার।শরীর কাঁটা দিলো।মনের গহীণ কোঁণে উঁকি দিলো আগাম কিছু দু:সংবাদ।অনন্ত সময় নষ্ট করলোনা।যেকোনো সময় যে কেউ এসে পরতে পারে।এই সুযোগটাই বেশ কষ্টে হাতে এসেছে।সে দ্রত কদমে এগিয়ে গেলো।তোহার নরম হাতের প্রতিরোধ নিমিষেই উঁপড়ে দিয়ে বলিষ্ঠ হাতে চেপে ধরলো তোহাকে নিজের সাথে।আপত্তিকর স্হানগুলো তার বাজে হাতের কলোষিত ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিতে থাকলো অবিলম্বে।তোহা চিৎকার করলো।বাইরে বোধহয় কিছু নিয়ে ঝগড়া বেঁধেছে।বাবার,খালুদের তুমুল উচ্চবাক্য শোনা যাচ্ছে।
পুনরায় চিৎকার করার আগেই অনন্ত তার মুখ চেপে ধরলো।স্পর্শকাতর স্থানে অধরের আগ্রাসী আক্রমণগুলো ক্ষত বানিয়ে ফেলছে।ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে তোহার মন।এই শ্রাবণ কি তবে কেবলই তার হৃদয়ের রক্তপাত ঘটানোর জন্য এসেছে?চোখ বেয়ে অঝর ধারায় গড়াচ্ছে পানি।মুখ দিয়ে গোঙ্গানি।তার নিজের মানুষটা তাকে স্পর্শ করার আগেই সে অন্যর ছোঁয়ায় রক্তাক্ত হয়ে গেলো কেনো?
কেউ বোধহয় আসছে।হ্যাঁ তাইতো,এদিকেই আসছে।খুব দ্রুতপায়ে।পায়ের হিলের শব্দ শোনা যাচ্ছে।খট খট খট।অনন্ত সরে দাড়ালো।সেদিনের চড়ের ঝালটা পুরোপুরি মিটেনি তবে যা পেরেছে এই ঢের।তোহাকে ছেড়ে দিয়ে পৈশাচিক হাসি হাসলো সে।ডানহাতের কুনুইয়ের কাছটা খামছিয়ে ধরে আরেকহাতে খুব দ্রুত গাঢ় লিপস্টিক ঢলে ছড়িয়ে দিলো,মাথায় চুল এলোমেলো করে বাইরের মানুষটা দরজা খোলার আগেই ভেতর থেকে দরজা টেনে সজোরে তোহাকে একধাক্কায় ছুঁড়ে মারলো বাইরে।
বাবুর্চিদের সাথে খাবার দাবারের বিষয় নিয়েই এক কথা দু কথায় বিস্তর কথা কাটাকাটি লেগে গিয়েছে ড্রইংরুমে।আরমান সাহেব উত্তেজিত হয়ে পরেছেন।আতিয়া আর নিশা সেখানে ব্যস্ত থাকায় স্বর্ণালী আসছিলো তোহার চুল বাঁধায় সাহায্য করতে।তবে রুমে প্রবেশ করার আগেই এই আকস্মিক ধাক্কাটা সে সামলে উঠতে পারলোনা।ড্রইংরুমে উপস্থিত প্রত্যেকটা চোখ তখন সেদিকে।ঝগড়া থেমে গেছে।সব শান্ত,শীতল।বিয়ে বাড়িতে বউয়ের এহেন বিধস্ত অবস্থা আর পরক্ষণেই রুমের ভেতর থেকে অনন্তের বের হওয়া দেখে মেহমানদের প্রায় সবাই-ই ঘটনা সম্পর্কে উৎসুক হয়ে উঠলো।তূর্য এগিয়ে এলো সর্বপ্রথম।বাকি কারো না চলছে পা না চলছে মুখ।তূর্য এসে স্বর্ণালির কাছ থেকে তোহাকে টেনে বুকের সাথে চেপে ধরলো দ্রুত।এলো স্নেহের চুলগুলোতে হাত ডুবিয়ে দিতেই ক্ষীণ স্বরে ডাকলো তোহা,”ভাইয়া।”সেই করুন ডাকটায় ভেতরটা যেন জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেলো তূর্যর।বোনের এ অবস্থা দেখে ঘটনা বুঝতে বাকি নেই তার।সে জাপটে ধরলো তোহাকে।যেন বুকের ভিতর লুকিয়ে ফেলবে আদরের বোনটাকে।তোহা চোখ বোজল।নিস্তেজ গলায় প্রশ্ন করলো,”উনি কোথায়?
অনন্ত দাড়িয়ে আছে উদ্ভ্রান্তের মতো।তার চোখে,ঠোঁটের বাঁকা হাসিতে যেন প্রকাশ পাচ্ছে নরপিশাচের তৃপ্তিকর ঢেঁকুর।আরমান সাহেব এগোলেন।রক্তচক্ষু নিয়ে সজোরে চড় মারলেন অনন্তর বামগালে।তার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে।হাত কাঁপছে।মাথা ঘোরাচ্ছে।অনন্ত ছিঁটকে পরে গেলেও মূহুর্তেই তাচ্ছিল্যর স্বরে হেসে বললো,”এখন যত ইচ্ছা মারেন আঙ্কেল।আপনার মেয়ের ক্ষতি তো করেই ফেলেছি।
তিহান বেরিয়েছিলো একটু।একটা জিনিস কিনতে।ধৈর্যশীল প্রেমিক মনটা আজ খুব বেশি তাড়া দিচ্ছে।তোহাকে বিয়ের শাড়িতে-সাজে,বধুবেশে দেখার জন্য তৃষ্ণার্থ মনটা হাহাকার করছে।এত তাড়া তো তার কোনোকালেই ছিলোনা?তবে?আজ এতো তাড়াহুড়ো কেনো?হাতের ছোট্ট জিনিসটা পরণের ধবধবে সাদা পান্জাবির পকেটে ঢোকালো সে।প্রায় সিঁড়ির মাথায় উঠে গেছে।কোনো কলরব নেই।বেরোনোর আগেই তো দেখলো সব সরব।এখন সব এতো নিরব কেনো?কিছু হলো না তো?
তোহাদের ফ্ল্যাটের দরজাটা আস্তে করে খুললো সে।সবার মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে থাকা আর অনন্তর ফ্লোরে বসা দেখেই বুঝলো খুব বাজে কিছু ঘটে গেছে।সে দেরি করে ফেলেছে।খুব দেরি।
কয়েককদম এগিয়ে যেতেই তোহার দেখা মিললো।তূর্যর বুকে গুটিশুটি হয়ে লুকিয়ে আছে।ভয় পাচ্ছে বোধহয়।
তিহান সবট বুঝেও যেনো বুঝলো না।বুঝতে চাইলো না।
তূর্যর চোখ সিক্ত।তিহান নির্বোধের মতো বললো,
কি হয়েছে এখানে?”তিহানের কন্ঠ কানে যাওয়া মাত্রই মুখ তুললো তোহা।রং ছড়ানো ঠোঁট,এলোকেশ,চুলের ফাঁক গলিয়ে ঘাড় গলার দৃশ্যমান ক্ষতগুলো যেন মূহুর্তেই দাবানল সৃষ্টি করে দিলো তিহানের শান্ত স্নিগ্ধ চোখদুটিতে।বজ্রহতের ন্যায় প্রাণপ্রেয়সীর বিক্ষিপ্ত আবেশ দেখে নিতেই ফুঁপিয়ে উঠে আবারো তূর্যর বুকে মুখ লুকালো তোহা।তূর্য আগলে ধরলো তাকে।খুব আদরে,চরম মমতায়।তিহান মুখ ফেরালো।বিধংস্বী,হিংস্র হয়ে উঠলো নিমিষেই।
লাথি লাগালো অনন্তর বুক বরাবর।আর্তনাদ করে উঠলো অনন্ত।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
তোর হবু বউকে তো কলঙ্কিত করেই ফেলেছি।পুরো বাড়িভর্তি সবাই সাক্ষী আছে।খুব তেজ না চড় মারার?আমা..”বাক্যটা শেষ করতে পারলোনা অনন্ত।তার আগেই আরেকটা ভারী লাথি পড়লো তার মুখের উপর।একপর্যায়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পরতেই থাকলো।এলোপাথারি।কেউ আটকাচ্ছেনা।সাহস পাচ্ছেনা।সৌহার্দ্যও চুপচাপ।তার ছোট ভাই যে এত নিকৃষ্ট তার জানা ছিলোনা।থাকলে হয়তো এতদিন অনন্তের মিথ্যা ভদ্র আবেশটা সে ধরে ফেলতে পারতো।সে ব্যর্থ।ভাই হিসেবে ব্যর্থ,এবাড়ির জামাই হিসেবে ব্যর্থ।
তিহানের চোখেমুখে যেনো আগুনের রক্তিম লাভা গলে গলে পরছে।তোহার ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দগুলো যেন সেই আগুনে ঘি ঢেলে তাকে আরও দাহ্য করে তুলছে।অনন্তর অবস্থা যায় যায়।রক্তের ফোটায় সাদা ফ্লোর রন্জিত।তূর্য বোনকে ছাড়তে পারছেনা নয়তো তার হাত থেকেও অনন্ত রক্ষা পেতো না আজ।আরমান সাহেব চোখ বোজে সোফায় বসেছিলো।অনন্তের আহাজারি গোঙ্গানিতে চোখ মেললো সে।তখন যদি ড্রইংরুমের তুমুল ঝগড়াটা না লাগতো তবে অবশ্যই তোহার চিৎকার কারো না কারো কানে তো আসতো।কিন্তু তা আসেনি।কোনোভাবে তো সে-ই দায়ী।
একবার মেয়ের দিকে তাকালো।তূর্য আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রেখেছে ভয়ার্ত বোনকে।ড্রইংরুমের এককোঁণে বোনের প্রতি ভাইয়ের নিরব ভালবাসার বহি:প্রকাশ হচ্ছে।তপ্ত দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়লো সে।তিহানের দিকে চেয়ে নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,,”থামো তিহান,মারা যাবে।আমি দেখছি কি করতে হবে।”
সাথেসাথেই থামলোনা তিহান।আরো কয়েকটা লাথি লাগিয়েও ক্ষান্ত হলোনা তার ক্ষ্যাপা মন।জোরে কয়েকটা হাঁফ ছেড়ে একটু দুরে সরলো সে।বললো,
আপনাকে আমি কালই সাবধান করেছিলাম খালু।আপনি শোনেননি।আজকে..”জড়িয়ে আসে তিহানের কন্ঠ।আরমান সাহেব চোখে অসহায়ত্ব নিয়ে তাকায়।তিহান শ্বাস ছাড়ে।ঢোঁক গিলে তোহার কাছে এগোয়।তূর্য কাছ থেকে ছাড়িয়ে সবার সামনেই নিজের বুকে জড়িয়ে নেয়।সবাই চুপ।কারো স্বাধ্যি নেই কিছু বলার।মানুষটার চিরচেনা বুকের গন্ধটা নাকের কাছে পেতেই ডুঁকরে উঠে তোহা।কাঁটা জায়গাগুলোতে জ্বলছে।অনেক জ্বলছে।তার চেয়ে বেশি জ্বলছে ভেতরটা।এই ছিলো তবে এত অপেক্ষার পরিসমাপ্তি?
উপস্থিত একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা ফোঁড়ন কাটলো,
বিয়ের আগে বরের সাথে এতো জড়াজড়ি কিসের?মেয়ের তো মনে হয় চরিত্রে সমস্যা।শুধু ছেলের দোষ কেন হইবো?”
চুপ।”বলে গর্জন করে উঠে তিহান।তার এক চিৎকারে মহিলা চুপসে যায়।বড়দের সাথে এভাবে সে কখনোই কথা বলেনা।তবে আজ..আজ কেনো যেনো পারছেনা।এলোমেলো,অগোছালো হয়ে যাচ্ছে সবকিছু।কানাঘুষা চলছে তখনো।আতিয়া মূর্ছা গেছে।স্বর্ণালী-নিশা সামলাচ্ছে তাকে।পরিবেশ খুব ভারি।তোহার শরীর নিস্তেজ,নির্জীব,অসাঢ় হয়ে আসছে।এত চাপ তার ছোট্ট মস্তিষ্ক নিতে পারছেনা।তিহান দাড়ালোনা।তোহাকে পাঁজাকোলা করে কোলে নিয়ে আরমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে ধীরকন্ঠে বললো,”নিয়ে যাচ্ছি ওকে।
এখানে ও নিরাপদ না।শুধু কাজি আসলে আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবেন।ওখানেই বিয়ে পড়ানো হবে।আর হ্যাঁ,পরিবারের মানুষ ছাড়া একজনকেও যাতে না দেখি।”শেষের কথাটা উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে বলে স্হান ত্যাগ করলো তিহান।আরমান সাহেব তার ঠান্ডা কন্ঠ শুনেই বেশ বুঝতে পারছেন তিহানের বলা কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন না হলে আজ ঘোর অনর্থ ঘটে যাবে।আফিয়া আর তূর্য ছুটলো তিহানের পিছু পিছু।তোহাকে নিজের রুমে এনে শুইয়ে দিলো তিহান।মেয়েটা বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছে।নাহ্,জ্ঞান হারায়নি।ওইতো চোখ খুলছে একটু আধটু।দূর্বল হয়ে পরেছে হয়তো।আফিয়া পানি এনে দিলো।তিহান ফাস্ট এইড বক্স এনে রাখলো টেবিলে।নিজেকে যথাসম্ভব সামলে তোহাকে ঠেস দিয়ে বসালো বুকের সাথে।আফিয়া পানি খাইয়ে দিয়ে বাইরে গেলো।তূর্য নিজের রুমাল বের করে মুখের লিপস্টিক,ছড়িয়ে যাওয়া সাঁজগোজ মুছে দিচ্ছে।
মোছানো হয়ে যেতেই রুমালটা পুনরায় পকেটে ঢোকালো সে।বোনের মুখের দিকে চেয়ে থাকলো অনেকক্ষণ।।তিহান ফাস্ট এইড বক্স খুললো।গলার কামড়ে ক্ষত করা জায়গাটায় স্যাভলনের ছোঁয়া দিতেই শিঁউরে উঠলো তোহা।চোখ বন্ধ অবস্থাতেই হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে শাড়ি খামছে ধরে করুন স্বরে বললো,”লাগছে।”
বুকের কোথায় যেনো একটা কাঁটা বিধলো।বড় একটা কাঁটা।খুব ধারালো।একদম রক্তাভ করে দিলো সব।তখনই দরজার সামনে আসলো সাইফ।তূর্যকে উদ্দেশ্য করে নিচু গলায় বললো,”খালু তোমাকে ডাকছে একটু।”বলেই জায়গাটা থেকে সরে গেলো সে।তূর্য আরেকবার বোনের দিকে তাকালো।অত:পর তাকালো তার পিছে বসা শক্তপোক্ত মানুষটার দিকে।প্রবল শ্রদ্ধাভক্তি নিয়ে।
তিহান তোহার গলার কাছটায় সযত্নে ব্যান্ড-এইড লাগাতে লাগাতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,যা তুই,আমি একাই পারবো।আর এখানে কাউকে আসতে মানা করবি।হট্টগোল চাচ্ছিনা,তিহুর রেস্ট প্রয়োজন।”
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com