গল্পঃ এ শহরে বৃষ্টি নামুক । পর্ব -০৭
রাত্রির চিৎকারে বুকটা ‘ধক’ করে উঠলো নিভ্রানের।শান্ত নিউরণগুলো অশান্ত হয়ে উঠলো।ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটা গম্ভীর গলায় জরুরি কথা বলে যাচ্ছে।কর্ণপাত করলোনা নিভ্রান।চট করে ফোনটা কেটে দিয়ে হন হন করে এগিয়ে গেলো রাত্রির দিকে।কপালের রগগুলো স্পষ্ট নীল।
শক্ত করে ওড়না টেনে ধরেছে রাত্রি।মতিন মিয়া সজোরে টান দিতেই তা হাত থেকে কিছুটা ছুটে গেলেও গা থেকে সরে গেলোনা।যন্ত্রনায় চোখ বুজে ফেললো রাত্রি।জর্জেট কাপড়ে ঘষা লেগে হাতটা বোধহয় ছিঁলেই গেছে।তবুও দমে গেলোনা সে।গায়ের জোরে না পেরে জিহ্বা কে কাজে লাগালো।বললো,
—“লজ্জা করেনা?তোর সন্তানের বয়সি একটা মেয়ের ওড়না ধরোস।ছিহ্।নিজের মেয়েটাকে অন্তত রেহাই দিস।কাপুরুষ কোথাকার।”
মতিন মিয়া দাঁত কিড়মিড় করে।বিশ্রি নজরে রাত্রির শরীরে চোখ বুলিয়ে বলে,
—“টাকা দিতে পারোনা আবার বড় বড় নীতি ক..”কথার মাঝেই শার্টের কলার টেনে ধরলো নিভ্রান।সজোরে ঝাঁকিয়ে গর্জন করে বললো,”ছাড়।”নিমিষেই ভয়ে কেঁপে উঠলো মতিন মিয়া।হাতের ওড়নাটা আপনাআপনিই ছুটে গেলো।রাত্রি যেনো জান ফিরে পেলো।নিভ্রান চোখে আস্ত অগ্নিবলয় নিয়ে চেয়ে আছে।সেকেন্ড না গড়াতেই ঘুষি পড়লো মতিন মিয়ার নাক বরাবর।রক্ত এসে গেছে।এদিক ওদিক তাকালো রাত্রি।ভাগ্য সহায় যে রাস্তা ফাঁকা।নতুবা এতক্ষণে গোলযোগ বেঁধে যেতো।মতিন মিয়া কোনরকমে উচ্চারণ করলো,
—“আমি টাকা পা..”
নিভ্রান তৎক্ষণাৎ ছাড়লো তার কলার।পকেটে হাত ঢুকিয়ে মানিব্যাগ বের করতে করতে বললো,
—“টাকা পাস তাইনা?কত টাকা বল?”
—“তিন হাজার পাঁচশো।”মতিন মিয়ার চটপট উওর।
রাত্রি তড়িঘড়ি করলো।অগোছালো কন্ঠে বললো,
—“দেখুন,আপনি..টাকা…আপনার দিতে হবেনা।”
নিভ্রান সজোরে ধমক দিলো,
—“চুপ করে থাকুন রাত।কোনো কথা বলবেন না।”
নিভ্রানের রাম ধমকে মূহুর্তেই চুপসে গেলো রাত্রি।আমতা আমতা করেও কিছু বলতে পারলোনা।নিভ্রান হাজার টাকার চারটে নোট বের করলো।মতিন মিয়ার মুখের উপর ছুঁড়ে মারতেই সেগুলো মেঝেতে পরে গেলো।মতিন মিয়া ব্যস্ত হাতে তুললো।যেন সাত রাজার ধন মাটিতে ছড়িয়ে গেছে।ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকালো রাত্রি।মানুষ টাকার জন্য এমন করে কেন?
নিভ্রান পকেটে মানিব্যাগটা ঢোকালো।রাত্রির হাত টেনে মুঠোয় নিলো।মতিনের দিকে চেয়ে বললো,
—“আমাদের ব্যাপারে কোন রকমের কুৎসা রটানোর আগে নিজের জিহ্বার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিবি।কেটে ফেলবো কিন্তু।”
—“কি যে বলেন স্যার,আমি তো শুধু টাকাটার জন্যই…।”নাকের রক্তটা মুছে টাকাগুলো ক্যাশবাক্সে রাখতে রাখতে বললো মতিন মিয়া।নিভ্রান আর একমূহুর্তের জন্যও দাড়ালোনা সেখানে।রাত্রিকে নিয়ে গটগট করে হেঁটে চললো উল্টোপথে।চোখভর্তি পানি নিয়ে মাথা নিচু করে থাকা অন্যমনস্ক রাত্রি খেয়াল করেনি তারা উল্টোপথে হাঁটছে।
ব্রিজটা সুনসান।রাস্তার ধারে দাড়ানো নিশ্চুপ নিয়ন বাতিগুলো মনে বচ্ছে মাথা ঝুঁকিয়ে পথ দেখিয়ে চলেছে মানব-মানবী দুটোকে।রাত্রি কথা বলেনি।মাথা নিচু করে চুপচাপ হাঁটছে।কয়েক ফোঁটা জল ইতিমধ্যেই গড়িয়ে পড়েছে গাল বেয়ে।নিভ্রানের শক্ত গম্ভীর দৃষ্টি সামনের দিকে।ঘড়িতে বাজে দশটা বিশ।রাত্রির বাসার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে এতক্ষণে।সেদিকে যেয়ে লাভ নেই।
—“আপনার টাকাটা আমি আমি দ্রুতই ফেরত দিয়ে দিবো।”ভেজা গলায় যথাসম্ভব স্বাভাবিকভাবে বলার চেষ্টা করলো রাত্রি।কিন্ত পারলোনা।নিভ্রান ধরে ফেললো সহজেই।হাতের বাঁধনে বল প্রয়োগ করে রাত্রিকে কাছে টেনে নিলো।সচকিত কন্ঠে বলে উঠলো,
—“আপনি কাঁদছেন?”
রাত্রির সহ্যক্ষমতা যেন নিমিষেই ভেস্তে গেলো।উচিত-অনুচিতের হিসেবটা ভুলে গেলো তার ব্যাথাময় মস্তিষ্ক।উতলে উঠলো ভেতরের চাপা কষ্টটা।হুঁশ হারিয়ে ডুকড়ে কেঁদে উঠে নিভ্রানের দুহাতে জাপটে ধরে বুকে মাথা গুঁজে দিল সে।থমকে গেলো নিভ্রান।রাত্রি গলা কাঁপিয়ে কাঁদছে।সেই ধ্বনির হৃদয়বিদারক সুর যেন মনের পর্দায় চরমভাবে আঘাত হানছে।নিভ্রান নিজেকে সামলালো।দ্বিধাদন্ত ভুলে ঠি ক প্রথমদিনের মতোই প্রচন্ড স্নেহ নিয়ে রাত্রির চুলের ভাঁজে হাত বুলাল।নরম গলায় ডাকলো,
—“রাত।”
রাত্রির উওর এলোনা।বরং কান্নার গতি বেড়ে গেলো আরো।ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।পৃথিবীটা অসহ্য লাগছে।নিভ্রান শুকনো ঢোঁক গিললো।রাত্রির মাথাটা বুকের সাথে আরো একটু চেপে নিয়ে পুনরায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
—“কাঁদেনা।”
রাত্রি কাঁদতে কাঁদতেই আহাজারি করে উঠলো,
—“মানুষ এমন কেনো?এত খারাপ কেনো?”
—“আচ্ছা,এসব বাদ দিন।কান্না থামান।কিছু হয়নি।”
রাত্রির কান্না দুই সেকেন্ডের মতো থেমে গেলেও পরের সেকেন্ডেই তা দ্বিগুন বেঁধে আছরে পড়লো নিভ্রানের বুকে।দিশেহারা হয়ে উঠলো নিভ্রান।বললো,
—“আপনাকে কান্না মানায় না রাত।আপনি না কতো সাহসী।”
রাত্রি নাক টানলো।ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো,”আমি আর পারছি না।সত্যি বলছি,একদম পারছিনা।”
—“আপনাকে পারতে হবে।দেখি।”বলে রাত্রিকে টেনে সরালো নিভ্রান।গালের পানি মুছিয়ে দিয়ে আচমকাই কোমড় ধরে বসিয়ে দিলো ব্রিজের রেলিংয়ে।রাত্রির মুখ এখন তার মুখ বরাবর।ভয়ে চমকে উঠলো রাত্রি।কান্নামিশ্রিত জড়ানো গলায় বললো,”পড়ে যাবো।নামিয়ে দিন।”
—“পরবেননা।”বলে একহাত আলতো করে কোমড়ে রেখে সযত্নে আগলে ধরলো নিভ্রান।চারচোখ এক করে নিতেই আবারো চোখভর্তি পানি নিয়ে মাথা নোয়ালো রাত্রি।নিভ্রান ঠোঁট কামড়ে ধরলো।মেয়েটার নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে।চোখ ফুলে গেছে।ঠোঁট দেখে মনে হচ্ছে রক্ত জমাটবাধা।
পানি গড়িয়ে পড়ার মাঝেই নরম স্পর্শে গালে হাত রাখলো নিভ্রান।বৃদ্ধাঙ্গুলের ছোঁয়ায় মাত্র বেরিয়ে পড়া ফোঁটার অস্তিত্ববিনাশ করে নম্র কন্ঠে বললো,
—“আবার কাঁদছেন কেনো?বললামনা আপনাকে কান্না মানায় না।আপনি তো এতো দুর্বল নন।”
জোরে একটা শ্বাস ছাড়লো রাত্রি।মাথাটা নুইয়েই রাখলো।নাক টেনে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বললো,
—“আপনার দেরি করিয়ে দিলাম।ক’টা বাজে?”
একনজর ঘড়ি দেখলো নিভ্রান।হতাশ গলায় বললো,
—“দেরি আপনার হয়েছে রাত।সাড়ে দশটার উপরে কাঁটা ঘুরছে।”
—“ও আল্লাহ।বলেই তড়িৎগতিতে নামতে গেলো রাত্রি।কিন্তু কোমড়ে রাখা হাতের মৃদু চাপ থামিয়ে দিলো তাকে।তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিভ্রান বললো,
—“রাখুনতো আপনার তাড়াহুড়ো।পানি আছে ব্যাগে?”
রাত্রি থামলো।বোকা কন্ঠে বললো,
—“আছে।আপনি খাবেন?”
—“বের করুন।”
পানির বোতলটা হাতে নিয়ে ছিপি খুলে রেলিংয়ে রাখলো নিভ্রান।রাত্রি কোমড় থেকে হাত সরাতেই থতমত খেয়ে দ্রুত নিভ্রানের কাঁধে হাত রাখলো রাত্রি।খামছে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
—“পরে যাবোতো।”
—“শক্ত করে ধরে রাখুন।”বলে একহাতের তালুতে পানি ঢেলে বোতলটাও রেলিংয়ের উপর রাখলো নিভ্রান।
অতিরিক্ত পানিগুলো রাস্তায় ফেলে ভেজা হাত রাত্রির চোখের পাতায় ছোঁয়ালো।পরিষ্কার করে মুছে দিতে দিতে বললো,”কেঁদেকেটে কি করলেন রাত।”
রাত্রি লজ্জা পেলো।সে কখনো কারো সামনে কাঁদেনা।কখনো কাঁদেনা।শেষবার বাবা মারা যাওয়ার পর হাউমাউ করে কেঁদেছিলো।তারপর থেকে মায়ের কাছে গেলেও কান্না চেপে রাখে।পাছে মা কষ্ট পাবে।সেজন্য সে কাওকে দেখায় না নিজের কষ্ট গুলো।আজ কেন এমন হলো বুঝতে পারছেনা।কেন সে নিজের নিয়ন্ত্রন হারালো?নিভ্রানের সামনে বাচ্চাদের মতো কান্না জুড়ে দিলো?
সারামুখ ভালোকরে মুছিয়ে দিয়ে বোতলের ছিপি আটকে দিলো নিভ্রান।রাত্রি অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছে।নিজের ঝুলন্ত পায়ের দিকে চেয়ে রয়েছে একদৃষ্টে।চোখেমুখে বিষন্নভাব।খানিকবাদেই সে স্বগতোক্তি করলো,
—“পৃথিবীতে সবকিছুর উর্ধ্বে টাকা।”
নিভ্রান হাসলো।দু’পাশে হাত রেখে ঝুঁকে গিয়ে হাল্কা ফিসফিস করে বললো,
—“আর আপনি আমার কাছে পুরো পৃথিবীর উর্ধ্বে।”
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com