বৃষ্টি ভেজা রাত । পর্ব- ১৬
ফোনে তীব্র গতিতে বেড়ে চলছে মেয়েটার কান্নার গতি। স্তব্ধ হয়ে আছে রাত। সেই চেনা কন্ঠস্বর অচেনা পরিচয়ে রাতের কানে বেজে উঠতেই চোখের কোনে পানি জমে গেলো তার। কিছু বলছেনা সে, শুধু বর্ষার কান্নার শব্দ গুলো কানে আসছে তার।
বর্ষা চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।
– কেমন আছো রাত।
রাত গম্ভির গলায় উত্তর দেয়,
– বেচে আছি।
– এভাবে কেনো বলছো তুমি?
– হ্যা আছি ভালোই আছি। তোমার কি খবর? আশা করি হাসবেন্ট নিয়ে সুখেই আছো। দোয়া করি চলতি পথে বেঈমান গুলোও সুখে থাকুক।
আবারও কন্নায় ভেঙে পড়ে বর্ষা। মাঝে মাঝে হিচকি তুলে কাদছে সে।
রাত আবারও ঠান্ডা মাথায় বলে উঠে,
– অজথা কান্নার অভিনয় করে লাভ নেই। ইনজয় করো, আমার থেকেও বেটার কাওকে পেয়েছো ইনজয় করো সময়টা।
বৃষ্টি এবার কাদতে কাদতে বলে উঠে,
– সেদিন বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর, তিহানদের বাসায় উঠেছিলাম। কেও ছিলোনা তাদের বাসায়। শুধু আমি আর তিহান। একা একটা একটা ছেলে ও একটা মেয়ে তাও আবার এই রাতে, নিজেকে আমি সেইভ ভাবিনি তখন। কিন্তু তিহানের চরিত্রে আমি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য দেখিনি। সেদিন মনে হয়েছিলো এই তিহানকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। তার পরদিব তিহানের সাথে চলে গেলাম ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে। ভালোই কাটছিলো দিন। খুব শিগ্রই বিয়ের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম। তিহানের ওখানকার এক বান্ধবির জম্মদিন পার্টতে গিয়েছিলাম। পার্টি শেষে সবাই চলে যাচ্ছে।আমি তখন তিহানকে বাইরে দাড় করিয়ে একটু ওয়াশ রুমে যাই। বের হয়ে দেখি তিহান সেখানে নেই। একটু হেটে উপরে যেতেই দেখি একটা রুম থেকে অদ্ভুদ শব্দ কানে আসছে। অতি ব্যাস্ততায় হয়তো দরজাটা লাগাতে ভুলে গিয়েছিলো। দরজা খুলে ভেতরে যেতেই দেখি তিহান ও তার বান্ধবি টা। এতটুকু বলেই হু হু করে কেদে দিলো বর্ষা। তার পর ওখানে এক বাংলাদেশির সাথে পরিচয় হয় আমার। তার হেল্পে আমি তিহানের থেকে মুক্তি পাই। কারন তিহান আমায় ভালোবাসেনি। চিট করেছে আমার সাথে।
রাত গম্ভির গলায় বলে উঠে,
– এসব কথা আমায় বলছো কেনো? আমি কি শুনতে চেয়েছি তোমার কাছে?
বর্ষা এখনো কাদছে,
রাত বলে উঠে,
– ওকে রাখলাম আমি, তোমার সাথে কথা বলে সময়টুকু নষ্ট করতে চাইনা আমি।
– রাত আমি আবার তোমার জীবনে………..
বাকিটা বলার আগেই ফোন কেটে দেয় রাত। হয়তো কথাটা শুনতে পায়নি সে।
রাত ফোনটা রেখে বিছানায় গিয়ে বসে দু,পা প্লোড়ে ছড়ানো। একটা অস্থিকর ভাব নিয়ে দু, হাত দিয়ে কপালে পড়ে থাকা চুল গুলো পেছনের দিকে নিয়ে আবার ছেরে দিলো সে। ছোট চুল গুলো পুনরায় আবার সামনে চলে আসে। রাতের চোখে পানি। যেই বর্ষাকে সে সব সময় চাইতো কষ্ট থেকে আগলে রাখতে আর সেই বর্ষাই আজ এতোটা কষ্টে আছে। যাই হোক সবই তার নিজের ভুলের প্রশ্চিত্ব।
বৃষ্টি রুমে আসতেই ঝটপট চোখের পানি মুছে ওয়াশ রুমে চলে যায় রাত। চোখে পানি ছিটিয়ে আবার বেড়িয়ে আসে সে। বৃষ্ট তখন ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে বিছানায়? রাতের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলেউঠে,
– আপনি কাদছিলেন?
– ক কই না তো।
– আপনার মনটাকে মাঝে মাঝে এমন বিষন্ন দেখতে একধম ভালো লাগেনা। একটু হাসি খুশু থাকেন না প্লিজ।
কথাটা রাতের খুব কাছাকাছি গিয়ে বলে উঠে বৃষ্টি।
রাত এবার তারাহুরা করে নিচে চলে যেতেই বৃষ্টি পেছন থেকে হাতটা ধরে বলে উঠে,
– আপুর সাথে কথা হয়েছে তাই না? কল লপস্টে দেখলাম একটু আগে আপুর নাম্বারটা থেকে কল এসেছে আর তা রিসিভও হয়েছে। কি বলেছে আপু?
– না এমনি কেমন আছে এসব আর কি।
– একটা প্রশ্ন করবো?
রাত এবার ঘুরেবৃষ্টির দু গালেহাত রেখে মিষ্টি করে হেসে বলে উঠে,
– কি?
– আপু জদি কখনো ফিরে আশে তাহলে কি আমায় দুড়ে ঠেলে দিবেন?
একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে আরশি ও তার বাবার পছন্দের ছেলেটা। গতকাল দেশে এসেছে সে। আরশির সাথে আজ দেখা করতে এসেছে এই রেস্টুরেন্টে। রিদও আরশিকে ফলো করতে করতে এসেছে এখানে। রেষ্টুরেন্টের অপর মাথায় মাস্ক পড়ে মাথায় একটা কেপ দিয়ে বসে আছে রিদ।
আরি ও লোকটা খুব হেসে হেসেই কথা বলছে। তা কেনো জানি সহ্য হচ্ছেনা রিদের। ইচ্ছে করছে এখনি উঠে আরশিকে ভুবন কাপানো দু,টা চর দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ছেলেটাকে বলতে,
– আরশি ইজ মাই লাইফ।
কিন্তু তা করলোনা সে। উঠে চলে গেলো সেখান থেকে।
রাতের বেলায় ছাদে দাড়িয়ে আছে রিদ। আরশি রিদের পাশে এসে দাড়ায়।
– ভাইয়া ডেকেছিলে?
– হুম, আজ ছেলেটাকে কেমন লাগলো?
– ভালোই তো ছিলো। খারাপ না।
– আমার থেকেও ভালো? দেখতে শুনতে ভালো হলে প্যামিলি ব্যাগ রাউন্ড, ছেলের ভালো পজিশন থাকলেই কি সে ফার্পেক্ট হয়ে যায়?
– মানে?
– তার মাঝে এমন কি আছে যা আমার মাঝে নেই? কিন্তু আমার মাঝে যা আছে তা ওই ছেলেটার মাঝে নেই। আর তা হলো কাওকে এক তরফা ভালোবাসা। হয়তো তার মাঝেও সেটা আছে। কিন্তু আমর থেকে কেও তোকে কখনোই বেশি ভালোবাসতে পারবেনা। একটা ছেলে কাওকে কতোটা ভালোবাসলে ফ্যামিলি ছেরে হাজার মাইল দুরে বছরের পর বছর একা পরে থাকে? কখনো ভেবে দেখেছিস একটা ছেলে একটা মেয়েকে কতোটা ভালো বাসলে তার জীবনের বাজি ধরতেও দিধা বোধ করেনা। যেমনটা আমি করেছিলাম তুই যখন ক্লাস নাইনে ছিলি। চাইলে সেদিন তোকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে আমি সরে যেতে পারতাম। কিন্তু সেদিন আমি নিজের মরনকে যতটা ভয় করিনি তার চেয়ে বেশি ভয় ছিলো তোকে হারিয়ে ফেলার। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে সেদিন তোকে বাচিয়ে দির্ঘ এক মাস মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছি ওই হসপিটালে। আমি সত্যিই ব্যর্থ। ভুল কাওকে এতোটা বেশি ভালোবেসেছি বলে। আমি আজ তোর কাছ থেকে জাস্ট একটা কথাই শুনতে চাই। তুই কি আমায় ভালোবাসিস নাকি আমি আমার ধারনাটাই ভুল ছিলো?
– রিদ ভাই আমি কখনোই তোমার এসব কথায় সিরিয়াস ছিলাম না। আমি ভাবতায় হয়তো তুমি আমায় নিয়ে মজা করতে। আর তোমাকে আমি যাষ্ট ভাইয়ের মতোই দেখতাম। কখনো ওসব কোনো অনুভুতি তোমার জন্য সৃষ্টি হয়নি আমার। তুমি আমার সাথে মজা করতে আমিও তোমার সাথে মজা করতাম, যাস্ট এতটুকুই। আর তুমি আমাকে সব সময় সারপ্রাইজ দিয়ে চমকে দিতে তাই আমিও তোমায় মাঝে মাঝে সারপ্রাইজ দিতাম। কিন্তু কেনো তুমি এটাকে এতো এগিয়ে নিতে চাইছো? কেনো আমার তোমাকে ভালোই বাসতে হবে? কেনো তোমাকে আমার বয়ফ্রেন্ডই হতে হবে? হোয়াই? আর তুমি আমার জন্য অনেক করেছো এটা আমি শিকার করছি তাই বলে এভাবে বেহায়ার মতো ওসবের বিনিময় ভালোবাসা চাইছো।
– ভালোবাসাকে কোনো কিছু দিয়ে বিনিময় করা যায় না আরশি।আর আমি বেহায়া, তোকে হারানোর ভয়ে আমি বেহায়া হয়ে গেছি আজ। প্লিজ আরশি এমন করিস না আমার সাথে। প্রতিদিনের মতো বলনা যে এটাও কোনো মজা ছিলো।
– দেখো রিদ ভাই, অন্য কোনো ছেলে হলে এখন থাপ্পর দিয়ে সব দাত ফেলে দিতাম। তুমি দেখে এখনো সম্মান দিয়েই কথা বলছি আমি। নেক্সট টাইম এসব নিয়ে বাড়ির কারো সাথে কোনো কথাই বলবে না তুমি। তাহলে কিন্তু আমিও ভুলে যাবো যে তুমি আমার কাজিন হও এবং আমার থেকে বড়।
পরদিন সকালে বাড়ি চলে যায় রিদ। এই বাড়িতে আর এক মুহুর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না তার। যতক্ষন এ বাড়িতে থাকছে ততোক্ষনই বুকের ভেতরটা শুধু খাঁ খাঁ করে উঠছে।
এভাবেই কেটে গেলো আরো দুদিন। মনে তীব্র কষ্ট রাত ভর চাপা কান্নায় দুইটা দিন পার হয়ে গেছে রিদের।
রাতে বৃষ্টির বাবাকে ফোন দেয় রিদ। জানায় পরদিন বিকেলে তার ফ্লাইট। বাবা মায়ের কাছে চলে যাচ্ছে অস্ট্রিলিয়া।
– কি অদ্ভুদ কথাবার্তা। আগামি মাসে আরশির বিয়ে আর তুই কাল চলে যাচ্ছিস এটা কোনো কথা?
– বাবা মাকে ছেরে অনেক বছরই তো এখানে পড়ে আছি। এবার আর থাকতে ইচ্ছে করছেনা তাদের ছারা। আমার বিদায় বেলায় আশা করি তোমরা সকলেই থাকবে।
এই নিয়ে রাতের সাথেও কথা হয় রিদের। পরদিন রিদের সাথে চলে গেলো সবাই এয়ার্পোর্টে। রাত, রুদ্র চৌধুরি, রাত্রি চৌধুরি, আরশি, বৃষ্টি সবাই আসছে।
এয়ার্পোর্টে দাড়িয়ে আছে সবাই। রিদ যেনো আজ কিছুতেই ভিতরে জেতে চাইছেনা আজ।
আর একটু আর একটু বলতে বলতে অনেক্ষন কাটিয়ে দিলো তাদের সাথে।
এতোটা বছর যেখানে ছিলো, যাদের কাছে বার বার ছুটে আসতো,
যাকে এক তরফা ভালো বেসে গিয়েছিলো তাদের সবাই এখানে উপস্থিত।
এক মাত্র আপন বলতে এরা ছারা আর কেও ছিলোনা এখানে।
আজ সেই আপন লোকদের ফেলেই চলে যাচ্ছে অনেক দুরে।
একটু পর ইমিগ্রেশন ক্রস করে ভেতরে চলে যাবে সে। চোখের জল টপ টপ করে গড়িয়ে পরছে রিদের গাল বেয়ে। রুদ্র চৌধুরিকে জড়িয়ে ধরে সে,
– অনেক দিন তো আপনাদের সাথে ছিলাম আঙ্কেল। আপনারাই ছিলেন আমার আপন বলতে সব।
এখানে বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়েছি আপনাদের সাথে।
জদি কখনো আমার ব্যাবহারে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকেন তাহলে প্লিজ।
নিজের ছেলে ভেবে মাপ করে দিবেন।
রুদ্র চৌধুরিও কিছু বলছেনা শুধু রিদকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছে নিচ্ছে।
রাত্রি চৌধুরিও গিয়ে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো রিদকে।
রুদ্র চৌধুরি ও রাত্রি চৌধুরির মাঝখানে রিদ। চোখের পানি গড়িয়ে পরছে অঝরে।
রাতকে জড়িয়েই হুহু করে কেদে দিলো রিদ।
কারন রাত শুধু রাত ভাই ছিলোনা এক জন ভালো বন্ধুও।
প্রায় পাচ মিনিট ধরে রাতকে জড়িয়ে ধরে কাদছে রিদ।
ছারার আগে ফিস ফিস করে শুধু একটাই কথা বলেছে।
“বর্ষাকে হারানোটা তোর আফসোস নয়।
বৃষ্টির মতো মেয়েকে হারিয়ে ফেললে এটাই হবে তোর জীবনের সব চেয়ে বড় আফসোস।
ওর মতো একটা মেয়ের সাথেই তুই সুখি হবি জীবনে।
দুজন দুজনের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখিস চির কাল।
স্বামী স্ত্রির বন্ধন একটা পবিত্র বন্ধন। এর মাঝে কখনো অন্য কোনো অপবিত্রটতাকে স্থান দিসনা।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চোখের জন মুছে ইমিগ্রশন ক্রশ করে ভিতরে চলে গেলো রিদ।
তবুও বার বার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে সবাইকে আবার দেখার জন্য।
সবাইকে ছেরে যাওয়ার কষ্ট যেনো বুকের মাঝে খাঁ খাঁ করছে আজ।
আরশির দিকে তাকাতেই চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে তার।
তবুও নিজেকে সমলে আরশির দিকে তাকিয়ে কান্না ভেজা মুখে একটা হাসির রেখা টানে রিদ।
যেনো ইশারায় বলে উঠে,
“” ভালো থাকিস।
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com