কালো বউ । পর্ব-৩৪
কী বলতে চাইছেন উনি ? ভোরে স্বপ্নে দেখা কথাগুলো ?
উনার দিকে তাকিয়ে বললাম, কী কথা বলুন ?
মেনে নেওয়াটা সহজ নয় সেটা তুমিও জানো ?
গতকাল যা হয়েছে সেসব ভুলে যাওয়াটা এতো তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়।
তবে বাবার সামনে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করো।
কয়েকদিন আগে বাবা বলছিলেন আমার বিয়ের কথা কিন্তু এভাবে হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাবে ভাবিনি।
আমি তাকে বুঝিয়ে বলেছি।
আমি চাই না এসব নিয়ে চিন্তা করুক তাই বুঝতে পারছো আমি কী বলতে চাইছি ?
যাক আঙ্কেলের জন্য আপাতত চলে যেতে বলতে পারবে না।
উনার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নিচের দিকে তাকালাম আর বললাম,
আমার দ্বারা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করবো।
রুপক ছোট করে শুধু বললো, ধন্যবাদ।
উনি ওয়াশরুমে চলে গেলো আর আমি সোফায় বসে রইলাম।
আচ্ছা উনাকে জিজ্ঞেস করা হলো না আমার চাকরি কী আছে, না চলে গেছে ?
বাউমা সারাদিন কী আজ রুমে বসেই থাকবে ? আমার জন্য কড়া এক কাপ চা দাও দেখি।
সারাজীবন তো সার্ভেন্টদের হাতের চা খেয়েই কাটালাম।
জীবনের শেষের সময়টায় আল্লাহ যখন ছেলের বউয়ের
হাতে চা খাওয়ার সুযোগ দিয়েছে তা হাত ছাড়া করতে চাই না।
ড্রয়িংরুমের সোফায় আজকের পত্রিকা হাতে বসে রবিন রুপকের রুমের দিকে
তাকিয়ে জোরে জোরে বললো।
সব সার্ভেন্টরা রবিনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে পাগল হয়ে গেলো নাকি।
রুপক বিয়ে করলো কবে যে বউমা আসবে ?
সার্ভেন্ট রবিনের সামনে গিয়ে বললো, স্যার আমি দিচ্ছি চা, আপনি একটু অপেক্ষা করুন।
রবিন সার্ভেন্টের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি বলেছি তোমাকে চা দিতে ?
না স্যার।
তাহলে আগ বাড়িয়ে দিতে এসেছো কেনো ? যার কাছে চেয়েছি সেই দিবে।
কিন্তু…
তমসা সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো,
আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি এখনই বানিয়ে দিচ্ছি।
তমসাকে সিড়ি দিয়ে নামতে দেখে সব সার্ভেন্ট নিজেদের কাজ রেখে ভূত
দেখার মতো করে তাকালো। তমসাকে সবাই চেনে রুপকের এসিস্ট্যান্ট হিসাবে।
রবিন তাকে বউমা কেনো বলছে সেটা কারো মাথায় ঢুকছে না
আর তমসাই বা এতো সকালে ওপরে কোথা থেকে এলো ?
এক সার্ভেন্ট বলে উঠলো, মেডাম আপনি এখানে ?
রবিন সেই সার্ভেন্টের দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ওর বাড়িতে ও আসবে না তো কে আসবে ?
সবাই এদিকে এসে দাঁড়াও।
আঙ্কেলের পাশে গিয়ে দাড়ালাম আর সব সার্ভেন্ট কাজ রেখে
একসাথে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেলো আমাদের সামনে।
গলাটা একটু পরিষ্কার করে রবিন বললো, রুপক আর তমসার বিয়ে হয়েছে গতকাল রাতে।
আজ থেকে তমসা তোমাদের সবার ছোট ম্যাম। বাড়ির সব কাজ আজ থেকে তমসার কথায় হবে।
এখন যে যার কাজে যাও যদি দেখেছি কেউ কোথাও দাঁড়িয়ে
এ নিয়ে কিছু আলোচনা করেছো তার এই বাড়িতে শেষ দিন হবে।
সব সার্ভেন্ট একসাথে বলে উঠলো, ঠিক আছে স্যার।
সবাই আবার যার যার কাজে চলে গেলো আর রবিন তমসার দিকে তাকিয়ে বললো,
আমার জন্য চা বানিয়ে আনো দেখি একটু।
তমসা একটু হাসার চেষ্টা করে বললো, এখনই এনে দিচ্ছি আঙ্কেল।
তমসা যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রবিন বলে উঠলো, দাঁড়াও।
তমসা ঘুরে দাড়িয়ে বললো, জী ?
তুমি আমাকে কী বলে ডাকলে ?
একটু ঘাবড়ে গিয়ে তমসা বললো, আঙ্কেল বলে ডেকেছি।
গম্ভীর গলায় রবিন বললো, আমি তোমার আঙ্কেল হই ?
না মানে জী ?
তমসাকে ভয় পেতে দেখে রবিন হেঁসে বললো,
আজ থেকে তুমিও রুপকের মতো আমাকে বাবা বলে ডাকবে।
আঙ্কেলের মুখের দিকে তাকালাম, আজ থেকে তমসা নামে আমাদের কোনো মেয়ে নেই।
আর কখনো তোমার এই মুখ আমাদের দেখাতে আসবে না।
বাবার বলা কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো।
চোখ দুটো টলমল করে উঠলো।
কী হলো, প্রবলেম আছে বাবা ডাকতে ?
ব্যস্ত হয়ে তমসা বললো, না না সমস্যা কেনো হবে ?
আমি আপনাকে বাবা বলেই ডাকবো আজ থেকে।
কিচেনের দিকে চলে এলাম। এক বাবা হারিয়ে আরেক বাবা পেয়ে গেছি আমি।
সবার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রোদ আর সোফায় বসে আকাশ রাগে ফুঁসছে।
রোদের পাশেই দাঁড়ানো সিনহা আর তার পাশে বৃষ্টি ।
সিনহাদের বাসার ড্রয়িংরুমে সবাই বসে আছে।
আকাশ সবাইকে সব বুঝিয়ে বলেছে,
সিনহার বাবা-মা আর তানভীর চুপচাপ শুনে গেছে শুধু।
তানভীরের বড্ড রাগ হচ্ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না
কারণ সামনে আকাশও আছে আর তানভীর আকাশকে অনেক সম্মান করে।
সিনহার বাবা নরম গলায় বললো, আমাদের জানাতে এলো ঝামেলা হতো না।
সিনহার মা বললো, কী আর করার ভুল করে ফেলেছে ?
আকাশ সিনহার দিকে তাকিয়ে বললো,
রোদ তোমার সাথে কোনো বাজে ব্যবহার করেছে মামুনি ?
বৃষ্টির মতো তুমিও আমার কাছে মেয়ের মতো। তাই রোদ
যদি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকে তুমি বলো,
আমি নিজে ওকে পুলিশে দিবো। আমার কাছে অন্যায়ের কোনো মাফ নেই।
সবার সামনে কথা বলতে ভয় করছে।
কিন্তু কিছু করার নেই আমি এখন চুপ করে থাকলে উনি বিপদে পরে যাবেন।
তাই নিচের দিকে তাকিয়েই আঙ্কেলের প্রশ্নের উত্তর দিলাম,
না আঙ্কেল উনি আমার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করেননি।
ভয় পেও না আমি তোমার সাথে আছি। তুমি সত্যি কথা বলো।
আমি সত্যি বলছি উনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি।
আকাশ এবার সিনহার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে রোদের সাথে সিনহার
আর তানভীরের সাথে বৃষ্টির বিয়ে দিতে চাই৷ এতো কাহিনির পর নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন
রোদ সিনহাকে পছন্দ করে।
আর আমার মেয়ে বৃষ্টি অনেকদিন আগেই আমার কাছে কিছু চেয়েছিলো।
তখন আমার কাছে মনে হয়েছিলো তার চাওয়াটা ভুল।
কারণ ও যাকে চাইছে সে ওকে চায় না।
তানভীরের দিকে তাকিয়ে বললাম, তবে এখন আমার সেটা মনে হচ্ছে না।
আমার কাছে আমার ছেলেমেয়ের চাওয়াই সবচেয়ে বড়।
তাই আপনারা নিজেরদের মধ্যে কথা বলে আমাদের জানাবেন।
আমি চাই না ওরা আর কোন ভুল করুক আর সমাজে আমার মানসম্মান যাক।
বাবার কথা শুনে শক খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বাবা এখনই কী বললো বিশ্বাস করতে পারছি না ?
এখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও এখন লজ্জা লাগছে।
আড়চোখে তানভীরের দিকে তাকালাম। সেও আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
সিনহা আর ভাইয়ারও একই অবস্থা। তবে ভাইয়া আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছে।
আসলে ভাইয়া আমার আর তানভীরের বিষয়ে কিছু আন্দাজ করতে পারেনি।
আকাশ গম্ভীর গলায় বলে উঠলো, এখন তাহলে আমরা আসছি।
আপনারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে আমাদের জানাবেন। রোদ আর বৃষ্টি বাসায় চলো।
বাবা বেড়িয়ে গেলে ভাইয়াও সাথে চলে গেলো।
আমি সিনহাকে বলে চলে এলাম সবার সাথে কথা বলতে লজ্জা করছিলো কেনো জানি।
আমি গাড়িতে বাবার পাশে গিয়ে বসলাম আর ভাইয়া ড্রাইভারের সাথে সামনে বসলো।
বাবা কথা বলছে না, গম্ভীর মুখে মেবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে।
ভাইয়া বা সিনহা কেউ এখনো তমসা আপু আর রুপক ভাইয়ার বিষয়ে কিছু জানে না।
জানলে রিয়াকশন কেমন হবে কে জানে।
বাসায় আসতেই আকাশ গাড়ি থেকে নেমে হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেলো।
কলিংবেলের শব্দে উঠে গিয়ে দরজা খোলে দিলাম,
ভোরবেলা উনি উঠে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে গেলেন কিছু না বলে।
তখন থেকে ড্রয়িংরুমে বসে ছিলাম। দরজা আটকাতে গেলাম আর বৃষ্টি এলো।
ওকে দেখে বললাম, তোমার বাবার কী হয়েছে ? এতো রেগে আছেন কেনো ?
মা….
রোদকে দেখে চমকে উঠে মেঘলা বললো, তুমি কোথা থেকে আসলে এখন ?
মা ছেলের কাহিনি দেখে বৃষ্টি বললো,
আগে ভেতরে যেত দাও তারপর তোমার ছেলের সাথে যত খুশি কথা বলো।
মেঘলা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালে বৃষ্টি ভেতরে গিয়ে রুমের দিকে চলে গেলো আর রোদ মায়ের সামনে দাঁড়ালো।
মেঘলার দিকে তাকিয়ে রোদ বললো, মা আমি অনেক টায়ার্ড একটু ফ্রেশ হয়ে নেই পরে কথা বলবো।
রোদও নিজের রুমের দিকে চলে গেলো, এদের সবার কী হয়েছে বুঝতে পারছি না।
আমিও নিজের রুমে চলে গেলাম।
উনি যেভাবে এসেছেন ওভাবেই বেডে শুয়ে আছে কপালের ওপর হাত দিয়ে।
আমি গিয়ে পাশে বসলাম। চুলে বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে আপনার ?
রোদ হঠাৎ করে চলে এলো কেনো ?
কপালের ওপর থেকে হাত সরিয়ে মেঘলার হাত ধরে বুকের ওপর রেখে বললাম,
মেঘলা আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেক বড় হয়ে গেছে।
মনে হয় এইতো সেদিন আঙ্গুল ধরে হাঁটতে শিখালাম। কিন্তু অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে টের পায়নি।
উনার দিকে তাকিয়ে বললাম, কী হয়েছে ? আজ হঠাৎ এসব বলছেন কেনো ?
মেঘলার দুহাত ধরে চুমু দিয়ে বললাম, আমাদের অবসরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে মেঘলা।
তোমার এই সংসার সামলানোর জন্য অন্যকারো ব্যবস্থা করে নিয়েছে তোমার ছেলে।
আর অফিস চালানোর যোগ্য হয়ে গেছে সেটাও প্রামণ করে দিয়েছে।
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘলা বললো, মানে কী ?
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
তোমার ছেলেমেয়ের বিয়ে ঠিক করে এসেছি।
কিছুদিন পর আমাদের ঘরের রাজকন্যা অন্যকারো ঘরের রানী হয়ে যাবে।
আর আমাদের রাজ্যের রাজা রানীর আসন গ্রহণ করার জন্য আমাদের ছেলে আর বৌমা চলে আসবে।
এটা তো খুশির খবর, আপনি এভাবে কেনো বলছেন ?
তুমি রাগ করোনি ?
রাগ কেনো করবো বলুন তো ?
এই যে তোমাকে ছাড়া একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আমি চাইনি এভাবে সব করতে।
চেয়েছিলাম জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তোমার সাথে সব খুশি ভাগ করে দিতে।
কিন্তু ছেলেমেয়ের জন্য আজ তোমাকে এই খুশি থেকে বঞ্চিত করেছি আমি।
আপনি সেই জন্য এতো রেগে আছেন।
আমি আপনাকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি। সেটা কী আপনি ভুলে গেছেন ?
আমি যেমন ওদের মা আপনিও তেমন ওদের বাবা।
ওদের জন্য যেটা ভালো সেটাই আপনি করবেন। এটা আমার থেকে বেশি কে জানে ?
তুমি সত্যি রাগ করোনি ?
একটুও না।
তাহলে আয়োজন শুরু করে দাও মেয়ে বিদায় আর বউ বরণের।
সেটা তো করতেই হবে। এক মেয়ে বিদায় দেবো আর আরেক মেয়ে বরণ করবো।
শাওয়ার নিয়ে টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো রুপক।
টেবিলের ওপর থেকে কফির মগ নিতে গিয়ে দেখে কফি নেই।
প্রতিদিন শাওয়ার নিয়ে এসে এক কাপ কড়া কফি চাই রুপকের।
প্রতিদিন ঠিকমতো পেয়েও যায়। কিন্তু আজ না পেয়ে খানিকটা রেগে গেলো।
আসলে হঠাৎ এভাবে রুপকের বিয়ের খবর শুনে সব সার্ভেন্ট নিজের কাজ গুলিয়ে ফেলেছে।
রুপক রুম থেকে উচু গলায় বললো, আমার ব্ল্যাক কফি কোথায় ?
যে সার্ভেন্ট প্রতিদিন রুপকের কফি দেয় এতোক্ষণে তার মাথায় হাত৷ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
এখনই আনছি স্যার।
হঠাৎ রবিন বলে উঠলো, বউমা রুপকের কফি আজ থেকে তুমি দেবে, যাও কফিটা দিয়ে এসো।
বাধ্য মেয়ের মতো তমসা বললো, জী বাবা দিয়ে আসছি।
তমসা ঝটপট কফি বানিয়ে রুপকের জন্য রুমে নিয়ে গেলো।
আসবো ?
দরজার দিকে তাকিয়ে রুপক বললো,
হ্যাঁ এসো তোমাকে যদি কেউ অনুমতি নিয়ে এই রুমে আসতে দেখে সবাই কী মনে করবে ?
রুমে আসার জন্য অনুমতির প্রয়োজন নেই।
রুমে ঢুকতে ঢুকতে তমসা বললো, ঠিক আছে৷ এই নিন আপনার কফি।
তুমি নিয়ে এসেছো কেনো ? বাসায় এতোগুলো সার্ভেন্ট কী করছে ?
বাবা বললো আমাকে নিয়ে আসতে।
ওহ্ ঠিক আছে।
স্যার কফি নেওয়ার জন্য কাপ ধরতে গিয়ে আমার হাত ধরে ফেললেন।
জানি না কেনো আমি খানিকটা কেঁপে ওঠলাম।
উনি বুঝতে পেরে সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিলেন ।
সরি আমি বুঝতে পারিনি।
ইটস ওকে, আপনি কফি খেয়ে নিচে আসুন আমি ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি।
কফির কাপটা সাইড টেবিলে রেখে নিচে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই উনি ডাকলেন।
তমসা ?
উনার দিকে তাকিয়ে বললাম, জী বলুন ?
চলবে,,,
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com