সে আমার । হিয়া চৌধুরী
হাতের খামচি দেওয়া জায়গা গুলো থেকে রক্ত পড়ছে অনুর।
নিজের সব রাগ নিজের উপর প্রয়োগ করার ফলে এমন হয়েছে।
চুল গুলো প্রচন্ড অগোছালো হয়ে আছে। বন্ধ একটা রুমে পাগলের মতো কান্না করছে সে।
তার চিৎকার আর আর্তনাদ তনু শুনছে। কিন্তু করার মতো কোনো কিছুই তার নেই।
বোন টাকে এভাবে কাঁদতে দেখে বুক টা ফেটে আসাড় হয়ে আছে। সে নিজে ও কাঁদছে।
সারাটা রাত ই এভাবে পার করলো অনু!
নাহ চোখে বিন্দুমাত্র ও ঘুম নেই। নেই কোনো ক্লান্তির ছাপ।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে থেকে থেকে ফুঁপিয়ে উঠছে সে! যেনো কতো শত জনমের কান্না করেছে সে আজ।
আহান বাসর ঘরে ঢুকে সিগারেট আর মদের বোতল হাতে নিয়ে সোফায় বসে পড়ে।
চোখ ভয়ংকর লাল বর্ণ ধারণ করে আছে। আগুন ঝরবে মতো। কপালের রগ গুলো টানটান হয়ে আছে।
এক্ষুনি ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে তার মৃত্যু ঘটাবে এমন। ঢকঢক করে মদ গিলে ফেলে সে।
তারপর সিগারেট জ্বালায়। জলন্ত সিগারেট দিয়ে হাতে আঘাত করে আহান। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে।
নাফিজা দৌড়ে এসে আহানের হাত ধরতে নিবে আহান গর্জন করে বলে উঠলো,
—“আমার কাছে আসবি না বলে দিচ্ছি একদম জানে মেরে ফেলবো!”
নাফিজা ভয়ে ঢোক গিলে। বিছানায় গিয়ে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে শুয়ে পড়ে।
আহান নিজেই ইচ্ছা মতো নিজের হাতে আঘাত করছে।
সিগারেটের আগুনে হাতে অনু লিখে তারপর থেমেছে।
নাফিজা কান্না করছে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছে সে।
আগে কখনো এতো টা ভয়ংকর রুপে আহান কে দেখে নি নাফিজা।
আহান মদের বোতল ফ্লোরে আছাড় মেরে ভাঙ্গতে শুরু করে।
তার রুমের বাইরে শব্দ যায় না, আশে ও না।
তাই কেউ শুনছে না। নেশার ঘোরে মাতাল অবস্থায় পড়ে আছে আহান।
নেশার ঘোরে বার বার অনুর নাম জপ করছে সে। আহান অনু কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
—“অনু? এই অনু? আমি আর তুমি ভর দুপুরের কড়া রোদ্দুরে সত্যি ই ছায়া খুঁজেছিলাম নাকি নিজেদের খুঁজেছিলাম? কেন এমন হলো অনু? আমি আর তুমি এক হলে কি সুন্দর হতো তাই না?
অনু আমি তোমাকে চাই! এই আহান শুধু অনুর! আর কারোর না! একদম ই না!”
অনু বরাবর ই এমন নিজের রাগ জেদ নিজের উপর ই দেখায়।
বিশেষ করে হাত গুলোর উপর।
আজ ও তাই করছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে হাত দুটোর দিকে।
ইশ কেমন লাল হয়ে আছে! টকটকে লাল! আচ্ছা এই হাত কি ব্যথা করেছিলো?
নাহ করেনি বোধহয় অনু তো কই কোনো ব্যথা অনুভব করে নি। অনু ওয়াশরুমে যায়।
চোখে মুখে পানির ঝাপটা মেরে আয়নার দিকে তাকাতেই আতঁকে উঠলো সে!
এটা কি সেই অনু? নাকি অন্য কেউ? চোখ মুখ ভীষণ ফুলে আছে। গাল লাল হয়ে আছে।
চোখের নিচে এমন ভাবে লাল বর্ণ ধারণ করেছে যে মনে হচ্ছে এই চোখ থেকে পানি নয় রক্ত ঝরেছিলো! আহানের ছোঁয়া তার হাতে মুখে ছিলো। সেই ছোঁয়াই আজ তার শরীর টাকে বিষাক্ত করে ফেলেছিলো। তাই ব্যথা লাগে নি বিন্দুমাত্র ও। এখন শরীর টা ক্লান্ত লাগতেছে। চারদিকে সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। অনু শুয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে দরজায় কড়া নাড়তেই ঘুম আচমকা ভেঙ্গে যায় অনুর। হেলেদুলে উঠে দরজা খুলে দেয়। তনু নিজেকে সামলে নিয়েছে। চোখে মুখে পানি নেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অনুর সামনে। অনু ঘুম জড়িত কন্ঠে বললো,
—“আহান তুমি এখন ও ঘুমাতে দিবা না আমাকে তাই না? সারারাত ঘুমোতে পারি নি কিন্তু! আমার ঘুম পেয়েছে খুব! দাও মাথায় বিলি কেটে দাও আমি তোমার কোলে ঘুমাই!”
তনু কে আহান ভেবেছে অনু। তনু বিলি কেটে দিচ্ছে অনুর মাথায়। কিছুক্ষণ নিরবতার পর চোখ খোলে অনু। এ তো তার অাহান নয়! আহানের স্পর্শ তার ঢের চিনা। ঘুম ছেড়ে তনুর দিকে তাকায় সে। তারপর সব মনে পড়লো অনুর…
আহান, অনু দু’জন দুইজন কে খুব ভালোবাসে। সম্পর্ক টা ৩ বছরের। দুজনের ভালোবাসা আত্নার সাথে সম্পৃক্ত। একজন আরেক জন কে ছাড়া যেনো নিশ্বাস ই নিতে পারবে না। তাদের ভালোবাসা দেখে সবাই হিংসা করতো। কোনো সন্দেহ একে অপরের মধ্যে ছিলো না। ছিলো আকাশ সমান ভালোবাসা। একে অপরের প্রতি ছিলো অঘাত বিশ্বাস। ভালোবাসার সম্পর্কে ফাটল ধরবে এমন কাজ থেকে গুনে গুনে কয়েকশ হাত দূরে ছিলো তারা।
অনু একদিন আহান কে বলে ছিলো, “যদি বিশ্বাস আর ভরসার জায়গা একবার ভেঙ্গে যায় তা আর কোনো অবস্থাতেই জোড়া লাগে না। কারণ আমি বহুবার ভেঙ্গে যাওয়া প্লেট জোড়া লাগিয়ে দেখেছি কোনো বার ই সেটি তে করে খাওয়ার উপযোগী হয় নি। তাই তোমার আর আমার সর্বদাই খেয়াল রাখতে হবে প্রিয় বিশ্বাস আর ভরসার জায়গা টা যেনো কখনোই ক্ষয়ে না যায়। সবসময় যেনো অক্ষয় থাকে।”
আহান মুগ্ধ হয়ে অনুর কথা গুলো শুনলো। আর সহমত পোষণ করলো। অনুর ফুফাতো বোনের বিয়ে তে আহানের সাথে প্রথম দেখা। অনুর ফুফাতো বোনের বরের ফ্রেন্ড ছিলো সে। তারপর আস্তে আস্তে চেনা জানা আর অবশেষে ভালোবাসা। এই তো কয়দিন আগেই তাদের রিলেশন টা সবাই জেনে যায়। সমস্যা ছিলো আহানের মা নাজিরা সুলতানা। তিনি তার বোনের মেয়ে নাফিজা কে আহানের সাথে বিয়ে দিবেন। তার কথায় তিনি অনড়। ভীষন ঘাড়ত্যাড়া মহিলা তিনি।
শত চেষ্টা বিফলে গিয়ে আহান বিয়ে করেছিলো কাল নাফিজা কে। নাহ নিজ ইচ্ছায় নয় নাজিরা সুলতানার জন্য। তিনি নিজের কসম চাপিয়ে দেন ছেলের উপর। তাই আহান বুঝতে পারছিলো না কার কথা সে ভাববে! বা তার ভাবা উচিত! জীবনের এই পর্যায়ে সে ভীষণ ই নিরুপায় আর দোটানায় পড়ে গিয়েছিলো। কোনো উপায় না দেখে অনু নিজেকেই গুটিয়ে নেয় আহানের থেকে। নাফিজা কেই বিয়ে করতে বাধ্য করলো সে। আর কাল রাতেই ছিলো আহানের বাসর রাত। বাসা টা ততোটা দূরে ছিলো না।
নাজিরা সুলতানা অনু কে অুশকে দেওয়ার জন্য আহানের বিয়ে তে দাওয়াত ও করেছে।
অনু গিয়েছিলো! নিজের হাতের নিজের ভালোবাসার মানুষটার বাসর ঘর খুব চমৎকার করে সাজিয়ে দিয়ে চলে এসেছিলো। আহান খুঁজেছিলো অনু কে আহানের সাথে দেখা না করেই চলে এসেছে। কারণ সে জানে এই একটা মানুষের কাছেই সে দুর্বল! প্রচন্ড দুর্বল! আর এসেই রাতে নিজের ওই অবস্থা করেছে অনু।
অনু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে তনু কে বলে উঠলো,
—“তনু রে ‘সে আমার’ আর নেই রে! আহান আজ অন্য কারো হয়ে গেছে! আমার আহান আজ আমার থেকে অনেক দূরে! চাইলে ও আর আমি পারবো না তাকে ছুঁতে, পারবো না তাকে ভালোবাসতে! কোনো অধিকার নেই আমার! আমি কিভাবে বাঁচবো তাকে ছাড়া? আমি মরে….”
অনু কে বলতে না দিয়ে তনু অনুর মুখ চেপে ধরে হুংকার দিয়ে বললো,
—“মরে যাওয়ার কথা আর ভুলে ও কখনো বলবে না আপু!”
অনু নিঃশব্দে কেঁদেছি যাচ্ছে। তনুর বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম সুরে বললো,
—“কেউ কাউকে ছাড়া মরে না আপু! ক্ষণিকের জন্য নিজের জীবন টা কে স্বাদহীন মনে হয়। এই যে তুমি আহান ভাইয়ার জন্য কাঁদছো, কষ্ট পাচ্ছো তোমার মনে হচ্ছে তুমি তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না আসলে সব ই মিথ্যা। আসল হচ্ছে ভুলতে না পারার কষ্ট টা। কারণ এই ভুলতে না পারা টা, কখনো কখনো মানুষ কে অন্য এক মানুষে পরিণত করে! আবার কখনো বা চূর্ণ বিচূর্ণ করে সব ধুলোয় মিশিয়ে দেয়।”
বাস্তবতা আসলেই অনেক কঠিন এবং নির্মম। একটা মানুষ চাইলে ও যা নয় তা করতে পারে না। করলে অন্যায় হবে ঘোর অন্যায়। নিষ্ঠুর সময়ে ও নিজেকে নিষ্ঠুরতার কাছ থেকে জিতিয়ে নিতে হয়! নিজেকে মানিয়ে নিতে হয় সকল পরিস্তিতি তে।
তনু কে সাথে নিয়ে অনু আবারো আসলো আহানদের বাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে পুরো বাড়ি টায় চোখ বুলিয়ে নিলো অনু! পড়নে নীল রঙের জামা। চোখে গাড়ো কাজল! মুখে হালকা সাজ। এই সাজেই পাগল ছিলো আহান! একমনে এসব ভেবে হাটছিলো অনু। আচমকা হাতে টান পড়ে। তাকিয়ে দেখে আহান দাঁড়িয়ে আছে। আহান দরজা বন্ধ করে দিয়ে অনির মুখের পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে!
এই চাহনি মোহনীয়। খুব গভীর ভাগে খুটিয়ে খুটিয়ে কিছু বিশ্লেষণ করছে আহান। দু’জন দু’জনের চোখে হারিয়ে গেছে। নিরবতা কাটিয়ে আহান বলে উঠলো….
—“কেমন আছো?”
—“পূর্ণতার চেয়ে অপূর্ণতার গল্প যার বেশি, তার কাছে ব্যর্থতার আরেক নাম ভালো আছি!”
আহান ছোট করে দম ফেলে বললো,
—“কতো দিন হয়েছে কিছু খাও না?”
—“খাই তো!”
—“মিথ্যা বলা পছন্দ করি না!”
অনু নিশ্চুপ।
—“আমি এক্ষুনি আসছি তুমি এই রুম থেকে এক পা ও নড়বে না!”
বাহিরে থেকে কড়া আটকিয়ে তনু কে খাবার নিয়ে আসতে বলে আহান। প্রায় অনেক্ষণ হলো তনু আসছে না। ব্যাপার টা বুঝতে সময় লাগলো না আহানের। নাজিরা সুলতানার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
—“মা তুমি যা চেয়েছো তাই করেছি এখন আমি চাই তা করতে দাও নয়তো আমার মৃত্যু দেখতে প্রস্তুত থাকো!”
নাজিরা সুলতানা ছেলের মুখে মরার কথা শুনে হকচকিয়ে উঠে বললো,
—“না না বাবা এসব বলিস না।”
নাজিরা সুলতানার হাত ছো মেরে সরিয়ে দিলো আহান। গা ঘিনঘিন করে এই স্পর্শ। প্লেটে খাবার আর পানি নিয়ে হাজির হয় আহান! অনু ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে! ক্ষুধা পেয়েছে খুব অনুর! আশ্চর্য এতোক্ষণ তো ক্ষুধা লাগে নি এখন? হয়তো আহানের হাতে খাওয়ার লোভ পেয়েছে।
চেটেপুটে পেট পুরে খেলো অনু। কতোদিনের ক্ষুধা মিটলো এখন! আহান সযত্নে খাইয়ে দিলো পর অনুর দিকে তাকিয়ে অনুর খাওয়া উপভোগ করলো! তার মায়াবতীর এই দৃশ্য টা সকল ভালো সময় কে হার মানায়! তার জীবনে সবচেয়ে খুশির দিন গুলোর মধ্যে এগুলো একটি!
একজন আরেকজনের মাথায় মাথা ঢেকে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। আহান অনুর ঠোঁট ছুতে যাবে অনু নিজেকেই সরিয়ে নেয়। আহান প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকায় অনু না বোধক মাথা নাড়ায়। আহানের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল….
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com