Breaking News

তাঁহার অপেক্ষায় | লিখা- মেহেরাব কাব্য

নদীর তীরে উদাস মনে বসে আছে নীলাদ্রি । মাঝে মাঝে একাই হেসে যাচ্ছে। ঢেউ এসে পাড়ের উপর উপচে পড়ছে। পা দুটো ঝুলিয়ে দিয়ে নাড়াচাড়া করছে ঢেউয়ের উপচে পড়া পানি ধরার জন্য৷ মাঝে মাঝে পিচ্চিদের মতো খিল খিল করে হেসে যাচ্ছে। আশপাশের ঘুরতে আসা মানুষেরা নীলাদ্রির এমন কান্ড দেখে হাসি তামাশা শুরু করে দেয়। নদীর তীরে বয়ে যাওয়া বাতাসে উশকো খুশকো চুল উড়ে বেড়ায় মাঝে মাঝে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে যায়। নদীতে নৌকায় কাঁপলদের বাহার। নীলাদ্রির মুখের আবরন মেঘের মতো কালো বর্ণ ধারণ করে। অঝরে ঝরতে থাকে বৃষ্টি। হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। হাসি তামাশা করা লোকগুলো বুঝতে পারেনা কি জন্য কাঁদছে। নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকে নীলাদ্রির দিকে।
১৯৯০ নভেম্বর ৩
শীতের সকাল কুয়াশায় আছন্ন চারপাশে। শিশিরে ভিজে গেছে ঘাস, গাছের পাতা। সকালে কুয়াশা মাখা শিশির ভেজা ঘাসে হাঁটতে বেশ ভালবাসে নীলাদ্রি। “প্রতিদিনের ন্যায় সকালে উঠে কুয়াশার ভেতর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটছে। বেশ সুন্দর একটা মূহূর্ত। ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটা। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ময়নামতি নদী (গল্পের ক্ষেত্রে এই নদীটা নেওয়া)
নদীর এপার গ্রাম ওপার শহর। নীলাদ্রি গ্রামে থাকে। পাখিগুলো তাদের আপন মনে ডেকে যাচ্ছে। নদীর ঢেউ পাড়ে আঁচড়ে পড়ছে। নীলাদ্রি ঢেউ এর শব্দ শুনে সেখান থেকে নদীর তীরে এসে ঢেউয়ের উপর দাঁড়ায়।”ঢেউয়ের উপর লাফালাফি করছে নীলাদ্রি। কুয়াশায় ওপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হাত দিয়ে নদীর পানি সামনের দিকে ছিটে দিচ্ছে। হঠাৎ করেই একটা ছেলে নৌকা বেয়ে যাচ্ছিলো। পানি গিয়ে ছেলেটার গায়ে পড়লো। নীলাদ্রির হাসিমুখ দেখে ছেলেটি স্তব্ধ হয়ে যায়। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে ছেলেটি। ” নীলাদ্রি ছেলেটার গায়ে পানি ছিটে লাগছে দেখে দৌঁড়ে পালালো। কুয়াশায় মিলিয়ে গেলো নীলাদ্রি। ছেলেটা নীলাদ্রির দৌঁড় দেখে হাসতে থাকে। নীলাদ্রির হাসিমুখ দেখে ছেলেটি যেনো প্রেম পড়ে গেলো। “ছেলেটির নাম হচ্ছে “কাব্য”। নদীর ওপারেই থাকে। গ্রামে এসেছে খালার বাসায়। কুয়াশার সকালে নৌকা চালানোর লোভ সামলাতে না পেরে চলে আসে নদীতে নৌকা নিয়ে নেমে পড়ে। কিন্তু কে জানতো কাব্যের সাথে নীলাদ্রির দেখা হয়ে যাবে। ” এতটা ভালো লেগে যাবে।
কাব্য বলতে লাগলো
“কুয়াশা আছন্ন চারিপাশে
একি দেখালে আমাকে
নদী তোমার পানে নাও ভাসাতে এসে ভেসে গেলাম এক অপরুপ সুন্দরীর মাঝে। “
এটা যেনো স্বপ্ন নয়,একি উপহার দিলে আমায় তুমি।”
নীলাদ্রি এক দৌঁড়ে বাসার গেইটে এসে দাঁড়ালো। গেইট ধরে হাঁফাচ্ছে। রমেলা বেগম দৌড়ে এসে নীলাদ্রির সামনে দাঁড়িয়ে (রমেলা বেগম নীলাদ্রির মা)
-কি হয়েছে মা। হাফাচ্ছিস কেন?
-আম্মা কিছু না একটু পানি দিবে। খুব পিপাসা পেয়েছে। “
-ভেতরে আয় পানি দিচ্ছি। “
নীলাদ্রি ভেতরে গিয়ে বসলো রমেলা বেগম পানি এনে নীলাদ্রির সামনে ধরতে,নীলাদ্রি পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢক ঢক করে এক নিমিষে শেষ করে দিলো।” রমেলা বেগম অবাক হয়ে
-কি হয়েছে আজ তোর বল আমাকে। “
নীলাদ্রি ফিক করে হেসে দিয়ে
-আম্মা কিছু না। ভূত দেখে ভয় পেয়েছি।”
রমেলা বেগম এক চিৎকার দিয়ে
-ওরে লিমল,নিলয়,রিয়াদ,শুভ্র তোরা কোথায় মাইয়াটার জন্য পানি পড়া নিয়ে আয় হুজুরের কাছ থেকে। “
নিলয়, শুভ্র, রিয়াদ,লিমন চোখ ডলতে ডলতে বাইরে বেরিয়ে এসে (এই চারজন হলো নীলাদ্রির ভাই৷ নীলাদ্রি খুব আদরের ছোট বোন)
-কি হয়েছে চিৎকোর মারো কেন?
রমেলা বেগম মাথায় হাত দিয়ে
-ওরে আমার মাইয়াটা ভূত দেখে ভয়ে দৌঁড়ে এসেছে। ব্যস্ত যা হুজুরের কাছ থেকে পানি পড়া নিয়ে আয়। “
লিমন রিয়াদ বলে উঠলো
-চিল্লায়ো না আমরা এক্ষুণি যাচ্ছি।
-হ হ ব্যস্ত যা।
নীলাদ্রি রুমে বসে বসে মায়ের কান্ড দেখে হাসতে লাগলো।
নিলয় আর শুভ্র নীলাদ্রির ঘরে গিয়ে
-তোকে কতবার মানা করবো একা যাবি না এই ভোর সকালে। “
নীলাদ্রি চুলের বেনি ধরে নাড়াচাড়া করছে আর মুখটা গম্ভীর করে
-ভাইজান আমার ভালো লাগে। কতবার কইছি তোমাগো কও৷ আমার ভাল লাগে। “
-দেখ বোন তুই যা আমাদের ডেকে নিলে পারিস তো। তোর যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমাদের অবস্থা বোঝার চেষ্টা কর? “
নীলাদ্রি হেসে দিয়ে
-কিছু হবে না ভাইয়া। ” তোমরা তো আমার ছাঁয়া।”
নীলাদ্রির হাসিমুখ দেখে চার ভাই খুব খুশি। নীলাদ্রিকে আজ পর্যন্ত কখনো ধমক দিয়ে কথা বলেনি। খুব আদরে বড় করেছে।
-ভাইয়া যাও তোমরা আমি ঘুমাবো। “
-কোথায় ভূত দেখছিলি বল আমাদের
-আরে তোমরা কি আম্মার মতো পাগল হলে নাকি। “আমি তো আম্মুকে
নিলয় নীলাদ্রিকে থামিয়ে দিয়ে
-হুম বুঝেছি। অনেক দুষ্টু হয়েছিস।
শুভ্র নিলয় বাইরে এসে
-মা নীলাদ্রির দিকে নজর দাও। বোনটা কত ভয় পাইছে। “
রমেলা বেগম দাঁতের সাথে দাঁত চেপে ধরে
-আমার কথা যদি ও শুনে। তোরা ভোরে উঠে ওর সাথে যেতে পারিস না।
কাব্য এখনো নদীর তীরে নৌকা নিয়ে বসে ছিলো। ” কুয়াশা কাটিয়ে সূর্যের দেখা মিললো। বেলা ১০ টায়। ” কাব্য নৌকা রেখে বাসায় চলে আসলো।” রেহানা বেগম কাব্যকে দেখে (রেহানা বেগম কাব্যের খালা) চিন্তিত ভাব নিয়ে
-বাবায় এত লেট করলে কেন?
কাব্য রেহানা বেগমের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে এতক্ষণ ধরে চিন্তা করেছে।
-খালাম্মা নদীর তীরেই ছিলাম। কত বছর পর এলাম বলো তো। “
-হুম। যা হাতমুখ ধুয়ে আয় খাবার দিচ্ছি।”
“আয়শা চুলে বেনি করতে করতে কাব্যকে বললো (আয়শা খালার একমাত্র মেয়ে। খুব দুষ্টু।)
-ভাইজান আসার টাইম হলো এখন? “
-কেন-রে ? কি হয়েছে ? “
আয়শা মুখটা বাকিয়ে
-আম্মা তোমাকে নিয়ে এতক্ষণ চিন্তায় ছিলো আসছো না কেন? তোমাকে নিয়ে যা চিন্তা করছে তা মনে হয় না আমাকে নিয়ে ততটা করে। কত ভালবাসা তার বোনের ছেলের জন্য। আমার জন্য একটু ও না। “
-তবে রে। “
আয়শা দৌঁড়ে চলে যায়। ” কাব্য হাসতে হাসতে ঘরে চলে গেলো। “
বিকাল বেলা
নীলাদ্রি ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে আইল ধরে হেঁটে যাচ্ছে দু-হাত ঢেউয়ের মতো করে। গুনগুনিয়ে গান গাচ্ছে।
“আয়শা কাব্যকে ঘুম থেকে তুললো। ” কাব্য চোখ ডলতে ডলতে
-কি হয়েছে ঘুমটা দিলি তো নষ্ট করে।”
আয়শা মুখটা বাঁকিয়ে
-উঁ বিকাল হয়ে গেছে কেউ যে পাশের গ্রামে ঘুরতে যাবে সেদিকে তার মনে নেই৷ ” পরে নাই বলবে আয়শু তুই ডাকলি না কেন?”
আয়শুর মুখ বাঁকানো ঢং করে কথা বলার ধরণ দেখে কাব্য রাগি চোখে তাকিয়ে
-বুড়ি হয়ে গেছিস তো । ” খালাম্মুকে বলতে হবে দেখি।”
আয়শা মুখটা ভেংচি কেটে
-যা বল যেয়ে।” আমি ও বলবো বুইড়া পোলা ছোট বোনকে বুড়ি বানাই দিয়েছে। ব্যস্ত আয় বেলা এমনিতে ছোট। গিয়ে আসতে হবে। “
আয়শা ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে দাঁড়ালো। কাব্য রেডি হয়ে বের হলো। রেহানা বেগম আর আয়শা দুজনে অবাক হয়ে। “রেহানা বেগম জিঙ্গেস করলো
-বাজান তুই লুঙ্গি পরে বের হইছিস। বাহ্ বাহ্ কত সুন্দর লাগছে তোকে। “
-হ ভাই শহরের ভাই গ্রামে আইসা গ্রাম্য হয়ে গেছে। “
রেহেনা বেগম আয়শার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে
-তুই চুপ থাক। “
কাব্য লুঙ্গি আর একটা পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছে। কাব্য বললো
-খালা খুলে ফেলি। “
-না না খুলতে হবে না। খুব সুন্দর লাগছে। “
আয়শা আর কাব্য দুজনে পাশের গ্রামে গেলো। কাব্যকে নিয়ে বিলের পথ ধরলো আয়শা। ” আয়শা আর কাব্য বিলের ভেতর দিয়ে হাঁটছে। আয়শা কাব্যকে বললো
– ভাইয়া সুন্দর না।
-হুম। প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। ” এ যেনো এক প্রকৃতি প্রেমময় গ্রাম।”
কাব্যের চোখটা সামনে যেতেই হা করে তাকিয়ে পড়লো। বাতাসে খোলা চুল বার বার নীলাদ্রির মুখের উপর এসে পড়ছে৷ নীলাদ্রি হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে তবু ও কাজ হচ্ছে না। ধানের সারির মতো খোলা চুলগুলো দোল খাচ্ছে। কাব্য নীলাদ্রির দিকে এক পলকে চেয়ে আছে। নীলাদ্রির চোখ এড়ালো না চোখ পড়ে গেলো কাব্যের দিকে। ” নীলাদ্রির চিনতে ভুল হলো না। কাব্যকে দেখে পিছনে ঘুরে দৌঁড়। কাব্য বোকার মতো তাকিয়ে আছে নীলাদ্রির দৌড়ানোর দিকে। আয়শা একা একা বকবক করছে আর হাঁটছে পিছনে ফিরে দেখলো কাব্য অনেকদূরে দাঁড়িয়ে আছে। আয়শার রাগ হলো। কটমট করতে করতে চুলে বেনি দুটো ঘাড়ের দু পাশে এনে ধরে হেঁটে কাব্যের সামনে এলো। কাব্য বলতে লাগলো
-প্রকৃতির অগোচরে আমি দেখেছি তোমাকে। এক মুগ্ধ রাশ করা বিকালে দিলে তুমি আবার ও দেখা। এ আমি কেমনে ভুলি। তোমার ও চরণে আমি যে এক কৃতদাস। “
আয়শা হা হয়ে গেলো রাগ যেনো পানি হয়ে গেলো। ” আয়শা কাব্যকে ধাক্কা মেরে,
-ভাইয়া কি হয়েছে।
কাব্য থতমত খেয়ে
-ক ক কই কিছু না তো।
-তাহলে দাঁড়িয়ে গেলি কেন? আর এই ছন্দ টা কিসের।
কাব্য কি বলবে ভেবে পায় না আকাশের দিকে তাকিয়ে
-ঐ দেখ পাখি গুলো কেমন আকাশ জুড়ে উঠছে। কত সুন্দর প্রকৃতি বল। “
নভেম্বর ৪
ভোর বেলায় নীলাদ্রি আজও এসেছে। কাব্য নৌকা দিয়ে ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে৷ নীলাদ্রি নদীর ঢেউয়ের সাথে খেলছে। কাব্য মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে। নীলাদ্রি কাব্যকে দেখে চলে গেলো। কাব্য মুচকি হেসে সেখান থেকে চলে গেলো। “
বিকাল টাইমে নদীর পাড়ে বসে আছে নীলাদ্রি। আয়শা আর মেহেরাব দুজনেই পাড় দিয়ে হাঁটছিলো। নীলাদ্রিকে দেখে কাব্য আয়শাকে নিয়ে বসে পড়ে। নীলাদ্রিকে ফলো করে। নীলাদ্রির চোখ কাব্যের দিকে যেতে সেখান থেকে নীলাদ্রি চলে গেলো। কাব্য শুধু মুচকি হাসি দিলো। “
এভাবে কেটে গেলো অনেক দিন
ডিসেম্বর ২৫
ভোরে নীলাদ্রি নদীর পাড়ে যেয়ে অবাক হয়ে গেলো। হা করে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে
চলবে..

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com