রাস্তার মেয়ে । শেষ পর্ব
কিছুক্ষণ পর নিজেই ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। এসে দেখি কাব্য বাচ্চাটাকে খাওয়াচ্ছে।
আমাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাব্য বললো।
–“জানো মিরা, আমি না ওর একটা নাম রেখেছি ‘রাইসা’ সুন্দর না?
কিন্তু আমি কোন উত্তর না দিয়ে বিরক্তির সাথে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছি।
তখন কাব্য বললো।
–“তোমার ওকে দেখে রাখতে হবে না, ওর জন্য কিছু করতেও হবে না।
আমি একজন কেয়ারটেকার রেখেছি। সে সারাদিন রাইসার দেখাশোনা করবে।
তোমার কাছে শুধু একটাই অনুরোধ ওকে কখনো জানতে দিওনা আমরা ওর আসল বাবা মা নই।
তারপর আমি কিছু না বলেই রাতের খাবার রান্না করতে কিচেনে চলে এলাম।
রাইসাকে দেখাশোনার জন্য কেয়ারটেকার চলে আসলো সকালে, কাব্য অফিসে চলে গেল।
আমি আগের মতই টিভি দেখে, প্রতিবেশীদের সাথে গল্প করে দিন কাটিয়ে দিলাম।
রাতে কাব্য চলে আসলে কেয়ারটেকার চলে যায়।
রাইসা এখন আমাদের বেডরুমেই খাটের পাশে দোলনায় ঘুমায়।
রাতে মাঝে মধ্যে প্রচন্ড কান্না করে।
তখন কাব্য ওকে কোলে নিয়ে অন্য ঘরে অথবা বারান্দায় চলে যায়।
রাইসা এখন বসতে পারে, আধো আধো কথা বলতে শিখেছে। আর ওর ডাকা প্রথম শব্দ হচ্ছে ‘মা’।
কাব্য শুনে খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু আমি তেমন কোনো অনুভূতি পাইনি।
কারণ ও রাস্তার মেয়ে আর আমি ওর মা নই।
একদিন হঠাৎ করে রাইসার খুব জ্বর আর ঠান্ডা লেগে গেল।
কাব্য অফিস থেকে ফিরেই রাইসার মাথায় পানি দিতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।
কাব্য আর রাইসা কেউই রাতে ঘুমায়নি সেদিন।
কাব্য রাইসাকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে গেছে, যাতে আমার ঘুমের ডিস্টার্ব না হয়।
মাঝরাতে কাব্য এসে বললো।
–“মিরা রাইসার অবস্থা খুব খারাপ, ওকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। (কাব্য)
–“ওকে যেখানে ইচ্ছা সেখানে নিয়ে যাও। আমাকে একদম জ্বালাতন করবা না। (আমি)
আমার কথা শুনে কাব্য চুপচাপ রাইসাকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল। আর আমি এসে আবার শুয়ে পড়লাম।
যদিও একটু খারাপ লাগছিল তাও।
সকালে কাব্য চলে এলো রাইসা কে নিয়ে। রাইসা এখন আগের চেয়ে ভালো আছে।
এরপর আবার সবকিছু আগের মতোই চলতে লাগলো।
আজ রাইসার এক বছরের জন্মদিন। জন্মদিন বলতে গত বছর ঠিক এই দিনেই রাইসাকে আমরা পেয়েছিলাম।
কাব্য অসম্ভব রকমের খুশি আজ। নিজের হাতে রান্না করছে ও,
ঘর সাজিয়েছে, রাইসাকে আজ খুব মিষ্টি দেখতে লাগছিলো।
কিন্তু আমার মনে ওর জন্য এখনো একটুও জায়গা হয়নি। কারন ও তো রাস্তার মেয়ে।
দেখতে দেখতে রাইসা স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছে। এখনো কেয়ারটেকার ই ওর দেখাশোনা করে।
খুব শান্ত হয়েছে ও, এবং ব্যবহারও খুব সুন্দর।
এখন আমাদের বাড়িতে একজন নতুন অতিথি আসতে চলেছে। হ্যাঁ আমার আর কাব্যর প্রথম সন্তান।
কাব্য যদিও বলে দ্বিতীয়, কিন্তু আমি এখনো রাইসাকে মেনে নিতে পারিনি এজন্য প্রথম।
আর হয়তো কখনো পারবো ও না রাইসা কে মানতে।
আমাদের বাড়িতে নতুন করে এসেছে আমাদের ছেলে রোহান।
এরপর থেকে সারাদিন ওকে নিয়েই আমার সময় কেটে যায়। রাইসার সাথে ওর খুব ভাব।
যেন কতজন্মের সম্পর্ক। দুজনে মিলে খেলা করে। একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতেই পারে না।
আর দুইজনই কাব্যের চোখের মনি এখন।
সময় কত দ্রুত চলে যায়। রাইসা এখন অনার্সে পড়ে।
প্রচন্ড মেধাবী আর নম্র। রোহানও লেখাপড়ায় খুব ভালো কিন্তু খুব দুষ্ট।
রোহান এবার এসএসসি দেবে। দুজনে মিলে সারা বাড়ি মাথায় করে রাখে।
রাইসা ভাইকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। ওর সারা পৃথিবী একদিকে আর ভাই অন্যদিকে।
কিন্তু এখনো আমি রাইসাকে মেনে নিতে পারিনি।
তারপর হঠাৎ একদিন কাব্য অফিস থেকে এসে অস্থির হয়ে পড়লো।
ওর নাকি বুকে খুব ব্যথা করছে।
আমরা কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি এম্বুলেন্স কল করলাম।
রাইসা আর রোহান কাব্যর কাছে বসে আছে।
কাব্য পানি খেতে চাইলে রাইসা এক গ্লাস পানি এনে কাব্যকে খাওয়ালো।
এরপর রাইসার কোলেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো।
এম্বুলেন্স আসার পর জানতে পারলাম কাব্য আর আমাদের মাঝে নেই।
পৃথিবীর সমস্ত সুখ ত্যাগ করে পাড়ি জমিয়েছে অন্য এক জগতে।
কথাটা শোনার সাথে সাথে রাইসা মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
রোহান ওর মুখে পানি ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে থাকে।
আর আমি শুধুই নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছি কাব্যর নিথর দেহের দিকে।
পরম মমতায় শুয়ে আছে রাইসার কোলে মাথা রেখে। মনে হচ্ছে যেন মা ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছে।
এভাবে হঠাৎ অসময়ে কাব্যর চলে যাওয়ায় আমাদের পরিবার সব দিক থেকে ভেঙ্গে পড়ে।
রাইসা একদিন আমার হাতে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বললো।
–“মা বেশি কিছু পারিনি। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে পার্টটাইম কাজ করেছি।
সামনের আমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেই ভালো কোন কাজ পেয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ্।
এই কয়েকটা মাস একটু কষ্ট করে চলতে হবে।
আর আমি ভাইয়ের পরীক্ষার ফিস ও দিয়ে এসেছি। তুমি আর চিন্তা করোনা।
এ কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে অঝোরে বৃষ্টি ঝড়ছে। সাথে সাথেই বুকে জড়িয়ে নিলাম রাইসাকে।
কাব্য চলে গেছে প্রায় তিন বছর হয়ে গেছে। রাইসা একটা সরকারি চাকরি করছে এখন।
আর রোহান এইচএসসি দিয়েছে। আমার সংসারে এখন আর কোনো সমস্যা নেই।
আজ রাইসার বিয়ে।
যদিও রাইসা আমাদের ছেড়ে যেতে চায়না তারপরেও মেয়েটা এই পর্যন্ত অনেক কষ্ট করেছে।
এইবার নাহয় একটু ভালো থাকুক।
নতুন বউয়ের সাজে বসে আছে আমার রাইসা।
আমি ওর কাছে যেতেই খেয়াল করলাম রাইসা কাঁদছে।
আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আর বললো।
–“মা, তোমার আর বাবার ঋন আমি কখনো শোধ করতে পারবো না। (রাইসা)
–“মা বাবার ঋন কি কখনো শোধ করা যায়?
–“মা বাবা না হয়েও তোমরা আমার জন্য যা করেছো………
–“কি বলছিস এইসব? মা বাবা না হয়ে মানে? আমরাই তোর মা বাবা।
–“মা আমি সবটা জানি।
তোমার ডায়রিটা আমি অনেক আগেই পড়েছিলাম।
তুমি যখন আমাকে এড়িয়ে চলতে এজন্য প্রথমে আমার খুব কষ্ট লাগতো।
কিন্তু পরে যখন জানতে পারলাম আমি একটা রাস্তার মেয়ে
তখন ভেবে উঠতে পারছিলাম না কীভাবে নিজেকে ক্ষমা করবো।
আমি ভুল বুঝেছিলাম তোমাকে। আমাকে ক্ষমা করে দিও মা গো।
তুমি চাইলেই আমাকে আবার রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিতে পারতে।
কিন্তু তুমি তা না করে আমাকে কখনো জানতেও দাওনি আমি ঠিক কে।
–“এক থাপ্পড়ে তোর সব দাঁত ফেলে দেবো। অনেক বড় হয়ে গেছিস তাই না।
কে বলছে তুই রাস্তার মেয়ে। তুই আমাদের মেয়ে, আমার আর তোর বাবার গর্ব।
জানি না কোন নেক আমলের জন্য আমরা তোকে মেয়ে হিসেবে পেয়েছিলাম।
(ঠিক তখন রোহান হঠাৎ করে ঘরে এসে)
–“মা মেয়ের “ভালোবাসায় এখন একটু ব্রেক দাও। জামাই চলে এসেছে।
তাড়াতাড়ি চলো মা। (রোহান)
–“হুম আসছি। আসছি……..
<>সমাপ্ত<>
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com