Breaking News

গল্পঃ তান্ডব!

থানার ওয়েটিং রুমে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে রাশেদ, বর বেশে।
হ্যা, ঠিকই পড়েছেন।
পরনে পায়জামা, শেরওয়ানি, মাথায় পাগড়ি।
কিউট একটা জামাই লুক নিয়ে চুপচাপ বসে আছে।
থানার পুলিশ কর্মকর্তারা একটু পরপর এসে দেখে যাচ্ছে তাকে।
ব্যাপারটা নজর এড়ায় না রাশেদের।
মাঝে মধ্যে লজ্জায় নাকে-মুখে রুমাল চেপে ধরছে সে।
কিছুক্ষণ পর একজন পুলিশ এসে দাঁড়ালো তার সামনে।
‘স্যার চা দিবো?’
‘না না। চা লাগবে না।’
‘ভালো কলা আছে। সাগর কলা। দেই?’
‘না ভাই, লাগবে না।’
‘তাহলে কী খাবেন? সেদ্ধ ডিম ছিল। দেবো?’
রাশেদ বোকার মতো পুলিশ লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো। আজব!
সে কি থানায় খাওয়া দাওয়া করতে আসছে নাকি!
রাশেদের চেহারা দেখে পুলিশ লোকটাও যেন একটু বিব্রতবোধ করলো।
মনে মনে ভাবলো, সেদ্ধ ডিমের কথা বলাটা হয়তো ঠিক হয়নি।
লোকটা এবার কিছু না বলেই সটকে পড়লো। রাশেদ নিজের হাতঘড়ি দেখে।
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। নীলা কোথায়?
রাশেদের সাথে নীলার পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকে। তাদের বাসা পাশাপাশি।
বলতে গেলে প্রায় একসাথেই বড় হয়েছে। কলেজে ওঠার পর নীলা সর্বপ্রথম রাশেদকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। সদ্য যৌবনে প্রবেশ করা যুবক রাশেদ সে প্রস্তাব বিনা সঙ্কোচেই গ্রহণ করে।
এরপর শুরু হয় তান্ডব। ওভার প্রটেক্টিভ নীলার কাছে রাশেদ যেন প্রেমিক নয়,
শিশু বাচ্চা। সারাক্ষণ ছায়ার মতো লেগে থাকে। ঠিক ছায়ার মতোনও না, ভূতের মতোন ঘাড়ে চেপে বসে থাকে।
রাশেদ কী খাচ্ছে, কখন ঘুমোচ্ছে, কখন পড়াশোনা করছে, কোথায় যায়,
বাসায় কখন থাকে আর কী করে এমন অসংখ্য ব্যাপারে নীলার সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল।
এই প্রেমের নামে তদন্ত অভিযান রাশেদের কাছে ক্রমেই বিরক্তিকর হয়ে ওঠে।
টানা চার বছর প্রেম করার পর তার মনে হয়, এই জীবনে প্রচুর প্রেম করে ফেলছে। আপাতত আর না।
তাই সে নীলাকে একদিন রেস্টুরেন্টে ডাকে। মনের কথা বলার পূর্বে ভরপুর পেটপূজো চললো।
কেননা নীলাকে খালিপেটে বা ক্ষিদে পেটে অবস্থায় ঘাটানো আর যমদূতের সাথে রঙ্গ-তামাশা করা সেইম লেভেলের বিপজ্জনক ব্যাপার।
‘নীলা।’
‘বলো সোনা।’
‘আমি আর পারছি না।’
‘তাহলে তুমি বসো। আমি খেয়ে সব শেষ করছি।’
‘আরে খাওয়ার কথা বলছি না। বলছিলাম যে, আমি আর এ রিলেশনে থাকতে পারছি না।’
রাশেদের কথা শুনে নীলা এক মুহূর্তের জন্যও ভড়কালো না। পিজ্জার বড় একটা টুকরো তুলে নিয়ে মুখে পুরলো। শান্ত চোখে রাশেদের দিকে তাকালো। এদিকে রাশেদের মনের ভেতর মহাপ্রলয় চলছে। ঠিক কত নম্বর বিপদ সংকেতের আভাস পাচ্ছে তা বলা মুশকিল। আর এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ।
‘আচ্ছা যাও, তোমার সাথে ব্রেকআপ।’
‘সত্যি? এত সহজেই!’
‘তাহলে কী ব্রেকআপ ক্যানসেল?’
‘আরে না না। ব্রেকআপই ঠিক আছে। আসলে আমি পড়াশোনায় মন দিতে চাই। আপাতত কোনরকম রিলেশনে থাকতে চাই না। খুব প্রেসার হয়ে যায়। বোঝোই তো, আমি পরিবারের বড় ছেলে। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি-বাকরি করতে হবে।’
‘হইছে। থামো। এসব তো শুনতে চাইনি। এনজয় ইউর ব্রেকআপ লাইফ। আর বিলটা দিয়ে দিও প্লিজ। নিজের টাকায় এক্সকে খাওয়ানোর মুডে নাই। টাটা।’
ব্রেকআপের পর নীলার সাথে রাশেদের দেখা-সাক্ষাৎ প্রায় হয় না বললেই চলে। যোগাযোগও নেই। পাশাপাশি বাসা হওয়া সত্বেও তাদের মধ্যে আকাশ-পাতাল দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। যেন দুজন দুই দেশ, না না, দুই গ্রহের বাসিন্দা! তবে রাশেদ তাতে ভীষণ খুশি। ব্রেকআপের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা সে উপভোগ করছে। কোনরকম প্যারা নাই। কোন মানসিক চাপ নাই। কারও কাছে কারণে-অকারণে জবাবদিহি করা লাগে না।
রাশেদ সত্যি সত্যিই পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে। সর্বোচ্চ মার্কস নিয়ে অনার্স-মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটি স্বনামধন্য ব্যাংকে চাকরিও পেয়ে যায়। আর চাকরি পাবার পরেই শুরু হয় তান্ডব পর্ব দুই! নীলা তার জীবনে ফিরে আসে। ঠিক ফিরে আসে বললে ভুল হবে, রাশেদের ঘাড়ে এসে ভর করে! রোজ তাকে কল দেওয়া শুরু করে নীলা। আলাপের এক পর্যায়ে জানতে পারে নীলা পুলিশে চাকরি করছে এবং বেশ বড় র‌্যাঙ্কে। শুনে গলা শুকিয়ে আসে রাশেদের। দুশ্চিন্তা তৈরি হয়, তবে কী তার প্রাক্তন প্রতিশোধ নিতে ফিরে এসেছে!
এরই মাঝে একদিনের ঘটনা। রাশেদ তার কলিগদের সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছে। খাওয়া দাওয়ার ফাঁকে হাসি-ঠাট্টা, গল্প-মজা চলছে। এমন সময় নীলার কল। রাশেদ কয়েকবার কল কেটে দেওয়ার পরও নীলা কল দিয়েই যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কল রিসিভ করতে হলো।
‘কিরে! কল কাটিস কেন?’
‘আমি ব্যস্ত আছি। আর তুমি আমার সাথে তুই-তোকারি করছো কেন?’
‘তাহলে কী করবো, চুমা খাবো?’
‘ধুর! কী যে বলো! এত রেগে আছো যে, কী হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি। তবে হতে পারে। পাশের মেয়ের কাছ থেকে উঠে অন্য কোথাও গিয়ে বস। আর লেগেপড়ে মেয়েদের সাথে গল্প করা বন্ধ কর। নইলে এমন মামলায় হাজতে ভড়বো, লজ্জায় পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলে গিয়ে থাকতে হবে।’
এটা বলেই কল কেটে দেয় নীলা। আশ্চর্যে, আতঙ্কে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে রাশেদ। আশপাশে তাকিয়ে নীলাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু তাকে দেখতে পায় না। এদিকে বুকের ভেতরে যেন কেউ পাগলের মতো ঘণ্টা বাজাচ্ছে। জীবনে এরকম ভয় খুব কমই পেয়েছে রাশেদ।
.
ভালো চাকরি পাবার একটা সাইড ইফেক্ট হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে বিয়ের প্রস্তাব আসে। রাশেদের বেলায় ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু মুশকিল হলো নীলা তাকে সারাদিনে অসংখ্যবার মেসেজ পাঠায়, কল দেয়। সবসময়ই ফাপড়ের উপর রাখে। তুই-তোকারি করে। এ মামলা সে মামলার ভয় দেখায়। কবে কখন কোথায় কোন আসামীকে ধরেছে, কী ট্রিটমেন্ট দিয়েছে সেগুলোর গল্প করে। সেসব শোনার পর আর বিয়ের কথা শুনতে ইচ্ছে করে না রাশেদের। অথচ বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিয়েই যাচ্ছে অনবরত।
এক বিকেলে রাশেদ ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে নীলাকে কল দিয়ে বসে।
‘নীলা।’
‘বল কী হইছে?’
‘বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।’
‘তো আমি কী করবো?’
‘আমার যতদূর বিশ্বাস, অন্য কাউকে বিয়ে করে আমি সুখী হতে পারবো না।’
‘গুড রিয়েলাইজেশন।’
‘তুমি কী আমাকে বিয়ে করবে?’
‘অফকোর্স। একশবার বিয়ে করবো। আমার বাসায় লোক পাঠাও। আমার তরফ থেকে অগ্রিম হ্যা রইলো।’
.
বাসা পাশাপাশি হওয়ায় দুই পরিবারের মধ্যে কোনরকম ঝুট-ঝামেলা হলো না। দুই পক্ষের মানুষ একে-অপরকে বেশ ভালো করেই চেনে। রাশেদ ওর বাবা-মাকে নিয়ে নীলার বাসায় গেল। বিয়ের পাকা কথা সম্পন্ন হলো। দিনক্ষণ ধার্য করাও হলো। এরপর চললো বিয়ের প্রস্তুতি।
কিন্তু বিয়ের দিন তান্ডব পর্ব তিনের দেখা মিললো। শুধু দেখা মিললো না কনের। দুপুরের একটু আগে নীলা জরুরী এক স্টিং অপারেশনের জন্য বেরিয়ে গেছে, কাউকে কিছু না বলেই। এদিকে বাসাভর্তি অতিথি। সবাই অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। রাশেদ নীলাকে অসংখ্যবার কল দিয়েছে। ধরে না। অবশেষে যখন রিসিভ করলো, জানালো সে থানাতে। রাশেদ তখনই থানায় রওনা দেয়। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে থানাতেই বসে রয়েছে। নীলার দেখা নেই।
রাত সাড়ে আটটার দিকে নীলার সাথে রাশেদের দেখা হলো। নীলা নিজেই ওয়েটিং রুমে এসে দেখা করলো। রাশেদের চেহারা তখন বাংলার পাঁচের মতোন হয়ে আছে।
‘কী গো জামাই, শরীর ভালো?’
‘হ্যা ভালো।’
‘মন ভালো?’
‘না।’
‘কেন? বিয়ে হয়নি সেজন্য?’
‘হ্যা।’
‘আসো, বিয়ে করে ফেলি।’
নীলার মুখে হাসি। ওর হাসিমুখের দিকে অপলক চেয়ে রইলো রাশেদ।
কিছুক্ষণ পর ওয়েটিং রুমে দুই পরিবারের মানুষ এসে উপস্থিত হলো।
নীলার মা একটি ব্যাগ এগিয়ে দিলো নীলাকে। সেটা নিয়ে সে পর মুহূর্তেই গায়েব।
এরই মাঝে তাদের সামনে পুলিশ সুপার পিয়াল মাহমুদ সাহেব এসে উপস্থিত হলেন।
তিনি বিনয়ের সাথে সবাইকে অভিবাদন জানালেন। সেইসাথে দুঃখও প্রকাশ করলেন।
একটি কুচক্রের চারজন মহিলা আসামীকে গ্রেফতার করতে স্টিং অপারেশন চালানো হয়েছে।
আর সেটা নীলাকে ছাড়া সম্ভব ছিল না। তাই বিয়ের দিনও নজর আন্দাজ করতে হয়েছে তাদেরকে।
পিয়াল সাহেবের কথায় সবাই সায় জানালো।
কেবলমাত্র রাশেদকে মুখ ভার করে এক কোণায় বসে থাকতে দেখা গেল।
.
কাজী ডেকে আনা হয়েছে থানায়।
পুলিশ সুপারের কক্ষে দুই পরিবার উপস্থিত।
সবার উপস্থিতিতে রাশেদ আর নীলার বিয়ে সম্পন্ন হলো।
বাড়ি থেকে আনা বিয়ের শাড়ি ও অন্যান্য অলঙ্কারে নীলাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।
রাশেদ রীতিমতো হা করে তাকিয়ে আছে নীলার দিকে। আনমনে চিন্তা করছে,
এই পরীর বাচ্চাটা যে একজন পুলিশ অফিসার সেটা কে বিশ্বাস করবে!
বিয়ে সম্পন্ন হবার পর সকলেই মিষ্টিমুখ করলো।
দুই পক্ষের মানুষজন বাসায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রাশেদকেও চলে যেতে হবে। নীলা যেতে পারছে না।
তার ডিউটি এখনো শেষ হয়নি। তদন্ত এবং বেশ কিছু পেপার ওয়ার্ক বাকি।
বাসায় যেতে যেতে সকাল হবে। রাশেদের দিকে এগিয়ে গেল সে।
‘ওগো শুনছো!’
‘কী?’
‘বাসর রাত তো একা একাই করতে হবে তোমাকে।’
‘জানি।’
‘আহারে! কষ্ট নিও না। আমার ছোট ভাইটাকে বলে রেখেছি,
ও গিয়ে তোমার সাথে থাকবে। লুডোর কোর্ট কিনে দিয়েছি।
দুজনে লুডো খেলে রাত পার করে দিতে পারবে।’
‘ধুর মিয়া!’
রাশেদ গাল ফুলিয়ে হাঁটা শুরু করে। পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে নীলা।
এভাবেই কিছু মুহূর্ত কেটে যায়। রাশেদের মুখে তখন হাসি লেগে আছে।
আর সে না তাকিয়েও বুঝতে পারে,
নীলার চোখে তখন অশ্রু। এটাকে হয়তো আনন্দ অশ্রু বলে।
‘নীলা।’
‘হুম।’
‘ভাবছি একটা ছোটখাটো অপরাধ করেই ফেলি। আসামী হিসেবে আমাকে নাহয় তোমার কাছে রেখে দিও।’
‘কী অপরাধ করবে?’
‘ধরো ডিউটিরত অবস্থায় এক মহিলা পুলিশ অফিসারকে চুমো দিয়ে দিলাম…!’
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! অপরাধটি করার কথা ছিল রাশেদের।
কিন্তু সেটা করে ফেললো স্বয়ং নীলা। রাশেদের আর করার কিছুই রইলো না। বেচারা!

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com