Breaking News

আবছা আলো । পর্ব -০৩

নিশিতাঃ শ্রাবণ চলে গেছে আজ দুমাস হয়ে গেছে,,,, তবে শ্রাবণের স্মৃতি আমার পিছু ছাড়ছে না,,, প্রতিটা মুহূর্তে মনে হয় শ্রাবণ আমার আশেপাশে আছে,,, কোনোদিন বলা হয়নি শ্রাবণ আমি তোমাকে ভালোবাসি,,, তবে শ্রাবণের কথাটাই সত্যি হয়েছে,,,, তার ভালোবাসা বুঝতে আমি অনেক দেরি করে ফেলেছি,,,, সত্যি অনেক দেড়ি,,,,,
শ্রাবণের মাঃ এই মেয়ে তোর রান্না হয়েছে,,,, সবাই কী না খেয়ে মরবে,,,,??
নিশিতাঃ না খালামুনি হয়ে গেছে,,,, আমি খাবার টেবিলে দিচ্ছি,,,, (খাবার টেবিলে সাজিয়ে গোসলে চলে গেলাম,,,, শ্রাবণ আর তার দেড় বছরের ছোট ভাই,,,, ছোট ভাইয়া সেই ছোটবেলা থেকে ঢাকায় পড়াশোনা করে,,, শ্রাবণ যেদিন মারা যায় সেদিন বর্ষণ ভাইয়া এসেছিলো,,, একবার দেখেছিলাম তাকে তারপর আমার আর কারো খোঁজ নেওয়ার মতো অবস্থা ছিলো না,,,তারপর আর এই দুই মাসে বাড়ি আসেনি,,,,,বাড়িতে আমি,, আর শ্রাবণের বাবা-মা আর কয়েকজন কাজের লোক ছাড়া কেউ থাকে না,,,, শ্রাবণের বাবার অনেক বড় কাঁচামালের ব্যবসা,,,, জমিজমাও আছে অনেক,,,,,,, শ্রাবণ সে সবই দেখাশোনা করতো,,, তারাই গ্রামের সবচেয়ে অবস্থা সম্পন্ন ,,,, সবাই শ্রাবণের বাবাকে খুব মানে,,,, গ্রামের একমাত্র শ্রাবণদের বাড়ি দুতলা আর অনেক বড় এড়িয়া,,,,, গোসল শেষ করে নামাজ পড়ে শ্রাবণের জন্য দোয়া করলাম,,,, তারপর খাবার খেতে আসলাম,,,,)
শ্রাবণের মাঃ খাবার দিয়েই মহারানী উধাও,,, কিছু লাগলে কে দিবে,,,??
নিশিতাঃ আসলে খালামুনি,,, আমি গোসল করে নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম,,,,, আর টুম্পা তো আছে,,,,
শ্রাবণের মাঃ মুখে মুখে কথা বলা আমার একদম পছন্দ না,,,,,
নিশিতাঃ( আর কিছু না বলে চুপচাপ খাবার বেড়ে দিতে লাগলাম,,, খালামুনি আমার সাথে ভালো করে কথা না বললেও কথা অন্তত বলে,,, কিন্তু খালুজান আমার সাথে একটা কথাও বলেনি শ্রাবণের মৃত্যুর পর,,, সবাই এটাই মনে করে শ্রাবণের মৃত্যুর জন্য আমি দ্বায়ী,,,,)
শ্রাবণের বাবাঃ চারমাস দশ দিন হতে আর কতদিন বাকি আমেনা (শ্রাবণের মা),,,??
নিশিতাঃ (কথাটা শুনে বুকের ভিতর ধক করে উঠলো,,, সত্যি কী এখান থেকে চলে যেতে হবে আমাকে,,,, কোথায় যাবো আমি,,,,?? ছোটখালার কাছে গিয়ে তার কষ্ট আর বাড়াতে পারবো না আমি,,, বড় ভাবির কথা আর সয্য করতে পারবো না,,,)
শ্রাবণের মাঃ আজকে দুইমাস,,,, (কান্না মিশ্রিত গলায়) আর দুই মাস দশ দিন,,,,
নিশিতাঃ(উনাদের খাবার দিয়ে নিজের,,, না না,, নিজের না,,, শ্রাবণের রুমে চলে এলাম,,,, বেডের সামনে দেয়ালে বড় একটা ছবি শ্রাবণের,,, মুখে মিষ্টি হাসি,,,, উনি অনেক হাসিখুশী মানুষ ছিলেন,,, সবসময় ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই থাকতো,,,, উনার এই ছবিটা দেখলে কেনো যেনো মনে হয় উনি আমার ভাগ্যের ওপর হাসছে,,,, বড় হিংসা হয় উনার ওপর,,, উনার পরিবর্তে আমি চলে গেলে কী ক্ষতি হতো,,,?? এতোদিনে নিশিতা নামটাও হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যেতো,,, কারণ নিশিতাকে মনে করার কেউ যে নেই,,,, চোখ গুলো আজকাল যেনো অটো হয়ে গেছে,,, যখন তখন পানি গড়িয়ে পড়ে,,)
★★★
বর্ষণঃ You know who am i,,,,??
,,,,,কে রে তুই,,, কোনো মিনিস্টারের ছেলে,,??
বর্ষণঃ বর্ষণ খান নিজের পরিচয়ে পরিচিত,,, অন্যের পরিচয় নিয়ে সে চলে না,,,,
,,,,,ব,,,বর্ষণ,,,, সরি স্যার ভুল হয়ে গেছে,,
বর্ষণঃ বর্ষণের কাছে ভুলের কোনো মাফ নেই আছে শাস্তি,,,,
(বর্ষণ খান,,,, পড়ালেখার কথা বলে ঢাকায় এসেছে,,, কিন্তু এখানে সে বিজনেস আর গুন্ডামী দুটোই করছে,,,, নতুন বিজনেস শুরু করেও এতো তাড়াতাড়ি সফল হওয়ার জন্য শত্রুও তৈরি করে ফেলেছে অনেক,,,, তাই গুন্ডামীটাও শুরু করে দিয়েছে,,, বর্ষনের কাজে ক্ষতি করার জন্য লোক পাঠালে,,,তারা বর্ষণের সামনেই পরেছে,,,, এখন সবগুলো হাসপাতালে আছে)
বর্ষণঃ আসসালামু আলাইকুম,,, বাবা,,,
শ্রাবণ/বর্সণের বাবাঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম,,,
বর্ষণঃ কেমন আছো,,,বাবা,,,??
বাবাঃ আলহামদুলিল্লাহ,,,, তুমি কেমন আছো,,,??
বর্ষণঃ আলহামদুলিল্লাহ,,,, বাড়ির সবাই কেমন আছে,,??
বাবাঃ সবাই ভালো আছে,,,
বর্ষণঃ সবাই বলতে সবাই,,,,,,??
বাবাঃ হুম,,, সবাই ভালো আছে,,,,
বর্ষণঃ ওহ্ ,,,,,, বাবা আমার আরো পঞ্চাশ লক্ষ টাকা লাগবে,,,,,
বাবাঃ এতো টাকা দিয়ে তুমি কী করছো বর্ষণ,,,,?? আজ প্রায় পাঁচ বছর ধরে তুমি কতো টাকা নিয়েছো তার হিসাবও হয়তো তোমার কাছে নেই,,, আমি যতো টাকা এই পর্যন্ত ইনকাম করেছি প্রায় সব টাকা তুমি নিয়ে গেছো,,,, আমি জিজ্ঞেস করলে বলো সময় হলে জানাবে,,,, আর কতো সময়,,,,, মনে রেখো পড়াশোনা আমিও করেছি যতো টাকা তুমি নিয়েছো ততো টাকা দিয়ে পুরো গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা হয়ে যাবে,,, তাই আমি জানি তুমি পড়াশোনার জন্য এই টাকা নাওনি,,,,, তাহলে,,??
বর্ষণঃ তুমিও কী আমাকে বিশ্বাস করো না,,,??
বাবাঃ বিশ্বাস করি বলেই এতোবছর ধরে তোমাকে এতো টাকা দিয়ে আসছি,,,, তবে কেনো দিচ্ছি সেটা জানার অধিকারও আমার আছে,,,
বর্ষণঃ এই বছরই শেষ,,, তারপর আর তোমার থেকে টাকা নিবো না,,, আর কেনো নিয়েছি সেটাও জানতে পারবে,,,,
বাবাঃ টাকা পরশু দিনের মধ্যে পেয়ে যাবে,,, মনে রেখো তোমার হাতে আর ছয়মাস সময় আছে,,,,
বর্ষণঃ মনে থাকবে,,,, বাড়ির সবার খেয়াল রেখো,,,
বাবাঃ বাড়ি কবে আসবে,,,?? অনেকদিন তো হলো,,,
বর্ষণঃ এই মাসে যেতে পারি,,, তবে সিউর বলতে পারছি না,,,
বাবাঃ ঠিক আছে,,, তুমি নিজের খেয়াল রেখো,,,,
বর্ষণঃ হুম,,,, আল্লাহ হাফেজ,,, (ফোন রেখে,,) রবি বাকি টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে,,, প্রজেক্ট কমপ্লিট কর,,, এবার কথায় না,,, কাজে উত্তর দিবো ঐ রাস্কেলদের,,,(কী করতে হবে রবিকে সব বুঝিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে আসলাম,,,,?? সোজা চলে গেলাম ফ্ল্যাটে,,,, আমার ইন্জিনিয়ারিং শেষ হয়েছে আরো তিন বছর আগে,,,, এখন কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা করি,,,, প্রজেক্ট ডিজাইন করা এবং প্রজেক্টে কোন প্রবলেম হলে তা দেখার দ্বায়িত্ব আমার আর রবির কাজ হলো আমার ডিজাইন অনুযায়ী প্রজেক্ট তৈরি করা,,,, আমাদের কোম্পানির ৭০% শেয়ার আমার আর বাকি ৩০% সবার,,,,কোম্পানির
সদস্য সব আমার ফ্রেন্ড সার্কেল,,,,।
বাবার থেকে নেওয়া সব টাকা আর ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে এই কোম্পানি দাড় করিয়েছি একটু একটু করে,,,,
এই প্রজেক্ট কমপ্লিট করতে পারলে ব্যাংক লোন আর বাবার সব টাকা পরিশোধ করতে পারবো,,,
আমার এই বিজনেসের কথা বাড়ির কেউ জানে না,,,
আমি করে দেখিয়েছি,,,, ছোটবেলায় শোনা একটা কথা আজ আমাকে এখানে দাঁড় করিয়েছে,,,,
কিন্তু যার সাথে আমার এতো প্রতিযোগীতা সেই তো চলে গেছে,,,,
আমি সত্যি চাইনি তুই এভাবে চলে যাস ভাইয়া,,,,
চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো,,,,
তুই যখন পাশে ছিলি তোকে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়া কিছুই ভাবিনি,,, কখনো ভাইয়া বলেও ডাকিনি,,,,,
একটা ছবির এলবাম নিয়ে বেডে বসে পড়লাম,,,,
আমার আর ভাইয়ার অনেক ছবি,,,,
তবে একটা ছবিতেও আমার চোখেমুখে ভাইয়ার জন্য ভালোবাসা নেই,,,,
তোর জন্য ভালোবাসা তো সেদিন উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম,,,,
যেদিন তোকে হারিয়ে ফেললাম,,,। জানিস ভাইয়া ভেবেছিলাম এই প্রজেক্ট শেষ হলে ব্যাংক লোন আর বাবার টাকা পরিশোধ করে সবার সামনে আনবো আমার যোগ্যতা,,,,
তোকে দেখিয়ে বলবো,,, দেখ মিস্টার শ্রাবণ খান,,,
যোগ্যতা শুধু তোর একার নেই,,,,
আমারও আছে,,, তোর থেকে বেশি,,,, কিন্তু এখন এসব আমি কাকে দেখাবো,,,,, একটা ছবিতে গিয়ে থেমে গেলাম,,,,। নিশি,,,,,,,, চোখগুলো ভরে এলো,,, তোর ভালোর জন্যই তো তোদের মাঝে থেকে সরে এসেছিলাম,,,
তবে এটা কেমন ভালো হলো রে নিশি,,,, কেমন,,,?? তুই সত্যি অভাগা রে নিশি,,,
ছোট খালামুনিঃ নিশু,,,,,,,,,,
নিশিতাঃ খালামুনি,,,,(আছরের নামাজ পড়ে রুমটা একটু গুছাচ্ছিলাম ,,,,,
হঠাৎ খালামুনির গলা শুনে এতো ভালো লাগছে বলে বুঝাতে পারবো না,,,
আমার কাছে খালামুনিই যে মা,,,, পেছনে ঘুরে খালামুনিকে দেখতে পেলাম)
খালামুনিঃ কেমন আছিস মা,,,(জড়িয়ে ধরে)
নিশিতাঃ ভালো,,, তুমি,,,
খালামুনিঃ তোকে ছাড়া যতটা ভালো থাকা যায়,,, তোকে নিতে এসেছি,,,,
বড় খালামুনিঃ এখনো আরো দুমাস দশদিন বাকি আছে,,,
তার আগে এই বাড়ির বাইরে পা রাখবে না ও,,,
খালামুনিঃ আপা তোমার খালা শাশুড়ী তো চলে গেছেন তাহলে এখন আটকে রাখছো কোনো,,,??
বড় খালামুনিঃ খালাম্মা চলে গেছেন,,, কিন্তু নিয়ম সাথে নিয়ে যান নি,,,
নিয়ম পালন শেষ করে তবেই ও যাবে,,,, তাছাড়াও বর্ষণ আসছে বাড়িতে,,,
আমি অসুস্থ বাড়ির কাজ কে করবে,,,??
খালামুনিঃ বর্ষণ বাবা কবে আসবে,,,
বড় খালামুনিঃ বলেছে এই মাসে আসবে,,, কবে আসবে কিছু বলেনি,,,
খালামুনিঃ বাড়িতে তো এতো কাজের লোক আছে,,, নিশিতা না থাকলেই বা কী,,,,??
বড় খালামুনিঃ আমি এতো কথা বলতে চাই না,,, ও কোথাও যাবে না এখন,,,
নিশিতাঃ বড় খালামুনি ঠিক বলেছে,,, আমিও কোথাও যেতে চাই না এখন,,,।
মানুষের সামনে যেতে ভালো লাগে না,,, এভাবেই ভালো লাগে,,,
বড় খালামুনিঃ মানুষের সামনে যাবি কীভাবে,,,,?? সবাই তোর মুখ দেখতেও ভয় পায়,,,
না জানি তোর মুখ দেখে কার কোন বিপদ হয়,,, অপয়া,,, অলক্ষি
,,,, আমার সাজানো সংসারটা শেষ করে দিয়েছে,,, (কাঁদতে কাঁদতে,,,,)
নিশিতাঃ খালামুনি তুমি কী আজ থাকবে,,??
খালামুনিঃ না রে,,, তোকে নিতে এসেছিলাম,,,
কিন্তু তা যখন হলো না এখনই চলে যাবো,,,,
আসছি,,(কপালে চুমু দিয়ে) আপার কথায় কষ্ট পাস না,,,
শ্রাবণ আপার নয়নের মণি ছিলো,,, তার কষ্টটাও বুঝার চেষ্টা করিস,,, আসছি,,,
নিশিতাঃ(খালামুনি চলে গেলো রুম থেকে,,,, আমি আস্তে আস্তে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম,,,,
সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে,,,,,
খালামুনি বাড়ির সামনে থেকে রিকশায় ওঠে বসলো,,,
গ্রামগুলো আর আগের মতো নেই,,, উন্নত হয়ে গেছে,,,, .
সবুজ ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে পিচঢালা ঝকঝকে পাকা রাস্তা,,, অন্যরকম সুন্দর লাগে,,,,
এই বাড়ির ছাদে দাঁড়ালে চারপাশে নানা ফল গাছের বাগান চোখে পরে,,,
সবই শ্রাবণদের,,, বড্ড ইচ্ছে করে এই বাগান গুলোতে ঘুরে ঘুরে আম,,, জাম,,,
পেয়ারা পেরে খেতে,,,। কিন্তু আমার জীবন যে চার দেয়ালের মাঝে আটকে গেছে,,,
নিয়তির বেড়াজালে বন্দী আমি,,,, সূর্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে,,, চারদিকে  আবছা আলো,,,,
আর আমার জীবনে নিকষকালো অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি,,,,
কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষেরই অনল জ্বলে গইয়া গইয়া।
ঘর বাঁধলাম প্রাণবন্ধের সনে
কত কথা ছিল মনে গো।।
ভাঙ্গিল আদরের জোড়া।।
কোনজন বাদী হইয়া।
জ্বলে গইয়া গইয়া।
কার ফলন্ত গাছ উখারিলাম
কারে পুত্র শোকে গালি দিলাম গো ,
না জানি কোন অভিশাপে
এমন গেল হইয়া।
জ্বলে গইয়া গইয়া।
কথা ছিল সঙ্গে নিব
সঙ্গে আমায় নাহি নিল গো।।
রাধারমন ভবে রইল ।।
জিতে মরা হইয়া।
জ্বলে গইয়া গইয়া।
কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া,
অন্তরে তুষেরই অনল জ্বলে গইয়া গইয়া।
চলবে…

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com