এক রক্তিম শ্রাবণে | পর্ব-০২
নিশার পাশে বসে একমনে তার হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিচ্ছে তোহা।তার চোখে মুখে প্রবল আড়ষ্টভাব।মুখে হাসি নেই।থমথমে চেহারা।তার গুমোট চেহারার দিকে তাকিয়ে নিশা ফিসফিসিয়ে বললো,
—“কি হয়েছে তোর?মুখের এমন অবস্থা বানিয়ে রেখেছিস কেন?”
তোহা শীতল কন্ঠে উওর দিলো,
—“কিছু হয়নি।”
নিশা ভ্রু কুঁচকে তাকায়।তার মেহেদির অনুষ্ঠান নিয়ে তোহার ই সবচেয়ে বেশি এক্সসাইটমেন্ট ছিলো।কে কোন রংয়ের শাড়ি-পান্জাবি পড়বে সব সে ই ঠি ক করেছে।তবে এখন এতো চুপচাপ কেন?তার তো এখন হইহুল্লোর করার কথা।
নিশা আবারো বললো,
—“কিছু হয়েছে তোহা?শরীর খারাপ লাগছে?”
তোহা এবার শক্ত কন্ঠে বললো,
—“বললাম তো আপু,কিছু হয়নি।আমি ঠি ক আছি।”
নিশা আর কিছু বললোনা।চুপ করে গেলো।মেয়েটার হঠাৎ কি হলো কে জানে!
মিনিটদশেক আগে একপ্রকার দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে তোহা।তিহানের মুখ থেকে সে কথাগুলো শোনার পর আর একমূহুর্ত সেখানে দাড়ায়নি।তিহান তাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই সে চলে এসেছে।তবে এখন মনে হচ্ছে,তার তিহানের কথাটা শোনা উচিত ছিলো।কারণ সে এতটুকু জানে যে তিহান অন্তত এমন মানুষ নয় যে কিনা লুকিয়ে লুকিয়ে তার শাড়ি পরা দেখবে বা তার দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকাবে।তেমনটা তিহান নয়,সে জানে।
তখন হঠাৎ করে তিহানের ওমন কথা আর বলার ভঙ্গি দেখে সেই সময়টায় তার ছোট্ট মস্তিষ্কে আর কিছু আসেনি।
তিহানের কথাটা তার সত্যিই মনে হয়েছিলো।কিন্তু এখন?এখন মনে হচ্ছে তিহান মজা করছিলো।
জোরে সাউন্ডে গান বাজানো হচ্ছে।সামনে নিশা আপুর কয়েকজন মেয়ে বান্ধবী উরাধুরা নাচ করছে।একেকজনের শাড়ি টারির যাচ্ছে তাই অবস্থা।বাড়ির বড়টা এদিকটায় নেই।এখানে সব কাজিনরা।বড়টা থাকলে হয়তো এভাবে নাচার কোন সাহস পেতোনা তারা।
খুব সম্ভবত তিহান তখন এদের কথাই বলছিলো।মেয়েগুলো আসলেই খুব উগ্র টাইপের।
এককোণায় দাড়িয়ে রয়েছে তার ভাইয়েরা।তার আর নিশার বড়ভাই তূর্য।আর তার ছোট খালামনির দুই ছেলে নুহাশ আর সাইফ।তারা আড্ডায় মশগুল।এদিকের অনুষ্ঠান নিয়ে তাদের ধ্যান ধারণা নেই।
তিহান তার বড় খালামনির একমাত্র ছেলে।বড় খালামনিরা তাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে।আর ছোট খালা থাকে অনেক দুরে।নিশার বিয়ে উপলক্ষে একসপ্তাহের জন্য এখানে এসেছে।তার বাবার কোন ভাইবোন নেই বিধায় তাদের কোন ফুফাতো ভাইবোনও নেই।
চুপচাপ মেহেদি লাগাচ্ছে তোহা।দুহাতে সে একা লাগাতে পারবেনা তাই ওপাশের হাতে স্বর্ণালি মেহেদি লাগিয়ে দিচ্ছে।স্বর্ণালি তার ছোট খালার মেয়ে।নুহাশ আর সাইফের ছোট বোন।কিন্তু বয়সে তার থেকে দেড় বছরের বড়।
নিশার বান্ধবীদের নাচানাচি থেমেছে একটু আগে।ক্লান্ত ভঙ্গিতে তারা সামনের চেয়ারে বসে আছে।
একনাগাড়ে এতক্ষণ বসে থাকতে থাকতে নিশার পা ধরে যাচ্ছে।চোখমুখ কুঁচকে সে বললো,
—“আর কতক্ষণ লাগবে রে তোদের?অসহ্য লাগছে আমার”
তোহা শান্ত চাহনীতে তাকালো।তার বোনটা বরাবরই ধৈর্যহীন।বললো,
—“আরো আধা ঘন্টাতো লাগবেই বা তার বেশিও…”।
পুরা বাক্য শেষ করার আগেই তিহানের ঝাঁঝালো কন্ঠ শোনা গেলো,
—“এই তিহু উঠ তো।সেই কখন থেকে পাশের সিট দখল করে বসেছিস।আমরাতো ছবিই তুলতে পারলামনা নিশার সাথে।উঠ!”
তোহা চমকে তাকালো।তিহানের সাথে নুহাশ আর সাইফও আছে।পরক্ষনেই দৃষ্টি নামিয়ে ভাবলো,তিহান কখন এলো এখানে?সে না ঘুমিয়েছিলো?
তিহান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে।তোহা উঠছেনা দেখে সে মৃদু ধমকের স্বরে আবারো বললো,
—“উঠ না।বসবো কোথায়?”
দ্রুত উঠে দাড়ালো তোহা।আবারো লজ্জা লাগছে তার।তিহান তার থেকে একটু দুরত্বে দাড়িয়ে আছে। তাড়াহুড়ো করে পা বাড়াতে যেয়ে হাতে থাকা খোলা মেহেদির কোণে জোরে চাপ লেগে প্রায় অনেকটা মেহেদি ছিঁটকে তিহানের পান্জাবিতে পরলো।আৎকে উঠলো তোহা।এখনই এটা হতে হলো?ধ্যাত্।
হন্তদন্ত কন্ঠে সে বললো,
—“সরি,আমি…মুছে দিচ্ছি।”
বলে হাত দিয়ে সেটা মুছতে যেয়ে আরো লেপ্টে ফেললো।ফলস্বরূপ তার হাতেও মেখে গেলো অনেকটা।নিশা বিরক্তিকর কন্ঠে বললো,
—“কি করলি তোহা?পান্জাবিটাতো পুরো নষ্ট হয়ে গেলো।তুই কি একটা কাজও…”
তিহান তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলো।পকেট থেকে টি স্যু বের করে একপলক তোহার দিকে তাকিয়ে নিজের পান্জাবি মুছতে মুছতে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—“সমস্যা নেই।”
অত:পর সবার সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।
তোহা চুপ করে এককোণায় যেয়ে দাড়ালো।মুখের ভারি ভাবটা আরো ভারি হয়েছে।তার হাতে এবড়োথেবড়ো ভাবে লাগা মেহেদিতে রং হয়ে যাচ্ছে।আশেপাশে মোছার জন্য কিছু পাচ্ছেও না।তিহানের মতো সেতো আর পকেটে টি স্যু নিয়ে ঘুরেনা।
চোখ জ্বালা করছে।সবকিছু অসহ্য লাগছে।ঘড়ির দিকে তাকালো সে।রাত দশটা বাজে।তার হাতে এখনো মেহেদি লাগানো হয়নি।আহত দৃষ্টিতে মেহেদি রাখা ডালার দিকে তাকালো সে।ডালা সম্পূর্ণ খালি।আপুর বান্ববীরা আর সবাই মিলে সব লাগিয়ে নিয়েছে।আর তার হাতে যেটা আছে সেটা দিয়ে নিশাকে লাগিয়ে দিতে হবে।
সুতরাং সে মেহেদি লাগাতে পারবেনা।আর এতরাতে কে ই বা তাকে নতুন করে কিনে এনে দিবে?”
হঠাৎ হাতে কিছু একটা অনুভব হতেই দ্রুত সেদিকে তাকালো তোহা।তার পাশে দাড়িয়ে আছে তিহান।
মেহেদি লাগা হাতটা আলতো করে ধরে নিজের রুমাল দিয়ে যত্ন করে তা মুছিয়ে দিচ্ছে তিহান।
তার দৃষ্টি তোহার হাতের দিকে।তোহা দ্রুত তার ভাইবোনদের দিকে তাকালো।নাহ্,সবাই ছবি তুলাতুলিকে মশগুল।এদিকে কারো নজর নেই।
তিহান হাতের দিকে তাকিয়েই একেবারে শান্ত কিন্তু অন্তত কঠোর কন্ঠে বললো,
—“তখন কিছুই দেখিনি আমি।আয়নার কথাটা মজা করে বলেছিলাম।আর তুই গাধী কিছু না বুঝেই ভোঁ
দৌড় দিলি।নিজের রুমে যেয়ে দেখিস।তোর ড্রেসিং টেবিলটা বাঁকিয়ে রাখা।বিছানা থেকে শোয়া অবস্থায় আলমারির আয়নায় তোর ড্রেসিং টেবিল না বরং ওয়াশরুম আর বারান্দার দরজা দেখা যায়।
পুরা কথা শুনে তারপর রিয়েক্ট করতে হয়।স্বর্ণা তোকে ডাকার আরো অনেকক্ষণ পরে উঠেছি আমি।যখন বুঝেছি তুই সম্পূর্ণ রেডি তখন।শাড়ির সরে রয়েছিলো তাই রাগের মাথায় বকে ফেলেছি আর সেজন্য আমি একদমই সরি না।
কারণ আমি সেটা ঠিক না করলে তুই ওটা ঠিক করার কথা মাথায়ও আনতি না,তা আমার জানা আছে।
আর তখন সত্যই মেহমান দিয়ে রুম ভর্তি ছিলো।আমাদের ফ্ল্যাটের চাবি ছিলো বাবার কাছে আর বাবা বাইরে বেরিয়েছিলো।নিশার রুমে খালা-খালুরা ছিলো।তাদেরকেতো আমি মুখের উপর বের হতে বলতে পারিনা ওপর মাথাটাও খুব ধরেছিলো তাই বাধ্য হয়েই তোর রুমে ঘুমাতে গিয়েছিলাম নয়তো কখনোই যেতাম না।
বলে তোহার হাতটা ছেড়ে দিলো তিহান।রুমালটা পকেটে ঢুকিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নিজের কপালের ঘাম মুছলো।তার চোখে স্পষ্ট অভিমান।তোহা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে।আসলেই সে এত বোকা কেনো?তিহানকে সে কিভাবে অবিশ্বাস করতে পারলো?এখনতো নিজের উপরই বিরক্ত লাগছে।অসহ্যকর!
রাত ১২টা…
মুখের মেক-আপ তুলে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো তোহা।মেহমানরা সব চলে গিয়েছে।
তার রুমে কেউ নেই।সে কখনো রুম শেয়ার করতে পারেনা।নিশা আপু,স্বর্ণালি আপু এক রুমে ঘুমিয়েছে।
তিহান ভাইদের ফ্ল্যাটে তিহান ভাইয়ের সাথে নুহাশ আর সাইফ ভাইয়া ঘুমিয়েছে।আর ছোটখালু আর তার বাবা তুর্য ভাইয়ার রুমে।তুর্য ভাইয়া ড্রইংরুমের সোফায় ঘুমিয়ে আছে।আর মা-ছোটখালা একরুমে।
শুধু তার রুমটাই খালি।
পরণের শাড়ি পাল্টে তোহার পরণে এখন সাদামাটা থ্রিপিস।চুলগুলো হাতখোঁপা করা।চোখেমুখ বিষন্নতার ছাঁপ।
বাড়ির সবার হাতে মেহেদি থাকলেও তার হাতে নেই।তার হাতটা মলিন,সাদা।কারণ মেহেদি শেষ।এতরাতে দোকান বন্ধ।কই পাবে সে মেহেদি?তাই কাউকে আনতেও বলেনি।
টলমলে পায়ে পড়ার টেবিলের ড্রয়ারটা খুললো তোহা।সেখানে নিজের ফোন বন্ধ করে রেখে গিয়েছিলো সে।তার ধারণা অনুষ্ঠানে ফোন নিয়ে গেলেই ফোনটা কোনোভাবে হারিয়ে ফেলবে সে।এর আগেও দুইবার ফোন হারিয়েছে।এরপর থেকে আর কোনো অনুষ্ঠানে ফোন নিয়ে যায়না সে।
ড্রয়ারটা খুলতেই চোখজোড়া বিস্ময়ে,খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো তোহার।মুখের বিষন্নতার ছাপটা চওড়া প্রশস্ত হাসির আড়ালে মিলিয়ে গেলো।ড্রয়ারের সামনেই একটা নতুন মেহেদির প্যাকেট রাখা।
সে দ্রুত সেটা হাতে নিল।
অত:পর ফোনটা অন করতেই মেসেজের টুংটাং শব্দে ঠোঁটের হাসিটা আরো একটু ঝলমলিয়ে উঠলো।
তিহানের নাম্বার থেকে মেসেজের এসেছে।সেখানে বাংলা ফন্টে লেখা ছোট্ট একটা মেসেজ–
“কাল সকালে মেহেদি রাঙা হাত ছাড়া চোখের সামনে আসবিনা।”
চলবে..
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com