এক রক্তিম শ্রাবণে
তিহান ভাই,আপনি বাইরে জাননা।আমি শাড়ি পড়ছিতো।”শাড়ির আচঁলটা কোনরকম পেঁচিয়ে দুহাতে আঁকড়ে ধরে বললো তোহা।তবে তার কথায় তিহানের কোনরূপ হেলদোল প্রকাশ পেলো না।সে নির্বিকার ভঙ্গিতে দরজার ছিটকিনি উপরের দিকটায় তুলে দিলো।তোহা ড্রেসিং টেবিলের গা ঘেঁষে মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে রয়েছে।হাতের এদিক ওদিক দিয়ে ছুটে যাচ্ছে অগোছালো শাড়ি।
তিহান তার দিকে তাকালো পর্যন্ত না।তার দৃষ্টি সামনের দিকে।সে সোজা গিয়ে তোহার বিছানায় বসে জুতো খুলে পা তুলতে তুলতে বললো,
—“তোহ্?তুই পড়না শাড়ি।আমি বারণ করেছি?”
তোহা চোখজোড়া সংকুচিত করে তাকালো।অনুরোধের স্বরে মিনমিনে কন্ঠে বললো,
—“তিহান ভাই প্লিজ,দেখুন সবাই অনেক আগেই তৈরি হয়ে রয়েছে।শুধু আমিই বাকি।”
তিহান তার কথা তোয়াক্কা করলো না।আয়েশি ভঙ্গিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে পরণের অফ ওয়াইট রংয়ের পান্জাবির উপরের বোতামগুলো খুলতে খুলতে বিরক্তিকর কন্ঠে বললো,
—“দেখ তিহু,ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।প্রচুর ঘুম পাচ্ছে আমার।অন্য কোন রুম ফাঁকা নেই।বাড়িভর্তি মেয়েলোক দিয়ে ভরা।কেমন গা গিজ গিজ করছে।তার উপর তোর বাবা না জানি কোথাকার মানুষজনকে দাওয়াত দিয়েছে।মেয়েগুলোতো খুবই গায়ে পরা স্বভাবের।সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে চাচ্ছিনা,তুই লজ্জা পাবি।মুল কথা হলো,তোর রুমটাই খালি আছে।ঘুমাতে দে।ব্যাস!”
তিহানের এতগুলো কথায় তোহা বোকা বোকা চাহনী নি:ক্ষেপ করে দাড়িয়ে রইলো।তিহান চোখ বন্ধ করে একটা হাত কপালে রেখে শান্তিমত শুয়ে রয়েছে।কেউ যেন আশেপাশে নেই।তোহার উপস্থিতি একেবারেই নগন্য।
তোহা চিন্তিত ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।ভাবলো,”তারমানে উনি এখন এ ঘরে ঘুমাবেন?তবে?আমি তৈরি হবো কিকরে?নিজের বোনের মেহেদির অনুষ্ঠানে কি আমার যাওয়াই হবেনা?”
অত:পর কিছুক্ষন এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা খাটিয়ে বললো,
—“অনুষ্ঠান শুরু হবে একটু পরে।আপনি এখন ঘুমাবেন?”
তিহান তাকালো না।আগের মতোই শুয়ে চোখ বন্ধ অবস্থাতে বললো,
—“সারাদিন অনেক খেটেছি।তোর বাপ-ভাইরাতো আমাকে বিনা বেতনে কর্মচারী রেখে দিয়েছে।ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারিনা।আর এই মেয়েলোকি মেহেদির অনুষ্ঠানে আমার থেকে কাজ নেই।তুই সেজেগুজে,যাতো।কানের সামনে অহেতুক চ্যান চ্যান করিসনা।”
তোহা কিছুটা সময় নিয়ে ভাবলো,এই “চ্যান চ্যান” কথাটার মানে কি?।উনার ভান্ডারেই যতসব উদ্ভুত কথাবার্তার উৎপত্তি।
বাইরে গানের শব্দ শোনা যাচ্ছে।তারমানে নাচগান শুরু হয়ে গেছে।হঠাৎই কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো তোহার চেহারা।তবে পানি বের হলোনা।কারণ তার সচল মস্তিষ্ক জানে যে কাঁদলে সাজ নষ্ট হয়ে যাবে।কাজল লেপ্টে যাবে।অত:পর ঠি ক ভুতের মতো দেখাবে তাকে।তা তো হতে দাওয়া যাবেনা।
কিছু সময় পর ধৈর্যহারা হয়ে এবার সে সরাসরিই বললো,
—“আমি আপনার সামনে শাড়ি পরতে পারবোনা।”তার কন্ঠে স্পষ্ট তীব্র দৃঢ়ভাব।
তিহান কোন কথা বললো না।তবে পরমুহূর্তেই বামকাত হয়ে ফিরে শুলো।নিজেই তোহার কাঁথাটা খুলে গায়ে টেনে নিয়ে তীক্ষ্ণ ভরাট কন্ঠে সাবধানী বাণী সমেত বললো,
—“ঘুরে শুয়েছি।আর একটা কথাও যদি বলিস,একেবারে সব খুলে চোখের সামনে বসিয়ে রাখবো।বলে দিলাম।”
তোহা আৎকে উঠলো।হৃদপিন্ডটা বারকয়েক লাফিয়ে শান্ত হয়ে গেলো।ভাবলো,উনার বিশ্বাস নেই।রাগের মাথায় দেখা যাবে সত্যিই সত্যিই যা বললেন তাই করবেন।কি বিশ্রি একটা কান্ডই না হবে!
আরেকবার তিহানকে সচেতন দৃষ্টিতে দেখে নিলো তোহা।গলাপর্যন্ত কাঁথা টেনে উল্টোদিকে ঘুরে কপালে হাত ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে তিহান।সুতরাং তার দিকে তাকানোর কোনো উপায় নেই।সে নিশ্চিন্ত মনে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে কোনরকম গায়ে জড়ানো আঁচলটা সরিয়ে রাখলো।
মনোযোগ দিয়ে কুঁচি করছে তখনই দরজায় খটখট শব্দ হলো।স্বর্ণালি আপুর কন্ঠ শোনা যাচ্ছে,
—“তোহা,আর কতোক্ষন লাগবে রে তোর?তোর বোনের মেহেদি আর তুই ই দরজা আটকে বসে আছিস।”
তোহা দ্রুত কুঁচিটা গুঁজে নিলো।গলা বাড়িয়ে বললো,
—“হয়ে গেছে আপু,আসছি।”
—“আয় জলদি।নিশাকে তো তুই ই মেহেদি পরিয়ে দিবি।ও অপেক্ষা করছে।”
—“হ্যাঁ,আসছি।যাও তুমি।”
আর কোন কথা শোনা গেলোনা স্বর্ণালির।তবে তার খালামনির কন্ঠ শোনা গেলো।তিনি ব্যস্ত কন্ঠে স্বর্ণালিকে বলছে,”এই তিহানটা কই গেলো রে স্বর্না?কই সাথে সাথে থাকবে,নিশ্চয় বাইরে বেরিয়েছে।
আচঁলটা সুন্দরকরে গায়ে জড়িয়ে কানে,গলায়,হাতে ফুলের গহনাগুলো পরে নিলো তোহা।তার আর তার বড়বোন নিশার জন্যই শুধু তাজা ফুলের গহনা আনানো হয়েছে।বাকিদের সবার আর্টিফিসিয়াল ফুল।মূলত শুধু নিশার জন্যই তাজা ফুলের গহনা অর্ডার দেয়া হয়েছিলো।সে যেহেতু বউ তাই ওকেই এটা মানাবে।কিন্তু বিকালের দিকে যখন গহনা আনা হলো তখন একদেখাতেই সেটা প্রচন্ড ভালো লেগে গিয়েছিলো তোহার।তখনই সে বলেছে যে তার তাজা ফুলের গহনাই লাগবে।নিশার মতো অতো বেশি ভারি ফুলের নয় নরমাল হলেই চলবে কিন্তু তবুও তার লাগবে।কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কিভাবে তাকে গহনা এনে দিবে?কারণ তাজা ফুলের গহনা একদিন আগে অর্ডার দিতে হয়।
শেষমেষ তার আবদারের কাছে হেরে গিয়ে সন্ধ্যার দিকে তিহান কোত্থেকে যেন মেনেজ করে এনে দিয়েছে।
সাথে একটা বেলিফুলের গাজরাও এনেছে।সেটার তীব্র সুঘ্রানে রুম ভরে গেছে।সুবাসিত হয়ে গেছে চারিপাশ।
তোহা খোঁপায় বেলিফুলের গাজরাটা পরছে তখনই তিহান সশব্দে উঠে বিছানা থেকে নেমে গেলো।তোহার দিকে এগিয়ে আসতেই সে গাজরাটা ক্লিপ দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,
—“কি হয়েছে?আমি শব্দ করিনিতো,আপনি ঘুমাননা”
তিহান উওর দিলোনা।ড্রেসিং টেবিলে কি যেন একটা খুঁজলো।কাঙ্খিত জিনিসটা খুজে পেতেই সেটা হাতে নিয়ে সামনে একহাঁটু গেড়ে বসে পরলো।তোহা ভ্রু কুচকে তাকালো।তিহানের হাতে একটা সেফটিপিন।অদ্ভুততো!সে কি করতে চাচ্ছে!বাকিটা ভাববার আগেই তিহান তার শাড়ির আচঁল টেনে নিলো।কোমড়ের দিকটা ঢেকে পিন লাগাতে লাগাতে ক্ষীপ্ত উত্তপ্ত কন্ঠে বললো,
—“বেয়াদপ মেয়ে!দিন দিন চরম অসভ্য হচ্ছিস।এমন অভদ্রদের মতো শাড়ি পরেছিস কেনো?”
তিহানের ধমকে আর বিচ্ছিরি কথা বার্তায় মনটা বিষিয়ে এলো তোহার।কাঁদোকাঁদো ভাবে বিষন্ন কন্ঠে সে বললো,
—“ওটা আমিই লাগিয়ে নিতাম তিহান ভাই”।
তিহান তার কথাটা গায়ে নিলো না।মন দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলো।অদ্ভুত হলেও সত্যি তার আঙ্গুলগুলো একবারের জন্য ভুল করে হলেও তোহার কোমড় স্পর্শ করেনি।খুব সন্তর্পনে সাবধানতার সাথে পিনটা আটকে দিয়ে উঠে দাড়ালো সে।
তখনও চুলের ক্লিপটা লাগাতে সফল হয়নি তোহা।তিহান তার পিছে দাড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—“হাত সরা”।
তিহানের রাশভারি কন্ঠের এহেন আদেশে তোহার হাতদুটো অটোমেটিক সরে গেল।
কোনরকম হাতদুটো গুটিয়ে দৃষ্টি নিচের দিকে দিয়ে রয়েছে সে।কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস আয়নায় তাকালেই একজোড়া পলকবিহীন চক্ষুযুগলে নিবদ্ধ হয়ে যাবে তার দৃষ্টি।যে চোখেজোড়ায় একরাশ মুগ্ধতা এসে ভর করেছে।সেই চোখে তাকানোর সাহস নেই তোহার।একদম সাহস নেই!
তিহান তার খোপায় গাজরাটা সুন্দর করে পরিয়ে ক্লিপগুলো লাগিয়ে দিলো।
অত:পর সরে গিয়ে ফের শুয়ে পরতে উদ্যত হলে তোহা একটু সাহস করে বললো,
—“আপনাকে খালামনি খুঁজছিলো।”
—“ভেরি গুড।এখন যা,বের হ তো রুম থেকে”।
তোহা আর ঘাটলো না।তার রুম থেকে তাকেই বের হতে বলছে তাও আবার কি তেজ।হুহ্।চলে যেতে নিয়েও কিছু একটা ভেবে থমকে দাড়ালো সে।একটা জিনিস বুঝে আসতেই হুড়মুড় করে ডেকে উঠলো,
—“তিহান ভাই?”
উওরে তিহান একনজর তাকিয়ে তিক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
—“তিহু রে,আজ শুধু একটা অনুষ্ঠান বলে বেঁচে গেলি।নয়তো বারবার আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানোর অপরাধে তোর গালদুটো চড়িয়ে লাল করে দিতাম আমি।”
তিহানের কথাগুলো তার কানের থেকে দু’শ মাইল দূর দিয়ে চলে গেল।বুকের ভেতর হাঁতুরি পেটা করছে।লজ্জায় গা শিঁউরে উঠছে।মনে হচ্ছে সে এখনই জ্ঞান হারাবে।কয়েকমূহুর্তের ব্যবধানে তার অচেতন দেহ লুটিয়ে পরবে ফ্লোরে।
সে দ্রুত কয়েককদম এগিয়ে এসে আগের মতোই হন্য ভঙ্গিতে বললো,
—“আপনি না ঘুমিয়ে ছিলেন?তবে দেখলেন কি করে আমার শাড়ি সরে রয়েছে?”
—“তুই আসলেই এত বোকা তিহু?নাকি ভান করিস?
….তুই কি ভুলে গেছিস তোর আলমারিতেও একটা বড়সড় আয়না লাগানো আছে।
সেটা যেহেতু বিছানার বামদিকে রাখা তো উল্টোদিকের সবকিছু আয়নায় দেখতে পাওয়া কি কোন আধ্যাত্বিক ব্যাপার মনে হচ্ছে তোর কাছে?
চলবে..
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com