Breaking News

রাস্তার মেয়ে

~স্যার, আমার বইনডারে কতক্ষণের লাইগা একটু রাখবেন? আমি একটু পর আইয়াই নিয়া যামু।
আমি মিরা, আর আমার স্বামী কাব্য। সপ্তাহের অন্যান্য দিনের ব্যাস্ততা কাটিয়ে প্রতি শুক্রবার আমাদের কোথাও না কোথাও যাওয়া হবেই হবে।কিন্তু এই শুক্রবার মানে আজ শরীর খানিকটা খারাপ থাকায় বেশি দূরে কোথাও না গিয়ে কাছেই একটা পার্কে এসে বসেছি দুজনে। হাজারো কথার সাথে সাথে চলছে বাদাম খাওয়া। হঠাৎ করে ৮/৯ বছরের একটা ছেলে এলো আমাদের সামনে। বাইরের সাজসজ্জা দেখে বোঝাই যাচ্ছে কোনো এক পথশিশু। তার কোলে ময়লা কাপড়ে ঢাকা ছোট্ট একটা বাচ্চা। তখন ছেলেটা বললো।
–“স্যার, আমার বইনডারে কতক্ষণের লাইগা একটু রাখবেন? আমি একটু পর আইয়াই নিয়া যামু।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কাব্য বললো।
–“আচ্ছা, দে আমার কাছে।
বাচ্চাটাকে কাব্যর কোলে এগিয়ে দিতে দিতে ছেলেটা বললো।
–“আপনেরা মেলা ভালা মানুষ। আল্লাহ আপনেগো রহমত দিক।
বলেই ছেলেটা চলে গেল।
কাব্যের এইসব কাজ দেখে মেজাজটা পুরোই গরম হয়ে গেলো। ওর বাচ্চা খুব পছন্দ তাই বলে এভাবে যার তার বাচ্চা নিয়ে বসে থাকবে। তখন আমি বললাম।
–“এটা তুমি কি করলে? এই বাচ্চার মা বাবার ঠিক আছে? কার না কার বাচ্চা কোলে নেওয়ার কি দরকার।
কাব্য তখন আমায় ধমক দিয়ে বললো।
–“চুপ থাকো তুমি। যারই বাচ্চাই হোক না কেন মানুষ তো। আর একটু পর এসেই তো ওর ভাই ওকে নিয়ে যাবে। ততক্ষণ আমাকে ওর সাথে খেলতে দাও।
আমি আর কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলাম। কিন্তু কাব্যর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সারা গায়ে ময়লা জড়ানো বাচ্চাটাকে নিয়ে ও খেলায় ব্যস্ত।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো। বাচ্চাটাও ঘুমিয়ে পড়েছে। পার্কটা ধীরে ধীরে জনমানবহীন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঐ ছেলেটার কোনো খোঁজ নেই। কাব্য বাচ্চাটাকে আমার কোলে দিয়ে ছেলেটাকে খুঁজতে গেলো। আমি অপরিষ্কার জিনিস একদম সহ্য করতে পারিনা। তাই বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে বেঞ্চে শুইয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর কাব্য চলে এলো। আর এসেই বললো।
–“এই কি করেছো তুমি? বাচ্চাদের কেউ এভাবে রাখে? (কাব্য)
–“আমি এই নোংরা বাচ্চাকে কোলে নিতে পারবোনা। আর তুমি যে কাজে গিয়েছিলে তার কি খবর। (আমি)
–‘আশেপাশে খুঁজলাম কিন্তু কোথাও ছেলেটাকে পেলাম না। এখন কি করা যায় বলোতো?
–“তোমাকে বলেছিলাম এসব ঝামেলায় জড়ানো দরকার নেই। তারপরেও আমার কথা শোনোনি। এখন বোঝো ঠেলা। কার না কার বাচ্চা এখন আমাদের ঘারে দিয়ে চলে গেলো।
–“মিরা একটু চুপ করে বসোতো। ভাবতে দাও আমাকে।
–“ভাবাভাবি বাদ দিয়ে পুলিশ স্টেশনে চলো।
–“আচ্ছা চলো।
তারপর পুলিশ স্টেশনে এসে ডায়রি করলাম। পুলিশ জানালো কালকে সকালের আগে কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু এখন সমস্যা হলো আজকে রাতে বাচ্চাটাকে কোথায় রাখবো। কাব্য কে বলেছিলাম কোনো এক অনাথ আশ্রমে রেখে আসতে। কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হলো না। আমার সাথে এক প্রকার ঝগড়া করেই বাচ্চাটাকে বাসায় নিয়ে এলো। রাগে আমি টগবগ করে ফুটছি‌। ওদিকে কাব্য বাচ্চাটাকে গোসল করিয়ে আসার সময় কিনে আনা জামা পড়িয়ে দিলো। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো।
–“মিরা দেখো, বাবুটাকে একেবারে পরীর মতো লাগছে। দেখ না একবার ।
আমি তাকিয়ে দেখলাম আসলেই খুব সুন্দর দেখতে। কিন্তু যাই হোক, ও রাস্তার মেয়ে।
রাতের বেলা কাব্য আমাদের মাঝখানে বাচ্চাটাকে শোয়ালো।
আমি ঝগড়া করলাম অনেক কাব্যর সাথে এ নিয়ে,
কিন্তু তারপর কাব্য ওকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে গেল।
রাস্তার বাচ্চাটার জন্য কাব্য আজ আমাকে রেখে চলে গেল।
রাগে অভিমানে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি খেয়াল নেই‌।
সকালে কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। অসহ্যকর একেবারে।
কাব্য ওকে চুপ করাতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর চুপ করলো।
আমি ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি কাব্য রেডি হচ্ছে। তখন আমি কাব্য কে বললা।
–“কোথায় যাচ্ছো তুমি?
–কেন? অফিসে।
–“অফিসে মানে? এই ঝামেলাটাকে সারাদিন কে দেখবে?
–“এভাবে বলছো কেন মিরা? একটা দিন একটা বাচ্চাকে দেখে রাখতে পারবে না?
–“বাচ্চাকে তো দেখে রাখতে পারবো কিন্তু এই রাস্তার বাচ্চাকে পারবো না।
তুমি যদি ওকে আমার কাছে রেখে যাও তাহলে ওকে যেখান থেকে নিয়ে এসেছো সেখানে রেখে আসবো।
কাব্য তখন কিছু না বলে অন্য ঘরে বাচ্চাটার কাছে চলে গেল।
হয়তো খুব কষ্ট পেয়েছে আমার কথায়,
কিন্তু আমি কিছুতেই রাস্তার এ মেয়েটাকে কাছে রাখতে পারবো না।
বিকেলবেলা থানা থেকে ফোন এলো। ছেলেটাকে পুলিশ খুঁজে পেয়েছে।
আমাদের থানায় যাওয়ার জন্য বলা হলো।
আমার বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকায় কাব্য আর বাচ্চাটাকে পাঠিয়ে দিলাম।
এখন মনে মনে খুব শান্তি লাগছে। রাস্তার এ বাচ্চাটাকে আর দেখতে হবে না।
কিন্তু প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর কলিং বেল বেজে উঠলো।
আমি দরজা খুলে একেবারে অবাক হয়ে গেলাম। কারন কাব্য চলে এসেছে।
সাথে আছে বাচ্চটা আর অনেক গুলো শপিং ব্যাগ। আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
কাব্য তখন ঘরে এসে বাচ্চাটাকে খাটে শুইয়ে দিল। আর আমাকে বললো।
–“মিরা, আমি বুঝতে পেরেছি তুমি খুব অবাক হয়েছো।
কিন্তু এছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই। পুলিশ ছেলেটাকে খুঁজে পেয়েছিলো।
এরপর ওকে জিজ্ঞাসাবাদের পর জানতে পারলাম, ও ওর মা বাবার সাথে বস্তিতে থাকতো।
ওর মা মানে এই বাচ্চাটার মা ওর জন্মের সাথে সাথেই মারা যায়।
আর ওদের বাবা কোথায় পালিয়ে যায়।
বস্তিতে যেখানে নিজেরই একবেলা খাবার জোটে না
সেখানে ছোট বোনকে বড় করা ছেলেটার কাছে প্রায় অসম্ভব মনে হয়।
বোনকে একটু ভালো রাখার জন্য ই ও এমনটা করেছে।
এসব শুনে আমি ছেলেটাকে কিছু টাকা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। আর বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছি।
ও এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবে, আমাদের মেয়ে হয়ে।
–“কাব্য তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? একদিন আমি সহ্য করেছি। কিন্তু আর না।
বাড়িটা কি অনাথ আশ্রম নাকি যে যাকে তাকে তুলে নিয়ে আসবে।
এই বাড়িতে আমি থাকবো না হয় এই বাচ্চাটা থাকবে।
–“তুমি ভুল করছো মিরা। মানুষকে এভাবে ছোট করতে নেই।
কিন্তু তাও যদি তোমার খুব বেশি সমস্যা হয় তাহলে তুমি চলে যেতে পারো।
আমি তখন কাব্য কে আর কিছু না বলে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে বসে রইলাম।
সত্যিই কিছু বলার নেই আমার।
চলবে….

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com