আমার গল্পে তুমি || পার্ট: ১০ ও ১১ || লেখিকা: সুলতানা তমা
ফ্রেশ হয়ে ডায়েরীটা হাতে নিয়ে বিছানায় এসে আধশোয়া হয়ে বসলাম। জানিনা এই ডায়েরীতে কি আছে তবে মন বলছে কিছু তো অন্তত পাবো। ডায়েরীর প্রথম পৃষ্ঠা উল্টালাম সাথে সাথে দরজায় টোকা পড়লো, ডায়েরী বন্ধ করে এসে দরজা খুললাম।
আমি: ওহ আপু তুই।
আপু: ভাই খাবি চল।
আমি: না ভালো লাগছে না।
আপু: আম্মুকে ডাকবো?
আমি: আম্মুকে কেন ডা...
আপু: ওটা কিসের ডায়েরী? (বিছানায় রাখা হিমির ডায়েরীর দিকে আপু ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো)
আমি: হিমির।
আপু: ও এজন্যই তুমি খাবে না, ডায়েরী পড়বে রাত জেগে? পড়াচ্ছি।
আমি: আপু ডায়েরী নিচ্ছিস কেন?
আপু: খাবার খেয়ে এসে চুপচাপ ঘুমাবি, সারাদিন অনেক ছুটাছুটি করেছিস। আর ডায়েরী সকালে নিস আমার থেকে।
আমি: আপু...
আপু: আগে তোর খাওয়া ঘুম ঠিকমতো হবে তারপর অন্যকিছু।
আপু ডায়েরীটা নিয়ে চলে গেলো ধ্যাত। এখন যা কিছুই বলি আপু সকালের আগে ডায়েরী দিবে না কারণ আপুর কাছে সবকিছুর আগে আমার সুস্থ থাকা। আমি একটু অসুস্থ হলে সবার আগে আপু অস্থির হয়ে পড়ে। অবশ্য সব ভাইয়ের জন্যই বোনরা এমন অস্থির হয়, এটাই হয়তো ভালোবাসা।
আম্মু: আরশান তোর আব্বু জিজ্ঞেস করছিল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে কি করবি, বাহিরে পড়তে যাবি নাকি...
আমি: এইটাও আব্বু ঠিক করে দিবেন? (খাবার খেতে বসে এসব শুনলে মাথাটাই গরম হয়ে যায়। সবকিছু আব্বুর ইচ্ছেমত করতে হবে আমাদের ইচ্ছের কোনো দাম নেই। পড়াশুনার ব্যাপারে তো অন্তত ছেলেমেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়া প্রয়োজন, জোড় করে চাপিয়ে দিলে কি পড়াশোনা করা যায়?)
আম্মু: কি করবি বল তোর আব্বু চায়...
আমি: ব্যবসা সামলাই তাইতো? তোমাদের কথামতো তো আদিত্য নাচে ওকে দিয়ে ব্যবসা সামলাও না আমাকে কেন টানছ? শুনো আম্মু আমি স্পষ্ট ভাবে বলে দিচ্ছি আমার যা মন চাইবে আমি তা করবো আমার উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করো না।
আম্মু: আমিতো তোদের স্বাধীনতা দিতে চাই কিন্তু তোদের আব্বু...
আমি: আপুর উপর ঠিক এভাবে পড়াশুনা চাপিয়ে দিয়েছিলে, আপু হতে চেয়েছিল ডক্টর কিন্তু আব্বুর চাই অন্যকিছু। শেষ পর্যন্ত কি হলো আপু রাগে পড়াশুনাটাই ছেড়ে দিলো। কেন আম্মু আমরা নিজের ইচ্ছেমত পড়াশুনাটাও কি করতে পারবো না?
আম্মু: তোর আব্বু ফারিয়ার বিয়ের কথা ভাবছেন। (এবার রাগটা চরমে উঠে গেলো, আব্বু ছেলে ঠিক করা মানে কোনো এক ব্যবসায়ীর ছেলে ধরে আনবেন যার কাছে ভালোবাসার কোনো মূল্য থাকবে না থাকবে ব্যবসার মূল্য)
আম্মু: কিরে কিছু বলছিস না যে?
আমি: আপুর মতামত নিয়ে তবেই বিয়ে ঠিক করো, আপুর চোখে পানি দেখলে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে মনে রেখো।
চাঁচি: আরশান তোর আব্বু আর চাচ্চু তো তোদের ভালোর জন্যই সবকিছু করে।
আমি: যে ভালো থাকায় আমাদের স্বাধীনতা থাকে না সে ভালো থাকা আমরা চাই না।
চাঁচি: তোর মুখেই এসব কথা শুনি শুধু, কই আমার আদিত্য তো এসব বলে না।
আমি: তোমার আদিত্য খুব ভালো ছেলে তাই বলে না আর আমিতো বখাটে।
আম্মু: আরশান খাবারটা খেয়ে যা।
রাগে চলে আসলাম। আমাদের মতামত না নিয়ে আব্বুর কোনো কিছু করাটাকে আমি একদম পছন্দ করিনা। আমার মতে ছেলেমেয়েকে পূর্ণ স্বাধিনতা দেওয়া উচিত। স্বাধীনতা পেয়ে যদি ভালো কাজে না লাগায় উচ্ছন্নে যায় তবেই শাসন করা প্রয়োজন। কিন্তু আব্বু তো সবসময় তার ইচ্ছেটাকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যা আমার একদমই পছন্দ না।
ভোরবেলা কারো গুণগুণ শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো, ঘুম ঘুম চোখে মোবাইল এনে দেখি ছয়টা বাজে, এতো সকালে কে গুণগুণ করছে? উঠে বসে কান পেতে শুনলাম হিমির কন্ঠ, ওর মিষ্টি কন্ঠ শুনে ঘুম উড়ে গেলো। আরেকটু স্পষ্ট ভাবে শুনার জন্য বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, হিমির মিষ্টি কন্ঠ সাথে শীতল বাতাস বইছে দারুণ একটা মুহূর্ত। আমি মুগ্ধ হয়ে হিমির গুণগুণ শব্দ শুনছিলাম, হিমির গুণগুণ করাটা এবার গানে রূপ নিলো...
আমারও পরানও যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো...
আমারও পরাণও যাহা চায়!
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই কিছু নাই গো...
আমারও পরানও যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো...
আমারও পরানও যাহা চায়!
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখেরও সন্ধানে যাও
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখেরও সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে
আরও কিছু নাহি চাই গো!
আমারও পরানও যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো...
আমারও পরানও যাহা চায়!
যাহ্ থেমে গেলো? আমি কতো মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম আর মায়াবতীটা গান বন্ধ করে দিলো?
আপু: ভাই? (হঠাৎ আপুর ডাকে দরজা খুলতে আসলাম)
আপু: এইনে তোর ডায়েরী আর সাথে এক মগ কফি ফ্রি।
আমি: থ্যাংকইউ।
আপু: ভাই তোর হিমি তো খুব সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গায়।
আমি: তুই শুনেছিস?
আপু: হ্যাঁ আমিতো সকালবেলা বাগানে গিয়ে বসি, হঠাৎ শুনলাম হিমি গান গাইছে। তোকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হিমির গান শুনতে দেখলাম আর তাই কফি নিয়ে আসলাম।
আমি: তুই তো এই মিষ্টি মেয়েটাকে ভুলে যেতে বলেছিলি।
আপু: কি করবো বল তোর বিপদ হবে জেনেও কি চুপ থাকতে পারি?
আমি: ভালোবাসায় এমন ছোটখাটো বিপদ আসবেই আপু, এসবে ভয় পেলে ভালোবাসা জয় করবো কিভাবে?
আপু: তা ঠিক। আমি কিন্তু এখন আর হিমিকে ভুলতে বলবো না। (আপুর দিকে ভ্রু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, আপু আমার হাতে থাকা ডায়েরীর দিকে তাকিয়ে হাসছে)
আমি: হাসছিস কেন?
আপু: আমি কিন্তু বেশি কিছু পড়িনি শুধু প্রথম পৃষ্ঠা পড়েছি।
আপু মুখ টিপে হেসে চলে গেলো, আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ডায়েরীর দিকে তাকিয়ে আছি। কি এমন লেখা আছে এই ডায়েরীতে যে আপু এভাবে হাসলো?
ডায়েরী নিয়ে বারান্দায় এসে চেয়ারে বসলাম, কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ডায়েরীর পৃষ্ঠা উল্টালাম। প্রথম পৃষ্ঠায় আমার নাম দেখে বেশ অবাক হলাম, আগ্রহ নিয়ে পরের পৃষ্ঠা উল্টালাম।
"গল্পতে পড়েছি, সিনেমায় দেখেছি প্রথম দেখায় ভালোবাসা হতে। কিন্তু আমার জীবনেও যে এমন কিছু ঘটবে তা কখনো কল্পনাও করিনি। এভাবে হুট করে কোনো একজন আমার জীবনে আসবে আর আমার মনের ভিতরটা তোলপাড় করে দিবে কখনো ভাবিই নি। অতীতের সবকিছু ভুলে আমি সেই মানুষটিকে মনের অজান্তে হৃদয়ে জায়গা দিবো সেটাও ভাবিনি। মানুষের ভাবনার মধ্যে তো সবকিছু সবসময় থাকে না তাই হয়তো মনের অজান্তে তাকে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি। আর ভালবাসবো নাই বা কেন? এমন পুরুষ তো প্রতিটা নারীর স্বপ্নের পুরুষ হয়। সেই প্রথম দেখা, সে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল পরনে ছিল হলুদ পাঞ্জাবী, চুল গুলো বাতাসে হেলেদুলে উড়ছিল, ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়ি যা ওর সৌন্দর্য কে বাড়িয়ে দিয়েছিল দ্বিগুণ। তার গভীর চোখ দুটো আটকে ছিল আমার দিকে। অবশ্য আমিতো সেদিন বুঝতেই পারিনি তাকে যে আমি প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি, সেদিন কেন তারপর ঘটে যাওয়া কাহিনী গুলো থেকেও বুঝতে পারিনি সে আমার মনে কতটা জায়গা করে নিয়েছিল। বুঝতে পারছি আজ সে যখন তার শহরে ফিরে গেলো। এক পৃথিবী সমান শূন্যতা যেন আজ আমাকে গ্রাস করে নিয়েছে, বার বার মন তার কাছে ছুটে যেতে চাইছে। ভালোবাসা বোধহয় এমনি কাছে থাকলে প্রিয় মানুষটির মর্ম বুঝা যায় না আর যখন প্রিয় মানুষটি চোখের আড়াল হয়ে যায় তখন বুকের ভিতরটা কেমন যেন হাহাকার করে, মনের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়, হৃদয়ের অনুভূতি গুলো সব এলোমেলো হয়ে যায় আর এটাই হয়তো সত্যিকারের ভালোবাসা"
"মায়াবতী, জানিনা সে এই কালো মেয়ের মধ্যে কি এমন দেখেছে যে প্রথম দিনই আমাকে মায়াবতী বলে সম্বোধন করেছে। আচ্ছা আমি কি আসলেই কারো মায়াবতী হওয়ার যোগ্য? জানিনা, আমি সত্যি জানিনা সে আমার মধ্যে কি দেখেছে আর কেন মায়াবতী বলে ডেকেছে। তবে হ্যাঁ তার মুখে মায়াবতী নামটা শুনতে একটু বেশিই ভালো লাগে আমার"
"এই কয়েকদিনের ছোট ছোট অনুভূতি গুলো আমি কখনো ভুলবো না। হলুদ পাঞ্জাবীতে তাকে প্রথম দেখা, তাকে ভয় পেয়ে কাজলের কৌটো ফেলে রেখে আমার দৌড়ে পালানো। মাঝরাতে তার চোখ দুটো আমাকে পাগলের মতো খুঁজেছিল আর অবশেষে আমাকে বাগানে দেখে তার মুখে এক ফালি হাসি ফুটেছিল। আর ভোররাতে? তাকে পুকুড়পাড়ে ড্রিংক করতে দেখেছিলাম। ইচ্ছে হয়েছিল কষিয়ে দুটো থাপ্পড় দিয়ে বলি ড্রিংক করা ভালো না কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছিল সে ড্রিংক করলে আমার কি আমি কেন কষ্ট পাচ্ছি? আশ্চর্য হয়েছিলাম তখন যখন দেখেছিলাম সে আমাকে দেখে ভয়ে ড্রিংক এর গ্লাস পুকুড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল, হাহাহা পাগল একটা"
"সেই স্নিগ্ধ সকালে তাকে আবারো দেখা। বেখেয়ালি মনে চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছিলাম বুঝতেই পারিনি সে আমাকে লুকিয়ে দেখছে। বুঝেছিলাম তখন যখন তার বন্ধুর ডাকে সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। তারপর তার মিষ্টি কন্ঠে গান। শুনেছিলাম একটা মানুষ কখনো সবদিকে পারফেক্ট হয় না কিন্তু আমার মনে হয় সে সবদিকে পারফেক্ট, যেমন তার সৌন্দর্য তেমনি তার হাসি আর তেমনি তার মিষ্টি কন্ঠ"
"আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বেলী ফুলের মালা গাঁথার চেষ্টা করছিলাম হঠাৎ আয়নায় তাকে দেখে চমকে উঠি, তার চোখ দুটো দেখে বুঝেছিলাম সে আমাকে পাগলের মতো খুঁজছিল। আমাকে পেয়ে সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল আর আমাকে অপলক ভাবে দেখছিল। তাকে দেখলেই মনের ভিতর কেমন যেন একটা করতো ভয় পেতাম বড্ড বেশি আর তাই তখন পালিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আসতে দেয়নি, আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল, কথা আছে। আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি কথা? তার প্রশ্ন ছিল আমার নাম কি। মুহূর্তেই আমার ভয় কেটে মুখে হাসি ফুটেছিল কারণ সেতো আমার নাম জানতো। তারপর? তারপরের অনুভূতি তো আমি কখনোই ভুলতে পারবো না, জিদ ধরে আমার চুলে তার বেলী ফুলের মালা গেঁথে দেওয়া আর তারপর এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় আমার দিকে তার চেয়ে থাকা। সে তখন চলে গিয়েও আবার ফিরে এসেছিল আমি ভয় পেয়েছিলাম, সে আমার কানেকানে বলেছিল 'এই দীঘল কালো চুল গুলো এভাবে ছেড়ে রেখো না কারো নজর লেগে যাবে' হাহাহা পাগল একটা"
"স্মৃতিময় রাত দুটোর কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। প্রথম রাত, হুট করে সে রাতের আধারে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বড্ড ভয় পেয়েছিলাম কারণ পুকুরপাড়ে কেউ আমাদের দুজনকে একসাথে দেখলে আমার গায়ে কলঙ্গের দাগ লেগে যেতো। সে তখন আমাকে তার ভালোবাসার কথা বলেছিল আমি পাত্তা দেইনি, বেশ অবাক হয়েছিলাম যখন সে বলেছিল আমি রাজি নাহলে নিজের ক্ষতি করবে। এমন পাগলও হয় সেটা আমি তখন বুঝিনি। তারপর হঠাৎ বড় ভাইয়ার ওদিকে আসা, ভয় পেয়ে তার টিশার্ট খামছে ধরে তার বুকে মুখ গুঁজেছিলাম আর সে আমাকে পরম যত্নে বুকের সাথে আগলে রেখেছিল। যখন বুঝতে পেরেছিলাম আমি তার বুকের সাথে লেপ্টে আছি তখন লজ্জায় তার দিকে তাকাতে পারিনি কিন্তু সে আমার লজ্জা দূর করার জন্য আমাকে তার কাছে টেনে নিয়েছিল। তারপর? ওড়না টেনে এনে আমার মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিয়েছিল, দুজন দুজনের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলাম"
"সেই সন্ধ্যাটা আমি কখনো ভুলবো না, আমার জীবনে সে দিনটা স্মৃতিময় হয়ে থাকবে আরশান আমার জীবনে থাকুক বা না থাকুক। আরশান আমাকে প্রপোজ করার জন্য কতো কি আয়োজন করেছিল, ডায়মন্ড এর রিং দিয়ে প্রপোজ করেছিল। কিন্তু আমি তার প্রপোজ রাখতে পারিনি, বড্ড ভয় পেয়েছিলাম কারণ সে তো শহরের ছেলে যদি কখনো ছেড়ে চলে যায়? সারাজীবন গ্রামের এই সাধারণ মেয়েটাকে সে মনে রাখবে কিনা সেই প্রশ্নটা আমার মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল। ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তাকে, জানি সে খুব কষ্ট পেয়েছিল"
"দ্বিতীয় রাত, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করছিলাম আর কাঁদছিলাম, জানিনা সেদিন রাতে কেন আমার এতো কান্না পেয়েছিল। হঠাৎ তার আগমন, চলে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে পিছু ডাকে। আমি কাঁদছি বুঝতে পেরে সে অস্থির হয়ে পড়ে, একটা সময় রেগে গিয়ে আমার হাত চেপে ধরে। কাঁচের চুড়ি গুলো ভেঙ্গে হাতে বিধে গিয়েছিল, দৌড়ে চলে এসেছিলাম সেখান থেকে। আমার হাত কেটেছে বুঝতে পেরে সে পাগলের মতো ছুটে আমার রুমে এসেছিল, পরম যত্নে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল। সেদিন তার দুচোখে পানি ছিল, আমার কষ্টে তারও কষ্ট হচ্ছিল। সে চলে গিয়েও আবার ফিরে এসেছিল, আমাকে বুকের সাথে ঝাপটে ধরেছিল। আমি তার বুকের সাথে লেপ্টে ছিলাম, ইচ্ছে হচ্ছিল এ বুকে মাথা রেখে কাটিয়ে দেই সহস্র বছর। সে চলে গিয়েছিল আর স্মৃতি হিসেবে নিয়ে গিয়েছিল আমার চুড়ি গুলো"
"সকালে সে শহরে ফিরে যাওয়ার সময় তার দুচোখ বারবার আমাকে খুঁজছিল কিন্তু পায়নি কারণ আমিতো গাছের আড়াল থেকে তাকে দেখছিলাম। আজ বুঝতে পারছি তাকে আমি ভালোবাসি, শুধু ভালোই বাসি না বড্ড বেশিই ভালোবাসি। কিন্তু আমি এইটাও বুঝতে পারছি আমার এই ভালোবাসা কখনো প্রকাশ করতে পারবো না, অপূর্ণ থেকে যাবে। কারণ ভয় হয় আমার সে যদি ফিরে আসে? আমার আরশানের যদি কোনো ক্ষতি করে"
"সে যদি ফিরে আসে" লেখাটা দেখে চমকে উঠলাম, হিমি কাকে ভয় পাচ্ছে? এতো ভালোবাসে অথচ বারবার আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। ডায়েরীর পৃষ্ঠা উল্টালাম আরো অনেক কিছু লেখা আছে কিন্তু এখন আর পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না, হিমির কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। ডায়েরী হাতে নিয়ে এক প্রকার দৌড়েই হিমির রুমের দিকে ছুটলাম।
হিমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল রুমে কেউ এসেছে বুঝতে পেরে পিছন ফিরে তাকালো আর আমাকে দেখে চমকে উঠলো।
হিমি: আপনি? আমার রুমে কেন এসেছেন আম্মু দেখলে প্রবলেম হবে। (ডায়েরীটা পিছনে লুকিয়ে হিমির কাছে এসে দাঁড়ালাম)
আমি: হিমি আমি তোমাকে ভালোবাসি এসব কিছুর ভয় পাই না আমি।
হিমি: কতবার বলবো আমি আপনাকে ভালোবাসি না, যান তো এখান থেকে।
আমি: সত্যি ভালোবাস না?
হিমি: বললাম তো না।
আমি: ভেবে বলছ তো? (এবার হিমি আমার দিকে তাকালো, আমি ডায়েরীটা হিমির সামনে ধরলাম। হিমি চোখ বড় বড় করে ডায়েরীর দিকে তাকিয়ে আছে)
হিমি: আপনি আমার ডায়েরী চুরি করেছেন কেন?
আমি: চুরি না করলে তো জানতে পারতাম না মায়াবতী যে এতো মিথ্যে বলতে পারে।
হিমি: আসসলেলে...
আমি: আসলে কি? এবার বলো ভালোবাস না।
হিমি: না মানে ইয়ে... (হিমি ভয় পেয়ে পিছাতে গিয়ে দেয়ালে আটকে গেলো, আমি ওর একদম কাছে এসে দাঁড়ালাম)
আমি: না মানে ইয়ে কি?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: কিসের এতো ভয় তোমার? এতো ভালোবাস অথচ বারবার দূরে সরিয়ে দিচ্ছ কেন?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: সব তো জেনে ফেলেছি, এবারো কি মিথ্যে বলবে আর আমাকে কাঁদাবে? (হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে ওর দুচোখে পানি টলমল করছে)
আমি: কোনো এক জনের অনুপস্থিতে এক পৃথিবী সমান শূন্যতা অনুভব করাকেই ভালোবাসা বলে হিমি, আর তুমি সেটা অনুভব করেছ। কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ সাথে আমাকেও কষ্টের আগুনে পুড়ে মারছ, কিসের ভয় তোমার?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: এখনো চুপ হয়ে থাকবে? হিমি আমি কিন্তু এবার... (আচমকা হিমি আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো, ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। আমি ওকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম)
আমি: আর তো মিথ্যে বলতে পারবে না।
হিমি: আর মিথ্যে বলবো না, এবার যান আম্মু দেখলে সমস্যা হবে। (হিমি আমাকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে কাঁদছে)
আমি: যাবো আগে বলো ভালোবাসি আর কান্না বন্ধ করো।
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: বলবা কিনা?
হিমি: ভালোবাসি। (হিমির মুখের কাছে আমার মুখ আনতেই ও ভয়ে বলে দিলো, আমি মৃদু হেসে ওর চোখের পানি মুছে দিলাম। হিমি আমার দুচোখের দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: ভালোবাসি মায়াবতী।
হিমি এক হাতে আমার শার্ট খামছে ধরে মাথা নিচু করে কাঁদছে, থুতুনি ধরে ওর মুখটা উপরে তুললাম। হিমির দুচোখে এখনো ভয়, জানিনা কিসের ভয় তবে ওর সব ভয় আমি দূর করে দিবো আমার ভালোবাসা দিয়ে। হিমির কপালে আসা চুলগুলো ওর কানের পাশে গুঁজে দিলাম, হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক ভাবে, আমি মুচকি হেসে ওর নাকের আঘার তিলকটায় আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম...
চলবে😍
#আমার_গল্পে_তুমি
পার্ট: ১১
লেখিকা: সুলতানা তমা
আমি হিমিকে অপলক ভাবে দেখছি আর হিমি উশখুশ করছে, ওর এমন অবস্থা দেখে বড্ড হাসি পাচ্ছে। আমিই তো ওকে দেখছি তাহলে এতো লজ্জা পেয়ে উশখুশ করার কি আছে? হিমি আসলেই...
হিমি: যান প্লিজ!
আমি: (নিশ্চুপ)
হিমি: আম্মু একবার দেখে ফেললে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে।
আমি: আর একটু।
হিমি: এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন বলুন তো।
আমি: আমার মায়াবতীকে। (মৃদু হেসে হিমির নাক টেনে দিলাম)
হিমি: আর বুঝি দেখেননি?
আমি: হুম দেখেছি। কিন্তু আজকের দেখায় অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করছে। (হিমি ভ্রু কুঁচকিয়ে আমার দিকে তাকালো, হয়তো আমার কথার মানে বুঝতে পারেনি)
আমি: আগে তো তুমি আমাকে ভালোবাসতে না শুধু আমি বাসতাম কাজেই ভালোবাসাটা এক তরফা ছিল। তখন তোমাকে দেখলে মনের মধ্যে কেমন যেন চাপা কষ্ট অনুভূত হতো আর আজ দেখো অন্যরকম এক মুগ্ধতা নিয়ে তোমায় দেখছি। কারণ আজ আমি জানি তুমি শুধু আমার। (হিমি আমার কথা গুলো শুনে মিটিমিটি হাসছে)
আমি: হিমি একটা প্রশ্ন করতে পারি? যদি অনুমতি দাও তো।
হিমি: অনুমতি চাওয়ার কি আছে? বলুন।
আমি: কারণ প্রশ্নটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে। (হিমি খানিকটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো)
আমি: তুমি কাকে ভয় পাও হিমি?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: হি...
"হিমি দেখে যা" (কিছু বলতে যাবো তখনি আন্টি হিমিকে ডাকলেন)
হিমি: যান প্লিজ!
আমি: এই শাশুড়ি মায়ের জন্য দেখছি শান্তিতে প্রেম করা যাবে না।
হিমি: আমাকে খুঁজতে খুঁজতে আম্মু যেকোনো সময় আমার রুমে চলে আসতে পারেন, আপনি যান প্লিজ!
আমি: যাচ্ছি, আবার কখন দেখা হবে?
হিমি: যখন সুযোগ পাবো।
হিমির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে আসলাম।
শান্ত বেডে শুয়ে আছে, পাশে সিফাত আর আরিয়ান। আমি এসে সিফাতের পাশে বসলাম, হিমির রুম থেকে বেরিয়ে সোজা হসপিটালে চলে এসেছি।
আরিয়ান: কিরে তোর তো কোনো খুঁজই নেই, কতবার ফোন দিলাম রিসিভ করলি না।
আমি: ফোন? (হঠাৎ মনে হলো ফোনটা বাসায় ফেলে রেখে এসেছি)
শান্ত: ওর কি আর আমাদের দেখার সময় আছে? ও তো এখন সকাল সন্ধ্যা হিমিকে দেখে শুধু।
আমি: ভাঙ্গা পায়ে দিবো একটা।
সিফাত: ভুল কি বললো?
আমি: একটা গুড নিউজ আছে।
শান্ত: কি?
সিফাত: কি?
আরিয়ান: বলনা আরশান।
আমি: হিমি রাজি হয়েছে আর আমাকে ভালোবাসিও বলেছে।
সিফাত: সত্যি?
শান্ত: আমি জানতাম তুই একদিন সাকসেস হবি।
আরিয়ান: ভালোবাসাটা যে সত্যি।
আমি: হুম।
আঙ্কেল: শান্ত ডক্টর বলেছেন বাসায় নিয়ে যেতে পারি কিন্তু...
শান্ত: ভয় নেই আমি সাবধানে থাকবো।
আমি: আজই রিলিজ নেওয়ার কি প্রয়োজন? আগে সুস্থ হ তারপর...
শান্ত: নারে আমার এখানে ভালো লাগছে না। তাছাড়া ডক্টর তো বললো একটু সাবধানে থাকলেই হবে।
আমি: তোর ইচ্ছে।
আঙ্কেল: বিকেলে রিলিজ করে দিবে।
শান্ত: ঠিক আছে।
আরিয়ান: আরশান তোর সাথে অধরার কথা হয়? (সবাই শান্তর পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম হঠাৎ আরিয়ানের প্রশ্নে অধরার কথা মনে পড়লো, এসব ঝামেলায় তো অধরার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বকবক করা মেয়েটা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল কোনো খুঁজ নেই তো)
আরিয়ান: কিরে কি ভাবছিস?
আমি: আমার সাথে তো কথা হয়নি, আচ্ছা অধরা শান্তকে দেখতে আসেনি?
শান্ত: না। অধরা হয়তো জানেই না আমি যে অসুস্থ আর হসপিটালে আছি।
আমি: ফোন দেতো।
সিফাত: দাঁড়া আমি দিচ্ছি। (অধরা তো সহজসরল একটা মেয়ে সবসময় বকবক করতে পছন্দ করে, আর রোজ তো আমাদের কারো না কারো সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু হঠাৎ মেয়েটা যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো কেন? আমরা চারজন কলেজে যাচ্ছি না অথচ অধরার কোনো ফোন মেসেজ নেই)
সিফাত: ফোন তো সুইচড অফ।
আরিয়ান: অধরা আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে না এমন মেয়ে তো ও নয়।
শান্ত: এবার কিন্তু চিন্তা হচ্ছে। মেয়েটা হোস্টেলে থাকে, কোনো বিপদ হলো নাতো? (কেমন যেন ভয় হচ্ছে আমার, শান্তর সাথে যা হয়েছে অধরার সাথে তেমন কিছু হয়নি তো? অধরাও তো আমার ফ্রেন্ড, হয়তো ওর সাথেও খারাপ কিছু হয়েছে)
আমি: আসছি আমি।
সিফাত: কোথায় যাচ্ছিস?
আমি: অধরার হোস্টেলে যাবো।
শান্ত: কিন্তু তোকে তো ঢুকতে দিবে না।
আমি: কোনো ভাবে তো ওর একটা খুঁজ আনতে পারবো।
সিফাত: চল আমি যাচ্ছি তোর সাথে।
আমি: হুম।
অধরার হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, কিভাবে কি করবো বুঝতেই পারছি না। মেয়েদের হোস্টেলে তো আর আমাদের ঢুকতে দিবে না। কি যে হচ্ছে আমার সাথে এসব। এবার তো ভয় হচ্ছে হিমির ভালোবাসার জন্য না আমি এই চারটা বন্ধুকে হারিয়ে ফেলি।
সিফাত: আরশান এই দারোয়ান তো আমাদের চেনেন আগেও এসেছি আমরা, কিছু টাকা দিয়ে যদি অধরার কোনো খবর আনা যায়।
আমি: আমার মাথা কাজ করছে না তুই গিয়ে কথা বল প্লিজ! আর যতো টাকা লাগে দিবি।
সিফাত: তুই এখানে দাঁড়া আমি যাচ্ছি।
আমি: হুম। (মন থেকে দোয়া করছি কোনো খারাপ খবর যেন আমাকে না শুনতে হয়, যা কিছু ঘটছে এখন সত্যি অল্পতে খুব বেশি ভয় পাই আমি। হিমিকে ভালোবাসার জন্য আমার যা হবার হউক কিন্তু আমার বন্ধুদের ক্ষতি আমি কখনোই মানতে পারবো না)
সিফাত: আরশান? (হঠাৎ সিফাতের ডাকে ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো)
আমি: কিরে কিছু বলেছে?
সিফাত: হ্যাঁ অধরা কলেজে গেছে, চল।
আমি: হুম চল।
তাড়াহুড়ো করে কলেজে এসে সব জায়গায় অধরাকে খুঁজলাম, গাছের নিছে আমাদের সেই আড্ডার জায়গাটায় খুঁজলাম কিন্তু অধরা নেই। শেষমেশ ক্লাসে আসলাম, অধরা পিছনের সিটে আনমনা হয়ে বসে আছে।
সিফাত: অধরা? (সিফাতের ডাকে কেঁপে উঠে অধরা আমাদের দিকে তাকালো)
আমি: কিরে কোথায় ছিলি তোর কোনো খুঁজ নেই। (অধরা আনমনা হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: অধরা?
অধরা: হুম। (আমি ওর পাশে বসে ধাক্কা দিতেই ওর ধ্যান ভাঙ্গলো)
সিফাত: কথা বলছিস না কেন কি হয়েছে তোর?
অধরা: কিছু নাতো।
আমি: তোর ফোন সুইচড অফ কেন?
অধরা: ফোন ছিনতাই হয়ে গেছে।
সিফাত: এজন্য তোর মন খারাপ? মন খারাপ করিস না প্লিজ আমরা ফোন কিনে দিবো। (সিফাতের কথা শুনে অধরা একটা মলিন হাসি দিলো, কিছুই বুঝতে পারছি না অধরা ফোন ছিনতাই হয়ে যাওয়ার জন্য মন খারাপ করবে কেন? ও তো চাইলে ফোন কিনতে পারে)
অধরা: তেমন কিছু হয়নি, কলেজে এসে তোদের দেখতে পাইনি তাই মন খারাপ হয়েছিল।
আমি: শান্ত হসপিটালে জানিস তুই?
অধরা: (নিশ্চুপ)
আমি: কিরে জানিস?
অধরা: হু... না না আমি জানবো কিভাবে আমার তো ফোনই নেই।
সিফাত: তুই কি আমাদের থেকে কিছু লুকাচ্ছিস?
অধরা: নাতো কি লোকাবো?
আমি: আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুই খুব ভয় পেয়ে আছিস, আচ্ছা তোকে কেউ ভয় দেখিয়েছে?
অধরা: আজব তো আমাকে ভয় দেখাবে কে আর কেনই বা দেখাবে?
সিফাত: এতো বকবক করা মেয়েটা হঠাৎ এমন চুপচাপ হয়ে গেলো কেন? অধরা কিছু কি লুকাচ্ছিস?
অধরা: না, শান্ত কেমন আছে?
সিফাত: ভালো। ওকে দেখতে যাবি?
অধরা: না, কাল একবার যাবো।
সিফাত: ঠিক আছে তুই ক্লাস কর আমরা আসছি।
অধরা: হুম।
সিফাত: আরশান চল।
আমি: চল।
অধরার দিকে একবার তাকিয়ে চলে আসলাম। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে অধরা আমাদের থেকে কিছু একটা লোকাচ্ছে, কিন্তু কি সেটা? অধরা সবসময় হাসিখুশি থাকে বেশি কথা বলতে পছন্দ করে কিন্তু আজ ওর মুখে কোনো হাসি ছিলনা দুচোখে ভয়ের চাপ ছিল। আমার জন্য যদি ওদের কোনো ক্ষতি হয় তাহলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না।
হসপিটালে ফিরে আসলাম, শান্তকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর আমরা সবাই বাসায় যাবো।
ডক্টর: আর কিছুদিন এখানে থাকলে ভালো হতো। (কেবিনে ঢুকতে গিয়ে ডক্টর এর কথা শুনে থেমে গেলাম। ডক্টর শান্তকে বুঝাচ্ছে, পাশে আঙ্কেল আর আরিয়ান)
শান্ত: সমস্যা নেই...
ডক্টর: একটু এদিক সেদিক হলে কিন্তু পরে খুব বড় প্রবলেম হবে।
আঙ্কেল: আমিও তো বলছি হসপিটালে থাকতে কিন্তু শান্ত...
আমি: শান্ত এখানেই থাকবে আঙ্কেল ভয় নেই।
শান্ত: আরশান?
আমি: চুপ, সবকিছুতে বাড়াবাড়ি করিস না।
আঙ্কেল: এখানেই থাক সুস্থ হলে পর বাসায় নিয়ে যাবো। বাবারা তোমরা এখানে একটু থাকো আমি বাসা থেকে আসছি।
সিফাত: ঠিক আছে আঙ্কেল। (আঙ্কেল আর ডক্টর চলে যেতেই শান্ত আমার দিকে রাগি চোখে তাকালো)
আমি: তোর এই অবস্থা তো আমার জন্য হয়েছে তুই পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি লাগবে না। প্লিজ জিদ করিস না।
শান্ত: হুম।
আমি: আরিয়ান, সিফাত তোরা শান্তর খেয়াল রাখিস আর রাতে তো আঙ্কেল আসবেনই, আমি আসছি।
সিফাত: কোথায় যাচ্ছিস?
আমি: হিমির থেকে সব জানবো আমি, এমন ভয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
শান্ত: হিমি বলতে না চাইলে চাপ দিস না এতে মেয়েটা আরো ভয় পেয়ে যেতে পারে।
আমি: হুম।
বাসায় এসে কলিংবেল চেপে দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, সারাদিনের ছুটাছুটির পর বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।
রোদেলা: ভাইয়া কোথায় ছিলে? (রোদেলা দরজা খুলেই প্রশ্ন করলো, সবাই হয়তো টেনশন করছিল)
রোদেলা: চাঁচি কতো টেনশন করছিল বলে যাবে না তুমি?
আমি: হসপিটালে গিয়েছিলাম শান্তকে দেখতে। (ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই দেখি হিমি আর আনিলা বসে আছে, হিমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো)
আমি: মহারাণী আমাদের ফ্ল্যাটে?
হিমি: আসতে মানা আছে?
আমি: তোমার শশুড়ের বাসায় তুমি আসবে আমি মানা করার কে? (আমার কথা শুনে হিমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো)
রোদেলা: এইযে আপনার শাশুড়ি রান্নাঘরে আছে দুষ্টুমি কম করুন।
আমি: শাশুড়ি রান্না ঘরে?
রোদেলা: হ্যাঁ আম্মু আর চাঁচির সাথে গল্প করছে।
আমি: বাহ্ বেয়ান হবার আগেই এতো মিল?
হিমি: আম্মু এসব কথা শুনলে কিন্তু সন্দেহ করবেন।
আমি: রাতে ছাদে এসো। (হিমিকে কথাটা আস্তে বলে মৃদু হেসে রুমে চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম তখনি আম্মু পিছু ডাকলেন)
আম্মু: আরশান কোথায় ছিলি?
আমি: শান্তকে দেখতে হসপিটালে গিয়েছিলাম।
আম্মু: বলে যাবি না? কতবার ফোন করেছি।
আপু: আম্মু তোমার ছেলে তো ফোন বাসায় ফেলে রেখে গিয়েছিল।
আম্মু: যাবেই তো মায়ের যে চিন্তা হয় সেটা কি আর বুঝে? কবে যে একটা বৌমা ঘরে আনবো। (আম্মু হিমির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে কথাটা বললেন, হিমি তো লজ্জায় লাল হয়ে গেছে)
আমি: তোমার বৌমা তো বিয়ের আগেই তোমার কাছে চলে এসেছে।
হিমি আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে, আমি মুচকি হেসে রুমের দিকে চলে আসলাম।
রাত আনুমানিক এগারোটা, ছাদে দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি। জানিনা হিমি আসবে কিনা, কিন্তু ওর আসাটা আজ খুব প্রয়োজন। হিমির থেকে সবকিছু আমি জানতে চাই, এভাবে ভয়ে দিন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সবকিছু জানতে পারলে একটা কিছু তো অন্তত করতে পারবো।
"আরশান" হঠাৎ হিমির ডাকে আমার ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো, পিছন ফিরে তাকালাম। একরাশ মুগ্ধতা যেন আমার দুচোখে ভড় করেছে, চোখ সরাতে পারছি না হিমির দিক থেকে। পূর্নিমা চাঁদের আলোতে হিমিকে ঠিক কেমন লাগছে কতোটা সৌন্দর্য ওকে ঘিরে নিয়েছে আমি বর্ণনা করতে পারবো না। আমি শুধু দুচোখে মুগ্ধতা নিয়ে হিমিকে কুটিয়ে কুটিয়ে দেখছি, সাদা পাড়ের নীল ওড়নাটা দিয়ে মাথায় ঘোমটা দেওয়া, চোখে গারো কাজল, হাত ভর্তি চুড়ি, হিমি একটু নড়াচড়া করলেই চুড়ি গুলো রিনিঝিনি শব্দে বেজে উঠছে।
হিমি: এইযে কি হলো? (হিমির আলতো ধাক্কায় আমার ঘোর কাটলো, মুচকি হেসে হিমির কাছে এগিয়ে গেলাম)
আমি: একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আমার মায়াবতীকে দেখছিলাম।
হিমি: আমি কি সত্যি মায়াবতী নামটার যোগ্য? (হিমির এমন প্রশ্নে মাথায় রাগ চড়ে বসলো)
আমি: নাতো তুমি যোগ্য নও রাস্তার মেয়ে যোগ্য, যাই রাস্তার কোনো একটা মেয়েকে গিয়ে মায়াবতী বলে ডাকি আর ভালোবাসি বলি? সহ্য করতে পারবে তো?
হিমি: এতো রেগে যাচ্ছেন কেন?
আমি: তোমাকে... ধ্যাত।
হিমির থেকে দূরে সরে আসলাম।
ছাদের রেলিং এ হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি আর রাগটাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছি। হঠাৎ হিমি এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার হাতের উপর ওর হাত রাখলো, রাগটা নিমিষেই শেষ হয়ে আমার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটলো। হিমির হাতটা আমার হাতের মুঠোয় এনে ওর দিকে তাকালাম।
আমি: আর কখনো এসব বলো না, আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই মায়াবতী বলে ডাকি। তাছাড়া তোমার সৌন্দর্য আমাকে তোমায় মায়াবতী বলে ডাকতে বাধ্য করে। বিশ্বাস করো তুমিই এই নামটার যোগ্য।
হিমি: কিন্তু আমি যে খুব সাধারণ অতি নগণ্য একটা মেয়ে, গায়ের রঙ কালো...
আমি: আমি এই সাধারণ মেয়েটাকেই ভালোবাসি আর ভালোবাসতে চাই সহস্র বছর, আমি তোমার এই নগণ্যতাকেই পছন্দ করি। আর গায়ের রঙের কথা বলছ? কিবা আসে যায় সামান্য গায়ের রঙে? ভালোবাসা কি গায়ের রঙ দেখে হয়? আর কালো মেয়েরা মায়াবতী হতে পারে না?
হিমি: হ্যাঁ পারে কিন্তু সেটা গল্পে, উপন্যাসে কিংবা কোনো সর্ট ফিল্মে।
আমি: আমি নাহয় এই কালো মেয়েটাকে আমার মনের ক্যানভাসের মায়াবতী করে নিলাম।
হিমি: কিন্তু আরশান আমাদের এই সম্পর্ক কেউ মেনে নিবে না।
আমি: কেন? ভয় হচ্ছে?
হিমি: জানেন না জগতের সব কালো ভালো শুধু কালো মেয়ে ছাড়া। সত্যি ভয় হচ্ছে...
আমি: ভয় পেয়ো না পাগলী আমি আমার ভালোবাসার এক ফালি রঙ দিয়ে তোমাকে রাঙিয়ে দিবো, আমার ভালোবাসার রঙের আড়ালে এই কালো রঙ ঢাকা পড়ে যাবে। (হিমি আমার দিকে অদ্ভুত এক মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে, আমি ওর কাজল কালো চোখ দুটোর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি)
আমি: তোমার এই গভীর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থেকে শুধু এই রাত না সহস্র বছর কাটিয়ে দিতে পারবো। (আমার কথা শুনে হিমি লজ্জা পেয়ে হাসলো)
আমি: তোমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার সারারাত কেটে যাবে, যে কারণে তোমাকে ডেকেছি শুনো...
হিমি: কি কারণ?
আমি: তুমি জানো শান্ত হসপিটালে?
হিমি: হ্যাঁ তারিন বলেছে শান্ত ভাইয়া নাকি এক্সিডেন্ট করেছে।
আমি: না হিমি শান্তকে ইচ্ছে করে এমন করা হয়েছে আর কে করেছে জানো? তুমি যাকে ভয় পাও। (হিমি আমার কথা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠলো)
আমি: হিমি তোমার কাছে আমার অনুরোধ তুমি বলো প্লিজ কে সে, আমার বন্ধুদের আমি হারাতে চাই না। হি...
হিমি: সজিব।
আমি: সজিব?
হিমি: লোকে বলে প্রথম প্রেম নাকি ভুল মানুষের সাথে হয়, আমার প্রথম প্রেম শুধু ভুল মানুষের সঙ্গে নয় বরং একটা জঘন্য নোংরা খারাপ মানুষের সাথে হয়েছিল। আর তার নাম সজিব।
আমি: কেঁদো না প্লিজ! সজিব কি তোমাকে এখনো ডিস্টার্ব করে?
হিমি: নাতো।
আমি: তাহলে আমাকে কেন ভয় দেখাচ্ছে? শান্তর এই অবস্থা কেন করলো?
হিমি: জানিনা। (হিমি আচমকা আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো)
আমি: কাঁদছ কেন পাগলী কি হয়েছে?
হিমি: আরশান আমি আপনাকে হারাতে চাই না, সজিব খুব খারাপ মানুষ আমি ওকে চিনি। সজিব এখন শান্ত ভাইয়ার এই অবস্থা করেছে কাল যে আপনার এই অবস্থা করবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে?
আমি: আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না কারণ আমার কাছে তোমার ভালোবাসা আছে। (হিমির দুগালে ধরে ওর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিলাম)
হিমি: আমার খুব ভয় করছে।
আমি: কিসের ভয়? আমার বউ হতে পারবে না?
হিমি: সবসময় এতো দুষ্টুমি করেন কেন?
আমি: তোমার চোখে কান্না দেখতে আমার ভালো লাগেনা, হাসো। (হিমি মুখ মলিন করে মাথা নিচু করে আছে। আমাকে ঝাপটে ধরার কারণে হিমির মাথার ঘোমটা পড়ে গিয়েছিল, ওড়না টেনে যত্ন করে হিমির মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিলাম)
আমি: এইযে মায়াবতী ঘোমটা দিয়ে তোমাকে আমার বউ করে নিলাম এবার তো অন্তত একটুখানি হাসো।
হিমি আমার পাগলামি দেখে ফিক করে হেসে দিলো। পূর্নিমার চাঁদের আলোতে কোনো মায়াবতী যদি এভাবে হাসে তাহলে কি মন মুগ্ধ নাহয়ে পারে? হিমি হাসছে আমি মুগ্ধ নয়নে ওর হাসি দেখছি আর ভাবছি এই মায়াবতীর মুখে সবসময় এই হাসিটা দেখার জন্য আমি সব করবো...
চলবে😍
(১০ এবং ১১ নং পর্ব একসাথে)
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com