অনুগল্প - কোয়ারান্টাইন এ গরীবের জীবন || লেখাঃ মোঃ নুরুল আজিম
স্টেশন থেকে বাড়ির দিকে এগোচ্ছি। রাস্তাঘাট একদম শূণ্য। দেশ লকডাউন। অনেকক্ষণ রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে করতে উপায়ান্তর না পেয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। রিকশা একটার প্রয়োজন ছিলো কেননা হাতে কয়েকটা প্যাকেট রয়েছে। কষ্ট হলেও হাঁটতে হচ্ছে।
.
আস্তে আস্তে এলাকায় ঢুকে পড়লাম। আর কিছুদূর যেতেই একটা রিকশা ড্রাইভার নজরে পড়লো।
হ্যাঁ লোকটা তো চেনা।
অবসর সময়ে প্রায় বসে উনার সাথে গল্প করতাম। বেশ ভালো মানুষ। কিছু ভাবান্তর আর উদ্ভট প্রশ্ন করতো যেগুলোর আদৌ কোনো উত্তর থাকতো না আমার কাছে। নিজেই অতঃপর সমাধান দিতো।
.
বেশ ভালো লাগলো উনাকে পেয়ে। হাতটা যেনো ছিঁড়ে যাওয়ার অবস্থা। উনি রাস্তার পাশে রিকশাটা রেখে রাস্তায় বসে আছেন। যতোটুকু দেখতে পাচ্ছি হয়তো কাঁদছে। মাথায় কিছুই ঠেকছে না। যে লোকটাকে সারাক্ষণ হাসি খুশিতে দেখতাম তিনি কি কারনে কাঁদতে পারে?
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে করতে উনার দিকে এগিয়ে গেলাম।
.
- আসসালামু আলাইকুম চাচা! কেমন আছেন?
উনি পেছন দিকে ফিরে আমাকে দেখতে পেয়ে চোখজোড়া মুছতে মুছতে সালামের জবাব দিলেন।
- ওয়ালাইকুম সসালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। এইতো বাবা আছি কোনোরকম। তো! তোমার কি অবস্থা? একদমই তো দেখা যায় না!
- আছি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ঘরেই ছিলাম এতোদিন। এখন আর তেমন বাইরে বের হচ্ছি না। এই আর কি!
কিছু মানুষ আছে যারা হুট করেই নিজেকে গুছিয়ে ফেলতে পারেন। আমার দেখা তাঁদের মধ্যে একজন এই চাচা। একটু আগেই কাঁদ ছিলো, আর এখন দেখে মনে হচ্ছে যেনো উনি একদমই স্বাভাবিক। বেশ গুণসম্পন্ন মানুষ বলতে হবে চাচাকে।
.
হাতে থাকা প্যাকেট গুলো একপাশে রেখে চাচার পাশেই বসে পড়লাম তিন ফুট দুরত্ব বজায় রেখে।
মনে মনে বললাম, একটা প্রশ্ন করেই দেখি ঘটনা কি!
- আচ্ছা চাচা! সমস্যা কি আমাকে কি বলবেন? কেনো আপনি এই অসময়ে রাস্তার ধারে বসে বসে কাঁদছেন?
অন্য মানুষ হলে হয়তো ভূমিকা করতো এই সেই বলে বলে। কিন্তু না! ইনি সম্পুর্ন ব্যাতিক্রম। সবগুলো সহজভাবে বলতে লাগলো।
- কি আর করার আছে বাবা! ঘরে চাল ডাল নেই খাওয়ার। দুইদিন যাবৎ চুলায় আগুন জ্বলছে না। তোমার চাচি পোলা মাইয়া সহ সবাই উপোষ।
এই কথা বলতেই দেখলাম চাচার মুখ থেকে হাসিটা যেনো কেউ কেড়ে নিলো। চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো মুখ বেয়ে।
- তো চাচা গাড়ি চালাচ্ছেন না নাকি!
- কি করে চালাবো। মাস্ক পরে বের হলেও পুলিশে পিটাচ্ছে। বলে যে ঘরে বসে থাক।
ঘরে কিছু নাই। পুলা মাইয়া দুটোই ক্ষিদের ছুটে কান্না করতেছে। এইগুলা আর দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না তাই চলে আসলাম এইখানে। তোমার চাচি হয়তো দরজার দিকে তাকিয়ে আছে আমি কখন চাল নিয়ে ঘরে ফিরবো।
- সরকার থেকে তো বোধহয় আপনাদের জন্য চাল ডাল ইত্যাদি দিচ্ছে। আপনি কি এইগুলো পাননি?
চাচা এবার গোমড়ামুখে বললেন,
- ওইগুলো কপালে থাকতে হয়। আমার ভাগ্য এমন যে ওগুলোও আমার কপালে জুটলো না।
করোনা থেকে বাঁইচা কি লাভ যদি ঘরে থেকেই বউ পুলা দের না খেতে পেয়ে মরতে দেখি?
.
আচ্ছা কোথাও কি লেখা আছে যে আগে ঘরবন্দী করো তারপর খাদ্য বিতরণ করো!
দেশ লকডাউন করছে ভালো কথা। আমাদের যে দেশের অবস্থা! তোমার কি মনে হয় তিনদিনেই প্রত্যেকের ঘরে ঘরে চাল, ডাল ইত্যাদি যা দিচ্ছে সব পৌঁছে যাবে?
ধরে নিলাম তিনদিনেই সব পৌঁছে যাবে। তো যারা দিনে এনে দিনে খাই তাঁরা কি বেঁচে যাবে!
সেই গরিব ঘরের চার বছরের বাচ্চা কি তিনদিন না খেয়েই এই জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে পারবে?
পারবে না। অনাহারেই মারা যাবে।
আমি মানলাম যে লকডাউন করলে করোনার বিস্তার কমে আসবে।
আমার মতো গরীবরা তো আর বেঁচে থাকবে না।
কোনো বাবাই কি দেখতে পারবে তাঁর সন্তানটা ক্ষুধার জ্বালায় মরে যাক!
নিশ্চয়ই চাইবে না।
.
- আপনাদের পাশে কি কোনো বড়োলোক নেই যারা এই দিনে আপনাদের একটু সহায়তা করবে?
- আছে বাবা! থাকবে না কেনো? তাঁদের কথা আর কি বা বলবো!
দেশ লকডাউনের কথা শুনে তাঁরা ফ্রিজে আর গুদামে জিনিসপাতি এক কেজির জায়গায় দশ কেজি নিয়ে নিয়ে জমাতে শুরু করছে।
এতে কি হয়েছো জানো!
এক কেজি আলু দশ টাকা বেড়ে বিশ টাকা থেকে ত্রিশ টাকায় গিয়ে পৌঁছেছে।
- কি বলেন চাচা! এ তো দেখি মহা সমস্যা।
- চারদিন আগে দশ-বারোজন লোক আসছিলো খাবার সামগ্রী দিতে। মোট হিসেব করলে দাঁড়াবে দুইশো টাকার জিনিস।
এইগুলো হাতে দিয়ে চল্লিশ-পঞ্চাশটি ছবি তুলে ফেলেছিল।
আমরা অসহায় বাবা! অনেক বড়ো অসহায়।
চাচার চোখ দিয়ে বৃষ্টির মতো পানি ঝরছে।
.
এবার দেখলাম চাচা দাঁড়িয়ে গেলেন।
- কই যাবেন চাচা?
- পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে। ঘরে বন্দী হয়ে থেকে বউ পুলা সহ উপোষেই না মরে তাঁদের মুখে খাবার তুলে দিয়ে করোনাই মারা গেলেও আত্মাটা শান্তি পাবে।
অন্তত ক্ষিদের জ্বালায় চটপট করতে করতে মরতে হবে না।
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com