তবুও ভালোবাসি || পার্ট: ৩০/অন্তিম || লেখিকা: সুলতানা তমা
রাত দশটা, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চেপে যাচ্ছি, কয়েকবার বেল বাজানোর পর ফিরোজ চাচ্চু এসে দরজা খুলে দিলেন।
ফিরোজ চাচ্চু: ওহ আনিশা মা তুমি এসেছ।
আমি: দরজা খুলতে এতো দেরি হলো কেন আর বাকিরা সবাই কোথায়?
ফিরোজ চাচ্চু: হসপিটালে। (সোফায় বসতে গিয়েও বসলাম না, সবাই হসপিটালে তারমানে ভাইয়ার কাছে আছে সবাই)
ফিরোজ চাচ্চু: জামাই বাবাজির কাছে অনেক বার ফোন করেছি কিন্তু উনি রিসিভ করেনি, সিহাব বাবাজিকে কারা যেন খুব মেরেছে।
আমি: আদিল ব্যস্ত ছিল তাই হয়তো রিসিভ করেনি।
ফিরোজ চাচ্চু: তুমি কি হসপিটালে যাবে?
আমি: হ্যাঁ আমি যাচ্ছি তুমি বাসায় থেকো।
ফিরোজ চাচ্চু: আচ্ছা মা।
আদিল না বুঝে ভাইয়ার এই হাল করেছে এইটা সবাইকে বলা প্রয়োজন, নাহলে ভাইয়া সুস্থ হয়ে এসব বললে চাঁচি হয়তো আদিলকে ভুল বুঝবেন। তাড়াতাড়ি হসপিটালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।
দরজা খুলতেই আব্বুর গাড়ি এসে থামলো, ফুফু আর আব্বু নেমে আসলেন।
আমি: আব্বু তোমরা চলে এসেছ ভাইয়া এখন কেমন আছে?
আব্বু: ভালো আছে সকালে রিলিজ করে দিবে।
ফুফু: তোকে কতবার ফোন করেছি কিন্তু...
আমি: আসলে ফুফু আদিল একটু ব্যস্ত ছিল, আদিল মিতু আর নীরবের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।
আব্বু: কি বলছিস? শিরিন জানে?
আমি: বিয়েটা মা'কে না জানিয়েই হয়েছে তবে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ওরা বাসায় ফিরে গেছে।
আব্বু: শিরিন মেনে নিয়েছে?
আমি: এখনো মেনে নেয়নি তবে আজ মা'কে কিছুটা অন্যরকম লাগছিল মনে হচ্ছিল উনি উনার ভুল কিছুটা বুঝতে পেরেছেন।
আব্বু: বুঝলেই ভালো।
আমি: আব্বু একটা কথা ছিল।
আব্বু: বল। (আব্বু সোফায় হেলান দিয়ে বসতে বসতে বললেন, আমি গিয়ে আব্বুর পাশে বসলাম)
আমি: আব্বু ভাইয়াকে কারা মেরেছে জানো?
আব্বু: না এখনো সিহাব কিছু বলেনি।
আমি: আদিল আর নীরব মেরেছে।
আব্বু: কি?
ফুফু: কি বলছিস কি তুই? (ফুফু রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিলেন আমার কথা শুনে এদিকে এগিয়ে আসলেন, সবাই রেগে গেলে আমি এখন কি করবো?)
আমি: আসলে ভাইয়া ও বাসায় গিয়েছিল মায়ের সাথে কথা বলার জন্য কিন্তু আদিল আর নীরব না বুঝে ভাইয়াকে মেরেছে। আব্বু পুরোটাই একটা ভুল বুঝাবুঝি তোমরা রাগ করোনা প্লিজ!
আব্বু: আমরা নাহয় বুঝলাম ভুল বুঝাবুঝি কিন্তু তোর চাঁচি কি বুঝবে?
ফুফু: এভাবে কেউ কাউকে মারে?
আমি: চাঁচিকে আমি বুঝিয়ে বলবো।
আব্বু: ঠিক আছে সকালে ওরা বাসায় ফিরে আসুক তারপর নাহয় দেখা যাবে কি হয়।
আমি: হুম।
আনমনা হয়ে ছাদের ফুল গাছ গুলোতে পানি দিচ্ছি আর ভাবছি সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চললো কিন্তু চাঁচি এখনো ভাইয়াকে নিয়ে আসছে না কেন? ভাইয়াকে কি তাহলে রিলিজ করেনি? গাড়ির হর্ণ এর শব্দে আমার ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো, নিচে তাকিয়ে দেখি চাঁচি গাড়ি থেকে নামছেন। আর এক মুহূর্ত দেরি করলাম না দৌড়ে নিচে আসলাম।
ফুফু দরজা খুলে দিতেই চাঁচি এসে ভিতরে ঢুকলেন, চাঁচির পিছনে মা আর মিতুকে দেখে বেশ অবাক হলাম।
আদিল: আস্তে আস্তে... (দরজায় আবারো চোখ পড়তেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম, আদিল আর নীরব ভাইয়াকে ধরে ধরে ভিতরে নিয়ে আসছে। ভাইয়ার কপালে ব্যান্ডেজ পায়ে ব্যান্ডেজ। আমিতো অবাক হচ্ছি ওদের কান্ড দেখে, গতকাল মেরে হসপিটাল পাঠালো আর আজ ধরে ধরে বাসায় নিয়ে আসলো?)
আব্বু: সবাই একসাথে আমার বাসায়?
চাঁচি: সিহাবকে এখানে বসিয়ে দাও। (আদিল আর নীরব ভাইয়াকে সোফায় বসিয়ে দিলো। আদিল সোফায় বসতে বসতে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মারলো, আদিল আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি)
ফুফু: সবাই একসাথে আমাদের বাসায় বুঝতে পারছি না কিছু।
মা: আমার ছেলেদের জন্যই তো সিহাবের এই অবস্থা হয়েছে তাই ওকে দেখতে হসপিটাল গিয়েছিলাম। (উনি ভাইয়াকে দেখতে এসেছেন আর আমি কিনা ভেবে বসে আছি উনি ভুল বুঝতে পেরেছেন)
মা: আর বাসায় এসেছি আমার বৌমাকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। (মায়ের কথা শুনে চমকে উঠলাম, আদিলের দিকে তাকালাম ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে)
মিতু: চিন্তা করো না এবার সব ঠিক হবার পালা। (মিতু এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কানেকানে বললো)
ফুফু: আনিশাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছেন? কিন্তু...
মা: আপনাদের মেয়েকে দিবেন না? ভুল করেছি মানছি তাই বলে শোধরানোর সুযোগ দিবেন না?
আব্বু: আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
মা: এতে না বুঝার কি আছে? আমি আমার ভুল গুলো বুঝতে পেরেছি আর তাই সবকিছু এবার শোধরে নিতে চাই।
আমি: মা কাল অব্ধি তো আপনি আমাকে সহ্য করতে পারতেন না।
আব্বু: যার ভুল এতো গুলো বছরে ভাঙাতে পারলাম না সে এক রাতের মধ্যে সব ভুল বুঝতে পারলো? এতো পরিবর্তন?
মা: এতো বছরে বুঝতে পারিনি বলে যে আর কখনো বুঝতে পারবো না সেটা তো নয়। মানুষ একদিন ঠিক ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনায় ভোগে যেমন আমি...
আব্বু: ভূতের মুখে রামনাম। (আব্বু আস্তে কথাটা বললেন আমি পাশে আছি বলে শুনে ফেললাম, মা শুনে থাকলে তো এখন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবেন)
মা: কিছু বললে?
আব্বু: নাতো। (আব্বুর কান্ড দেখে হাসি পাচ্ছে মনে হচ্ছে দুজন বাইশ বছর আগের জীবনে ফিরে গেছেন। কিন্তু মায়ের ব্যাপারটা তো আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না, এক রাতের মধ্যে কি এমন হলো যে মা এতোটা শোধরে গেলেন?)
চাঁচি: সবকিছু পরে শুনো এখন সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো সেই সকালে সবাই হসপিটালে এসেছিল।
ফুফু: হুম দিচ্ছি সবাই ফ্রেশ হয়ে এসো।
আদিল: রুমে চলো। (আদিল কানের কাছে এসে বললো, ওর দিকে তাকিয়ে আছি কি যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না)
আদিল: কি হল চলো।
আমি: হুম।
আদিলের পিছু পিছু রুমে আসলাম, আদিল রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে ফেললো।
আমি: কি করছ?
আদিল: আই লাভ ইউ আনিশা। (আদিল আমাকে জড়িয়ে ধরলো আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি)
আমি: আদিল কি হচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আদিল: আম্মু তোমাকে মেনে নিয়েছেন।
আমি: সত্যি?
আদিল: হুম। (আদিল আমার দুগালে ধরে আমার কপালে আলতো করে একটা চুমু দিলো)
আদিল: আর তোমার থেকে আমাকে দূরে থাকতে হবে না। (আদিলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম)
আদিল: আমি বোকা তাইতো বারবার নিজের ভালোবাসার উপর বিশ্বাস হারিয়েছি আর আম্মুর থেকে আলাদা হয়ে যেতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি? তুমি কখনো নিজের ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস হারাওনি মনে জোড় রেখেছ সব একদিন ঠিক হয়ে যাবে ভেবে। আর দেখো আজ সব ঠিক হয়ে গেল। তখন যদি আমি আম্মুর থেকে আলাদা হয়ে যেতাম তাহলে আজ হয়তো আম্মু নিজের ভুল বুঝতে পারলেও আমাকে ক্ষমা করতো না।
আমি: এবার বুঝেছ তো মা বাবাকে একা করে দিয়ে কখনো দূরে যেতে নেই। সন্তান ভুল করলে যেমন মা বাবা ক্ষমা করে দেন তেমনি মা বাবা ভুল করলেও সন্তানের ক্ষমা করে দেয়া উচিত।
আদিল: হুম বুঝেছি।
আমি: এবার যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।
আদিল: তার আগে...
আমি: কি? (আদিল আমাকে টেনে ওর কাছে নিয়ে গেল, আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে)
আমি: আদিল কি হচ্ছে?
আদিল: চুপ।
আদিল আলতো করে আমার দুগাল ধরে আমার ঠোঁটে ওর ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো, কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে ওয়াশরুমে চলে গেল, ফাজিল একটা।
আমি: আচ্ছা আদিল কাল রাতে কি এমন হলো যে মা এতোটা পাল্টে গেলেন? (আদিল ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ওর দিকে তোয়ালেটা এগিয়ে দিতে দিতে প্রশ্নটা করলাম)
আদিল: অনেক কিছু।
আমি: যেমন?
আদিল: রাতে তুমি চলে আশার পর আমি আম্মুর রুমে যাই আম্মুকে বুঝাব বলে, রুমে গিয়ে ভাইয়ার ডায়েরীটা আলমারির কাছে পড়ে থাকতে দেখি। কিছুটা খটকা লাগে আম্মু ডায়েরীটা না পড়ে ফেলে রেখেছে নাকি এইটা ভেবে। আম্মুকে জিজ্ঞেস করতেই আম্মু রেগে গিয়ে বলে এসব ডায়েরী পড়ার প্রয়োজন নেই।
আমি: তারপর?
আদিল: তারপর আমি আম্মুর পাশে বসে ডায়েরীটা পড়তে শুরু করি, আম্মু খুব কাঁদছিল ভাইয়ার লেখা গুলো শুনে। শেষ পৃষ্ঠা যখন পড়লাম বিশ্বাস করো আনিশা এর আগে কখনো আম্মুকে এতোটা কাঁদতে দেখিনি, আম্মু কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেল। মিতু আর আমি তো ভয়ে কান্না শুরু করেছিলাম আম্মুর কিছু হলে তো আমরা আবারো এতিম হয়ে যেতাম। নীরব ডক্টর নিয়ে আসে, ডক্টর ইনজেকশন দিতেই আম্মু আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেন। আম্মু ভাইয়ার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করছিল তখন দাদু আম্মুকে বুঝায় যে আমাদের এতো কষ্ট যে দিচ্ছে যদি আমার বা মিতুর কিছু হয়ে যায়? আম্মু তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে সবকিছু মেনে নেন।
আমি: আমাকেও?
আদিল: আমাদের বিয়েটা মেনে নিলেও আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম আম্মু তোমার উপর রেগে আছেন সিহাবের বিষয়টা নিয়ে। আম্মুর ভুল ভাঙানোর জন্য সকালে আম্মুকে হসপিটাল নিয়ে যাই আর সবকিছু খুলে বলি।
ফুফু: আনিশা আদিলকে নিয়ে নিচে আয়।
আমি: আসছি ফুফু।
আদিল: চলো।
মা: তোমার বিষয় নিয়ে আমি জিদ করেছি সেটা আমিও মানছি কিন্তু আনিশার উপর রাগ করাটা আমার অন্যায় কোথায় ছিল বলতে পারো? (মা আব্বুর উদ্দেশ্যে কথাটা বললেন আব্বু খাবার রেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন)
ফুফু: আদিলকে নিয়ে বস। (আদিলকে চেয়ার টেনে দিয়ে ওর পিছনে দাঁড়িয়ে রইলাম)
মা: কোনো মেয়ে বিয়ের পর অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক রাখবে আর সেটা শাশুড়ি মেনে নিবে এমনটা কখনো হয়? সিহাব আমাকে আনিশার ব্যাপারে বাজে কথা বলেছে এমনকি ছবি দেখিয়ে আমাকে ভুল বুঝিয়েছে তাই আমি আনিশার উপর এতো রেগে ছিলাম, এবার তোমরা বলো আমার রাগ করাটা কি অন্যায় ছিল?
চাঁচি: না না আপনার অন্যায় হবে কেন আপনাকে তো ভুল বুঝানো হয়েছিল। সব দোষ আমার ছেলের আর ও তো নিজের দোষ স্বীকারও করেছে।
মা: হুম রাতে যদি আদিল আবিরের ডায়েরী পড়ে আমাকে না শুনাতো তাহলে হয়তো আমার রাগ জিদ কখনো কমতো না। আর সকালে হসপিটাল যাওয়ার পর যদি সিহাব আমাকে সব সত্যি না বলতো তাহলে হয়তো আনিশাকে আমি সবসময় ভুল বুঝে যেতাম।
ফুফু: তাহলে আমাদের মেয়ের উপর থেকে সব রাগ অভিমান মিটে গেছে তো?
মা: একদম। আমার জিদের কারণে আবির আর রাইমা মারা গেছে সেটা আমি দেরীতে হলেও বুঝতে পেরেছি। আমার মিতু বা আদিল আবিরের মতো কোনো ভুল করুক তা আমি চাই না, নীরব আর আনিশা কষ্ট পাবে সেটাও আমি চাই না তাই ওদের মেনে নিয়েছি।
ফুফু: আর ভাইয়ার প্রতি রাগ অভিমান? (ফুফুর কথা শুনে সবাই নীরব হয়ে গেল, আব্বু আর মা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছেন)
ফুফু: আব্বু আম্মু মারা যাওয়ার পর বড় ভাইয়া আমাকে আর ছোট ভাইয়াকে খুব কষ্ট করে বড় করেছেন। আগে তো আমাদের এসব ছিলনা কিন্তু ভাইয়ার ভালোবাসা ছিল আর ভাইয়ার ভরসা ছিলে তুমি। তোমাকে কখনো দেখিনি কিন্তু ভাইয়ার মুখে সবসময় তোমার নাম শুনতাম, ভাইয়া বলতো সারাদিনের সব কষ্ট ভুলে যায় যখন তোমার সাথে কথা বলে।
মা: (নিশ্চুপ)
ফুফু: কিন্তু হঠাৎ করে তুমি পাল্টে গেলে ভাইয়া দিন দিন কেমন যেন হয়ে গেল, ভাইয়া সবসময় লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত। একটা সময় তুমি তোমার ভাইয়ার কথায় ভুলে গেলে তোমাদের ভালোবাসার কথা। তোমাকে হারানোর জন্য ভাইয়া সবসময় আমাদের গরীব হওয়াটাকে দায়ী করতো, আর তাই ভাইয়া রাগে অভিমানে ছুটতে থাকে টাকার পিছনে। হুট করে আমার বিয়ে দিয়ে দিল কয়েকমাস পর ডিভোর্স নিয়ে আবার ভাইয়ার কাছে ফিরে আসলাম কারণ স্বামী নেশা করতো জোয়া খেলতো। ভাইয়াকে বিয়ের কথা বললে রাগ করতো তাই শেষমেশ ছোট ভাইয়াকে বিয়ে করানো হলো। এক বছরের মাথায় ছোট ভাইয়া আর আমি ভাইয়াকে বিয়ের জন্য খুব ছাপ দিলাম কান্নাকাটি করতাম, আমাদের কথা রাখতে গিয়ে ভাইয়া বিয়ে করলো। কিন্তু...
আব্বু: সায়মা থাকনা এসব কথা।
মা: ওকে বলতে দাও।
ফুফু: কিন্তু ভাবিকে ভাইয়া আপন করে নিতে পারেনি। সংসার হয়েছিল কিন্তু ভাবি কখনো ভাইয়ার ভালোবাসা পায়নি। ভাইয়া তোমার উপর জমে থাকা রাগ থেকে সারাক্ষণ টাকা টাকা করতো, একটা সময় ভাইয়ার এসব ব্যাংক ব্যালেন্স সব হয়। ভাবি প্রেগন্যান্ট হয় ভাইয়ার মন পরিবর্তন হতে শুরু করে, ভাইয়া ভাবিকে ভালোবাসতে শুরু করে কিন্তু সে ভালোবাসা বেশিদিন টিকেনি। রাইমা আর আনিশাকে জন্ম দিতে গিয়ে ভাবির মৃত্যু হয়। কিছুদিন পর ছোট ভাইয়া এক্সিডেন্টে মারা যায়। ছোট ভাবি সিহাবকে নিয়ে বাবার কাছে চলে যায়। আর আমি ভাইয়া রাইমা আর আনিশাকে অনেক কষ্টে বড় করি। এখন আমাদের সব আছে শুধু হারিয়ে গেছে ছোট ভাইয়া আর ভাবি সাথে তোমার আর ভাইয়ার ভালোবাসা। ভাইয়া তোমাকে সত্যি খুব ভালবাসতো। (ফুফুর কথা গুলো শুনে সবাই কেমন যেন নীরব হয়ে গেছে। আব্বু আর মায়ের দুজনের চোখেই পানি। সত্যি ভালোবাসা বড়ই অদ্ভুত)
আব্বু: সায়মা এখন আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রেম করার সময় আর তুই কিনা আমাদের বুড়োবুড়ির গল্প জুড়ে দিলি। (আব্বু চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করে হাসছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যই আব্বু চোখের পানি লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে হাসছেন)
আব্বু: সব ভালোবাসা কি পূর্ণতা পায়? কিছু ভালোবাসা অপূর্ণ রয়ে যায়। বেশ তো আছি আমার মেয়েকে নিয়ে আমি ভালো আছি শিরিন ওর ছেলে মেয়েদের নিয়ে ভালো আছে, দুজনের আবার দেখা হয়েছে আর কি চাই? হয়তো বাইশ বছর আগের দিনগুলো আর ফিরে আসবে না কিন্তু বন্ধু হয়ে তো থাকতেই পারি মরণের আগ পর্যন্ত। তাছাড়া আমরা তো এখন বেয়াই বেয়াইন এভাবেই কাটিয়ে দিবো বাকি দিনগুলো, কি বলো শিরিন?
আব্বু জোড়ে জোড়ে হাসছেন, মা আব্বুর দিকে তাকিয়ে শুকনো একটা হাসি দিলেন। ভালোবাসা বোধহয় এমনি কাউকে হাসায় কাউকে কাঁদায়, আবার কিছু ভালোবাসা অপূর্ণই থেকে যায়।
ফুফু: আনিশা তোর হলো?
আমি: হ্যাঁ ফুফু এইতো সব সাজানো শেষ।
ফুফু: সবাইকে ডেকে নিয়ে আয়।
আমি: ঠিক আছে।
ফুফু আর চাঁচি রাতের খাবার গুছিয়ে দিচ্ছেন আর আমি টেবিলে এনে সাজিয়েছি, খেয়েই বাসায় ফিরতে হবে। মা'কে অনেক কষ্টে ফুফু আর চাঁচি রাজি করিয়েছেন রাতের খাবার খেয়ে তারপর বাসায় ফিরতে। সারা বিকেল সবাই একসাথে আড্ডা দিয়ে গল্প করে কাটিয়েছি এখন রাত হয়েছে খাবার খেয়েই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।
মা: কথায় আছে না অহংকার পতনের মূল? আমার অহংকার তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। সেদিন যদি আমি টাকা পয়সার অহংকারের চেয়ে ভালোবাসাকে বড় করে দেখতাম তাহলে আজ এমন দিন আসতো না আমাদের জীবনে। (আব্বুকে ডাকতে আব্বুর রুমে এসেছিলাম, দরজার কাছে আসতেই মায়ের কন্ঠ শুনে থেমে গেলাম)
মা: আমি তোমার ভালোবাসা বুঝিনি ভাইয়ার কথায় আমি নিজের ভালোবাসা ভুলে গিয়েছিলাম, তোমার মন ভেঙেছিলাম। যদি কখনো পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও। (মা আব্বুর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন, আব্বু মায়ের হাত নামিয়ে দিলেন)
আব্বু: হ্যাঁ অহংকার পতনের মূল আর ভালোবাসার চেয়ে বড় আর কিছু নেই। তবে এটাও সত্যি জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবকিছু আল্লাহর হাতে। তোমার সাথে আমার জুটি লেখা ছিলনা তাই সেদিন এমন হয়েছিল, তুমি নিজেকে অজতা দায়ী করো না। তোমার কাছে একটাই অনুরোধ আমার আনিশাকে মায়ের ভালোবাসা দিও একটু।
আমি: আসতে পারি? (আমার কন্ঠ শুনে দুজনেই চোখের পানি মুছে নিলেন)
আব্বু: হ্যাঁ আয়।
আমি: আব্বু, মা খাবে চলো।
আব্বু: আমার মেয়েটাকে আগলে রেখো শিরিন, মা হারা মেয়ে একটা বোন ছিল সেও ছেড়ে চলে গেছে এখন তু...
মা: চিন্তা করো না আনিশা আমার মেয়ে হয়ে থাকবে। (মা আমার কপালে চুমু দিলেন, মায়ের ভালোবাসা কেমন হয় আজ বুঝলাম। আদিলের কথা শুনে যদি মা'কে ছেড়ে আলাদা বাসায় চলে যেতাম তাহলে কি আজ এই ভালোবাসা টুকু পেতাম?)
মা: এই পাগলী মেয়ে কাঁদছিস কেন? চল বাসায় ফিরে যেতে হবে তো। (মা আমার চোখের পানি মুছে দিলেন)
আব্বু: চল।
আমি: হুম চলো।
ভাইয়া: আনিশা?
আমি: হুম। (খাওয়াদাওয়া সেরে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে বেরুচ্ছিলাম দরজায় আসতেই ভাইয়া পিছু ডাকলো। ভাইয়ার কাছে এসে সোফায় বসলাম)
আমি: কিছু বলবে?
ভাইয়া: পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস।
আমি: যে ভুল করে পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনায় ভোগে তাকে ক্ষমা না করে পারা যায়? আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। (ভাইয়া মৃদু হাসলো)
আমি: আসছি সাবধানে থেকো।
সবাইকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
মা কলিংবেল চাপলেন আর দাদু এসে দরজা খুলে দিলেন। আজ মনে হচ্ছে আমি আমার নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছি আমার সংসারে আমি ফিরে এসেছি।
দাদু: এসেছিস তোরা? আমার নাতবৌ কোথায়?
আমি: এইতো দাদু আমি।
দাদু: ভিতরে আয়।
মা: তোদের সবার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস। (ভিতরে আসতেই মা হাত জোড় করে সবার কাছে ক্ষমা চাইলেন, আদিল আর মিতু মা'কে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো)
আদিল: যা হবার হয়েছে আম্মু সব ভুলে যাও।
মা: হুম সবাই রুমে যা।
দাদু: আমি ওদের রুমে নিয়ে যাবো।
মা: কেন?
দাদু: ও তুই বুঝবি না তুই রুমে যা। আদিল এখানে বসে থাক নড়বি না আর আনিশা চল তো মিতুর রুমে।
দাদুর পিছু পিছু মিতু, নীরব আর আমি মিতুর রুমে আসলাম।
পুরো রুম সাজানো দেখে দাদুর দিকে সবাই অবাক হয়ে তাকালাম দাদু হাসছেন। যাক অন্তত ওদের বাসরঘর তো সাজানো হলো ওদের মনে কোনো আপসোস থাকবে না।
দাদু: কেমন হয়েছে?
নীরব: খুব সুন্দর দাদু, থ্যাংকইউ।
দাদু: আনিশা চল।
আমি: হ্যাঁ চলো।
নীরব: দেখেছ যা হয় ভালোর জন্য হয় কাল এই খাট সাজানো ছিলনা বলে তোমার মন খারাপ ছিল আর আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাসর হয়নি। আজ দেখো আম্মু খুশি মনে আমাদের মেনে নিয়েছেন আর এই খাটও তোমার মনের মতো করে সাজানো। আই লাভ ইউ পিচ্ছি মিতু। (নীরব মিতুর কপালে চুমু দিয়ে মিতুকে জড়িয়ে ধরলো, এদিকে দাদু আর আমি হাসছি)
আমি: আমরা কিন্তু সব দেখে ফেলেছি। (হঠাৎ আমার কন্ঠ শুনে মিতু লজ্জা পেয়ে নীরবের থেকে দূরে সরে গেল)
নীরব: ভাবি তুমি না সত্যি একটা ফাজিল মেয়ে, আর দাদু তুমি...
আমি: দরজা খুলা রেখে রোমান্স করলে সেটা কি আমাদের দোষ?
দাদু: একদমই আমাদের দোষ না।
নীরব: যাও বলছি দুজন।
দাদু আর আমি হাসতে হাসতে চলে আসলাম।
মা: আদিল মিতু যেন কখনো সত্যিটা জানতে না পারে। (ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখি মা আদিলের হাত ধরে কাঁদছেন)
মা: আমি মিতুর মা হয়ে বাকি জীবন কাটাতে চাই।
আদিল: তুমি আমাদের মা নও ফুফু এইটা মিতু কখনো জানবে না আম্মু।
দাদু: শিরিন।
মা: আব্বু আমাকে ক্ষমা করে দাও।
দাদু: পাগলী মেয়ে চল রুমে চল। আর আদিল আনিশাকে নিয়ে রুমে যা সারপ্রাইজ আছে।
আদিল: কি সারপ্রাইজ দাদু?
দাদু: সারপ্রাইজ কি কেউ আগে বলে? (দাদু মা'কে নিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলেন)
আমি: দাদু কিসের সারপ্রাইজ এর কথা বললেন?
আদিল: জানিনা। (আদিল আমার কাছে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলো)
আমি: কি করছ?
আদিল: চুপ। (চুপ হয়ে আদিলের শার্ট খামছে ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি)
রুমে এসে আদিল আমি দুজনেই চমকে গেলাম, দাদু আমাদের জন্য এমন একটা সারপ্রাইজ রেডি করেছেন? খাটে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে আছে পাশের টেবিলে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা রাখা, পুরো রুম জুড়ে অনেক গুলো ক্যান্ডেল লাইট জ্বলছে। ক্যান্ডেল লাইটের আবছা আলোতে রুমটাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।
আদিল: এতো সুন্দর সারপ্রাইজ?
আমি: দাদু পারেনও বটে।
আদিল: দাদু আমার মনের কথা বুঝেছেন।
আদিল মুচকি হেসে আমাকে এনে খাটে শুয়ে দিলো। আমি আদিলকে মুগ্ধ নয়নে দেখছি, আমার তাকানো দেখে আদিল মৃদু হাসলো তারপর আমার কপালে ওর ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো।
সাত মাস পর...
বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে ফোনে বেবিদের পিক দেখছি হঠাৎ পেটে মৃদু ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম।
আমি: উফফ!
আদিল: আনিশা কি হয়েছে? (আদিল সোফায় বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিল দৌড়ে এসে আমার পাশে বসলো)
আদিল: কি হয়েছে?
আমি: কি হবে তোমার ছেলে আমার পেটে লাতি দিয়েছে।
আদিল: ওহ এই কথা ঠিক আছে আমি আমার ছেলেকে নিষেধ করে দিচ্ছি। (আদিল আমার পেটের একদম কাছে এসে কথা বলছে দেখে হাসছি, আদিল মাঝেমাঝেই এমন করে আর পেটে কান পেতে ছেলের কথা শুনে ছেলে নাকি ওকে এখনি আব্বু বলে ডাকে হিহিহি)
আদিল: আব্বু তোমার আম্মুকে এখন জ্বালিও না কেমন? তুমি বড় হলে পর বাপ ছেলে দুজন একসাথে মিলে তোমার আম্মুকে জ্বালাবো।
আমি: এই কি হচ্ছে আমাকে জ্বালানোর প্ল্যান হচ্ছে ছেলের সাথে? (আদিল মুচকি হেসে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো)
আদিল: রাগ করো না, তুমি যে আমাকে এখনো ভালোবাস এটাই তো আমার সৌভাগ্য। আম্মু তোমার উপর কতো অত্যাচার করেছেন, আমি নেশা করে তোমাকে অত্যাচার করেছি এতো কিছুর পর তুমি তবুও...
আমি: তবুও ভালোবাসি। আর কেন ভালোবাসি কেন কষ্ট পাই তুমি যেমন জানো আমিও তাই, তবুও ভালোবাসি তবুও ভেজে চোখ এভাবেই বেঁচে থাকা এভাবেই যে আমার সুখ।
আদিলের দুচোখে পানি কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাসিও আছে, এই হাসি ভালোবাসা জয়ের। আদিল আমার পেটে আলতো করে চুমু খেলো আমি পরম আবেশে চোখ বুজে ফেললাম। রাগ, অভিমান, জিদ, অহংকার সবকিছুকে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার জয় হলো।
সমাপ্ত😍
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com