Breaking News

গল্প- মেঘের ছায়া || নীল আহমেদ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি লেক,

এপাশ থেকে ওপাশে সাদা রংয়ের
একটি ছোট স্টিলের ব্রীজ, পাশেই কিছু
কাঁশবন, সাদা ফুলে পরিবেশটা অপরুপ
সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ করে তুলেছে, মাথার
উপর ফুলেভরা কয়েকটা কৃষ্ণচুড়ার গাছ,
গাছের ডালে প্রতিদিনের
অতিথি হিসাবে বেশ কিছু পাখির
দেখা মেলে। বিকেলের
সময়টাতে স্থানটা যেন জগতের অতুলনীয়
একটা পরিবেশের সৃষ্টি করে।
প্রকৃতি প্রেমী হাতে গুণা কিছু লোক
মাঝে মধ্যে এখানে আসেন মধুর কিছু মুহুর্থ
উপভোগ করতে। যান্ত্রিক এ শহরে সবাই
যার যার কাজ নিয়ে ব্যাস্ত, কার
হাতে সময় আছে এরকম
একটা পরিবেশে একাকী নিজের
সাথে একটু সময় কাটানোর।
লেকের ধারে কাঁশবন গুলোর
পাশে প্রতিদিন
একটা মেয়ে একা একা বসে থাকতো।
নিরবে একাকী কিছু সময়
কাটিয়ে সূর্যাস্তের সাথে সাথে সেও
কোথাও হারিয়ে যেত। কোনদিন
তাকে তার পরিচিত
কারো সাথে দেখা যায়নি,
তবে স্থানটাতে আর কেউ আসুক
কিংবা না আসুক খনিকের
আতিথি পাখি গুলোর সাথে মেয়েটার
প্রতিদিন’ই দেখা হত। মেঘের ছায়ার
নিচে বসে মেয়েটা প্রতিদিন
কি করতো কেউ কোনদিন জানার আগ্রহ
দেখায়নি, কিংবা এটা বলা চলে কেউ
কোনদিন তার সম্পর্কে কোন কিছু
উপলব্দি করেনি।
মেঘ এই এলাকায় নতুন এসেছে, কোন
একদিন পরিচিত কেউ একজনের সাথে এই
স্থানটাতে বেড়াতে এসেছিল।
জায়গাটা তার কাছে অনেক পছন্দ
হয়েছিল, তাই মাঝে মধ্যে সময়
পেলে এখানে আসার চেষ্টা করে।
বেশির ভাগ সময়টাতেই একা আসা হয়।
প্রথম কয়েকদিন সে মেয়েটার
দিকে তেমন লক্ষ করেনি, কিন্তু কিছুদিন
পর সে অনুমান করল যে সে যেদিনই
এখানে আসে মেয়েটাকে এখানে দেখে।
সেই একই জায়গায় বসে থাকে,
কারো সাথে কোন কথা নেই, একদম
নিশ্চুপ একা একা সময় পার করে। মেঘ
কিছুটা কৌতুহলি হয়ে ঠিক করল
সে একসাথে সারা সাপ্তাহ
এখানে আসবে দেখা যাক
মেয়েটা কোনদিন
এখানে না থাকে কিনা। কিন্তু
সাপ্তাহে প্রতিদিনই মেয়েটাকে একই
জায়গায় দেখতে পায় সে, আর নিয়মিত
একা একা কোন সঙ্গিহীন অবস্থায়।
এমন অবস্থা দেখে একদিন সে ঠিক করল
মেয়েটার সাথে কথা বলবে। পড়ন্ত
বিকেল,
আকাশটা সাদা মেঘে ঢাকা মেয়েটা বসে আছে…
মেঘ মেয়েটার কাছে গেল,
‘বসতে পারি?’ (কোন উত্তর নেই)
– সে বসে পড়ল ‘কেমন
আছেন?’ (আবারো উত্তর নেই)
– ‘আমি বেশ কিছুদিন
থেকে দেখছি আপনি প্রতিদিন এই
জায়গাটায় একা একা বসে থাকেন,
কারো সাথে কোনদিন কথা বলতেও
দেখিনি, এর
পিছনে কারণটা জানতে পারি?’-
– একটু গম্ভীর মুখ করে বিরক্তিকর ভাব
নিয়ে মেয়েটা মেঘের
দিকে তাকালো, ‘দেখুন আমি আপনার
সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না,
আমি একা থাকতে পছন্দ করি, প্লিজ
আপনি এখান
থেকে চলে গেলে খুশি হব!’ (কথা গুলো বলেই
মেয়েটা আবারও মুখ ফিরিয়ে নিল)
– ‘দেখুন আমি আপনাকে মোটেও বিরক্ত
করার জন্য আসিনি, আপনাকে অনেকদিন
থেকে দেখে আসছি তাই একটু
কৌতুহলি হয়েই আপনার কাছে আসলাম।’
– (মেয়েটা আরেকটু বিরক্তিকর ভাব নিল)
– ঠিক আছে আজ আপনার মন
যদি ভালো না থাকে তাহলে আমি অন্যদিন
আসবো। চলে যাচ্ছি ভালো থাকবেন!’ (এই
বলে মেঘ উটে আসল)
পরেরদিন মেয়েটা আসার আগেই মেঘ
সেই জায়গাটাতে চলে গেল।
হাতে কিছু নুড়ি পাথর
নিয়ে বসে বসে লেকের উপর ঢিল ছুড়ছে,
এমন সময় মেয়েটা পিছন থেকে এসে তার
থেকে একটু দূরে সে যেখানে প্রতিদিন
বসে সেই স্থানটায় মেঘের সাথে কোন
কথা না বলেই বসে পড়ল।
– ‘এসে গেছেন আপনার জন্যই
অপেক্ষা করছিলাম, আজ ভালো আছেন?’
– (মেয়েটা কোন উত্তর দিল না)
– ‘জানেন আজ আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে,
মনে হচ্ছে আজ আপনার
মনটা ভালো আছে!’
– ‘এই যে মিস্টার, আমি আপনার
সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না তারপরেও
আপনি আমাকে এভাবে বিরক্ত করতেছেন
কেন?’
– ‘দেখুন আমি আপনাকে কোন বিরক্ত
করতে আসিনি, আমি এই এলাকায় নতুন
এসেছি, কারো সাথে আমার তেমন কোন
পরিচয় নেই, আর আপনার
ব্যাপারটাতো গতকালই বললাম, আপনিও
এখানে একা থাকেন আমিও
এখানে তেমন কাউকে চিনি না,
ভাবলাম আপনার সাথে একটু পরিচয়
করে নিলে, এখানে আসলে দুজনের
সময়টাই একটু ভালো কাটবে।’
– ‘দেখুন মিস্টার…’
– ‘জ্বি, আমার নাম মেঘ!’
– ‘আপনি মেঘ-বৃষ্টি যেই হন না কেন
আপনার সাথে পরিচিত হতে আমার কোন
আগ্রহ নেই, আর
আমি এখানে একা থাকতে পছন্দ করি,
তাই দয়া করে আপনি আমাকে আর
কোনদিন বিরক্ত না করলে খুশি হব।’
– ‘ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি,
আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য
ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, ভালো থাকবেন
খোদা হাফেজ!’
মেঘ সেই জায়গাটা থেকে চলে গেল…
পরের দিন আবারো মেয়েটা আসার
আগে সেই
জায়গাটাতে গিয়ে সে হাজির,
মেয়েটা যেখানে বসে সেখান
থেকে একটু দূরে পিছনে দিকে মাটির
উপর হাত দিয়ে আকাশের
দিকে চেয়ে আছে। সেই
সময়টাতে মেয়েটা এসে হাজির…
– ‘আপনাকে না বলেছি আমাকে আর
কোনদিন ডিস্টার্ব না করতে, আপনি আজও
এসেছেন?’
– ‘শুনুন আমি আপনাকে বলেছিলাম
আপনাকে আর বিরক্ত করবো না, আমি এই
জায়গাটিতে আসবো না সেটা আপনাকে বলিনি!’ (মেয়েটার
দিকে গাড়
বাকা করা কথা গুলো বলে মেঘ
মাথাটা আবারও উপরে তুলে নিল)
– (মেয়েটা আর কিছু না বলে তার
জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল!)
… সেদিন মেঘ কিংবা মেয়েটা কেউ
কারো সাথে আর কোন কথা বলল না।
বিকেল শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগ
মুহুর্থে প্রথমে মেয়েটা তারপর মেঘ
জায়গাটা থেকে চলে গেল।
এভাবে মেঘ প্রতিদিন
সেখানে যাওয়া শুরু করে, কোনদিন
মেয়েটা আসার আগে কোনদিন
হলে পরে, কিন্তু কেউ
কারো সাথে কথা বলতো না। মেঘ
কানে হেড ফোন দিয়ে প্রকৃতির লাবণ্যটুকু
উপভোগ করতো। মেয়েটার
কাছে মাঝে মধ্যে ফোন কল আসতো,
কখনো ফোনে কথা বলতো কোনদিন
হলে ফোন কল শেষ
করে মেয়েটা সেখানে থেকে চলে যেত।
কিন্তু মেয়েটা সেখানে প্রতিদিন কেন
বসতো কিংবা কার জন্য বসতো আজ পর্যন্ত
মেঘ কিছু জানাতে পারেনি। দিন
শেষে লেক
থেকে বেরিয়ে এসে সে এক পথে আর
মেয়েটা এক পথে হেঁটে যার যার
গন্তব্যে ফিরে যেত। এভাবেই চলল
কয়েকদিন…
একবার মেঘ কোন এক কারণবসত
টানা তিনদিন লেকটাতে গেল না।
মেয়েটা সেখানে তার আগের মতই সেই
দিন গুলোতে আসল, কিন্তু মেঘ
সেখানে নেই, তিনদিন আসল
না সেটা দেখে মেয়েটা একটু বিস্মিত
হল। তিনদিন পর মেঘ আবারো আগের মত
সেই জায়গাটিতে গেল,
মেয়েটা আগে থেকেই বসে আছে,
মেয়েটার থেকে একটু
দূরে বসতে গেলে মেয়েটা তাকে উদ্দেশ্য
করে বলে উঠলো…
– ‘এই তিনদিন আসলেন না কেন?’
– ‘আমাকে বলছেন?’
– ‘এখানে কি আর কেউ আছে?’
– ‘আচ্ছা! তাহলে আপনি এই
তিনদিনে আমাকে অনেক মিস করেছেন?’
– ‘আমি আপনাকে মিস করতে যাবো কেন?
এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম!’
– মেঘ উঠে গিয়ে মেয়েটার আরেকটু
কাছাকাছি বসল, ‘এখান
থেকে হয়তো আমাদের
কথা গুলো ভালো শুনা যাবে!’
– ‘বললেন না যে এই তিনদিন কেন
আসেননি?’
– ‘জানার খুব ইচ্ছা?’
– ‘বলতে না চাইলে থাক…’
– ‘ঠিক আছে বলছি, আমার আম্মু একটু অসুস্থ
হয়ে গিয়েছিলেন
উনাকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলাম!’
– ‘অহ সরি! এখন কেমন আছেন’
– ‘এখন আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছেন,
ডাক্তার রেস্ট নিতে বলেছে!’
– ‘তা আপনি এখানে কেন, মায়ের
কাছে থাকলেন না কেন?’
– ‘আপনি যে আমাকে অনেক বেশি মিস
করতেছেন সেজন্য চলে আসলাম!’
– ‘বললাম না আমি আপনাকে মিস করিনি!’
– ‘আচ্ছা ঠিক
আছে তাহলে আমি চলে যাচ্ছি, আর
আসবো না!’
– ‘সত্যি?’
– কোনটা বলবো,
চলে যাচ্ছি সেটা নাকি আর
আসবো না সেটা?’
– ‘আর আসবেন না?’
– ‘কেন আপনি কি চান আমি আরো আসি?’
– ‘না সেটা বলিনি!’
– ‘আপনার নামটা জানতে পারি?’
– ‘ছায়া’
– ‘ছায়া! বাহহ সুন্দর নাম তো!’
– ‘আচ্ছা একটা কথা বলবেন?’
– ‘জ্বি বলেন!’
– ‘আপনার নামটা মেঘ
কে রেখেছিলেন?’
– ‘আচ্ছা, আপনি তাহলে আমার নামটাও
মনে রেখেছেন, ভালো ভালো!’
– ‘প্রতিদিন আকাশের মেঘকে আর নিচের
মেঘটাকে দেখতে দেখতে নামটা মনে গেঁথে গেছে।’
– ‘আপনার কাছে কোনটা ভালো লাগে?
আকাশের মেঘ নাকি নিচেরটাকে?’
– ‘নামটা কে রেখেছেন বললেন
না কিন্তু?’
– ‘আমার আব্বু রেখেছিলেন, আকাশের
মেঘ উনার অনেক পছন্দ ছিল তাই ছেলের
নামটাও সেটার সাথে মিল
করে রেখে দেন!’
– ‘হমম ভালো করেছেন! সুন্দর নাম!’
– ‘আমার প্রশ্নটার কি হল?’
– ‘আকাশেরটা এতদিন ভালো লাগতো,
নিচেরটার সাথে আজকেই
ভালো ভাবে পরিচয় হল তাই কিছু
বলতে পারছি না!’
– ‘ঠিক আছে অপেক্ষায় থাকলাম!’
এভাবেই দুজনের মধ্যে পরিচয়ের প্রথম
আলাপচারিতার শুরু, ছোট ছোট কথা আর
একে অন্যের প্রতি প্রশ্নের ঝাড়ি।
সেদিনের পর থেকে আগের মত প্রতিদিনই
তাদের আসা যাওয়া চলতে থাকে, কিন্তু
পরিবেশটায় এখন আগের থেকে বেশ
পরিবর্তন এসে গেছে, পাশের
কাঁশবনে ফুল গুলো যেন
নিরবতা ভেঙ্গে প্রাণ ফিরে পেয়েছে,
কৃষ্ণচুড়া গাছগুলোর ফুল যেন আরো রঙ্গীন
হয়ে সেজেছে, পাখি গুলোর ডাকে যেন
আরো মধুরতা মিসেছে, সবকিছুই এখন যেন
একটু আলদা মমতাময়ী মনে হয়।
একা একা বসে থাকা সেই নিরব
মেয়েটা আজ প্রাণ
খোলে হাসতে পারে, তার মুখে এখন
কথার ফুলঝরি ফুটে। হঠাৎ করেই
জীবনটা একটু ব্যাতিক্রমি ধারায়
চলতে শুরু করেছে, আজকাল দুজনের
দিনটা অনেক ভালো কাটে। কিন্তু এখন
পর্যন্ত কেউ কারো ফোন নাম্বারটা পর্যন্ত
নেয়নি, কিংবা একে অন্যের বাসার
ঠিকানাটা পর্যন্ত জানে না। দুজনের
যোগাযোগের একটাই মাধ্যম প্রতিদিন
বিকেলে এই লেকের কিনারায়।
এখনো কোনদিন তাদের দেখা হওয়া বাদ
যায়নি, নিয়মিত দেখা হচ্ছেই, একই সময়,
একই জায়গায়, যেদিন দেখা না হওয়ার
সম্ভাবনা আছে আগের দিন
একে অন্যকে বলে দিচ্ছে। তাই কেউ
কারো ফোন নাম্বার নেওয়ার
এখনো কোন প্রয়োজন পড়েনি। আর
দরকারটাই বা কি, একটা ভালো সম্পর্কের
জন্য একটা নিদৃষ্ট মাধ্যম’ইতো যতেষ্ট,
হয়তো এর থেকে বেশি কিছু হলে তাদের
সম্পর্কের সেই ব্যাতিক্রমতা’টুকু
থাকবে না। সত্যি’ই তাই, দুজনের
মাঝে এখন অনেক ভালো সম্পর্ক, বন্ধুত্বের
সম্পর্ক।
… তাদের সম্পর্কটা এখনো শুধুমাত্র
বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ, দুজনের কেউই
একে অন্য
প্রতি সেটা থেকে বেশি কোন অনুভুতির
সৃষ্টি করেনি। দুজনেই খুব সাধারণ
ভাবে বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছে, এর
থেকে বেশি কিছু করার ক্ষেত্রে উভয়ের
আগ্রহ নেই বরং দ্বিমত। আর যোগাযোগের
মাধ্যম হিসাবে এই একটি ক্ষেত্র
তো আছেই, সেটার ক্ষেত্রেও কোন
বার্তি কিছু যোগ করার প্রয়োজন নেই।
কথা গুলো যদিও ছায়ার পক্ষ থেকে একটু
বেশি জোড়ালো।
কৃষ্ণচুড়া গাছ গুলোর ফুল
ধীরে ধীরে ঝরে পড়তে শুরু করেছে,
গ্রীষ্মের আগমনের
বার্তা হিসাবে লেকের পানিও
আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে দিয়েছে,
কাশবনেও আগেও মত বসন্তের হাওয়া নেই।
সাময়িক প্রাকৃতিক পরিবর্তনের
প্রভাবটা লেকের সেই সৌন্দর্যপূর্ণ
পরিবেশটাতেও এসে পড়ছে।
কোন একদিন মেঘ প্রতিদিনের মত
লেকে আসল, কিন্তু আগে কোন কিছু
না বলেও সেদিন ছায়া অনুপস্থিত।
বিষয়টা মেঘের কাছে একটু অন্যরকম
মনে হল, এরকম তো আগে কোনদিন ঘটেনি।
ছায়া কোনদিন
না আসলে আগে বলে যেত সবসময়,
তাহলে আজ কি হল? সারা বিকেল
গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো, মেঘ
এখনো সেখানে অপেক্ষা করছে, কিন্তু
ছায়া আর আসলো না।
পরের দিন গিয়েও একই অবস্থা, মেঘ
অনেক বেশি চিন্তিত হয়ে গেল, তার
কাছে ছায়ার খোঁজ নেওয়ার মত কোন
মাধ্যম নেই, আজই সে প্রথম অনুভব করল
তাদের যোগাযোগের মাধ্যমটা আরেকটু
আগানো উচিত ছিল। ছায়ার খোঁজ
নেওয়ার মত দ্বিতীয় কোন মাধ্যম তার
কাছে নেই, একমাত্র অপেক্ষা ছাড়া অন্য
কোন পথ তার কাছে খোলা ছিল না।
একদিন, দুইদিন, সাপ্তাহ ঘনিয়ে মাসেরও
অতিক্রম হল ছায়ার কোন খোঁজ মিলল না।
কিন্তু সেই প্রত্যেকটি দিন,
প্রত্যেকটি বিকেল শত কাজের ভিড়েও
মেঘের কেঁটেছে সেই লেকের
ধারে কাশঁবন গুলোর পাশে। গ্রীষ্মের
প্রখর রোদ আর অন্তহীন কষ্ট
নিয়ে একাকী কেঁটেছে দিন
গুলো ছায়ার অপেক্ষা করে। কিন্তু
প্রতিটি দিন
তাকে ঘরে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে নিঃস্ব
মনে, চোখের কোণে জমা পড়েছে নীরব
ব্যাথা ভরা আরো কিছু অশ্রু ধারা। এত
অর্থহীন অপেক্ষার পরেও
সে কখনো আশাহীন হয়ে পড়েনি,
প্রতিটি নতুন দিন নতুন করে ফিরে আসার
স্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষা করে গিয়ছে।
ধীরে ধীরে পার হয়ে গেল তিনটি মাস,
এই সময়টার মধ্যে মেঘের পৃথিবীটা অনেক
বদলে গেছে, বদলে যেতে শুরু
করেছে প্রকৃতির রুপও। কোন এক
বিকেলে প্রতিদিনের মত নিঃসঙ্গ
একাকী সেই লেকের
ধারে বসে আছে মেঘ, এতদিনের অন্তহীন
অপেক্ষার খাতায় যোগ
হচ্ছে আরো একটি দিন। সে আজও
জানে না তার এই অপেক্ষার
পিছনে আদৌ কোন অর্থ আছে কিনা।
মেঘ আকাশে উড়ন্ত দুটো চীলের
দিকে তাকিয়ে আছে, এমন সময় সহসাই
গাছের ঝরে পড়া শুকনো পাতার উপর
দিয়ে কেউ হেঁটে আসার
পদধনী শুনতে পেল সে।
সংঙ্গে সংঙ্গে পিছন ফিরে তাকালো,
কেউ একজন হুইল-চেয়ারে বসে আছে পিছন
থেকে অন্য একজন
চেয়ারটা ঠেলে নিয়ে তার দিকেই
আসছে। দৃশ্যটা দেখেই
সে উঠে দাড়ালো, কাছে আসতেই
দেখা গেল চেয়ারে বসা মেয়েটা আর
কেউ নয় যার জন্য সে এতদিন প্রহর গুণ ছিল।
কিন্তু বিষয়টা কি সে কিছুই
বোঝে উটতে পারলো না,
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা কাছে এসে জিজ্ঞেস
করল, ‘আপনার নাম কি মেঘ?’ মুখে কিছু
না বলেই হ্যাঁ সূচক ভাব দিল মেঘ।
মেয়েটা তার
হাতে একটা ডায়রী তুলে দিল,
ডায়রীটা হাতে নিয়েও কিছু অনুভব
করতে পারল না। মেঘ
ডায়রীটা খোলে পড়তে শুরু করল…
ডায়রীটার মধ্যে ছায়া তার
সম্পর্কে অনেক কিছু লিখে রেখেছে, গত
ছয় মাস আগে এক মেডিক্যাল
টেস্টে ছায়ার ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে।
ডাক্তার তাকে ৬ মাসের সময় দিয়েছিল,
ধারণা অনুযায়ী সে হয়তো এর ভিতরেই
তার মানুসিক জ্ঞান
হারিয়ে ফেলতে পারে,
সেটা হলে তার ব্রেন আর কাজ করবে না।
মাত্র তিন মাসের মধ্যেই ডাক্তারের
ধারণার প্রতিফল ঘটে। ছায়া তার
সম্পর্কে এসব
কথা গুলো মেঘকে কখনো জানায়নি,
কিন্তু মেঘের সাথে পরিচয় এবং তার
সাথে গড়ে উটা সম্পর্ক
নিয়ে প্রতিটা কথা সে তার
ডায়রীতে লিখে রেখেছিল। মেঘের
সাথে কাটানো সেসব স্মৃতী গুলোর
কথা একটা একটা করে ডায়রীতে পড়তে থাকে মেঘ,
সাথে ছায়ার সব অপূর্ণ স্বপ্ন এবং তার
সম্পর্কে মেঘের অজানা কথা গুলো।
মেঘের চোখ
বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলে ভিজে যায়
ডায়রীর এক একটি পাতা।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা ছায়ার
ছোট বোন মায়া, তাদের পরিবারে কেউ
কখনো জানতো না মেঘের সম্পর্কে। তার
মুখ থেকেই সে জানতে পারে সেদিন
রাতে হঠাৎ করেই
মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল ছায়া, প্রায়
১ মাস হাসপাতালের বিছানায়
জ্ঞানহীন অবস্থায় শুয়েছিল সে। অবস্থার
কোন উন্নতি না হওয়ায় বাসায়
নিয়ে আসা হয়। দুই দিন আগে ছায়ার রুম
থেকে তার
লেখা ডায়রীটা মিলে তাদের কাছে,
সেটা পড়েই তারা মেঘের
সম্পর্কে জানতে পারে। ছায়ার কোনদিন
কোন বন্ধু ছিল না, স্কুল-
কলেজে ক্লাসে সব সময় একা একাই
থাকতো,
কখনো কারো সাথে মিশতো না। এই
লেকটা তার সবচেয়ে পছন্দের
জায়গা ছিল, তাই প্রতিদিন
বিকেলে এখানে এসে নিজের
সাথে সময় কাটাতো, আনমনে নিজের
জীবনের কথা চিন্তা করতো। তার
ভিতরে কষ্টটা কখনো কাউকে বোঝতে দেয়নি,
নিজের মনের সাথে একা একাই যুদ্ধ
করতো, আর অপেক্ষা করতো পৃথিবীর শেষ
আলোটা দেখে যাওয়ার। কিন্তু মেঘের
সাথে পরিচয়ের পর থেকে তার
জীবনটা অনেক বেশি পরিবর্তন হতে শুরু
করে, সেই চুপচাপ সবসময় একা থাকতে পছন্দ
করা মেয়েটাকে অনেক
বেশি হাসিখুশি প্রাণউচ্ছল
হয়ে উটতে দেখা যায়, যে কিনা নতুন
করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে আরো কিছুদিন
পৃথিবীতে বেঁচে থাকার। ডায়রীটার
মধ্যে সে এটাও লিখে রেখে ছিল,
সে ধীরে ধীরে মেঘকে ভালবাসতে শুরু
করেছে, কিন্তু তার এই
ক্ষণস্থায়ী জীবনের
সাথে আরেকটি প্রাণবন্ত জীবনকে নষ্ট
করতে চায়নি বলেই
নিজে থেকে বিষয়টা সব সময়
এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো।
ছায়া জানতো মেঘ তার জন্য
অপেক্ষা করবে, কারণ সে মেঘের
চোখে তার জন্য সেই অন্যরকম
ভালো লাগার অনুভুতিটা দেখেছে,
সে অনুভব করেছে মেঘও
অগচরে তাকে ভালবেসতে শুরু করেছে,
আর তাই তো সে তার
ডায়রীতে লিখে রেখেছিল এই
জায়গাটির কথা, যেখানে সে নিশ্চিত
ছিল মেঘ তার জন্য
অপেক্ষা করে থাকবে। যেটা ছিল তার
বিশ্বাস, আর হয়তো এই বিশ্বাসটাকেই
ভালবাসা বলে।
(সমাপ্ত)

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com